উড়ালমেঘেরভেলায়
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
পর্ব_৫
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]
রানিয়া ড্যাব ড্যাব করে আভিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আভিয়ান তাকিয়ে আছে রানিয়ার কোমরের দিকে৷ রানিয়া ওর দৃষ্টি অনুসরণ করতেই বিচলিত হলো। মিহি স্বরে আভিয়ানকে প্রশ্ন করলো, “কী হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“দেখছি।”
আভিয়ানের অদ্ভুত শান্ত কন্ঠস্বর। রানিয়া তাতে যেন আরো বেশি বিচলিত হলো। কাপা স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করলো— “কী দেখছেন?”
“তোমাকে। স্যরি, তোমার কোমরকে।”
আভিয়ান কথাটা বলে নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত হলো। মনে মনে বললো, “শিট! কি হচ্ছে আমার! এই মেয়ের জন্য কিনা . .!”
আভিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও বললো, “কোমরে কতোটা ব্যাথা পেয়েছো?”
“কেন?”
“বেশি ব্যাথা পেলে প্রবলেম হবে ফিউচারে। এখন-ই মলম লাগানো প্রয়োজন।”
“ব্যাথা দিয়ে আবার মলম লাগানো হচ্ছে! ব্যাটা বজ্জাত! জুতা মেরে গোরু দান করছে।”
রানিয়া বিরবির করলেও আভিয়ান শুনতে পেল কথাগুলো। ততক্ষণে ও রানিয়ার রুমের বেডসাইড ড্রয়ার থেকে খুঁজে-টুজে একটা ব্যাথার মলম বের করে এনেছে। মুভের খাপটা খুলতে খুলতে ও রানিয়ার প্রশ্নের জবাবে বললো, “ব্যাথাও আমি দেবো, আর মলমও আমি-ই লাগবো। বুঝেছো?”
আভিয়ান রানিয়ার কোমরের কাছ থেকে কামিজের কোণার অংশ কিছুটা টেনে ওপরের দিকে ওঠাতেই রানিয়া কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো। দ্রুত আভিয়ানের হাত চেপে ধরে ওকে বাঁধা দিয়ে বললো, “একি! কী করছেন? লজ্জা-শরম কি একটুও নেই আপনার?”
“নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথে আবার কীসের লজ্জা?”
জবাবটা দিয়ে রানিয়ার চেপে ধরে রাখা হাতটা টেনে সরিয়ে দিয়ে জোরপূর্বক ওর কোমরের কাছ থেকে কামিজ সরিয়ে কিছুটা মলম বের করে হাতে নিয়ে আভিয়ান উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করলো, “কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?”
“এইযে এখানে।”
রানিয়া দেখিয়ে দিতেই আভিয়ান সেখানে মলম মালিশ করে দিতে রাগলো। এতোটাই কোমলভাবে মালিশ করতে লাগলো যে, রানিয়ার সংবেদনশীল ত্বক মারাত্মক শিউরে উঠলো। ও কম্পমান স্বরে বললো, “আভিয়ান।”
“হ্যাঁ বলো।”
“প্লিজ তাকাবেন না।”
“তাকাবো না মানে?”
“তাকাবেন না মানে তাকাবেন না৷ প্লিজ আভিয়ান, ভদ্র-সভ্য স্বামী আমার, প্লিজ তাকিয়েন নাহ।”
এই মেয়ের উদ্ভট কথাবার্তা শুনলে রীতিমতো বিরক্ত লাগে আভিয়ানের। একইসাথে রাগও ওঠে প্রচন্ড। তবে আপাতত সেই রাগকে দমন করে রেখে আভিয়ান ওর কোমরে মালিশ করে দিতে দিতে বললো, “আমি না তাকালে কে তাকাবে? বাইরের ছেলেপেলে?”
“হুঁ? মানে না!”
“ওই ছেলেটার নাম কী যেন? জাহিন তাইনা? জাহিন সরদার, জাহাঙ্গীরনগরের অনার্স প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। চট্টগ্রাম ফেরার আগে দেখে যাব ওকে।”
আভিয়ানের কথা শুনে আঁতকে উঠলো রানিয়া৷ নড়েচড়ে জোর গলায় বললো,
“দেখে যাবেন মানে? কী দেখে যাবেন? ওর চেহারা খারাপ। শুধু খারাপ না। খুব খারাপ। ওকে দেখতে হবে না। দেখলে মুড খারাপ হয়ে যাবে আপনার।”
“শাট আপ! চুপচাপ শুয়ে থাকো। নড়াচড়া কোরো না।”
রানিয়া আভিয়ানের কথা শুনলো না। চুপচাপ শুয়েও থাকলো না ও। বরং উঠে বসে হঠাৎই আভিয়ানকে হতভম্ব করে দিয়ে ওর শার্টের কলার চেপে ধরে বললো, “হঠাৎ এতো দরদ দেখাচ্ছেন কেন? কারণ কী এসবের? স্বামী স্বামী ভাব নিচ্ছেন কেন?”
“শার্টের কলার থেকে হাত সরাও।”
রানিয়া ঠোঁট চেপে আভিয়ানের চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পেল৷ তবে সেই ভয়টা সামনা-সামনি প্রকাশ করলো না। উল্টো আরো শক্ত করে শার্টের কলার চেপে ধরে বললো, “আপনি সবাইকে কেন বলেছেন আপনি আমার জন্য এখানে এসেছেন? এটা তো সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।”
“কোনো মিথ্যা নয়। আমি মিথ্যা কথা বলি না, আর বলা পছন্দও করি না।”
“তাহলে?”
রানিয়া বোকার মতো প্রশ্ন করলো। আভিয়ান রানিয়ার হাতের বাহু চেপে ধরে শান্ত স্বরে জবাব দিলো, “তোমার জন্যই তো এসেছি আমি৷ তুমি আসতে বাধ্য করেছো আমাকে। আমাকে ডিস্টার্ব করে খুব শান্তিতে ছিলে তাই না? আমার জীবনটা অশান্ত করে নিজে শান্তিতে থাকতে চাচ্ছো হ্যাঁ? থাকতে পারবে না রানিয়া। আমাকে অশান্ত করে কেউ শান্তিতে থাকতে পারে না।”
“আমি কখন, কীভাবে আপনাকে অশান্ত করলাম?”
আভিয়ান স্পষ্ট প্রশ্নটা শুনেও কোনো জবাব দিলো না। এই নিরবতায় রানিয়ার জেদ আরো বেড়ে দ্বিগুণ হলো। ও আভিয়ানের কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, “জবাব দিচ্ছেন না কেন? আমি কেন আপনার অশান্তির কারণ হবো? কে আমি? কেউ না তো তাইনা? হঠাৎ এতোদিন পরে আজ আসলেন কেন আমার কাছে? এখন ডিভোর্সের কথা বলায় আপনার যে একটা বউ আছে, সেকথা মনে পরেছে তাইনা? ওকে! আপনি আমাকে ডিভোর্স দিবেন। আজ-ই, এখুনি। ডিভোর্স না দিয়ে চট্টগ্রামে ফিরতে পারবেন না আপনি।”
আভিয়ান যথেষ্ট শান্ত থাকার চেষ্টা করলো। নিজের রাগটা উচ্চমাত্রায় উঠতে দিতে চাইলো না ও। চাইলো না, এখন কোনো অঘটন ঘটুক। তবু রানিয়া ওকে রাগিয়ে দিলো এবার। আভিয়ানকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করতেই ও রানিয়ার কোমরে যেই জায়গায় ব্যাথা পেয়েছিল ঠিক সেখানটাতেই দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বিছানার সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো, “জেদ ধরো না রানিয়া। ইউ নো দ্যাট, তোমার চাইতেও বেশি জেদ আমার।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। আপনার জেদ অনেক বেশি। কোনো মানুষের এতো জেদ হতে পারে না৷ অমানুষদের হয়। আপনি অমানুষ। তাই আপনার সীমা ছাড়া জেদ। জেদের জন্যই তো নিজের আন্ডারের ট্রেইনিং ক্যান্ডিডেটদের সামান্য ভুলেও অমানুষের মতো শাস্তি দিতে বাঁধে না আপনার। আপনাকে খুব ভালোভাবে চিনি আমি।”
“চেনো যখন আরো চিনে নাও।”
আভিয়ান নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রানিয়াকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। ওর পিঠে বলিষ্ঠ হাতজোড়া রাখলো। রানিয়া ব্যাথা পেল। সেদিকে খেয়াল নেই আভিয়ানের। রানিয়ার মাথায়ও ভূত চেপেছে এখন। সন্ধ্যায় আভিয়ানের তার মা-বাবাকে বলা কথাগুলো মনে পরেই জেদ উঠছে ওর। ও আভিয়ানের হাতের কব্জির কাছটায় খামচে ধরে রেখে বললো, “আমি কোনো কথা শুনতে চাই না৷ আমাকে ডিভোর্স দিন।”
“ডিভোর্সের এতো শখ তোমার তাইনা? একটা পবিত্র সম্পর্ককে নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো! আমার রেপুটেশন নষ্ট করতে চাইছো! ঘুচিয়ে দিচ্ছি তোমার এই শখ, এই দিবাস্বপ্ন। এরপর আর কখনো ডিভোর্স চাওয়া তো দূর, ডিভোর্সের কথা ওই বেয়াদব মুখেও আনতে পারবে না।”
রানিয়া ভ্রু কুঁচকালো। প্রথমে বুঝতে পারলো না আভিয়ানের কথা। পরমুহূর্তে আভিয়ানের চোখে চোখ রাখতেই বুঝতে পারলো, ও কি করতে চলেছে! রানিয়া অপ্রস্তুত হলো, প্রচন্ড রকমের ঘাবড়ে গেল। এই শীতের রাতেও ঘামতে লাগলো ও। তবে আভিয়ানকে বাঁধা দিলো না। একবারের জন্যও বাঁধা দিতে পারলো না ও। বরং, আভিয়ান আকস্মিক ঠোঁট আঁকড়ে ধরতেই বেহায়ার মতো উপভোগ করতে লাগলো স্বামী-স্পর্শ। কিছুক্ষণ আগে জেদ ধরে বলা ডিভোর্সের কথাও ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেল ও।
.
.
সাতসকালে উঠে গোসল সেরেছে রানিয়া। ও গোসল করে আসার পরপরই দেখলো, আভিয়ানও ফ্রেশ হতে গেছে। আভিয়ান চলে যাবে আর অল্প কিছু সময় পরেই। রানিয়ার সেকথা মনে পরতেই অজানা কোনো কারণে কান্না পাচ্ছে ভীষণ। ভেতরে ভেতরে মন ডুকরে কেঁদে উঠছে। রানিয়া ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। ও বিছানা গোছগাছ করছিল। সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে দেখলো, আভিয়ান ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে। লোকটা এমনিতেও চুপচাপ স্বভাবের। তারওপর মুখটা কেমন গোমড়া করে রাখে। প্রচন্ড অসামাজিক লোক। এমন লোকের সাথে কেউ যেচে পড়ে কথা বলতে চাইবে না নিশ্চয়ই। মুখে সচারাচর হাসি থাকে না লোকটার। অথচ রানিয়াকে দেখো! সারাক্ষণ কতো প্রফুল্ল থাকে, সবসময় হাসি-খুশি থাকে, নিজের চারপাশ মাতিয়ে রাখে।
চাদর ভাঁজ করতে করতে রানিয়া আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, আভিয়ান ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছছে৷ চুল আর্মি কাট দেওয়া। দেখতে সুন্দর-ই লাগে। সদ্য গোসল সেরে আসা সুপুরুষকে দেখে রানিয়ার বেহায়ার মতো একটানা তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তবে ও নিজের মন এবং চক্ষু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালায়। সরাসরি তাকায় না আভিয়ানের দিকে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওপাশে দাঁড়ানো লোকটা একবারের জন্যও তাকাচ্ছে না রানিয়ার দিকে। রানিয়ার রাগ হয় খু্ব। পুরুষ মানুষ এমনই। রাতে এরকম, আর দিনে আরেকরকম। রাত-দিনে হুবহু মিলানো যায় না এদের।
আভিয়ান খুব দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো৷ রানিয়া বিছানার ওপরে বসে ওর তৈরি হওয়া দেখলো। আভিয়ান রুম থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে রানিয়াকে কাছে ডাকলো হঠাৎ। রানিয়া চুপচাপ এগিয়ে গেল। আভিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা রানিয়াকে আপাদমস্তক দেখলো একপলক। তারপর হঠাৎ মেয়েটাকে সর্বোচ্চ চমকে, স্তব্ধ করে দিয়ে বলে উঠলো, “আজকে আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে আমার সাথে আর কোনোপ্রকার যোগাযোগ রাখবে না রানিয়া। কোনো কল-টেক্সট, কিছু না। আর চাইলে তুমি আমাকে ডিভোর্সটাও দিয়ে দিতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
চলবে
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৯
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৮
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৪
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৭
-
উড়াল মেঘের ভেলায় গল্পের লিংক
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৩