উড়ালমেঘেরভেলায়
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
পর্ব_৮
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]
রানিয়া ড্রয়িংরুমে তার বাবা-মায়ের সামনে সোফায় বসে আছে। ওর আম্মা ওকে সরু চোখে দেখছেন। তবে রানিয়ার বাবা আলী আহসানের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি স্বাভাবিক মুখ করেই বসে আছেন। ইতিমধ্যে রানিয়া তার হোস্টেলে যেয়ে থাকার কথাটা সবার মাঝে বলে ফেলেছে। সেজন্যই নাজমা পারভীন কিছুটা অন্য চোখে তাকাচ্ছেন। সেই চাহনি দেখে রানিয়ার ঘাবড়ানোর কথা। তবে ও ঘাবড়ালো না। বরং স্বাভাবিকভাবে বললো, “আমাকে হোস্টেলে যেতেই হবে। এখানে থেকে আমার পড়াশোনা হচ্ছে না। তাছাড়া, আমি নতুন যেই কোচিং-এ ভর্তি হবো; সেটাও রামপুরার কাছাকাছি। ওখানে গিয়ে থাকলে আমার জন্য ভালো হবে। তোমরা কোনো টেনশন কোরো না। আমি সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছি।”
“কিন্তু তুমি হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিলে কেন? সিদ্ধান্ত তো নিয়েই ফেলেছো, অথচ আমাদের আগে কোনোকিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না।”
নাজমা পারভীন বিচলিত কন্ঠে কথাটা বলতেই রানিয়া জবাব দিলো, “তোমরা একটা বিষয় বুঝতে পারছো না, আমার অ্যাডমিশনের আর মাস দুয়েকের মতো সময় আছে। এখন থেকেই ভালোভাবে প্রস্তুতি না নিলে আমি চান্স পাবো কীভাবে?”
“কিন্তু. . .”
“কিন্তু কী আম্মা?”
“কথা হচ্ছে, আমাদের রাজি হওয়াতে তো এখন শুধু সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তোমার মনে রাখতে হবে, তোমার এখন বিয়ে হয়েছে, স্বামী আছে তোমার। আভিয়ান বাবা তো তোমার আরেকজন অভিভাবক। তার কাছ থেকে না শুনে কীভাবে তুমি হোস্টেলে যেতে চাও? তোমার এমন কান্ডে কী মনে করবে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন? ”
নাজমা পারভীন বাঁধ সাধতেই ওপাশ থেকে আলী আহসান বলে উঠলেন, “জামাই বাবা আর কী বলবে? পড়াশোনার জন্য তো ওকে দূরে যেতেই হবে। এখানে তো কারো কিছু করার নেই। তুমি শুধু শুধু ঝামেলা কোরো না তো নাজমা। মাত্র দুই মাসের জন্য যাচ্ছে যাক। এরপর পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে দূরে থেকে পড়াশোনা করতে হলেও করবে। এখানে এতো বাঁধা দেওয়ার কী আছে? তাছাড়াও, ও তো এখন শ্বশুরবাড়িতেও থাকছে না, যে কারো মতামত নিতে হবে বা ও কিছু করলে কেউ মাইন্ড করবে। এতো ভেবে লাভ আছে? বরং, আমাদের মেয়ের-ই লোকসান। ওর পড়াশোনার ক্ষতি হবে। অন্য কারো কিছু হবে না।”
মনে মনে দ্বিমত থাকলেও স্বামীর মুখের ওপর আর কোনো কথা বলতে পারলেন না নাজমা পারভীন। রানিয়ার আব্বা চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। সচারাচর খুব একটা কথা বলেন না কোনো বিষয়ে। তবে একবার বলে দিলে তার সেই কথাটাই চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আর নাজমা পারভীন তার স্বামীকে খুব শ্রদ্ধা করেন, তাকে মেনে চলেন, তিনি কোনো একটা কথা বলে দিলে সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নেন। এজন্য নাজমা পারভীন চুপ করে গেলেন। এই বিষয়ে আর কোনো কথা বললেন না৷
রানিয়াকে ওর আব্বা বললেন, “তুমি হোস্টেলে যাও। কোনো অসুবিধা নেই। আমি তোমার হোস্টেলের সকল খরচ-খরচা দেবো। ও নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তবে একটা কথা।”
“কী কথা আব্বু?”
“ছুটির দিনে তোমাকে অবশ্যই বাসায় আসতে হবে। ছুটির দিনগুলো বাসায় কাটাবে। তোমাকে ছাড়া বাসা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”
রানিয়া তার আব্বার কথা শুনে মলিন মুখে হাসলো। হোস্টেলে তো ওরও যেতে ইচ্ছা করছে না। বাসার সবাইকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না। ওর আম্মা যখন ওকে ট্রেনিংয়ের জন্য জোর করে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিলেন, তখন সেই সময়টা খুব খারাপ কেটেছিল রানিয়ার। সর্বক্ষণ ঘরকুনো একটা মেয়েকে দীর্ঘ কতগুলো দিন ঘরছাড়া হয়ে থাকতে হয়েছিল। সে থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল কতোদিনের জন্য। আবার ভাগ্যের জোরে সেই অবস্থানেই ফিরে যেতে হচ্ছে ওকে। তবে কিছু করার নেই রানিয়ার। ওর প্রেগন্যান্সির খবরটা লুকাতে হলেও সবার থেকে দূরে থাকতে হবে। অন্তত ওর বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখার আগে অবধি। রানিয়া সবাইকে জানিয়ে দিলো, সে আজই হোস্টেলে চলে যাবে। ওর আব্বা ওকে এগিয়ে দিবেন জানালেন। রানিয়া ছোটভাইকে ডেকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
.
.
আজ হোস্টেলে আসার তেরো তম দিন। হোস্টেল ঠিক বলা যায় না। এটা ছোট ফ্ল্যাটের মতো। এখানে দুইটা রুম, ড্রয়িংরুম, একটা ব্যালকনি, দু’টো বাথরুম আর একটা কিচেন রুম। রানিয়াকে ওর ফ্রেন্ড কেয়া-ই সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়েছে। মেয়েটা এখনো জানে না যে, রানিয়া প্রেগন্যান্ট এবং ও ঠিক কি কারণে এখানে এসেছে।
সকালের দিকে রানিয়া ঘুম থেকে উঠে বিছানা গোছগাছ করছিল। আজ ওর কোচিং নেই। আর কেয়াও বাইরে বের হয়নি আজ। সচারাচর দু’জনের সকালটা কোচিং-এ কাটিয়ে যায়। ওদের দেখা হয় দুপুর বারোটার দিকে। তখন দু’জনে বাসায় এসে একসাথে মিলেমিশে রান্না করে।
আজ রানিয়ার ঘুম একটু দেরিতে ভেঙেছে। ও কম্বল ভাঁজ করে রেখে দাঁড়ানো মাত্রই ওর মাথা হঠাৎ কেমন চক্কর দিতে লাগলো। মনে হলো, আরেকটু দাঁড়িয়ে থাকলেই মাথা ঘুরে ফ্লোরে পড়ে যাবে। পেটে হাত চেপে ধরে ভয় পেয়ে ধপ করে বিছানার ওপর বসে পরলো রানিয়া। পালঙ্কে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। কেয়া তখন টেবিলে এলোমেলো করে রাখা বইপত্র গুছিয়ে রাখছিল। রানিয়াকে ওভাবে বসে পরতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসলো ওর কাছে। রানিয়া মাথা নিচু করে রেখেছে। ওর একহাত পালঙ্কে ঠেস দেওয়া। কেয়া নিচু হয়ে ওকে প্রশ্ন করলো, “কী হয়েছে রানিয়া? শরীর খারাপ লাগছে তোর?”
রানিয়া কথা বলতে পারছিল না। কষ্ট হচ্ছিল ওর৷ শুধু দুইপাশে মাথা নেড়ে না বোঝালো ও। কেয়া মানলো না। ও উদ্বিগ্ন স্বরে বললো, “কিন্তু আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তোর শরীর খারাপ করছে। প্রেশার লো হয়ে গেছে নাকি? ডাক্তারের কাছে যাবি? চল নিয়ে যাই তোকে।”
“উহুঁ। ডাক্তারের কাছে যাবো না কেয়া। একটু পানি দে আমাকে।”
রানিয়া সকালে এখনো কিছু খায়নি। কেয়া ভাবলো, ওকে কিছু খাইয়ে দেবে। তাহলে হয়তো ওর ভালো লাগবে। একথা ভেবে ও পানির সাথে সাথে একটা চিজ কেক নিয়ে আসলো। রানিয়া সাধারণত চিজ কেক খায়নি এই ক’দিনে। কেয়ার আবার চিজ কেক ভীষণ পছন্দ। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রানিয়াকে চিজ কেক সাধলেও মেয়েটা কোনোভাবেই খেতে চায় না। মানা করে দেয়। অথচ ওরা আগে যখন একসাথে রেস্টুরেন্টে যেত, তখন রানিয়া বেশিরভাগ সময় চিজ কেক অর্ডার দিতো নিজের জন্য। অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা ভাবেনি কেয়া।
রানিয়ার মাথা ঘুরাচ্ছে প্রচুর। কেয়া যে ওকে চিজ কেক খাইয়ে দিয়েছে, এটা প্রথমে বুঝতে পারেনি ও। গালে নিয়ে গিলে ফেলতেই টের পেল। চিজের গন্ধে সঙ্গে সঙ্গে ওর বমি আসার উপক্রম। ও দৌড়ে গেল ওয়াশরুমে। কেয়া ওর পেছন পেছন গেল।
রানিয়া বমি করছে। এদিকে কেয়া ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে পেছন থেকে। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগে ওর মাথায় সামান্য পানিও ঢেলে দিলো। এরপর ওকে ধরে এনে বিছানার ওপরে বসালো।
রানিয়ার এবার কিছুটা সুস্থ লাগছে। বমি হয়ে যাওয়ার পরে শরীরটা হালকা লাগছে। এতোক্ষণ ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। ও গামছাটা টেনে নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে লক্ষ্য করলো কেয়া ওর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা। রানিয়া চোখ সরিয়ে নিলো। ও কিছু বলার আগেই কেয়া ওকে প্রশ্ন করলো, “চিজ কেক খেয়ে বমি হলো কেন তোর? আমার ভীষণ অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। কেক তো ভালোই আছে।”
রানিয়া কথা এড়াতে বললো, “শরীরটা এমনি একটু খারাপ তো। এজন্য বোধহয় হঠাৎ খালি পেটে এভাবে চিজ কেক খাওয়ার কারণে এমন হয়েছে।”
“তা হতে পারে…”
কেয়া বিরবির করলেও ওর মন মানতে পারলো না। রানিয়া এখানে আসার পর থেকেই ও খেয়াল করেছে, মেয়েটা হঠাৎ কেমন যেন বদলে গেছে। আগের রানিয়া আর এখনের রানিয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। দু’জনকে মিলাতে পারে না ও। চঞ্চল মেয়েটাও সর্বক্ষণ কেমন চুপচাপ এবং অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। এই তেরো দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার রানিয়ার শরীর খারাপ হয়েছে। প্রথম প্রথম কেয়া অতোটা গুরুত্ব দিতো না। শুধু দুশ্চিন্তা করতো। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত এক রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঘোলাটে লাগছে ওর কাছে। কেয়া ওকে বললো, “তুই ওয়েদার চেঞ্জ করেছিস, এজন্যই মনে হয় এভাবে প্রায়সময় শরীর খারাপ করছে। এক কাজ কর। তুই কিছুদিনের জন্য নিজের বাসা থেকে বেড়িয়ে আয়। দেখবি, সুস্থ হয়ে যাবি দ্রুত।”
“পরে যাবো।”
রানিয়া মিনমিন করতেই কেয়া জবাব দিলো, “পরে যাবি বলতে বলতে দু’টো সপ্তাহে কেটে গেল। তুই তো একটা ছুটিতেও বাসায় গেলি না। আঙ্কেল-আন্টি কল দিয়ে যেতে বললেও না করে দিলি। বললি, পরে যাবি। কী হয়েছে তোর রানিয়া? আমাকে বল। কোনো সমস্যা? শেয়ার করতে পারিস।”
রানিয়া বিরবির করে বললো, “কিছু হয়নি আমার। কিছুই হয়নি।”
তৎক্ষনাৎ রানিয়ার ফোনের রিং বেজে উঠলো। কেয়া উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা এনে রানিয়াকে দিলো। ও ফোন স্ক্রিনে দেখলো, ওর আম্মা কল দিয়েছেন। রানিয়া কল রিসিভ করে ঠিকমতো সালামও দিতে পারলো না। তার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে ওর আম্মা বলে উঠলেন, “তুমি বাসায় আসো তো এখন।”
রানিয়া আশ্চর্য হলো। হঠাৎ এমন কথা! ব্যাপারটা কী? ও কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো, “বাসায় আসতে হবে, তা-ও এখুনি?”
“হ্যাঁ এখন-ই।”
“কেন আম্মা? কোনো জরুরি দরকার?”
“হ্যাঁ, জরুরি দরকার-ই বটে। তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসছে একটু পরে। কি বিষয়ে যেন কথা আছে। তোমাকে এখন-ই আসতে হবে।”
“হঠাৎ যে?”
“অতো কিছু জানা নেই। তবে শুনলাম, আভিয়ান নাকি ঢাকায় এসেছে।”
আভিয়ানের নামটা শুনতেই রানিয়া থমকালো, স্তব্ধ হলো। বিচলিত কন্ঠে বিরবির করলো,
“আভিয়ান ঢাকায় এসেছে!”
চলবে
🔹
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৫
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৪
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৯
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৭
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১০