১০.
Dark_Desire
ডার্ক_ডিজায়ার
দূর্বা_এহসান
বাইরে ভোর হয়ে এসেছে। বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার। পাতার ফাঁকে ফোঁটা ফোঁটা রোদ ঝরে পড়ছে। ঘরের জানালায় আলো এসে পড়েছে তরুর মুখে।মৃন্ময় চুপচাপ বসে আছে চেয়ারে। সারারাত ঘুমায়নি। হাতে এক কাপ কফি, কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেক আগেই। চোখ তার শুধু তরুর উপর।
তরু ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চারপাশ কিছুক্ষণ অচেনা লাগল। তারপর বুঝল সে কোথায় আছে। মুখ ফিরিয়ে দেখল মৃন্ময়।
চোখে এখনো ক্লান্তি। জ্বর পুরোপুরি যায়নি এখনও।
তরু কিছু বলতে চাইল, কিন্তু চুপ করে রইল।তাকিয়ে থাকল মৃন্ময়ের দিকে। এই মানুষটাকে ঘৃণা করার কথা, অথচ সেই ঘৃণার ভেতরেও একটা অজানা টান কাজ করছে।
মৃন্ময় ধীরে উঠে জানালার পাশে গেল। বলল,
“তুমি যদি ভাবো আমি বদলে গেছি, ভুল ভাবছো। আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি, পাখি।”
তরু চোখ বন্ধ করে ফেলল। “ভালোবাসা?” ঠোঁট কেঁপে উঠল।
মৃন্ময় ফিরে তাকাল। তরু হেসে ফেলল তিক্তভাবে।কিছুক্ষণ চুপ। ঘরের ভেতর শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ হচ্ছে।
মৃন্ময় ধীরে তরুর পাশে এসে বসলো।কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলো। জ্বর ছাড়ার পর অতিরিক্ত ঘেমে গেছিল তরু।তারপর আবার ও জ্বর এসেছে।একটু পরেই তরুর নিঃশ্বাস বদলে গেল। মুখটা কুঁচকে উঠল যন্ত্রণায়।তরু দুই হাতে পেট চেপে ধরলো। মৃন্ময় চমকে তাকাল।
“কি হয়েছে? পেটে ব্যথা করছে?”
কণ্ঠে আতঙ্ক।তরু মাথা নাড়ল, কণ্ঠ কাঁপছে,
“না”
বলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। যেন লজ্জা মেশানো কষ্টে শরীরটা গুটিয়ে ফেলতে চাইলো। মুখটা কেমন সাদা হয়ে গেছে।নিঃশ্বাস ভারী।মৃন্ময় তাড়াতাড়ি ওর পাশে বসে পড়ল,
“জ্বর বেড়ে গেল নাকি?”
তরু ঠোঁট কামড়াল, মাথা নাড়ল ধীরে,
“না… মানে… কিছু না…”
কথাগুলো প্রায় শোনা গেলো না,এতটাই আস্তে বললো। গলার স্বর ভাঙা, চোখে কষ্টের ছাপ।মৃন্ময় হাত রাখল কপালে। তাপ স্বাভাবিক।তবু তরুর মুখে যন্ত্রণার রেখা গভীর হচ্ছে প্রতি মিনিটে।
“ডাক্তার ডাকি?”
তরু চোখ বন্ধ করল, নিঃশব্দে মাথা নাড়ল না বোঝাতে।তার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত, শরীরটাও কেমন শক্ত হয়ে গেছে যন্ত্রণায়.মৃন্ময় অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল। কিছু বুঝতে পারছে না।তরু কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু লজ্জায় থেমে গেলো।মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হাতগুলো আরও শক্ত করে পেটের কাছে চেপে ধরলো।মৃন্ময় অবশেষে উঠে গেল। পানির গ্লাস এনে ধরল হাতে।
“একটু পানি খাও, তারপর আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। কিছু একটা তো হয়েছে।”
তরু মাথা নাড়ল.চোখ নামিয়ে বলল খুব আস্তে,
“না, দরকার নেই।সব ঠিক আছে।”
দু’হাতের মধ্যে তরুর কাঁপতে থাকা আঙুলগুলো নিল নিজের হাতে।ভেতরে ভেতরে উদ্বেগে জ্বলছে সে।তবু কিছু না বুঝে শুধু তাকিয়ে থাকে তরুর মুখের দিকে।ওর নরম নিঃশ্বাস, ঠোঁটের কাঁপুনি, আর চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু ,সবই যেন তাকে বলছে, কিছু একটা হয়েছে।বাইরে তখন আবার হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে।তরু মুখ ঘুরিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে।
ভেতরের ব্যথা সামলে নিতে চেষ্টা করলো।
তরু আবার পেট চেপে ধরল। এবার আগের চেয়ে জোরে।
মুখে যন্ত্রণার ছাপ এমন যে। মৃন্ময়ের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল।
“পাখি!”
সে তীব্র কণ্ঠে ডেকে উঠল। প্রায় চিৎকার করে।তরু কোনো উত্তর দিল না।নিঃশ্বাস টানছে ছোট ছোট করে, কপালে ঘাম।
মৃন্ময় উঠে পড়ল, বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তরুর মুখের দিকে তাকাল।
“কিছু বলছ না কেন?ব্যথা?”
কণ্ঠে আতঙ্ক আর রাগ একসঙ্গে মিশে গেছে ।রাগটা নিজের উপর, কিছুই বুঝতে না পারার অসহায়তায়।তরু কষ্টে চোখ খুলে তাকাল। ফ্যাকাশে মুখ। ঠোঁট সাদা হয়ে গেছে।মৃন্ময় তাড়াহুড়ো করে তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিল।তারপর ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে বলল,
“ডাক্তার ডাকছি, এক্ষুনি!”
“না… না, দরকার নেই…”
হাত তুলে থামাতে চাইল, কিন্তু সেই হাতটাও কাঁপছে।
“দরকার নেই মানে?”
মৃন্ময় রাগে চিৎকার করে উঠল।কিন্তু পরের মুহূর্তেই নিজের গলাটা থেমে গেল।ওর চোখ ভিজে উঠেছে।
সে তরুর কাঁধ ধরে নাড়িয়ে বলল,
“বলো পাখি কি হয়েছে?আমি জানি না কি করব এখন।
একবার চোখ খুলে ঠিকঠাক কথা বলো। আমি ভয় পাচ্ছি!”
তরু কষ্টে একটুখানি হাসল। খুবই ক্ষীণ, যন্ত্রণায় ভরা।
“আপনি ভয় পাচ্ছেন?”
মৃন্ময়ের গলা ভাঙল,
“হ্যাঁ, তোমার কষ্ট হচ্ছে আর আমি কিছু করতে পারছি না”
তরু কিছু বলল না, শুধু মুখটা ঘুরিয়ে নিল।।কিন্তু মৃন্ময় তখনও স্থির হতে পারছে না।ওর হাত কাঁপছে, বুক ধকধক করছে।
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, পাখি।বল কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে।ঘরের ভেতর মৃদু আলো, আর তরুর মৃদু নিঃশ্বাস ।সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত নীরবতা।মৃন্ময় ঘুরে আবার বিছানার পাশে এসে বসে পড়ল।চোখে অস্থিরতা, তবু হাতটা আলতো করে রাখল তরুর কপালে।তরু চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে শ্বাস নিল।বাইরে বাজ পড়ল হালকা। সেই আলোয় দেখা গেল,মৃন্ময়ের মুখে উদ্বেগ, ভালোবাসা, আর অসহায় এক ভয় একসঙ্গে মিশে আছে।
মৃন্ময় আর স্থির থাকতে পারলো না।তরুকে কোলে তোলার উদ্দেশ্যে এক টানে গায়ে থাকা কাথা সরিয়ে ফেললো।মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল সে। তরু চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলেছে। মৃন্ময়ের ইচ্ছে হলো ঠাটিয়ে তরুকে একটা থাপ্পর মারতে।
“পিরিয়ড!এটা বলতে পারছিলি না তুই?”
নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রেখে বলার চেষ্টা করলো।কিন্তু রাগ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ হতে চাচ্ছে না।তাকে এতক্ষন কেন বললো না? তাকে বলতে চায়না?নিজেকে শান্ত করলো।
তরুর মুখে হাত রাখল আলতো করে।
“পাখি।উঠে বসো একটু। ভয় পেও না, আমি আছি।”
তরু চোখ খুলে তাকাল। ক্লান্ত, দুর্বল, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা লজ্জার ছায়া।
“আমি,,,, আমি সামলে নেব”
বলল ধীরে।মৃন্ময় মাথা নাড়ল, কণ্ঠটা শান্ত।
“না। আজ তুমি কিছু করবে না। শুধু বিশ্রাম নাও।”
সে পর্দা টেনে দিল, আলো কমে গেল ঘরে।
তরুকে আলগোছে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে গেল।ভিতরে যেতে চাইলো।তরুর দাঁড়ানোর শক্তি টুকুও নেই।কিন্তু তরু ঢুকতে দিল না।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন মৃন্ময়। তারপর বিছানার কাছে চলে গেলো। বেড সিট টা এক টানে তুলে ফেললো।রুমের এক কোনায় রেখে আলমারি থেকে দ্রুত নতুন বেড সিট এনে বিছিয়ে দিল।
রান্নাঘরে গিয়ে পানি বসালো চুলোয়।চুলার আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে রুমে চলে এলো।তোয়ালে, পরিষ্কার কাপড় সব এনে রাখল বেড সাইড এ।সব কাজ এত দ্রুত করলো।
কিছুক্ষণ পর তরু ওয়াশরুমের দরজার খুলল। মুখে এখনও ফ্যাকাশে ভাব। শব্দ শুনে তরুকে গিয়ে কোলে তুলে নিলো।এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো।শুয়ে পড়তেই মৃন্ময় তার কপালে ঠান্ডা তোয়ালে রাখল।
তারপর ধীরে আলতো হতে মুছে দিলো মুখে থাকা পানি টুকু।তরু কিছু বলতে গেল, কিন্তু পারল না। গলায় দলা বেঁধে আছে কিছু অপ্রকাশিত কথা।এই মানুষটাকে সে ঘৃণা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এমন যত্নের ভেতর ঘৃণাটা বারবার ভেঙে পড়ছে।
মৃন্ময় চুপচাপ কম্বলটা টেনে দিল তার গলায় পর্যন্ত।
বাইরে তখন রোদ উঠছে। ভেজা পাতায় আলো ঝিলমিল করছে।তরু চোখ বুজল।
মৃন্ময় পানি আনার উদ্দেশ্য রুম ছাড়ল।তরুর ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল।
—————
খান ভিলার ভেতরে এখন যেন তাণ্ডব চলছে।মেঝেতে ভাঙা গ্লাস, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুশন, দেয়ালে পড়ে থাকা ফুলদানি।সব মিলিয়ে যেন যুদ্ধক্ষেত্র।রজনী দাঁড়িয়ে আছে হলরুমের মাঝখানে। চুল এলোমেলো। চোখ লাল, ঠোঁট কাঁপছে রাগে।
“ওই মেয়েটাকে নিয়ে গেছে! আবার সেই তরু! মৃন্ময় আমাকে হাস্যকর বানিয়ে দিয়ে গেছে সবার সামনে!”
চেঁচিয়ে উঠল সে।আরেকটা ফুলদানি তুলে ছুঁড়ে মারল দেয়ালের দিকে।চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ল।
পাশে ইখতিয়ার দাঁড়িয়ে। কপালে ভাঁজ।
“রজনী, যথেষ্ট হয়েছে।রুমে যাও”
রজনী হেসে উঠল তীব্র শব্দে।
“ওকে আমি শেষ করে ফেলবো”
সে টেবিলের ওপর থাকা একটা ছবি তুলে নিল।তরু আর মৃন্ময়ের পুরনো এক ছবি।দুজনের হাসিমুখ।রজনীর চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
“এই মেয়েটাই সর্বনাশের কারণ। এই মুখটাই ওকে আমার থেকে দূরে নিয়েছে।”
রক্তমাখা আঙুল দিয়ে ছবিটা ছিঁড়ে ফেলল ধীরে ধীরে।ইখতিয়ার এগিয়ে এলেন, “রজনী, শান্ত হও!”
রজনী হঠাৎ ঘুরে তাকাল। চোখে রাগ, কিন্তু ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি।
” এবার আমিই ঠিক করব সব। ওরা শান্তিতে থাকতে পারবে না। না মৃন্ময়, না তরু। আমি ওদের শান্তি কেড়ে নেব।”
তারপর এক নিঃশ্বাসে বলল,
“এই খান বাড়ির মাটিতে ওর নাম আর মুখ আমি রাখতে দেব না।”
বজ্রপাতের মতো তার গলা কেঁপে উঠল।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চাকর ভয়ে এক ইঞ্চিও নড়তে পারছে না।রজনী সোজা উঠে গেল উপরের ঘরে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় তার মুখে শুধু একটাই কথা,
“মেরে ফেলবো। ও আবার আমার পথের কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে”
ইখতিয়ার নিচে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি জানতেন না মৃন্ময় বিয়ে করেছে। রজনীর থেকেই জানতে পারলেন। যে মৃন্ময় তার আদেশ ছাড়া কিছু করার সাহস দেখায় না সেই মৃন্ময় এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়েছে।আবার এমন একজনকে বিয়ে করেছে যে কিনা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল।
রজনী উপরের ঘরে দরজা বন্ধ করেই আয়নার সামনে দাঁড়াল। ভেজা চুল মুখে লেগে আছে, চোখ দুটো লালচে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“l”তরু, আমি তোকে ছাড়ব না।”
ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা মেকআপ ব্রাশটা হাতে নিয়ে চেপে ধরল। এত চাপ যে হাতের শিরা ফুলে উঠেছে। মুখে হাসি। সেই হাসিতে ভয় আছে, পাগলামি আছে, প্রতিশোধের নেশা আছে।
রজনীর ফোন বেজে উঠল।
“বল।”
ওপাশ থেকে কর্কশ গলা,
“ম্যাম,সব রেডি”
রজনী ধীরে হাসল।
“ঠিক সময় মতো করো কাজটা। আজ ওর পাশে ওই মেয়েটা থাকবে না।”
ফোন কেটে রাখল সে।
চলবে,,,,
Share On:
TAGS: ডার্ক ডিজায়ার, দূর্বা এহসান
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৪
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৬
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৯
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১১
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ২
-
ডার্ক সাইড অফ লাভ পর্ব ১
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৩(প্রথমাংশ + শেষাংশ)
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১৭
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ৭
-
ডার্ক ডিজায়ার পর্ব ১২