Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১১


ডিজায়ার_আনলিশড ❤️‍🔥

✍️ সাবিলা সাবি

✦ পর্ব ১১✦

শপিং মলের করিডরটা তখনো তছনছ অবস্থায়। লাইটগুলো ঝলমল করছে ঠিকই কিন্তু শপিং মলের অস্তিত্ব যেনো প্রায় শেষ, চারদিকে মানুষের কথোপকথনের গুঞ্জন আর হাহাকার ছড়িয়ে আছে।

জাভিয়ান তান্বীকে নিয়ে ট্রায়াল রুম থেকে বের হয়েছে। জাভিয়ানের মুখে হালকা ক্লান্তির ছাপ আর তান্বীর চোখে এখনও আতঙ্ক। জাভিয়ান দ্রুত হাঁটছিলো, পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।

তান্বীর বুক কাঁপছে অদ্ভুত অশনি-আশঙ্কায়। ঠিক সেই মুহূর্তেই সামনের দিকে হঠাৎ কয়েকজন লোক এসে হাজির। তাদের চেহারায় রুক্ষ ভাব, চোখেমুখে খু/নের দৃষ্টি।

তান্বীর নিঃশ্বাস একেবারে আটকে গেলো। হঠাৎই ভয়ে সে ঝট করে জাভিয়ানের পেছনে সরে দাঁড়ালো। তার ব্লেজারের ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে।

মনের ভেতর একটাই চিন্তা—“শেষ! এরা এবার আমাকে আর ওনাকে গুলি করে মেরে ফেলবেই…”

কিন্তু ঘটলো উল্টো। লোকগুলো জাভিয়ানের দিকে একবার গভীরভাবে তাকালো। চোখে-মুখে কেমন এক আতঙ্ক ভেসে উঠলো। তাদের ভঙ্গি বদলে গেলো মুহূর্তেই।

তারা যেনো এক অদৃশ্য নির্দেশ মেনে নীরব সম্মতিতে সরে গেলো পাশ কাটিয়ে।কেউ আর এগিয়ে এলো না, একপ্রকার দৌড়ে সরে গেলো অন্যদিকে।

তান্বী হতভম্ব। এদিকটায় আর ফিরেও তাকালো না তারা। তান্বী জাভিয়ানের পিঠে কেঁপে ওঠা আঙুল চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো—“ওরা… ওরা চলে গেলো কেনো?”

জাভিয়ান শুধু এক কোণে ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা হাসলো, কোনো উত্তর দিলো না। তার চোখে তখন এক রহস্যময় দৃঢ়তা, যেনো এই শহরের অন্ধকারের মাঝেও তাকে দেখেই সবাই পিছু হটে যায়।

শপিং মলের পেছনের কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে, সামনের দিকের গেইটের পার্কিং লটে আসতেই জাভিয়ান এক মুহূর্তে খেয়াল করলো—রায়হান গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, যেনো সবকিছু আগেই আন্দাজ করে রেখেছিলো।

সে এগিয়ে এসে দ্রুত বললো, “স্যার, আপনি আর মিস গজদন্তনি ঠিক আছেন তো?”

জাভিয়ান সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,গলায় একটুখানি রুক্ষতা মিশিয়ে বললো—“চলো, এক্ষুনি এখান থেকে বের হতে হবে।”

এক মুহূর্ত দেরি না করে রায়হান গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। জাভিয়ান তান্বীকে নিয়ে পেছনের সিটে বসলো। গাড়ি স্টার্ট নিতেই শহরের আলো পেছনে মিলিয়ে যেতে লাগলো।

হঠাৎ তান্বী বুকের ভেতর হাত চেপে ধরে ধীরে বললো,
“আমার পেটের মধ্যে না একটা প্রশ্ন… অ্যাকুরিয়ামের জেলিফিশের মতো লাফাচ্ছে।”

জাভিয়ান তার দিকে একবার ঘুরে তাকালো—চোখে তীক্ষ্ণ ঝলক, যেনো প্রশ্নটার আগাম আন্দাজ পাচ্ছে। ড্রাইভ করতে করতে রায়হানও কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী প্রশ্ন, মিস?”

তান্বী দ্বিধায় কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো। তারপর সরাসরি জাভিয়ানের চোখে চোখ রেখে বললো—“আপনিও কি… মাফিয়া?”

গাড়ির ভেতরে হালকা নীরবতা নেমে এলো। জাভিয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো “তোমার মাথায় এমন ধারণা কেনো এলো?”

তান্বী সরাসরি বললো—“ওই লোকগুলো আপনাকে দেখেই যেভাবে আতঙ্কে পালিয়ে গেলো… আর আপনি তো রিকার্দোর সাথে ডিলও করেন, তাই না?”

জাভিয়ান ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলো—“রিকার্দো আমার কলেজের ক্লাসমেট ছিলো। ওর বাবার সাথে আমার বাবার ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে, এর বেশি কিছু নয়। আমি কোনো মাফিয়া টাফিয়া নই।”

তান্বী ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো—“তাহলে গুন্ডারা আপনাকে দেখেই এভাবে ছুটে পালালো কেনো?”

জাভিয়ান হালকা হাসলো, চোখের কোণে রহস্যময় খেলা। “হয়তো আমি দেখতে… খুব ভয়ানক।”

তান্বী একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো তারপর পুনরায় বললো—
“আমার পেটের মধ্যে আরেকটা প্রশ্ন…”

তার কথা শেষ না হতেই জাভিয়ান কপালে ভাঁজ ফেলে ধমক দিলো— “আর একটাও প্রশ্ন করবে না। যখন তুমি কথা বলো, মনে হয় কানের সামনে নন-স্টপ রেডিও বাজছে।”

তান্বীর মুখ লাল হয়ে গেলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দিলো—“আপনি জানেন, এই নন-স্টপ রেডিও শোনার জন্যই ভার্সিটিতে সবাই আমার জন্য পাগল ছিলো! সবাইতো এটাও বলতো আমি কথা বলতে বলতে হাসলে অনেক সুন্দর লাগে আমাকে।”

জাভিয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকালো তার দিকে। “কে বলেছে তুমি হাসলে সুন্দর লাগে?”

তান্বী ঠোঁট কামড়ে মাথা উঁচু করে বললো—“কেনো দেখেন না? আমার দাঁতের কিনারার দাঁতের ওপর আরো দুটো দাঁত আছে… এটার জন্যই আমার হাসি আলাদা লাগে। রায়হান ভাইয়াও তো আমাকে গজদন্তনী বলে ডাকে।”

জাভিয়ান এবার হেসে উঠলো, ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ ঝরে পড়লো। “রায়হান একদম ঠিক বলেছে। তোমার দাঁতের সাথে হাতির দাঁতের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। হাতির যেমন দু’পাশে দুটো বড় দাঁত বেরিয়েছে… সেই কারণেই তো তাকে বলে গজদন্ত আর তুমি তার ফিমেল ভার্সন।”

তান্বী থম মেরে গেলো, তার চোখ গোল হয়ে গেলো। অবশেষে সে আর এই বিষয়ে কিছুই বললো না কারন এতে জাভিয়ান আবার কিনা কি কথা বলবে কারন তান্বী এতদিনে এটা বেশ বুঝেছে এই জাভিয়ান নির্লজ্জ আর ফাউল মুখের অনেকটা।

তান্বী ঠোঁট কামড়ে হালকা অভিমানী গলায় বললো—“আমার তো এখনো নিজের শপিংটাই করা হলো না… আর আপনার বোন? কেমন মেয়ে সে! আমাকে একা ফেলে এভাবে চলে গেলো? এতোটা নির্দয় আর কেউ হতে পারে নাকি?”

জাভিয়ান কোনো উত্তর দিলো না। তার চোয়াল শক্ত হলো, চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে সরে গেলো।

তান্বী নিঃশব্দে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো তার দিকে, বুকের ভেতর ক্ষোভ জমে উঠতে লাগলো।
মনে মনে বললো —“এরা সবাই একই রকম। পুরো পরিবারটাই যেনো এক ঠাণ্ডা, নির্দয় দুনিয়া। শুধুমাত্র দাদি বাদে। আর এই মিস্টার জাভিয়ান… সেও তো খারাপ কম নয়। মুখে যতই গম্ভীর ভাব ধরে রাখুক, আসলে এরা সবাই এক।”
.
.
.
.
স্ট্রোম হাউজের দরজা বন্ধ করেই ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে পড়লো মেইলস্ট্রোম। তার চোখ লালচে, কণ্ঠ কাঁপছে রাগে আর অস্থিরতায়।

“তুমি কেনো এমনটা করলে, মম?”—গর্জে উঠলো সে।
“কেনো আমাকে মল থেকে টেনে নিয়ে এলে? আর একটুখানি সময় পেলে… আমি তান্বীকে পেয়ে যেতাম!”

ইসাবেলা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালো। তার ঠোঁট কেঁপে উঠলো, কণ্ঠে তীক্ষ্ণ সুর—“তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছো, মেইলস্ট্রোম? তোমার চোখের সামনে তো সেই জাহাজ বিস্ফোরণে ছাই হয়ে গেলো! যদি সবাই মরে যায়, তবে ওই মেয়েটা বেঁচে থাকে কীভাবে?”

মেইলস্ট্রোম বুক ধড়ফড় করে শ্বাস নিলো। তার চোখে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠলো, কণ্ঠ ভারী আর দৃঢ়—“হ্যাঁ, হয়তো আমার চোখ ভুল দেখেছে… হয়তো হাজার মানুষের মধ্যে বিভ্রম হয়েছে… কিন্তু আমার হৃদয় কখনো মিথ্যে বলবেনা, মম। আমার ভেতরের অনুভূতি চিৎকার করে বলছে—ওটা তান্বীই ছিল।”

ইসাবেলা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে।
তার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো—“তুমি… তুমি হ্যালুসিনেশনে ডুবে যাচ্ছো মেইলস্ট্রোম।”

মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো। “নো, মম। এটা হ্যালুসিনেশন না। এটা আমার সত্য… আমার হ্নদয়ের সত্য।”
.
.
.
.

ভিলা এস্পেরেন্জার সবাই যার যার নিজ নিজ রুমে অবস্থাধ করছে।চারপাশে রাজপ্রাসাদের মতো সাজানো ভিলা— নিস্তব্ধ, শুধু দূরের সমুদ্রের হাওয়া জানালার কাচে ধাক্কা দিচ্ছে।

রাত গড়িয়ে এলো। তান্বী ধীরে ধীরে বাথরুমের দরজা টেনে ভেতরে প্রবেশ করলো। আধুনিক সেই বাথরুমে আলো হালকা নীলাভ, দেয়ালে বড় আয়না, চারপাশ চকচকে মার্বেল আর একপাশে সাদা বাথটাব। তান্বী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দীর্ঘ চুলে হাত বোলালো। চুল প্রায় কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। ঘন,ভারী আর মসৃণ কেশ তার। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে।

মনে পড়ে গেলো তার জীবনের সেই দৃশ্যগুলো—
দু’দিন পরপর মা নিজ হাতে শ্যাম্পু করিয়ে দিতো, চুল ধুয়ে শুকিয়ে দিতো আবার নিজ হাতে তেল মালিশ করে দিতো চুলে। আর বোন এলিনা মজা করে কখনো ফুল গুঁজে দিতো, কখনো লম্বা বিনুনি করে দিয়ে হাসতো আর বলতো, “তোকে তো পরীর মতো লাগছে আরে না না তোকেতো ডিজনি প্রিন্সেস রাপান্‌জেলের মতো লাগছে।”

তান্বী নিজের অশ্রুসিক্ত চোখদুটো মুছে বাথটাবের ধারে বসল। আজ এখানে, হাজার মাইল দূরে ,তার আপনজন কেউ নেই পাশে। নিজের ভারী চুলে একা একা শ্যাম্পু করাটা ওর কাছে অদ্ভুত কষ্টকর মনে হচ্ছে আজ।

বড় বোতলটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো।
তারপর দাঁত চেপে চুলে শ্যাম্পু ঢাললো। চুল ভিজিয়ে ফেনা তুলতে গিয়েই হাত ক্লান্ত হয়ে পড়লো— চুলের ওজন যেনো অতীতের সব স্মৃতির মতো, টেনে নিচ্ছে, ভারী করে দিচ্ছে বুকের ভেতরটা।

শেষে টাবের ধারে হেলে বসে পড়লো। পিঠ বেয়ে শ্যাম্পুর ফেনা গড়িয়ে নামছে, আর চোখের কোণে জমা হচ্ছে লোনাজল।

তান্বী মনে মনে ফিসফিস করলো—“মা… আপা…তোমাদের ছাড়া আমি অসহায়, একা হয়ে গেছি…”

তান্বী অনেকক্ষণ ধরে বাথরুমে ছিলো। ভেজা চুল কাঁধ ভিজিয়ে নিচে নামতে নামতে পিঠের নিচ পর্যন্ত গড়িয়েছে। এতো বড় চুল একা সামলানোই যেনো যুদ্ধের মতোই। হাত ব্যথায় অবশ হয়ে আসছে—তবুও দাঁতে দাঁত চেপে চুল ধুয়ে, শাওয়ার নিয়ে বের হলো সে।

এবার এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল।
হেয়ার-ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ভেজা চুল যেনো জেদী নদীর মতো—যেদিকেই টানে সেদিকেই আবার গিঁট পাকাচ্ছে। কয়েকবার কপাল কুঁচকে বিরক্তিতে চুল ঝাঁকিয়ে ফেললো।

ঠিক সেই সময় দরজা খোলার শব্দ হলো। জাভিয়ান ঢুকলো হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ নিয়ে। কোনো কথা না বলে বিছানায় বসল। মগটা হাতের আঙুলে হালকা ঘোরাচ্ছে, আর আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে তান্বীর হিমশিম খাওয়া চেহারা।

চুল শুকানোর চেষ্টায় তান্বীর ঠোঁট কামড়ে ধরা, ভেজা গালের পাশে ছোট ছোট চুল লেগে আছে— তার ভঙ্গিটা এক অদ্ভুত মায়া ছড়াচ্ছিলো। কিন্তু জাভিয়ান কিছুই বললো না। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে দেখলো একবার।

কিছুক্ষণ পর—

তান্বী আয়নার সামনে বসে তখনও চুল শুকোতে ব্যস্ত। হাতে হেয়ার ড্রায়ার, চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎই ড্রায়ার তার হাত থেকে নিয়ে নিলো জাভিয়ান।

এক হাতে ড্রায়ার চালু করলো, অন্য হাতে তান্বীর চুল ছুঁয়ে আলতো করে শুকাতে লাগলো। তান্বী অবাক হয়ে এক ঝটকায় হালকা সরে গিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো— “আপনি হঠাৎ আমার চুল শুকিয়ে দিচ্ছেন কেনো?”

জাভিয়ান ভ্রু কুঁচকে একদম নির্লিপ্ত স্বরে বললো— “তোমার এই চুল শুকানোর নাটক করতে করতে রাত বারোটা বাজাবে। আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। লাইট অন থাকলে আমার ঘুম আসবে না। তাই চাইছি তাড়াতাড়ি তোমার এই ড্রামা শেষ হোক, লাইট অফ করে আমি শুতে যাই। তাই হেল্প করছি। এবার চুপচাপ বসে থাকো। একটুও নড়বে না।”

তান্বী নিঃশব্দে ড্রায়ারের গরম বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে জাভিয়ানের বিরক্ত স্বর শুনতে থাকলো—হৃদয়টা কেনো যেনো অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠলো।

ড্রায়ারের গরম হাওয়ায় তান্বীর ভিজে থাকা চুল উড়তে শুরু করলো। প্রথমে যেন স্বাভাবিকভাবেই শুকাচ্ছিলো, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই জাভিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়লো।অসীম ধৈর্যের পরও যখন মনে হলো চুলের শেষপ্রান্ত এখনো ভেজা, সে বিরক্ত হয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো —“এগুলো আসলে চুল, নাকি মাথার ওপর অ্যামাজনের জঙ্গল ঝুলিয়ে ঘুরছো? লতাপাতার মতো কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে!”

তান্বী সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও থেমে গেলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো— “আপনি জানেন, মানুষ এমন লম্বা, ঘন চুল পাওয়ার জন্য কত আফসোস করে? কত স্ট্রাগল করে, লাখো টাকার প্রোডাক্ট কিনে ব্যাবহার করেও পায় না এমন চুল। আর আপনি আমার চুলকে বনজঙ্গল বানিয়ে দিলেন?”

ঘরের ভেতর হালকা নীরবতা নামলো। জাভিয়ান কোনো উত্তর দিলো না।কেবল চোখ নামিয়ে আবারও হেয়ার ড্রায়ার তুলে নিলো। অবশেষে ধৈর্য ধরে পুরো চুল শুকিয়ে দিয়ে যন্ত্রটা বন্ধ করলো।

তারপর তান্বী ছোট্ট একটা বালিশ বগলদাবা করে এগিয়ে যাচ্ছিলো ডিভানের দিকে। কিন্তু হঠাৎই জাভিয়ানের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো— “ওখানে ঘুমানোর দরকার নেই। তুমি এখানে ঘুমাও, বেডে।”

তান্বী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “কি মাথা খারাপ! আমি আপনার সাথে একসাথে বেডে পাশপাশি শোবো নাকি?”

জাভিয়ানের ঠোঁট বাঁকলো দুষ্টু হাসিতে—“পাশপাশি কে বললো? আমরা তো ঘুমাবো 69 পজিশনে।”

তান্বীর চোখ বিস্ফারিত। মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো।
“কি-কি বললেন?!”

জাভিয়ান হেসে মজার ভঙ্গিতে বললো— “মানে তুমি ঘুমাবে ওইদিকে মাথা দিয়ে, তোমার পা থাকবে আমার সাইডে। আর আমি শোবো এদিকে, আমার পা থাকবে তোমার মাথার পাশে। ব্যস! মাথা উল্টো, শরীর উল্টো, দূরত্ব বজায়। বুঝেছো?”

তান্বী একদম থম মেরে গেলো। ভেতরে ভেতরে ভাবলো— “আচ্ছা, কথাটা খারাপ না… ডিভানে তো ঘুমাতে বেশ কষ্টই হয়।”

একটু দ্বিধার পর অবশেষে নিজের কম্বল টেনে বেডে উঠলো। দু’জনেই উল্টো দিকে শুয়ে পড়লো—তান্বীর মাথার পাশে জাভিয়ানের লম্বা পা, আর জাভিয়ানের মাথার পাশে তান্বীর সরু পা। আলাদা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে দু’জনেই।
.
.
.
.

মধ্যরাত।

পুরো ভিলা নিস্তব্ধ, শুধু হালকা এয়ারকন্ডিশনের গুঞ্জন।জাভিয়ান চোখের ওপর এক হাত দিয়ে শুয়ে আছে হালকা ঘুমন্ত অবস্থায়—ঠিক তখনই হঠাৎ তান্বীর এক পা এসে ধপ করে পড়লো তার মুখের ওপর। সে কপাল কুঁচকে বিরক্ত গলায় ফিসফিস করলো, “শিট…!”

কয়েকবার হাত দিয়ে তান্বীর পা সরালো। কিন্তু মিনিট না পেরোতেই আবার কখনো তার বুকের ওপর, কখনো কাঁধের ওপর পা উঠে আসছে।

জাভিয়ানের ধৈর্য ফুরিয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে উঠে বসল। “এই মেয়ে ঘুমায়,নাকি ফুটবল খেলে?!” — বিরক্ত কণ্ঠ ছুঁড়ে দিলো ফিসফিস করে।

সে উঠে গিয়ে লাইট অন করতেই দেখলো—তান্বী একদম মরা মানুষের মতোই গভীর ঘুমে। চোখ বন্ধ, ঠোঁট হালকা ফাঁক, মুখে ক্লান্তির ছাপ।

জাভিয়ান একদম অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকলো মুহূর্তখানেক। তারপর ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলে ড্রয়ার খুললো।হাত বাড়াতেই চকচকে সিলভার হ্যান্ডকাফ বেরিয়ে এলো। কোনো ভ্রূক্ষেপ ছাড়াই ঝটপট তান্বীর পা ধরে বেডের একপাশে আটকে দিলো।

হ্যান্ডকাফের শব্দটা কক্ষে প্রতিধ্বনি তুললো।

জাভিয়ান মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো,“এবার তো শান্তিতে ঘুমাতে পারবো।”

তারপর লাইট অফ করে নির্ভারভাবে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লো। রুম আবার ডুবে গেলো অন্ধকারে।
.
.
.
.

এদিকে মেইলস্ট্রোম ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। একটার পর একটা সিগার ধরাচ্ছে— ধোঁয়ার রিংগুলো ভেসে যাচ্ছে অন্ধকার ঘর জুড়ে। এক হাতে অর্ধেক খালি রেড ওয়াইনের বোতল, অন্য হাতে অস্থিরতা।

চেয়ারটা আস্তে আস্তে দুলছে, বারান্দার দিকটা অন্ধকারে ডুবে আছে। দূরের আলো ঝাপসা হয়ে তার চোখে পৌঁছাচ্ছে, যেনো পৃথিবীটা তার সামনে থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে।

ঠিক তখনই ভেসে এলো তান্বীর চেহারাট। সেই মুখটা যেনো বাতাস চিরে তার মনে এসে আঘাত করলো, আবার মিলিয়ে গেলো শূন্যে।

মেইলস্ট্রোম ঠোঁটে সিগার চেপে নিজের মনে বললো—
“এতো কাছে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেললাম তোমাকে… কেনো নিয়তি বারবার তোমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়? আমি তো নিয়তি মানি না। তাহলে কি সত্যি নিয়তি বলে কিছু আছে? তাহলে কেনো পৃথিবীর সবকিছু আমার হাতে থাকলেও,শুধু তোমাকেই পাই না…?”

তার ঠোঁট ফিসফিস করে নাম উচ্চারণ করলো—
“Soulflame…” ধোঁয়ার রিংগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো, যেনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।
.
.
.
.

ভিলা এস্পেরেন্জা!সকালের আলোটা জানালা ভেদ করে কক্ষে এসে পড়েছে।জাভিয়ান ধীরে ধীরে চোখ মেললো।

চোখ খুলতেই তার দৃষ্টি আটকে গেলো এক অদ্ভুত দৃশ্যে।তান্বী নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে আছে একদম তার পেটের ওপর। দুটো পা এখনো হ্যান্ডকাফে বাঁধা, তবুও মাথাটা কাত হয়ে জাভিয়ানের পেটের মাঝখানে জড়িয়ে আছে। ঘন বড় চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে তার চারিপাশে আর আর নিঃশ্বাসের উষ্ণতা জাভিয়ানের গায়ে লাগছে।

জাভিয়ান কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেলো। তার চোখ আটকে গেলো সেই শান্ত মুখে —চোখের ঘন পাপড়িগুলো যেনো আলতোভাবে দুলছে, শ্বাসের সাথে সাথে। অজান্তেই তার মনে ভেসে উঠলো সেই শপিং মলের ট্রায়াল রুমের মুহূর্তটা।

কাল যখন মলে তান্বী হঠাৎ করে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো,তার বুকের সাথে মিশে গিয়েছিলো।এক মুহূর্তের জন্য তান্বী মাথা তুলে তার বড় বড় টানা টানা কাজল মাখা চোখদুটো দিয়ে তাকিয়েছিলো তার দিকে।সেই চোখ…অস্থির, ভেজা, আর কেমন যেনো নেশাভরা। কান্নায় কাজল লেপ্টে গিয়েছিলো, তবুও চোখজোড়ার গভীরতা তাকে ঝড়ের মতো আঘাত করেছিলো।

আজ সকালে সেই একই চোখের ছবি যেনো আবার তার ভেতরে বেজে উঠলো। কিন্তু এবার তান্বী ঘুমন্ত—আরও অসহায়, আরও কোমল। জাভিয়ান অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেলো মুহূর্তটার ভেতরে, বুঝতেই পারলো না কতক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে সেই মুখে।

জাভিয়ান হঠাৎই নিজের ভেতরের এক অদ্ভুত অনুভূতিতে বিরক্ত হয়ে উঠলো। চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে নিজেকেই বললো— “এই বাজে আবেগের প্রয়োজন নেই…”

এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে তান্বীর মাথায় জোরে ধাক্কা দিলো। অপ্রস্তুত তান্বী হকচকিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে সাথে সাথে উঠে বসে পড়লো।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো।
পা নাড়াতে গিয়েই অনুভব করলো— শীতল ধাতব শব্দ… ঝনঝন… তার গোড়ালিতে হ্যান্ডকাফ আটকানো!

তান্বীর গলা কেঁপে উঠলো, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো—
“আমার পায়ে কে হ্যান্ডকাফ লাগিয়েছে!?”

জাভিয়ান ঠান্ডা ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকালো। “তুমি কি ঘুমাও, নাকি স্বপ্নে ডান্স করো? সারারাত আমার ওপর পা তুলে দিয়েছো। বিরক্ত হয়ে আটকে দিয়েছি।”

তান্বী ফুঁসে উঠলো রাগে—“আপনি এতো খারাপ…!”

জাভিয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিলো। অবশেষে হ্যান্ডকাফ খুলে দিলো তার পা থেকে। কোনো উত্তর না দিয়েই সোজা উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।

তান্বী তখনও রাগে কাঁপছে, বুক ওঠানামা করছে দ্রুত গতিতে। মাথার ভেতর একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে—
“এই লোকটা আসলেই একটা বজ্জাত… অতিরিক্ত খারাপ!”

তান্বী কৌশলে ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলো। ভেতরে তখন জাভিয়ান।

সময় কেটে গেলো মিনিটে মিনিটে…অবশেষে প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেলো, কিন্তু জাভিয়ানের কোনো নড়াচড়া নেই।

তান্বী চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছিলো—ভাবছিলো, এখনই হয়তো দরজা খুলে বাইরে আসতে চাইবে, আর তখনি তান্বী তাকে দিয়ে অনুতপ্ত ভঙ্গিতে “Sorry” বলিয়ে নিবে কিন্তু কিছুই হলো না।

ধীরে ধীরে তান্বীর বিরক্তি চূড়ান্তে পৌঁছালো সে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো সাড়া না পেয়ে ঠোঁট কামড়ে বিছানায় গিয়ে বসল।

ঠিক তখনই দরজায় টক টক শব্দ হলো…জাভিয়ানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ভেতর থেকে— “এই মেয়ে, দরজা খুলো, দরজা কোনো লাগিয়েছো?”

তান্বী ছুটে এসে হাত ক্রস করে দাঁড়ালো দরজার সামনে। চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক, ঠোঁটে একরাশ জেদ—“খুলবো না। যতক্ষণ না ‘Sorry’ বলছেন।”

ভেতর থেকে জাভিয়ানের গম্ভীর কণ্ঠ—“Sorry my foot!”

তান্বী ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো—“ঠিক আছে। তাহলে আমি নীচে নেমে যাচ্ছি। আপনি থাকুন আটকে।”

ভেতরে খানিক নীরবতা। তারপর এক বিরক্ত-হতাশ নিঃশ্বাসের শব্দ। অবশেষে জাভিয়ান দাঁত চেপে বলে উঠলো— “Okay! I’m sorry. Now open the damn door.”

তান্বীর মুখে সন্তুষ্টির এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো।
সে ধীরে দরজা খুলে দিলো।

দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো জাভিয়ান—চোখে বিরক্তির আগুন, মুখে ঝড় থামানোর চেষ্টা। রাখি ভঙ্গিতে, যেনো নিজের অহংকার সামলাতে লড়াই করছে।

তান্বী পাশে সরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে তাকালো,তার মনের ভেতর ছোট্ট বিজয়ের নাচন।

আর এক মুহূর্তে তান্বী হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললো—“আমার পেটের মধ্যে একটা প্রশ্ন অ্যাকুরিয়ামের জেলিফিশের মতো লাফাচ্ছে।”

জাভিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো “হোয়াট?”

তান্বী ঠোঁট কামড়ে একটু ইতস্তত করলো, তারপর বললো— “আপনি এতো ঘন্টা ধরে বাথরুমে আসলে করেনটা কি?”

জাভিয়ান তখন ধীরে ধীরে হেসে বাঁকা চোখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি। “খুব সিক্রেট কাজ করি।”

তান্বী ভ্রু তুলে বললো—“কি সিক্রেট কাজ?”

জাভিয়ান ফিসফিস করে বললো— “মাস্টারবেশন করি।”

তান্বীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সে এক ঝটকায় বললো— “ছিঃ… কিসব ফাউল কথা বলেন আপনি!”

এক বলেই আর এক মুহূর্তও জাভিয়ানের সামনে দাঁড়ালো না, সে দরজা ঠেলে দ্রুত নিচে নেমে গেলো।

জাভিয়ান একা দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসলো।তার ঠোঁটে মৃদু স্বরে ফিসফিস—“অপদার্থ মেয়ে একটা।”
.
.
.
.

স্ট্রোম হাউজ। সকাল বেলা।

মেইলস্ট্রোমের চোখ লালচে হয়ে উঠেছিল। তার সামনে মেঝেতে পড়ে আছে নিজের দলের কয়েকজন লোক, দম নিতে হাপাচ্ছে কেউ, আবার কেউ আর নড়ছে না।

সে বন্দুক নামিয়ে কষে দাঁত চেপে বললো—“আমি ২৪ ঘণ্টার ডেডলাইন দিয়েছিলাম…মলের সিসিটিভি ফুটেজ আনতে বলেছিলাম… আর তোরা সেটা আনতে পারিসনি উল্টো বলছিস সেদিন সব সিসি ক্যামেরা আর ফুটেজ সব ধ্বংস হয়ে গেছে!”

তার কণ্ঠে এমন গর্জন ছিল, যেনো পুরো ঘর কেঁপে উঠলো। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু শ্বাসরুদ্ধ আতঙ্ক। হঠাৎই আবার বন্দুক উঠিয়ে ট্রিগার টিপলো। আরেকজন পড়ে গেল নিথর।

ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো
—“Enough, Maelstrom!”

কক্ষে প্রবেশ করলো ইসাবেলা। কালো সাটিনের নরম অথচ রাজকীয় পোশাক, আর গলায় হালকা ডায়মন্ড চেইন, চোখে এক ধরণের কঠোরতা আর মাতৃত্ব মেশানো দৃঢ়তা।

সে এগিয়ে এসে মেইলস্ট্রোমের হাত চেপে ধরলো।
“তুমি কেন সবসময় এত মাথা গরম করো,বলো তো?”

মেইলস্ট্রোম ফুঁসে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত থেমে গেল।

ইসাবেলা কঠিন কণ্ঠে বললো “এভাবে করে তুমি নিজের ক্ষতি করছো। নিজের লোকদের এভাবে মেরে ফেলতে থাকলে… একদিন তোমার পাশে কেউই থাকবে না।”

ঘরে আবার নীরবতা নেমে এলো। শুধু বন্দুক থেকে ধোঁয়া উঠছে… আর মায়ের কথাগুলো যেনো ছুরি হয়ে মেইলস্ট্রোমের অহংকার ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে।
.
.
.
.
ভিলা এস্পেরেন্জা।

সকালবেলা সুবিশাল ডাইনিং হলে সকালের আলো এসে পড়ছে ক্রিস্টাল ঝাড়বাতির কাঁচে। দীর্ঘ টেবিলে সাজানো হয়েছে নানান রকম খাবার। জাভিয়ানের বাবা-মা, চাচা, চাচাতো ভাই সবাই বসে আছেন। শুধু নেই লুসিয়া কারন সে তান্বীকে একা ফেলে আসার ভয়ে এখনও ফ্রেন্ডের বাসা থেকে বাসায় ফেরেনি।

ডাইনিং টেবিলের একপাশে তান্বী, আর তার পাশে জাভিয়ান। হঠাৎ নীরবতা ভাঙলো জাভিয়ানের মা কার্গো চৌধুরীর কণ্ঠে—“জাভিয়ান, সত্যি করে একটা কথা বলো তো… তুমি কি সত্যিই এই মেয়েটাকে ভালোবেসে বিয়ে করে এনেছো? নাকি কোথাও থেকে জোর করে তুলে এনেছো?”

চামচটা ধীরে নামিয়ে রেখে জাভিয়ান মায়ের দিকে তাকালো। “এমনটা মনে হলো কেনো তোমার ?”

মা ঠান্ডা চোখে উত্তর দিলেন—“আমার কেনো মনে হয় তোমাদের দুজনের মাঝে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া তোমরা আলাদা ঘুমাও।”

জাভিয়ানের ঠোঁটে হালকা হাসি টানলো। “বাহ, এই বাড়ির লোকজন তো এখন দেখি দেয়ালেও কান পাততে শুরু করেছে।”

মা দৃঢ় গলায় বললেন— “কান পাততে হয় না, দেখেই বোঝা যায় তোমাদের সম্পর্ক ঠিক নেই, তোমাদের মাঝে সেসব কিছুই নেই।”

এক মুহূর্ত নীরবতা নেমে এলো। তারপর জাভিয়ান গ্লাস নামিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললো—“তুমি কি বলতে চাইছো মম? যে আমাদের মধ্যে কোনো রোমান্টিক সম্পর্ক নেই? আর সেরকম কিছুই তোমরা দেখতে পাও না? ওকে… তাহলে আজ তোমাদের সেই রোমান্টিক ক্লাইম্যাক্স দেখাই।”

এবার হঠাৎ করেই জাভিয়ান তান্বীর হাত ধরে টেনে নিলো নিজের কোলের ওপর ।তান্বী বিস্ময়ে জমে গেলো। পুরো পরিবারের চোখ ওদের দিকে নিবদ্ধ।

জাভিয়ান এক হাতে ওকে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে তান্বীর চিবুক উঁচু করলো। “লজ্জা পেয়ো না, তারা আমাদের রোমান্সের লাইভ দেখতে চায়।”

বলেই হঠাৎ তান্বীর গালে এক চুমু দিলো।তান্বী লজ্জায় লাল হয়ে ছটফট করতে লাগলো, কিন্তু জাভিয়ান তাকে ছাড়লো না।ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো জাভিয়ান… এবার ঠোঁটে চুমু দেওয়ার মুহূর্ত।

ঠিক তখনই চেয়ার ঠেলেই একে একে সবাই উঠে চলে গেলো টেবিল থেকে। ডাইনিং হল ফাঁকা হয়ে গেলো।

তান্বী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো জাভিয়ানের কোলে।
শুধু শুনতে পেলো তার কানে ভেসে আসা জাভিয়ানের ফিসফিসে স্বর— “ অভ্যাস করে নাও, এই বাড়িতে অলটাইম কিছু না কিছু ড্রামা চলতেই থাকে। আর সেই ড্রামার মেইন লিড হচ্ছে জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী ।”

তারপরই জাভিয়ান যেন কিছুই ঘটেনি, সেভাবেই তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। কোনো ব্যাখ্যা নয়, কোনো হাসি নয়—শুধু হেঁটে চলে গেলো ডাইনিং হল থেকে।

কিন্তু তান্বী তখনও স্তব্ধ। শব্দহীন, নির্বাক হয়ে বসে রইলো চেয়ারে। তার হাত আস্তে আস্তে গিয়ে ছুঁলো সেই জায়গাটা—গালটা, যেখানে এখনও জাভিয়ানের উষ্ণতার ছাপ লেগে আছে।এক মুহূর্তে পৃথিবীটা যেন থেমে গেছে,আর তান্বীর বুকের ভেতর ঢেউ তুলছে এক অচেনা কাঁপুনি।
.
.
.
.
দুপুরের কড়া রোদের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢুকে বিশাল ঘরটাকে উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে তুলেছে। জাভিয়ান আগের মতোই নিখুত ভাবে তৈরি হয়ে নিলো। হাতে চকচকে ঘড়ি, ইস্ত্রি করা শার্ট আর দামি পারফিউমের গন্ধে যেন চারপাশ ভরে উঠলো।

আজকের দিনটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নতুন পারফিউম কোম্পানির লঞ্চ—যার ব্র্যান্ড নামের চারদিকে ইতিমধ্যেই উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে। তারপর আছে অফিস রি-মডেলিং, যেটা সেদিন কিনে নিয়েছে। প্রতিটি কর্নার নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা, প্রতিটি ডিটেইল তার চোখে নিখুঁত হতে হবে।

তাই সকাল থেকেই ব্যস্ততা। কোনো অকারণ সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। একবারও পেছনে না তাকিয়ে, জাভিয়ান নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো ভিলা এস্পেরেন্জার সেই বিশাল করিডোর পেরিয়ে।

তান্বী তার চোখের সামনে একবারও পড়েনি সেই ডাইনিং টেবিলের ঘটনার পর।জাভিয়ানের চলে যাওয়া কিংবা প্রস্তুতির কোনো ছাপ তার সামনে এসে পড়েনি।এই অদৃশ্য দূরত্ব যেন আরো একবার মনে করিয়ে দিলো—তাদের জগৎ, তাদের জীবন, একসাথে থেকেও কত ভিন্ন।
.
.
.
.
সন্ধ্যা নামতেই মেক্সিকোর এক নামিদামি ক্লাবের ভেতর জমে উঠেছে আলো আর সুরের ঝলক। জাভিয়ান রায়হানকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আজ তাদের এক মেক্সিকান বন্ধুর জন্মদিন, আর সে উপলক্ষ্যে ছোটখাটো পার্টি।

ভিআইপি লাউঞ্জের এক কোণায় নরম সোফায় বসলো দু’জন। আশেপাশে তাদের মেক্সিকো থেকে আসা বন্ধুরা ইতোমধ্যে বসে গ্লাস হাতে আড্ডা দিচ্ছে। ওয়েটার ট্রেতে করে ড্রিঙ্ক সাজিয়ে রাখলো। কেউ কেউ শট গ্লাস এক চুমুকে শেষ করে ফেললো।

জাভিয়ান আস্তে করে একট সিগার ধরালো। ধোঁয়ার রিং ভেসে উঠতেই পাশে বসা বন্ধু হেসে বললো— “এই ভাই, আজকাল তোকে খুঁজে পাওয়াই যায় না।”

আরেকজন মজা করে যোগ দিলো—“পাবে কিভাবে? এখন তো ভদ্রলোক বিয়ে করে ফেলেছে। নতুন বউ রেখে আর কে-ইবা ক্লাবে আসে?”

চারপাশে হো-হো করে হাসি ছড়িয়ে পড়লো।জাভিয়ান গ্লাস হাতে নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললো— “আরে বাদ দে এসব কথা। তোদের কথা বল।”

ঠিক তখনই এক মেয়ে এসে পাশের এক বন্ধুর কোলের ওপর বসল।আর সেই বন্ধুটি তার সাথে সহজভাবে ফ্লার্ট করতে শুরু করলো, গলায় গলায় হেসে উঠলো।

পাশ থেকে আরেকজন বন্ধুর ঠাট্টা করে বললো “ওরে শালা,তোর গার্লফ্রেন্ড জানলে তো তুই শেষ!”

সে অবহেলাভরা ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো, সিগারের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো— “আরে দূর, জানলেই বা কী! লাইফ মানেই তো এনজয়। একজন নিয়েই পড়ে থাকলে কি চলে নাকি?”
.
.
.
.
রাত হয়ে এসেছে।বারের ভেতর আলো-ঝলমলে পরিবেশ। কোণের টেবিলে বসে আছে জাভিয়ান আর রায়হান। চারপাশে গ্লাসের টুংটাং, হালকা সঙ্গীত আর হাসাহাসি চলছে।

হঠাৎ তার এক বন্ধু কোথা থেকে এগিয়ে এসে বললো—
“এই জাভি, আজকে এখানে নতুন একটা মেয়ে এসেছে… শুনেছি কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না। তুই একবার দেখ, আমি বাজি রাখি তোর ওপরই ফিদা হয়ে যাবে।”

জাভিয়ান এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো, তারপর গ্লাসটা জোরে টেবিলে রেখে কড়া গলায় বললো—“এসব ফাউল জিনিস আমাকে অফার করবি না। আবার বললে আমি এখুনি উঠে চলে যাবো।”

পরিস্থিতি সামলাতে আরেকজন হেসে বললো— “আরে দোস্ত, ও মজা করছে! আমরা তো জানি তুই এসবের মধ্যে নেই। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তুই হঠাৎ করে বিয়ে করে ফেললি—এইটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। তোর বউকে দেখার খুব ইচ্ছে আমাদের।”

আরেকজন কথার মাঝে যোগ দিলো—“শুনেছি বাংলাদেশের মেয়েকে বিয়ে করেছিস?”

সাথে সাথে আরেকজন বললো—“আরে ওতো ওর বাবার চাপে পড়ে করেছে।”

তখন আরেকজন ঠাট্টা করে হেসে উঠলো—“যাইহোক, জাভিয়ান যেহেতু কোনো মেয়েকে বিয়ে করেছে, মেয়েটা নিশ্চিত দারুণ কিছু একটা হবে। মানে… সেরা মাল হবে।”

এতটুকু শুনেই জাভিয়ানের চোখ লাল হয়ে উঠলো। ভেতরের রাগ চেপে রাখতে সে একের পর এক ড্রিংক গলায় ঢালতে শুরু করলো। প্রথমে ধীর গতিতে, তারপর হঠাৎ যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। কখন যে নেশা মাথার ওপর দিয়ে গেলো, সে বুঝতেই পারলো না।

বাকি সবাই ডান্সফ্লোরে চলে গেলো, আলো-ঝলমলে মিউজিকের তালে হারিয়ে গেলো। কোণে শুধু বসে রইলো জাভিয়ান আর রায়হান।

রায়হান উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে বারবার বললো—
“স্যার, আপনি যথেষ্ট খেয়েছেন… প্লিজ, আর নয়। এখনই বাড়ি ফিরি আমরা চলুন।”

জাভিয়ান তখন আধো মাতাল কণ্ঠে হেসে ফেললো।
“এই রায়হান… ড্রিংক তো শেষ! আরো নিয়ে আসো…”

তারপর গ্লাসটা তুলে নিয়ে ঝাপট মেরে শেষ চুমুক দিলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সোফার উপর ঢলে পড়ে গেলো জাভিয়ান। চোখ আধখোলা, নিঃশ্বাস ভারী, টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে খালি গ্লাস। তার শরীর থেকে ভেসে আসছে তীব্র অ্যালকোহলের গন্ধ।

ঠিক তখনই তার বন্ধুরা ডান্স ফ্লোর থেকে ফিরে এলো।
আর এক ঝলক জাভিয়ানের দিকে তাকিয়েই সবাই থমকে গেলো।

“একি… জাভি?” — বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো একজন।
“ওর এই অবস্থা কেনো?”

রায়ান দ্রুত জাভিয়ানের নাড়ি পরীক্ষা করলো।
তারপর জাভিয়ানের বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো—“স্যারকে আর এখানে রাখা যাবে না… অবস্থা খারাপ।”

তখন রায়হান এগিয়ে এসে জাভিয়ানের এক পাশের হাত কাঁধে তুলে নিলো। অন্য হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো জাভিয়ানের কব্জি। জাভিয়ানের মাথা ঝুঁকে আছে রায়হানের কাঁধে, নিস্তেজ আর ভারী ভাবে।

ধীরে ধীরে তাকে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো রায়হান। আর এদিকে জাভিয়ানের বন্ধুরা নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। বিশ্বাসই করতে পারছিলো না তারা —যে অহংকারী, কড়া নিয়ন্ত্রণে থাকা জাভিয়ান আজ এভাবে মাতাল হয়ে ভেঙে পড়েছে।

বারের আলো-ঝলমলে পরিবেশে হঠাৎই জাভিয়ানের মুখ অস্বাভাবিকভাবে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। রায়হান কিছু বুঝে ওঠার আগেই—

“উহ্—”

জাভিয়ান হঠাৎ রায়হানের ওপর পুরো বমিট করে ফেললো। রায়হান স্তম্ভিত হয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কণ্ঠে ফিসফিস করে উঠলো—“স্যার! এটা… এটা আপনি আমার ওপরই করলেন? শেষমেষ আমাকে-ই বেছে নিলেন?”

চারপাশে কয়েকজন ঘুরে তাকালেও, রায়হান নিজেকে সামলে দ্রুত বার কাউন্টারের পাশে ছোট্ট ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ভেতরে গিয়ে নিজের শার্ট খুলে কলের নিচে জোরে জোরে ঘষতে লাগলো।

পাঁচ মিনিট পর রায়হান ভেজা শার্টটা গায়ে চাপিয়ে নিলো। বারের বাইরে তখনো হালকা গানের সুর বাজছে, কিন্তু রায়হানের চোখে চিন্তা আর অসস্থি স্পষ্ট।

তারপর সে সরাসরি জাভিয়ানের কাছে গিয়ে, পানি দিয়ে জাভিয়ানের মুখ ধুইয়ে দিলো, টিস্যু দিয়ে মুছে দিলো।

শেষমেষ রায়হান আগের ভঙ্গিতেই জাভিয়নাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে স্তব্ধ রাত, আকাশে হালকা কুয়াশা। গাড়ি সামনের দিকেই দাঁড়িয়ে।

রায়হান গাড়ির দরজা খুলে জাভিয়ানকে বসিয়ে দিলো আর সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে নিজে গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে।

রায়হান গাড়ি স্টার্ট দিলো। পাশের সিটে জাভিয়ান আধো ঘুমন্ত ভঙ্গিতে মাথা হেলিয়ে রেখেছিলো।

হঠাৎ করেই জাভিয়ান গম্ভীর গলায় বললো—“রায়হান, গাড়িটা ফার্মহাউসে নাও।”

স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে রায়হান অবাক হলো। “স্যার, বাড়ি যাবেন না? মিস গজদন্তনি তো চিন্তা করবে। এতক্ষণ ধরে হয়তো অপেক্ষাও করছে।”

জাভিয়ান ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিলো—“ওর কারণেই যাচ্ছি না।”

রায়হান চমকে উঠলো। “মানে স্যার? ওনার জন্যই বাড়ি ফিরবেন না?”

জাভিয়ান ঠাণ্ডা স্বরে বললো—“ হ্যাঁ! কারণ, আজ যদি বাড়ি যাই…অঘটন ঘটবেই।”

রায়হান একদম হতভম্ব। “কি বলেন স্যার! এতদিনেও আপনাদের অঘটন ঘটেনি।মানে আপনাদের ইয়ে-ইয়ে কিছু হয়নি?”

জাভিয়ান মুখ ঘুরিয়ে বিরক্ত গলায় বললো— “ইয়ে ইয়ে আবার কি?… ও আচ্ছা, বুঝেছি। না, হয়নি।”

রায়হান চোখ বড় করে তাকালো। “স্যার, এক বাড়িতে, এক রুমে থেকে… এখনো কিছুই হয়নি?”

“না।” জাভিয়ানের কণ্ঠ দৃঢ়।

রায়হান এবার হালকা হেসে মাথা নাড়লো। “স্যার, তাহলে তো আপনাকে হারবাল খাওয়ানো দরকার। বউ পাশে থেকেও যিনি নিজেকে সামলাতে পারেন, তিনি সাধারণ মানুষ নন।”

জাভিয়ান তখন ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো— “শাট আপ, রায়হান। সামনে তাকাও আর গাড়ি ঠিকভাবে চালাও।”

রায়হান মুখ চেপে হেসে দিলো। গাড়ি রাতের আঁধারে দ্রুত গতিতে ফার্মহাউসের দিকে ছুটতে লাগলো।
.
.
.
.
রাতটা নীরব। তান্বী বিছানার ধারে বসে আছে।
চারপাশে এত বড় ঘর, এত আধুনিক সাজসজ্জা—তবুও কেনো যেনো অস্বস্তি লাগছে।

মনে মনে ভাবছে—”অদ্ভুত তো! যতদিন ধরে দেখেছি, জাভিয়ান সবসময় তাড়াতাড়িই বাড়ি ফেরে। আজ এত রাত হয়ে গেলো এখনো ফিরছে না কেন?”

মুখে ঠোঁট কামড়ে ধীরে ধীরে বিড়বিড় করলো— “থাক-বদমাইশটা বাড়িতে না থাকলেই তো শান্তি পাচ্ছি।”

কিন্তু হৃদয় যেনো মুখের কথা শুনতে চাইলো না। বুকের ভেতর একটা হাহাকার উঠলো, নিঃশব্দে ফিসফিস করলো— “কিন্তু কেনো এত অস্থির লাগছে? উনি না থাকলেই কি সত্যিই শান্তি লাগছে, নাকি… খালি খালি মনে হচ্ছে কিছু?”

তান্বী জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অচেনা আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারলো— শান্তি আর অস্থিরতার মাঝখানে জাভিয়ান নামের একটা ছায়া আটকে আছে।

হঠাৎ করেই জাভিয়ানের কক্ষের ভেতরে রাখা ল্যান্ডলাইনের ফোনটা বেজে উঠলো। তান্বী একটু চমকে উঠে ফোনটা ধরলো।

অপর প্রান্ত থেকে রায়হানের গম্ভীর গলা ভেসে এলো—
“মিস গজদন্তনি… এখনই পেছনের গেইটে আসুন। স্যার আমার সাথে আছে, কিন্তু স্যার অনেকটা ড্রাঙ্ক অবস্থায়।”

তান্বীর বুক ধক করে উঠলো। ফোন নামিয়ে রেখে তাড়াহুড়ো করে পেছনের মেইন গেইটের দিকে ছুটে গেলো। আর সত্যিই—ওখানে দাঁড়িয়ে রায়হান, আর তার কাঁধে ভর দিয়ে আধশোয়া জাভিয়ান। মুখে একরাশ ক্লান্তি, চোখ আধা বোজা, অগোছালো ভঙ্গি।

রায়হান এগিয়ে এসে তান্বীর হাতে প্রায় ঠেলে দিলো জাভিয়ানকে। জাভিয়ানের ভারে তান্বীর শরীর কেঁপে উঠলো। সে প্রায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো।

শ্বাসকষ্টে ভরা কণ্ঠে তান্বী বললো—“না রায়হান ভাইয়া, আমি পারবোনা… ওনাকে আমার মতো মেয়ের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। আপনি প্লিজ ওনাকে ঘরের ভেতর দিয়ে আসুন।”

রায়হান একটু অস্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়লো, তারপর আবার নিজের কাঁধ বাড়িয়ে দিলো জাভিয়ানের জন্য।

রায়হান জাভিয়ানকে ধরে কক্ষে নিয়ে এল। বিছানার কাছে পৌঁছাতেই তাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বিছানার ওপর ফেলে দিলো। মুখে দুষ্টু হাসি টেনে তান্বীর দিকে তাকিয়ে বললো —“এই নিন, এবার সামলান ওনাকে।” বলেই রায়হান চলে যেতে উদ্যত হয়। আর তখনি তান্বী তাড়াতাড়ি পিছু ডাকলো, গলায় হালকা উৎকণ্ঠার সুর—“শুনছেন, রায়হান ভাইয়া… প্লিজ… ওনার পোশাকটাও পাল্টে দিয়ে যান না।”

রায়হান চোখ কুঁচকে তাকালো তান্বীর দিকে, ঠোঁটে কৌতুকমাখা টান খেললো।—“বাহ, মিস! হাজবেন্ড আপনার! আর পোশাকও পাল্টে দিতে হবে আমাকে?”

তান্বীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। কোনো জবাব দিতে পারলো না, শুধু চুপচাপ চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

রায়হান মজা পেয়েই হেসে উঠলো —“আচ্ছা, আচ্ছা। চিন্তা নেই।”

সে আলমারি খুলে এক জোড়া নরম সিল্কের নাইট স্যুট বের করলো। জাভিয়ানের আলমারি একমাত্র রায়হান খুলতে পারে আর বর্তমানে তান্বী।

কিছুক্ষণ পরেই জাভিয়ানের গায়ে শোভা পেলো গাঢ় কালো রঙের সিল্কের শার্ট আর শর্টস।

সবকিছু গুছিয়ে রায়হান দরজার কাছে গিয়ে হালকা হাত নাড়লো—“হয়ে গেছে। এখন সামলান নিজের জিনিস।”

দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দের পর ঘরে রইলো শুধু তান্বী আর জাভিয়ান।তান্বী বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো। জাভিয়ান শুয়ে আছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। কিন্তু হঠাৎ করেই চোখ আধখোলা করে ধীরে বললো—“রায়হান… পানি… খাবো… পানি।”

কিছুক্ষণ বাদেই তান্বী ট্রেতে করে পানি নিয়ে এলো। গ্লাসে অস্বাভাবিক টক লেবুর রস মিশিয়ে নিয়েছিলো সে। চুপচাপ এসে জাভিয়ানের পাশে বসলো, মৃদু গলায় বললো—“এই নিন, পানি খান।”

জাভিয়ান তখনো অর্ধচেতন। মাথা সামান্য উঁচু করে চোখ মেলল। দৃষ্টি ঝাপসা, তবুও স্পষ্ট দেখতে পেলো সামনে বসা মেয়েটিকে। অবাক হয়ে ফিসফিস করলো—“তুমি… তান্বী? ফার্ম হাউসে এলে কীভাবে?”

তান্বী তার উত্তর না দিয়ে গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। “আগে পানি খান।”

জাভিয়ান ধীরে গ্লাসটা ঠোঁটে নিলো। এক চুমুক দিতেই মুখ কুঁচকে উঠলো। “উফ! এটা কী জঘন্য জিনিস! ছিঃ, মুখটাই নষ্ট করে দিলে।”

তান্বী এবার একটু জোর করেই তাকে পানি পান করালো। পানি অর্ধেক শেষ হতেই গ্লাস রেখে সে উঠে যেতে চাইলো। কিন্তু হঠাৎই জাভিয়ানের হাত এগিয়ে এলো— দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলো তান্বীর কব্জি।

“ডোন্ট গো।” গভীর, কর্কশ কণ্ঠস্বরে বললো জাভিয়ান।

এরপর নিজেই ভারসাম্য রাখতে না পেরে জাভিয়ান হঠাৎই তাকে টেনে আনলো নিজের ওপর। দু’জনেই বিছানায় পড়ে গেলো। তান্বী পড়লো একেবারে জাভিয়ানের বুকের ওপর, আর জাভিয়ানের দমবন্ধ করা উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে তার।

তান্বী থমকে গেলো।চোখ তুলে তাকাতেই বুক কেঁপে উঠলো তার— জাভিয়ানের দু’চোখ রক্তাভ হয়ে আছে, নেশায় ভরা, তীক্ষ্ণ আর ঝড়ো দৃষ্টিতে যেন তাকে গ্রাস করছে।

তান্বী তড়িঘড়ি করে ছাড়াতে চাইলো। “আমাকে ছাড়ুন! কী করছেন আপনি?”

জাভিয়ান কোনো উত্তর দিলো না। তাই তান্বী পুনরায় বললো ” আমাকে ছাড়ছেন না কেনো? আপনি আসলে কি চান?”

তখনি জাভিয়ানের হাত তার কোমরে আরো শক্ত হলো। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটলো জাভিয়ানের।তারপর সে ঝুঁকে এসে নিঃশব্দে ফিসফিস করে বললো— “তোমাকে ভালোবাসতে চাই… একেবারে খাট ভেঙে ফেলার মতো ভালোবাসা ।”

তান্বীর বুক ধক করে উঠলো। মুহূর্তেই মুখ লালচে হয়ে গেলো রাগে আর লজ্জায়। সে মুঠি শক্ত করে জাভিয়ানের বুকে কষাল এক ঘুষি—“ছি! অসভ্য! বদমাইশ! লম্পট লোক! কি সব বাজে কথা বলছেন নেশার ঘোরে! আর কে বলেছিলো আপনাকে এভাবে আখেরি মদ গিলতে ?”

জাভিয়ান তখনো হাসছিলো— হালকা, কিন্তু মাতালের মতো অস্থির হাসি।

তান্বী হালকা কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো—“ছাড়ুন আমাকে…”

কিন্তু তার কথা শেষ হবার আগেই জাভিয়ানের শক্ত বাহু আরও জোরে তাকে আবদ্ধ করলো। তান্বীর বুক ধড়ফড় করতে লাগলো, অনুভব করলো তার শরীর জাভিয়ানের উষ্ণ বুকের ওপর ঠেসে ধরা। সে দেখলো এবার — জাভিয়ানের ঠোঁট ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে আসছে। তান্বীর নিঃশ্বাস আটকে গেলো, চোখে অদ্ভুত আলোড়ন ছড়িয়ে পড়লো।

হঠাৎ করেই জাভিয়ানের দম ভারী হয়ে এলো।
মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখ আধো ঘুমে ঝাপসা হয়ে এলো, আর তান্বীর ঠোঁট স্পর্শ করার আগেই সে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো।

তান্বী অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
শক্ত বাহু এখনও তাকে বেঁধে রেখেছে, বুকের ভেতর জাভিয়ানের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।তান্বীর ঠোঁট কেঁপে উঠলো, মনে হলো তার সমস্ত দম যেন থেমে গেছে। সে চেষ্টা করলো নড়তে, কিন্তু জাভিয়ানের গ্রিপ এত দৃঢ় যে কোনোভাবেই পারলো না।

ঠিক তখনই ওর চোখ আটকে গেলো জাভিয়ানের মুখে। লাভ শেপের চিকন পাতলা ঠোঁটের নিচে ডানপাশে ছোট্ট একটা তিল— অদ্ভুতভাবে আকর্ষণীয়। তান্বী অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেমে গিয়ে তাকিয়ে রইলো সেই তিলের দিকে।

রাতের আধো অন্ধকারে দুজনের নিঃশ্বাস মিশে গেলো—
একজন অচেতন ঘুমে, আরেকজন অচেনা কোনো আকর্ষণে।

(চলবে……)

(যেহেতু শনিবার আর রবিবার দুই পর্ব দেয়ার কথা ছিলো আর আমি প্রতি পর্ব ৩ হাজার শব্দের দেই। আর আজকেরটা ৫হাজার + শব্দ আছে একবারে দুদিনেরটা এক পর্বে দিয়ে দিলাম)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply