উড়ালমেঘেরভেলায়
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
পর্ব_৭
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]
রানিয়ার রীতিমতো প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। শরীর কাঁপছে ওর। কান্না আসছে প্রচুর। তবে জোরে চিৎকার করে কাঁদতেও পারছে না৷ জোরে কান্নাকাটি করলে বাইরে থেকে বাবা-মা অথবা ছোটভাই রেহান শুনে ফেলতে পারে — এই ভয়ে রানিয়া মুখে হাত চেপে ধরে কান্না করছে। মিশা ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মিশা বললো, “কান্না করিস না রানি। নিজেকে সামলে নে। এখন কান্না করলে যদি তোর শরীর খারাপ হয় তখন? তাহলে তো তোর-ই কষ্ট পেতে হবে।”
রানিয়া কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। তবু অনবরত হেঁচকি তুলতে লাগলো। এমন ক্রিটিকাল সিচুয়েশন লাইফে এর আগে কখনো আসেনি ওর। এতোটা বেশি নার্ভাসনেস কাজ করেনি। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ও। রানিয়ার হাত কাঁপছে দেখে ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো মিশা। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো৷ বললো, “এখন যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে রানিয়া। কিন্তু তোর তো পরিস্থিতি সামলাতে হবে। এভাবে ভেঙে পরলে তো চলবে না। এতে তোর-ই ক্ষতি।”
“ক্ষতি তো অলরেডি হয়েই গেছে। ক্ষতি হওয়ার আর কিছু বাকি নেই। আমার জীবনেরও আর কিছু বাকি নেই। শেষ, সব শেষ আমার।”
“কী শেষ? কোনোকিছুই শেষ হয়নি। চুপ কর তো। আজেবাজে কথা বলিস না।”
“তুই বুঝতে পারছিস না মিশা। আমার লাইফটা এখন এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আমি কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। পেছনে এগোনোর মতো পরিস্থিতি নেই। আর সামনে যে এগোবো, সেই উপায়ও নেই। মনে হচ্ছে, কেউ আমার সামনে লম্বা একটা দেয়াল খাঁড়া করে রেখেছে। সব আমার দোষে হয়েছে। সব দোষ আমার! আমি যদি.. যদি উনাকে সেদিন কাছে আসতে না দিতাম, তাহলে এতোকিছু হতো না। আমি বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি যে, একটা রাতের জন্য জীবন আমাকে এমন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করাবে। জানলে কখনো ওই ভুল করতাম না। মনের ভুলেও করতাম না। আসলে, ভুল একটা করে ফেলার সময়ে আমরা বুঝতে পারি না। করার পরে যখন হাতেনাতে ফলাফল পাই, তখন উপলব্ধি করতে পারি। এই যেমন দেখ, আমি এখন বুঝতে পারছি, চরম ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু এই ভুল শোধরাবার কোনো উপায় আমার জানা নেই। আমি এখন কী করবো মিশা? এইযে, ছোট শিশুটা আমার পেটে, ওর কী দোষ বল? ও তো নিষ্পাপ একটা বাচ্চা। ওকে কেন এভাবে পৃথিবীতে আসতে হচ্ছে? ওকে কেন একটা লোকের জেদের ফল হতে হচ্ছে? পরিণাম কী হবে ওর? জানা নেই আমার। সত্যিই জানা নেই।”
রানিয়ার হঠাৎ শরীর খারাপ হতে লাগলো। প্রচন্ড শরীর কাঁপছে ওর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বমি বমি পাচ্ছে। ওর অবস্থা দেখে মিশার-ই কান্না পেল। ও রানিয়াকে শক্ত করে ধরে রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো, “তুই তো এভাবে বাঁচতে পারবি না রানি। তোর বাসার সবাইকে জানানো প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে জানাতে হবে। তোর শারীরিক অবস্থা একদম খারাপ। আমি গিয়ে আন্টিকে ডেকে নিয়ে আসি।”
“না, না। তুই যাবি না। আম্মাকে ডাকার দরকার নেই মিশা। কাউকে কিছু বলতে হবে না।”
মিশা উঠতে যেতেই ওকে টেনে ধরে বাঁধা দিলো রানিয়া। মিশা বাঁধা পেয়ে বসে পরলো। হতাশার সুরে বললো, “তুই কী করতে চাচ্ছিস রানিয়া?”
মিশার প্রশ্ন শুনে চোখের জল মুছে সোজা হয়ে বসলো রানিয়া। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে ব্যস্ত হলো। পেটে হাত রাখলো আলতোভাবে, পরম আদরে। তারপর বিরবির করে বললো, “পেটে বাচ্চা আসলে মেয়েরা বোধহয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে মায়েদের মতো মমতাময়ী হয়ে যায় তাইনা মিশা?”
মিশা চুপ করে থাকে। রানিয়া প্রশ্ন করে জবাবের অপেক্ষা করলো না৷ পুনরায় বলতে লাগলো, “দ্যাখ না, মাত্র জানতে পারলাম, ছোট্ট সোনাটা আমার পেটে আছে। অথচ অদ্ভুতভাবে, এটুকু সময়ের মধ্যেই ওর প্রতি আমার কতোটা মায়া জড়িয়ে গেছে! আমি ঠিক করে নিয়েছি, ওকে আমি পৃথিবীতে আনবো। অবশ্যই আনবো। আর খুব সুন্দরভাবে মানুষ করবো। ও হবে পরম আদরের৷ অন্যের জেদের ফল ওকে ভোগ করতে দেবো না আমি। আমি-ই হবো ওর বাবা এবং মা। ওকে ওর বাবার অভাব বুঝতেই দেবো না। ওরকম জঘন্য খারাপ লোককে বাবা জানার চাইতে ওর বাবা নেই— একথা জানা বেশি ভালো।”
“মানে?!”
মিশা হতভম্ব রানিয়ার কথাবার্তা শুনে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্নটা করতেই রানিয়া জবাব দিলো, “আমি ওকে ওর বাবার পরিচয় জানতে দেবো না। আর আহমেদ আভিয়ানও জানবেন না, তার একটা সন্তান আছে। কোনোদিনও জানতে পারবে না। আমি জানাবো না তাকে।”
রানিয়া চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালো। আলমারি খুলে নিজের জামাকাপড় বের করে লাগেজে গুছিয়ে রাখতে লাগলো। তা দেখে মিশা তাজ্জব বনে গেল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “লাগেজ গোছাচ্ছিস কেন?”
“এখান থেকে যেতে হবে আমাকে।”
“যেতে হবে মানে? কোথায় যাবি?”
“দূরে যাবো। এখান থেকে, সবার থেকে বহুদূরে।”
“সবাই কী দোষ করেছে? সবার থেকে দূরে কেন যাবি?”
“কেউ কোনো দোষ করেনি মিশা। আমার বাচ্চাকে আমাকে আগলে রাখতে হবে। সবার থেকে আড়াল করে রাখতে হবে। ওর কথা আপাতত আমি আমার ফ্যামিলিকেও জানতে দেবো না। আগে ও পৃথিবীর আলো দেখুক, তারপর সবাই জানবে। তার আগে ওকে রক্ষা করার কর্তব্য আমার। যেহেতু আমি ওর মা। ওকে আগলে রাখতে হবে আমাকেই।”
“তারমানে দুলাভাই ওর কথা জানবে না?”
“চুপ! দুলাভাই মানে? কীসের দুলাভাই? উনার সাথে আনঅফিশিয়ালি সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছি। একবার শুধু আমার সোনা বাচ্চাটা তার মায়ের কোলে আসুক। এরপর তাকে আমি ডিভোর্স দিয়ে দেবো।”
রানিয়ার কষ্ট হচ্ছে। তবু ও লাগেজ গোছগাছ করছে দেখে মিশা উঠে গিয়ে ওকে জোর করে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে ওর জামাকাপড় গুছিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো, “হঠাৎ এভাবে কোথায় যাবি তুই? কি করতে চলেছিস কিছু বুঝতে পারছি না আমি। তোর জন্য বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিছু তো বল।”
“আমার এক পুরোনো ফ্রেন্ড আছে। আমাদের কলেজে পড়তো। ও এখন বর্তমানে রামপুরায় একটা হোস্টেলে থাকে। ওর সাথে কলে কথা হয়েছিল কিছুদিন আগেই। তখন কথায় কথায় ও বলছিল, যদি কখনো হোস্টেলে ওঠার প্রয়োজন হয়; তখন যেন ওকে জানাই। ও হোস্টেলে একা একটা ফ্ল্যাটে থাকে ও। একটা কোম্পানি দরকার, এজন্য অনেককে জানিয়েছিল। তখন তো আমার হোস্টেলে ওঠার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এখন পড়াশোনার কথা বলে হোস্টেলে চলে যাবো ভাবছি। বাসায় ম্যানেজ করে নেবো। ওকেও কল করে জানিয়ে দিচ্ছি। আজ লাগেজ গুছিয়ে রাখবো। আগামীকাল বেরিয়ে পরবো।”
মিশা এই কথার পরে আর কোনো কথা বলতে পারলো না। চুপচাপ রানিয়াকে সাহায্য করতে লাগলো।
.
.
“আহমেদ আভিয়ান।”
নামটা শোনামাত্র পেছনে ঘুরে তাকালো আভিয়ান। ওর চোখের সামনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। আভিয়ান হাত দিয়ে ইশারা করে ওকে ডাকলো। মেয়েটা এগিয়ে আসতেই চেয়ার টেনে ওর বসার ব্যবস্থা করে দিলো।
ক্যাফে মিলানো।
এখানকার এক কোণের একটা টেবিলে বসে আছে আভিয়ান এবং হিয়া।
মেয়েটা জুসের গ্লাসে স্ট্রো নাড়ছে অববরত। আর আভিয়ানকে দেখছে। আভিয়ানের ওর দিকে কোনো খেয়াল নেই। ও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে একধ্যানে, অন্যমনস্ক হয়ে। তখন হিয়া বলে উঠলো, “তোমার কি এমন করা ঠিক হচ্ছে আভিয়ান?”
আভিয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর কথা শুনতে পেল। ঘাড় না ঘুরিয়েই তৎক্ষনাৎ প্রশ্নের জবাবে বললো, “ইয়েস, ঠিক হচ্ছে।”
“কেন করছো এরকম? আমাকে তো স্পষ্ট করে কিছুই বললে না। অথচ তুমি আমার সাথে সব কথা শেয়ার করো।”
“ফিলিংস বুঝতে চাইছি।”
“সিরিয়াসলি?”
“ইয়াহ।”
হিয়া অবাক না হয়ে পারলো না। আভিয়ান বোধহয় বিরক্তবোধ করছে। ওকে খুব ভালোভাবে চেনে হিয়া। বিরক্তবোধ করলেই ছেলেটা শার্টের কলারের অংশ ধরে অযথাই টানতে থাকে। হিয়া ওর বিরক্তি দেখেও চুপ করলো না। বরং মুখের ওপর বলে বসলো, “তোমার এই মাইন্ড গেইমের চক্করে সে যদি তোমার থেকে দূরে সরে যায়, তখন?”
এই কথাটা শুনে আভিয়ান বোধহয় একটু থমকালো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো হিয়ার দিকে। তারপর হঠাৎ গম্ভীর মুখ করে বললো, “এসব নিয়ে মাথাব্যথা না বাড়িয়ে জুস খাও। আর যে কারণে মিট করতে বলেছো, সেটা জলদি শেষ করো। আমার টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে।”
চলবে
এই গল্পের পরের পর্ব সবার আগে পেতে আমাদের গ্ৰুপ জয়ের করুন ধন্যবাদ
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৮
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৫
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৪
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৩
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৯
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১০