ডিজায়ার_আনলিশড
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব-১০
দু’দিন সময় কেটে গেছে।
ভিলা এসপেরেঞ্জার নরম, স্বপ্নময় পরিবেশে থেকেও তান্বীর মনে অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল। দু’দিন ধরেই সে শুধু শাড়ি পরে আছে। শাড়ি তার নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতির স্মৃতি দিলেও… এখানে, এই আধুনিক ভিলায়, সবাই পশ্চিমা পোশাকে অভ্যস্ত। এমনকি জাভিয়ানের মা কার্গো চৌধুরীও প্রতিদিন স্টাইলিশ ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে থাকেন।
শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে বিরক্ত তান্বী আজ সাহস করে বলেই ফেললো জাভিয়ানকে— “আমি শপিং করতে যেতে চাই। কিছু ড্রেস কিনতে হবে আমার।”
জাভিয়ান ডেস্কে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। চোখ না তুলেই বলল— “ড্রেস? অনলাইনে অর্ডার করে দিচ্ছি। এক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে।”
তান্বী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল—“না, আমি মল থেকে কিনতে চাই। এখানে তো সবাই ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে। আমার শাড়ি পরে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না, শাড়ি পড়ে থাকার অভ্যাস আমার নেই।আসার সময় দাদি দিয়েছিলো কিন্তু এখানেতো আর দাদি নেই,তাই শাড়ি না পড়লেও চলবে। আর তাছাড়া… আমার কিছু পার্সোনাল জিনিসও কিনতে হবে।”
জাভিয়ান এবার চোখ তুলে তাকালো। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি ভেসে উঠলো। “পার্সোনাল জিনিস? কী কিনবে? বিকিনি?”
তান্বীর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো —“ছি!এতোটা নির্লজ্জ আপনি। আপনার মুখে কিছুই আটকায় না?”
জাভিয়ান মৃদু হেসে কাঁধ ঝাঁকালো—” আমার কোনো কিছুই আটকায় না।”
তান্বী এবার বিরক্ত মুখে ঘুরে দাঁড়ালো— “আমার এখনই যেতে হবে শপিং-এ।”
জাভিয়ান শান্তভাবে চেয়ারে হেলান দিলো
—“আমি আজ ব্যস্ত। শপিং-এ নিয়ে যেতে পারবো না। তোমাকে আমি লুসিয়ার সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
তান্বী এক ঝটকায় ঘুরে তাকালো—“আপনার ওই বোন? মিস লুচির সাথে আমি যাব না!”
জাভিয়ানের ভ্রু উঁচু হলো—“আস্তে করে বলো।ও যদি শোনে তুমি ওর নামের দফারফা করে দিচ্ছো লুচি বলে ডেকে।”
তান্বী হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে বললো— “তো কী? এখানে একেকজনের যেই নাম! উচ্চারণ করতে করতে আমার জিভ খসে যায়। লুসিয়া আর লুচি—একই তো হলো।”
জাভিয়ান আর কিছু না বলে শান্ত ভঙ্গিতে ওয়ালেট থেকে একটা ঝকঝকে ব্ল্যাক কার্ড বের করে তান্বীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো “নাও,এটা ধরো। যা ইচ্ছে কিনে নিও।”
তান্বী অবাক চোখে কার্ডটা ঘুরিয়ে দেখলো, তারপর ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বললো—“ক্রেডিট কার্ডের পিন নাম্বার কী?”
জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি নিয়ে বললো “6969।”
তান্বী ভ্রু কুঁচকে তাকালো, তারপর বিরক্ত মিশ্রিত বিস্ময়ে বলে উঠলো—“এটা পিন নাকি… পজিশন নাম্বার?”
জাভিয়ান হেসে মাথা একটু কাত করলো “বি পজিটিভ।”
তান্বী বিরক্ত-হতবুদ্ধি সুরে বললো—”কিভাবে পজিটিভ হবো?”
জাভিয়ানের চোখ হঠাৎ গভীর হয়ে উঠলো।
জাভিয়ান: “6969 মানে হচ্ছে আমার জীবনের ট্রমা আর শান্তি। 6 উল্টো করলে 9 হয়। মানে আমি হচ্ছি শান্তি আর আমার জীবনে চলে আসে বিপরীতটা আর সেটা হলো ট্রমা। দুটো একসাথে থেকেও, বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।”
তান্বী চুপ করে শুনলো, তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বললো—“রাইট… অনেকটা আপনার আর আমার মতো। আমরা একসাথে থেকেও একেবারে উল্টো চরিত্র।”
জাভিয়ান এবার চোখ নামিয়ে হালকা গম্ভীর গলায় বললো—“একদম ঠিক ধরেছো। যেমন তুমি আর আমি—পুরোপুরি বিপরীত! তবুও একসাথে থাকতে হয়… একে অপরকে সহ্য করতে হয়।”
.
.
.
.
হাসপাতালের কক্ষ।
সাদা দেয়াল, যন্ত্রের শব্দ, স্যালাইনের ফোঁটা টুপটাপ।
হঠাৎই চোখ খুললো মেইলস্ট্রোম। দুই দিন পর তার বুক আবার শ্বাসে উঠলো-নামলো।
পরের মুহূর্তেই যেন অগ্নি ঝড় বয়ে গেলো। সে বিছানা থেকে উঠে বসে পড়লো, চোখদুটো লাল হয়ে আছে, শিরা ফুঁলে উঠেছে। “ আমার তান্বী…! রিকার্দো… আমি ওকে ছিঁড়ে ফেলবো…!”
নার্সরা দৌড়ে এলো, কিন্তু মেইলস্ট্রোমকে থামানো যেন সমুদ্রের ঢেউ থামানোর চেষ্টার মতোই। তার মা, ইসাবেলা মোরেলাস, তাড়াহুড়ো করে এসে দু’হাত রাখলো তার কাঁধে।
“স্টপ ইট, মেইলস্ট্রোম!” কণ্ঠ দৃঢ়, কিন্তু চোখ কাঁপছে।
“যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তুমি একটা মেয়েকে মাত্র একবার দেখেছো… আর তার জন্য আজ মরতে বসেছিলে?”
মেইলস্ট্রোমের মুখে বিদ্রোহের আগুন। “একবার হলেও ও-ই আমার জীবনের নিঃশ্বাস হয়ে গেছে, মম! ওই রিকার্দোকে আমি এমন নৃশংস মৃ/ত্যু দেবো—যা দেখে সবাই চিরকাল আতঙ্কে ভুগবে।”
ইসাবেলা ঠান্ডা গলায় বললেন,“আমরা প্রায় ওকে ধরে ফেলেছিলাম। একটা ছেলে আমাদের সাহায্যও করেছিলো… কিন্তু রিকার্দো হচ্ছে গভীর জলের মাছ। তাকে ধরতে চাইলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে আমাদের।”
কিন্তু মেইলস্ট্রোম দাঁতে দাঁত খিচিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
হাসপাতালের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে দিলো এক টানে, তার আদেশে তার লোকেরা তার জন্য স্যুট নিয়ে হাজির হলো।
কালো পোশাক—সিগনেচার গিয়ার—পরে নিলো যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে — “এখনই গাড়ি বের করো।”
তার কণ্ঠে ছিলো তলোয়ার-তীক্ষ্ণ সিদ্ধান্ত।
ইসাবেলা শেষবারের মতো বললেন,“তুমি এখনও দুর্বল… দয়া করে থামো!”
মেইলস্ট্রোম তার দিকে না তাকিয়েই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। হাসপাতালের আলোতে তার ছায়া পড়লো দীর্ঘ,অগ্নিময়। যেন ঝড়ের আগে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা।
.
.
.
.
ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় ফারহান হাঁটছিলো অস্থির মনে তার মস্তিষ্কে ভাসছে সেই সংবাদটা। জাভিয়ান চৌধুরী তার বোন তান্বীকে নিয়ে মেক্সিকোতে ফিরে গেছে।
কিন্তু তার মাথা আটকে আছে আরো অন্য একটা খবরে।যা তার ভেতরে বজ্রাঘাতের মতো আঘাত করেছে—“ডুবাইগামী জাহাজ বিস্ফোরণে ডুবে গেছে… পাচার হওয়া অনেক মেয়ের প্রাণ গেছে।” আর সেই জাহাজেই ছিলো ফারহানের বোন, এলিনা।
ফারহানের মাথার ভেতর যেনো শব্দের তুফান শুরু হয়েছে সেটা শোনার পর থেকে তার মুখে একটাই কথা “না… না এটা হতে পারে না… এলিনা…!”
তার হাঁটার গতি থেমে থেমে চলছে। পা কাঁপতে শুরু করেছে একটা পর্যায়। রাস্তায় মানুষ ভিড় করছে, গাড়ির হর্ন বাজছে,কিন্তু তার কানে কিছুই আসছে না।
এক মুহূর্তে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ফারহান মুখ আকাশের দিকে তুললো, তারপর ভেঙে পড়লো কান্নায়।
আঁকশির মতো ব্যথা বুকের ভেতর ছিঁড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে মাথা ঠেকিয়ে দিলো গরম রাস্তার উপর।রাস্তার ধুলো, মানুষের পায়ের শব্দ, হর্ন—সব মিলিয়ে এক অসহায় দৃশ্য। “আমার বোন এলিনা… ওকে আমি বাঁচাতে পারলাম না… আমি ভাই হয়েও পারলাম না…” তার গলা ফেটে যাচ্ছে চিৎকারে, চোখের পানি আর ধুলা একসাথে গড়িয়ে পড়ছে।
ঢাকার ব্যস্ত নগরীর ভিড়ের মাঝেই,এক ভাইয়ের দুনিয়া যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
.
.
.
.
ফারহান ধীর পায়ে হেঁটে এল পুরান ঢাকার সরু গলিপথ পেরিয়ে, সেই পরিচিত মোড় ঘুরতেই সামনে ভেসে উঠলো রেহমান প্রিয়াঙ্গনের বিশাল গেট। তার বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে কেঁপে উঠলো। কতদিন পর সে ফিরে এলো এই বাড়ির সামনে… কিন্তু এবার আর ভেতরে পা রাখার সাহস হলো না।
গেটের ওপাশে, উঠোনে, তার মা বাবাকে দেখা যাচ্ছে।
মা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে, আর বাবা হুইলচেয়ারে বসা। ফারহানের চোখ মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে গেলো। বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠলো, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু।
মনের ভেতরে নিজেকে ফিসফিস করে বললো— “এক বোনকে আমি বাঁচাতে পারিনি… তাকে আমার চোখের সামনে হারিয়েছি। কিন্তু আরেক বোনকে… তান্বীকে আমি আবারও মা-বাবার কোলে ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমার যেন মৃত্যু না হয়। সেই প্রতিজ্ঞা আজ এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই করছি।”
তার দৃষ্টি গেটের ওপাশে স্থির হলো, হাত দুটো মুঠো করে চেপে ধরলো। দিনের আলোয় তার চোখের অশ্রু যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো —এখন আর কেবল ভাই নয়, সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক যোদ্ধা হয়ে উঠলো।
.
.
.
.
ঢাকার রাত। শহরের অন্ধকারে মিশে আছে রাস্তাঘাটের ফ্যাকাশে বাতিগুলো। একটা পুরোনো ভবনের চিলেকোঠায় বসে আছে ফারহান। তার সামনে টেবিলে ছড়ানো কিছু ফাইল, নোটবুক, আর ডলার-বান্ডিল।কোণের ড্রয়ারে লুকানো আছে একাধিক ভুয়া আইডি, আর পাসপোর্ট।
এটাই তার গোপন আশ্রয়।বছরের পর বছর ধরে জমানো টাকাগুলো এখানে লুকিয়ে রেখেছে। কেউ জানে না—তার মা-বাবা পর্যন্তও না।
ফারহানের চোখে এখন একটাই লক্ষ্য—মেক্সিকো।
তার বোন তান্বীকে ফিরিয়ে আনা। যেভাবেই হোক, যেকোনো মূল্যে। তার বোন এখন জাভিয়ানের হাতে বন্দী। ফারহান জানে, শুধু কান্না করে কিছু হবে না।প্রতিপক্ষকে হারাতে হলে নিজের মাটির নিচে যতটুকু শক্তি আছে, সবটুকু জড়ো করতে হবে।
সে আবার কাগজগুলো একে একে গুছিয়ে রাখে। ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার সব দরকারি জিনিসপত্র একসাথে করে নিচ্ছে। হৃদয়ের ভেতর চাপা উত্তেজনা আর ভয় একসাথে ধুকপুক করছে।
তারপর ফারহান ধীরে ধীরে তার কয়েক মাস আগেই কেনা একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির দিকে তাকালো। ছোট্ট, তেমন দামি কিছু নয়—কিন্তু এখন সেটাই তার চলার শক্তি, তার স্বাধীনতার প্রতীক।
সে এক গভীর শ্বাস নিলো। মনে মনে বললো—“অপেক্ষা কর বোন আমার। আমি আসছি। তোকে ফিরিয়ে আনার জন্য…যেখানেই যাস, যতদূরেই যাস।”
.
.
.
.
ভিলা এসপেরেঞ্জার সকালের হাওয়া যেনো আরও প্রাচুর্যের আভিজাত্য ছড়াচ্ছিলো। বৃহৎ সিঁড়ি বেয়ে নামতেই জাভিয়ান সোফায় বসা লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো— “লুসিয়া, তান্বীকে নিয়ে একটু শপিং মলে যা।ওর যা দরকার সব কিনে দিবি। ওর কাছে ব্ল্যাক কার্ড দিয়ে দিয়েছি যতো ইচ্ছা ব্যবহার করবে।”
কথাটা শুনেই লুসিয়ার ঠোঁটে টান পড়ল, হাসির মতো দেখালেও ভেতরে ভেতরে বিরক্তি ঢেকে রাখা যাচ্ছিল না। সে চোখ নামিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল, —“ ভাইয়া তুমি কি নিশ্চিত? আমাকে… ওর সাথে যেতে বলছো?”
জাভিয়ানের চোখে একচুল নড়াচড়াও নেই।
দৃঢ় অথচ নিঃশব্দ শাসন ভরা কণ্ঠে সে জবাব দিল,—“হ্যাঁ। আমার অনুপস্থিতিতে ওর সব দেখাশোনা করবি তুই। কোনো আপত্তি শুনতে চাইনা আমি।”
কথাটা যেন হুকুমের মতো শোনাল।লুসিয়া দাঁত চেপে হাসল, ঠোঁটে আনল ভদ্রতার মুখোশ, কিন্তু অন্তরে তীব্র আগুন জ্বলছিল। বাংলাদেশী মানুষের প্রতি তার বরাবরের অবজ্ঞা, আর আজ সেই মেয়েকেই ভাবি স্বীকার করতে হবে! মন থেকে মানতে না পারলেও জাভিয়ানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তার নেই। —“ঠিক আছে,” ঠাণ্ডা স্বরে বলল সে।
তবে তান্বীর দিকে একঝলক তাকাতেই চোখে জ্বলে উঠল বিদ্বেষের অদৃশ্য ঝিলিক।তান্বী হয়তো কিছুটা টের পেল, কিন্তু লুসিয়ার ভেতরে প্রতিটি মুহূর্তে কাঁটার মতো বিঁধছিল এ সত্য—জাভিয়ানের সবকিছু দখল করে নিচ্ছে একজন বাংলাদেশী মেয়ে।
.
.
.
.
সকালের রোদটা ঝলমল করছিল কাচের জানালা ভেদ করে। জাভিয়ান আজকে অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। স্যুট পরতে পরতে আয়নার সামনে একবার তাকাল, যেন নিজেকেই প্রস্তুত করছিল নতুন এক যাত্রার জন্য।
আজকের দিনটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ—কারণ বহুদিনের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। সে নিজস্ব একটি কোম্পানি খুলবে, আর সেই কোম্পানির ব্যবসা হবে পারফিউমের সাম্রাজ্য। শুধু বোতল নয়, বিল্ডিং থেকে শুরু করে শোরুম, কারখানা, এমনকি রাস্তা পর্যন্ত—সবকিছুর নকশা দেখতে হবে আজ।
জাভিয়ান রায়হানের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
—“রায়হান, সব কাগজপত্র ঠিক আছে তো?”
রায়হান,সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল,—“জি স্যার, সব রেডি। আজকে তিনটা প্রজেক্ট ভিজিট আছে। প্রথমে পারফিউম টাওয়ারের লোকেশন, তারপর কারখানার জন্য জমি, আর শেষে অফিস বিল্ডিং। গাড়ি তৈরি আপনার।”
এরপর দু’জনেই বেরিয়ে পড়ল। কালো গাড়ির জানালা দিয়ে শহরের ভিড় দেখতে দেখতে জাভিয়ানের চোখে ভেসে উঠল এক নতুন সাম্রাজ্যের স্বপ্ন। তার ভেতরে জ্বলছিলো এক অন্য রকম আগুন—সে শুধু একটা কোম্পানি নয়, এক ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাইছে, যেটা একদিন তার নামের মতোই প্রভাবশালী হবে।
.
.
.
.
মেক্সিকো সিটি!
এক অভিজাত আন্ডারগ্রাউন্ড ক্লাবে,আলো ঝলমলে ডান্সফ্লোর আর দামি মদের গন্ধে ভারী বাতাস। তবু কোথাও লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য শীতল আতঙ্ক।
ক্লাবের ভিআইপি সেকশনটা—অর্ধেক অন্ধকার, আর লাল-কালো আলোতে ডুবে আছে। সেখানেই বসে আছে নাইট রেভেন (Night raven) —কালো স্যুটে পড়া মুখটা আংশিক ছায়ায় আড়াল করা আর চোখে ঠান্ডা শিকারীর দৃষ্টি।
তার সামনেই হাঁটু গেড়ে পড়ে আছে এক কাঁপতে থাকা ছেলে—যে ভুল করে তার কাজের পথে দাঁড়িয়েছিল। তার কিছু ইনফরমেশন লিক করতে চেয়েছিলো। চারপাশের লোকেরা মাথা নিচু করে আছে কেউই সাহস করে তার চোখে তাকায় না।
একজন লোক ধীরে বলে উঠলো —“বস… কী করা হবে এর সাথে? গুলি করে শেষ করে দিই?”
নাইট রেভেন ঠোঁটে আনল ঠান্ডা হাসি।
কণ্ঠে তা্য শীতলতা—“মৃত্যু? হাহ… এত সহজ শাস্তি? আমার শহরে ওটা প্রিভিলেজ।”
সে এক আঙুল নাড়লো। সাথে সাথেই দরজা খুলে ঢুকলো পাঁচ-ছয়জন লোক—সবাই অদ্ভুত সাজে সজ্জিত,তাদের ভারী শরীর, চোখে কামুক হিংস্র ঝিলিক। তাদের হাতে লোহার চেইন, লাঠি, চাবুক। বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে গেল।
ফিসফিসানি উঠলো আশেপাশে—তারা পরিচিত শহরে “গে গ্যাং” নামে। যেখানে শাস্তি মানেই শুধু প্রহার নয়, আরো ভয়ঙ্কর, অপমানজনক যন্ত্রণা।
নাইট রেভেনের চোখে ঠান্ডা আগুন জ্বললো।
সে ফিসফিস করে বলল——“Fu/ck him until the death” ও যেন জীবিত থেকেও মৃত্যুর স্বাদ পায়।”
ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে কান্না শুরু করল—
—“না… না… প্লিজ… আমাকে মেরে ফেলুন তবুও এই শাস্তি দিবেন না আমাকে ক্ষমা করে দিন…”
কিন্তু কেউ পাত্তা দিল না। গে গ্যাং এগিয়ে গেলো তার দিকে, তাদের মুখে বিকৃত হাসি।
শেষবারের মতো নাইট রেভেন ছেলেটার দিকে তাকালো,চোখে কোনো দয়া নেই, শুধু বরফশীতল নিষ্ঠুরতা—“Take him away… break him… burn him in his own screams.I don’t care if it takes all night—make him beg for death.”
ছেলেটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো অন্ধকার কক্ষে। তার অসহায় চিৎকার থেমে গেল ভারী দরজা বন্ধ হতেই।
বাইরে আবার বাজতে শুরু করল ঠান্ডা জ্যাজ।
ডান্সফ্লোরের কেউই বুঝলো না—পরদার আড়ালে মেক্সিকোর গডফাদার নাইট রেভেন কেমন ভয়ঙ্কর নিয়মে শাসন করে এই শহরকে।
.
.
.
.
কালো লিমোজিনটা নরম শব্দে এসে থামল মেক্সিকো সিটির সবচেয়ে বিলাসবহুল শপিং মলের সামনে। ভবনটা যেন এক আধুনিক প্রাসাদ—স্বচ্ছ কাচে মোড়া বহুতল, সোনালি ফ্রেমে ঝিকিমিকি করা দেয়াল, চারপাশে রোদের ঝলমলে আলোয় ভরে উঠেছে। প্রবেশপথে লাল কার্পেট বিছানো, দু’পাশে সুবিশাল ফুলের টব, নিরাপত্তারক্ষীরা টানটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথমেই দরজা খুলে নামল লুসিয়া। তার লাল হাই হিলের টকটক শব্দ মেঝেতে প্রতিধ্বনিত হলো। কালো ডিজাইনার ব্যাগ হাতে, নিখুঁত আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মুখভঙ্গি—চারপাশের দৃষ্টি যেন আগেই চেনে তাকে। ধনী পরিবারের সেই পরিচিত দৃশ্য।
তারপর ধীরে নামল তান্বী। লিমোজিন থেকে পা রাখতেই নিঃশ্বাস আটকে গেল তার। চোখ বিস্ফারিত হয়ে চারদিকে তাকাল। কাচের বিশাল দরজা, মাথার উপর ঝুলে থাকা স্ফটিকের ঝাড়বাতি, প্রতিটি ফ্লোরে আলোকোজ্জ্বল সাইনবোর্ড—Gucci, Prada, Dior, Chanel—সব মিলিয়ে যেন এক রূপকথার ভুবন।
তান্বীর ঠোঁট হালকা ফাঁক হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে রইল একেবারে মুগ্ধ হয়ে, চোখে শিশুসুলভ বিস্ময়। কানে ভেসে আসছে নরম সুরের মিউজিক, বাতাসে ভেসে আসছে দামি সুগন্ধির মাদকতা। মনে হলো যেন কোনো শপিং মল নয়, স্বপ্নের কোনো রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।
লুসিয়া একপাশে তাকিয়ে ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি টেনে বলল—“কি হলো? প্রথমবার দেখছো নাকি?”
তান্বী চমকে উঠে তার দিকে তাকাল, তারপর বিব্রত হেসে মাথা নাড়ল। কিন্তু চোখের ভেতরের ঝলক—তার মুগ্ধতা—লুকোনোর কোনো উপায় নেই। আর তখনি তাদের গাড়ির পেছন দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল কালো SUV-এর কনভয়।
সামনের গাড়ির ভেতর বসেছিল শহরের আতঙ্ক—মাফিয়া কিং মেইলস্ট্রোম। জানালার কাচ অর্ধেক নামানো, আঙুলে ধরা সিগারেট থেকে ধোঁয়া পাক খেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারিদিকে।
হঠাৎই তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।সামনের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণী…
তান্বী।
মলের প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছিল সে। নিঃশব্দে যেন সময় থমকে গেল মেইলস্ট্রোমের দেহ জমে গেল, হাতে ধরা সিগারেট প্রায় ফসকে পড়ে যাচ্ছিল। ঠোঁট ফাঁক হয়ে এলোমেলো স্বরে বেরিয়ে এলো— “অসম্ভব…”
সে তো জানত, সমুদ্রের জাহাজ বিস্ফোরণে তান্বী মারা গেছে। সে নিজেই ছিলো সেখানে। তাহলে এখন যে অবয়বটা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে—ও কে? আমার হ্যালুসিনেশন? নাকি সত্যিই তান্বী জীবিত?
SUV এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মেইলস্ট্রোমের চোখ আটকে রইল জানালার ফাঁক দিয়ে। বুকের ভেতর অস্থিরতা দপদপ করতে লাগল। অবশেষে কর্কশ গলায় আদেশ দিল—“Stop the car!”
হঠাৎ ব্রেক কষে থেমে গেল কনভয়। মেইলস্ট্রোম দরজা ঠেলে নেমে দাঁড়াল। নিঃশ্বাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। তার চোখ এখনো গেঁথে আছে সেই প্রবেশপথে।
কিন্তু ততক্ষণে তান্বী ভেতরে প্রবেশ করছে, পাশে লুসিয়া।
কাঁচের স্বয়ংক্রিয় দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। ভিড়ের ভেতরে মিলিয়ে গেল তার অবয়ব।
মেইলস্ট্রোম স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল। সারা শরীরে বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠল প্রশ্নটা— “যদি ও-ই তান্বী হয়… তবে ও কিভাবে বেঁচে গেলো আর যদি বেঁচেও থাকে তবে ও মেক্সিকোতে কি করছে?”
রাস্তার হট্টগোলের মাঝেও সে দাঁড়িয়ে রইল নিরব, যেন হঠাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্য আবার তার সামনে ফিরে এসেছে।
.
.
.
.
মেইলস্ট্রোমের চোখ কালো সানগ্লাসে ঢাকা,দাঁতে দাঁত চেপে সে মোবাইল কানে ধরল।—“একটা লোকেশন সেন্ড করছি এক্ষুনি … পুরো মলটাকে ঘিরে ফেলতে হবে।”
তার কণ্ঠে এমন এক শীতল হুকুম, যেটা অমান্য করার সাহস কারও নেই।
এদিকে মলের ভেতরে লুসিয়ার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল তার বয়ফ্রেন্ডের নাম।—“হে বেবি, আজকে তো তোমার সেই নিউ মিউজিক রেকর্ড হবে, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি চলে আসো।”
লুসিয়ার ঠোঁটে একরকম তৃপ্তির হাসি ফুটল।সে তান্বীর দিকে না তাকিয়েই, যেন কিছুই ঘটেনি এমন ভঙ্গিতে, হাই হিলের ঠকঠক শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল মল থেকে।
তান্বী হতভম্ব।পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখল— লুসিয়া নেই। —“লুচি আপু…?”
কিন্তু কোনো জবাব নেই।
সে ব্যাকুল হয়ে ভিড়ের ভেতর খুঁজতে লাগল। ব্র্যান্ডেড স্টোরের ঝলমলে আলো, ক্রেতাদের ভিড়ের মাঝে তার নিশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠল। ঠিক তখনই—
ঠাস! ঠাস! ঠাস!হঠাৎ ভেসে উঠল গুলির শব্দ। কাচ ভাঙার বিকট আওয়াজে মলের পুরো ফ্লোর কেঁপে উঠল। চারদিক চিৎকারে ভরে গেল। মানুষ দৌড়াচ্ছে, ছুটছে, হুড়োহুড়িতে কেউ পড়ে যাচ্ছে।
তান্বী ভয়ে একদম থমকে গেল।“হঠাৎ কী হলো?”
মেইলস্ট্রোমের লোকেরা ঢুকে পড়েছে। কালো পোশাক, ভারী অস্ত্র হাতে, যেভাবে টার্গেট করে ঢুকেছে—সেটা সাধারণ ডাকাতির মতো মনে হচ্ছিল না। তারা কারও দিকে তাকাচ্ছে না, যেন কাউকে বিশেষভাবে খুঁজছে।
মেইলস্ট্রোম নিজেও ভেতরে ঢুকল। তার পা থেমে আছে, চোখ শুধু একদিকে। সে জানে কাকে খুঁজছে।
কিন্তু তান্বীর কাছে সেটা কেবলই এক আতঙ্কের দৃশ্য।
তার বুক কেঁপে উঠছে, চোখ ভিজে উঠছে অঝোর কান্নায়।
ঠিক তখনই একজন স্টাফ তার হাত টেনে ধরল। —“এদিকে আসুন ম্যাম, দ্রুত!”
তাকে টেনে নিয়ে গেল একটি ট্রায়াল রুমের ভেতরে।
দরজা লাগানো হলো। ভেতরে ইতিমধ্যেই কয়েকজন মানুষ গুটিসুটি মেরে বসে আছে। কেউ নিশ্বাসও নিচ্ছে না যেন।
তান্বী কেঁপে কেঁপে দাঁড়িয়ে আছে, বুকের ভেতর ধকধকানি থামছে না। তার মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন—“কেন… হঠাৎ এই হামলা? কারা এরা?”
বাইরে, মেইলস্ট্রোমের কণ্ঠ গর্জে উঠল—“আমি তাকে দেখতে পেয়েছি। এই মলের সামনেই দেখতে পেয়েছি। ও এখানেই আছে ওকে খুঁজে বের করো… আজ আমি ওকে খুঁজে না পেলে এই মলটা আগুনে পুড়িয়ে দেব।”
তান্বী শব্দটা শুনতে পেল, কিন্তু বুঝলো না। ভাবলো— এটা হয়তো কোনো বড় ব্যবসায়ীর বা মলের মালিকের বিরুদ্ধে হামলা।কিন্তু সে তো জানেইনা— আসলে এই রক্তাক্ত তাণ্ডব, সবই তার জন্যই।
.
.
.
.
দুপুরের সোনালি আলো যখন শহরের আকাশ ছুঁয়ে বিকেলে পরিনত হচ্ছে, তখনও ভিলা এস্পেরেন্জার ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে।
জাভিয়ান বাড়িতে ফিরে, সোজা নিজের কক্ষে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। তার রুমটা নিঃশব্দ, অথচ কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই।সে ঘুরে ঘুরে তাকাল, চোখ খুঁজতে লাগল—কিন্তু তান্বী নেই।
মুহূর্তেই কপালে ভাঁজ পড়ল।গলা ভারি করে ডেকে উঠল,—“এই মেয়ে তান্বী কোথায় তুমি…?”
কিন্তু কোনো সাড়া নেই। সে ড্রইংরুমে গেল, গ্যালারির প্রতিটি কোণায় খুঁজল,এমনকি বাড়ির বিশাল বাগানের দিকেও খোঁজ করলো। কিন্তু কোথাও তান্বীর নাম-গন্ধ নেই। আর নিজের মনেই ফিসফিস করে বললো— “Where did my trauma go?” তারপর সে চোখে রাগের ঝিলিক নিয়ে ফোনটা বের করল।প্রথমেই ডায়াল করল লুসিয়ার নাম্বার। রিং বাজছে, বাজতেই থাকছে…কিন্তু কেউ ফোন ধরল না।
জাভিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।—“Damn it!”
অপেক্ষা না করেই সে আবার ফোন দিল—এইবার রায়হানকে। কল রিসিভ হতেই ঝড়ের মতো গর্জে উঠল,
—“রায়হান! আমার অপদার্থ বউটা এখনো শপিং মল থেকে ফেরেনি। দেখো তো ব্যাপারটা।”
ওপাশ থেকে ভেসে এল শান্ত অথচ সতর্ক কণ্ঠ,—“কি বলছেন স্যার… মিস গজদন্তনী এখনো ফেরেনি। ঠিক আছে আমি খোঁজ নিচ্ছি।”
জাভিয়ানের চোখে রাগ জমে উঠল।—“লুসিয়াও ফোন ধরছে না। তুমি এখনই বের করো তারা কোন শপিং মলে গেছে। ইমিডিয়েট।”
রায়হানের স্বর কেঁপে উঠল,—“Yes, sir!”
কল কেটে দিয়ে জাভিয়ান কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল।
তার আঙুল মুঠো হয়ে শক্ত হলো, চোখে নামল অস্থিরতার ছায়া।রাগ, অধৈর্য আর ভেতরের অদ্ভুত এক শঙ্কা মিলে যেন এক ঝড় বইতে লাগল তার ভেতরে। বিকেলের আলো ততক্ষনে নিভে গিয়ে আকাশকে অন্ধকারে ঢেকে দিবে।
.
.
.
.
বিকেলের শেষ আলোয় বাড়ির ভেতর এক অস্থির নীরবতা। জাভিয়ান বারবার করিডরে পায়চারী করছে। ফোন বেজে উঠতেই তাড়াতাড়ি রিসিভ করে নিলো। ওপাশ থেকে সংবাদ এলো—“স্যার, লুসিয়া মিস গজদন্তনীকে নিয়ে গ্র্যান্ড রয়্যাল মলে গিয়েছে। আর ওখানে নাকি মেইলস্ট্রোমের লোকের হামলা চলছে।”
জাভিয়ান এক মুহূর্ত নীরব রইলো, তারপর গর্জে উঠলো—“হোয়াট,আমি ইমিডিয়েট বের হচ্ছি।”
দশ মিনিটের মধ্যেই ভিলা এস্পেরেন্জার আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এলো Lamborghini Urus Performante—গাঢ় কালো রঙ, আগ্নেয়গিরির মতো গর্জন তোলা ইঞ্জিন, বুলেটপ্রুফ গ্লাস আর আল্ট্রা-মডিফায়েড সিকিউরিটি সিস্টেম।
ড্রাইভার নেই। স্টিয়ারিংয়ে নিজেই বসেছে জাভিয়ান।
কালো গ্লাভস পরা হাতে গিয়ার চেপে ধরতেই গাড়ি গর্জন করে ঝাঁকিয়ে উঠলো। গাড়ির ইন্টেরিয়রে নীল আলো ঝলকাচ্ছে, আর ড্যাশবোর্ডে ফোন স্ক্রিন বারবার জ্বলে উঠছে।
জাভিয়ান একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরাচ্ছে, অন্যহাতে ওটা-টু ডিভাইস নিয়ে কল দিচ্ছে একের পর এক।তার চোখে ঝলসে উঠছে অস্থিরতা, ঠোঁটে গর্জন— “Truma… তুমি আসলেই একটা troublemaker যেখানেই যাও বিপদ আপনাআপনি চলে আসে।”
Urus তখন বজ্রের মতো ছুটছে সরাসরি গ্র্যান্ড রয়্যাল মলের দিকে…
.
.
.
.
মলের হামলার তাণ্ডব থেমে এসেছে কিছুক্ষণ আগে।
দোকানপাট এলোমেলো—কাঁচ ভাঙা, ম্যানিকুইন গুঁড়িয়ে পড়ে আছে, মেঝেতে ছড়ানো রক্ত আর ছুটে পালানো মানুষের জিনিসপত্র। বড় বড় শাটার টেনে পালিয়েছে সবাই, আহতদের কেউ কেউ করিডোরে কাতরাচ্ছে।
প্রেস আর মিডিয়ার ক্যামেরা ঝড়ের মতোই সেখানে পোঁছে গেছে। সরাসরি সম্প্রচারের উদ্দেশ্য তারা রেডি কিন্তু মেইলস্ট্রোমের লোকেদের কারনে তারা বাইরে থেকে নিউজ করে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই— ইসাবেলা মোরেলাস তাড়াহুড়ো করে এসে হাজির হয় শপিং মলে। তার মুখ কঠিন, ভ্রু কুঁচকানো। সে বুঝে গেছে—যদি এই ঘটনা ক্যামেরায় মেইলস্ট্রোমের ওপর ধরা পড়ে,তবে শেষ। গোটা সাম্রাজ্যের নাম ধুলোয় মিশে যাবে।
মলের ভেতর তখন অন্ধকারের মতো বিশৃঙ্খল। মেইলস্ট্রোম চারদিকে নিজের লোক ছড়িয়ে রেখেছে। প্রতিটি করিডোর, প্রতিটি শপের সামনে তাদের অস্ত্রধারী গার্ড দাঁড়িয়ে। মেয়েদের ট্রায়াল রুম —এখনও অক্ষত, এখনো সেখানে কেউ প্রবেশ করেনি।
.
.
.
.
গ্র্যান্ড রয়্যাল মল তখনও বিশৃঙ্খলায় ভরা। গুলির শব্দ, ভীত মানুষের চিৎকার —সব মিলিয়ে যেন যুদ্ধক্ষেত্র।
এমন সময় কালো urus মলের গেটের সামনে থামল।
দরজা খুলে নেমে এলো জাভিয়ান। কালো স্যুটে তার উপস্থিতিই যেন চারপাশে হিম শীতলতা ছড়িয়ে দিল।
মলের ভেতরে ঢুকতেই ভিড়ের মধ্যেই চোখ আটকে গেল—ইসাবেলা মোরেলাসের দিকে।
তার চোখের সঙ্গে চোখ মিলল জাভিয়ানের। মুহূর্তটা যেন স্থির হয়ে গেল, চারপাশের চিৎকার নিস্তব্ধ হয়ে এলো।কিন্তু হঠাৎই ইসাবেলা তড়িঘড়ি করে মেইলস্ট্রোমের হাত টেনে ধরে তাকে ভিড়ের ভেতরে নিয়ে চলে যেতে লাগল।
জাভিয়ান ঠায় তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। চোখে ঝড় বয়ে গেল —অবিশ্বাস, আর অদ্ভুত এক অস্থিরতা।কিছুক্ষণ পর সে যেন নিজেকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করল,—“No… এখন তান্বীকে খুঁজে বের করাই আমার প্রথম কাজ।”
সে মোবাইল বের করে দ্রুত তান্বীর ছবি স্ক্রিনে তুলে নিল। কাছেই দাঁড়ানো এক মলের স্টাফকে ছবিটা দেখিয়ে গর্জে উঠল, —“Have you seen her?”
স্টাফ কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়ল—“জি…উনিতো ট্রায়াল রুমের দিকে গেছে। সেখানেই অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।”
শুনেই জাভিয়ানের চোখে দপ করে জ্বলে উঠল আগুন।
সে সোজা ট্রায়াল রুমের দিকে এগিয়ে গেল— তার পদক্ষেপে যেন মাটি কেঁপে উঠছে।
জাভিয়ান ট্রায়াল রুমে প্রবেশ করলো। আধুনিক লাইটিং, মিরর, আর মার্বেল ফ্লোর—সবকিছু এতই স্বচ্ছ, যে প্রতিটি পদক্ষেপে রিফ্লেকশনে যেন তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে।
তান্বী, যে আতঙ্কে জড়সড় হয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলো।হঠাৎ করে থেমে গেলো সবকিছু। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো, চোখের সামনে জাভিয়ানকে দেখতেই, আর এক মুহূর্তেই —কোনো কিছু না ভেবেই সে জাভিয়ানের দিকে ছুটে গেল। জাভিয়ানকে দেখতেই তার সব ভয় আর আতঙ্ক যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। অবচেতনভাবে, প্রাণের জোরে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল— তার পুরো শরীর জাভিয়ানের বিস্তৃত বুকের দিকে নেমে এলো। তার বাহু অবলম্বন খুঁজে পেল জাভিয়ানের ঘাড়ে, শক্ত করে জাপ্টে ধরল।
জাভিয়ান, যে এতদিন মানুষের কাছে সর্বদা শক্তিশালী, মেয়েদের কাছে অনড় আর সংযত ছিলো, এই প্রথম মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার চোখে বিস্ময়, গলার স্বর স্তব্ধ, আর হৃৎপিণ্ড একটু দ্রুত বেজে উঠলো এই অপ্রত্যাশিত মুহূর্তের জন্য।
এই প্রথম কোনো নারী তাকে এমনভাবে জাপ্টে ধরেছে—যা কেবল শারীরিক নয়, বরং অনুভূতির গভীরতায়। জাভিয়ান বুঝতে পারলো, তান্বীর এই আচরণে তার নিজের কঠিন, নিয়ন্ত্রিত হৃদয়ও নড়ে উঠেছে।
তান্বী, শ্বাস নিতেই ধীর, কিন্তু শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বললো— “আপনি অবশেষে এসেছেন, আমিতো ভয় পেয়েই গিয়েছিলাম ।”
জাভিয়ান এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে তান্বীর কাঁধে হাত রাখলো শক্ত করে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোমলভাবে।
(চলবে………)
নোটিশ: এখন থেকে ডিজায়ার আনলিশড গল্পটা সপ্তাহে তিনদিন দেয়া হবে পর্ব (শুক্রবার, শনিবার, রবিবার) তবে আজকে যেহেতু পর্ব দিয়েছি তাই পরবর্তী পর্ব শনিবার পাবেন ধন্যবাদ 🥰
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৯
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৯
-
ডিজায়ার আনলিশড গল্পের লিংক