Golpo romantic golpo উড়াল মেঘের ভেলায়

উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২০


উড়ালমেঘেরভেলায়

লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক

পর্ব_২০

[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]

সিলেট শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চড়াইবিল। এটা বিস্তৃতি জলাভূমি অঞ্চল।
বর্ষাকালে এই অঞ্চলটা প্রায় পুরোপুরি হাঁটু এবং কোমর সমান পানিতে ডুবে থাকে। আর শুষ্ক মৌসুমে এখানকার মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বলা চলে, প্রখর খরার দেখা দেয়।
এখানকার বাতাসে সবসময় কেমন যেন একটা বারুদের গন্ধ লেগে থাকে। আর থাকে বিভিন্ন রকম নেশাদ্রব্যের গন্ধ। স্থানীয় সকলে খুব ভালোভাবেই জানে, এটা অপরাধীদের খুব আরামপ্রিয় স্থান। এখানে সাধারণ মানুষ তো দূর, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত ঢুকতে ভয় পায়। কোনো সাধারণ মানুষের সচারাচর এখানে পদচারণ পড়ে না।
একটা মস্ত বড় খাল পাড়ি দিয়ে অপর প্রান্তে গেলেই জঙ্গল। সেই জঙ্গলে অজস্র গাছগাছালি। এখানে খুব বেশি বিষাক্ত এবং ভয়ংকর জন্তু-জানোয়ার না থাকলেও টুকটাক সাপ-খোপ এবং কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল আর বানরের দেখা-সাক্ষাৎ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে যায় প্রায়ই৷ এই জঙ্গল পেরিয়ে একটু গভীরে গেলেই গাছগাছালির আড়ালে অবস্থিত একটি ইট-পাথরের তৈরি দালান। লাল রঙের মিশেলে তৈরি লাল কেল্লার মতো দেখতে এই বিধ্বস্ত দুর্গের বাইরে থেকে দেখলে বোঝা-ই যায় না যে, এরমধ্যে জনমানবের চিহ্ন অবধি থাকতে পারে। বাইরের কেউ তো বুঝতেই পারবে না। তবে স্থানীয়রা খুব ভালোভাবেই জানে, এখানে ঠিক কি চলে এবং কিসের আস্তানা আছে।
দোতলা এই ভবনের নাম — চড়াইবিল সেফহাউজ। সবাই ভবনটাকে এই নামেই চেনে।
দিনের বেলা জায়গাটা শান্ত, নিরব এবং মাঝেমধ্যে পক্ষী সমাজের বিচরণে মুখরিত থাকলেও রাতের বেলা এর পরিবেশ বেশ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে বটে। যেকোনো ভীতু প্রকৃতির মানুষ এখানে এসে সর্বোচ্চ একঘন্টার বেশি সময় যাপন করতে পারবে বলে মনে হয় না। সম্ভব হলে হার্ট অ্যাটাক করে ইন্তেকাল করবে, তবু এখানে অবস্থান করতে চাইবে না।
বিল্ডিংয়ের সামনে একটা হাঁটাচলার সরু পথ। যেকোনো বিচক্ষণ ব্যক্তি প্রথম দেখাতেই বলে দিতে পারবেন, এই পথে নিত্যদিন লোক যাতায়াত চলে৷ পথের শুরুটা ভবনের সামনের ওঠা-নামার সিঁড়ি থেকে প্রবাহমান হয়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে নদীর দিকটায় গিয়েছে।
দূর থেকে দেখেই বোঝা যায়, দু’টো কপাট টেনে ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা কাঠের দরজা, দরজায় লোহার কড়ায় মরচে ধরা একটা মাঝারি আকৃতির তালা। সামনের দিকে দু’টো জানালা। তবে সেগুলো দেখলে মনে হয়, জানালা দু’টোর কপাট কস্মিনকালেও খোলা হয় না।
আভিয়ানের হাতে একটা ব্ল্যাক কালারের এনক্রিপটেড মিলিটারি ওয়াকিটকি। ওর বিচক্ষণ দৃষ্টি ওর লাল রঙা ভবনের দিকেই।
যৌথ বাহিনীর অভিযান এটা৷ জয়েন্ট টাস্ক মিলিটারি অপারেশন।
আভিয়ানের ঠিক পাশেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেনা অফিসার মেজর মেজবাহ ইফতেখার। তার হাতে একটা Beretta M9 সিরিজ। আভিয়ানের হাতেও একই জিনিস। আভিয়ানকে মেজবাহ ইফতেখার বললেন, “লেফটেন্যান্ট সাহেব, আমাদের এখন-ই ভেতরে যেতে হবে। আর ইউ রেডি?”

“ইয়েস মেজর, আ’ম রেডি।”

আভিয়ান এয়ারপিসটা মুখের কাছে ভালোভাবে টেনে এনে সকলের উদ্দেশ্যে বললো, “এভ্রিওয়ান, বি রেডি। উই হ্যাভ টু ইন-ফিল-ট্রেট দেয়ার পেরি-মিটার।”

“ইয়েস স্যার! উই আ’র রেডি!”

সবাই কমান্ড মান্য করে যে যার পজিশনে ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়ালো। আভিয়ান একবার তার পাশে অবস্থানরত সহকারীকে দেখলো। মেজর মেজবাহ ইফতেখার। তুখোর মেধাবী একজন আর্মাড অফিসার। যে কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না। মেজবাহ’র এই অবধি একটা মিশনও ফেইল হওয়ার রেকর্ড নেই। বরং, একাধিক মিশন জয়লাভ করার কারণে বীরত্বের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়েছে গতবছর। ছেলেটা আভিয়ানের বছরখানেকের জুনিয়র। এই অল্প বয়সেই সে কতকগুলো মিশন কমপ্লিট করায় দ্রুত পদোন্নতি করে মেজর মেজবাহ ইফতেখার হয়ে উঠেছে। যা দারুণ নজির বটে। ছেলেটা ভীষণ পরিশ্রমী, মেধাবী এবং তুখোর বিচক্ষণ একজন অফিসার। নচেৎ, এতো অল্প বয়সে কেউ এতোটা ওপরে উঠতে পারে না। আভিয়ান ওকে দেখে মুগ্ধ হয়। এতো ট্যালেন্টেড একটা ছেলে সিনিয়রদের যথেষ্ট সম্মান করতে জানে। আভিয়ান ওকে চেনে বছর দুয়েক আগে থেকে। একবার একটা সামরিক কাজে চাকরির সূত্রেই এখানে আসা হয়েছিল ওর। তখন কয়েকদিন এখানে থাকায় কনফারেন্স রুমে মেজবাহ’র সাথে পরিচয়। এরপরও ওদের কয়েকবার দেখা হয়েছে। যখনই দেখা হবে, তখনই মেজবাহ এগিয়ে এসে আগে ওকে সালাম দেবে। আসলেই ছেলেটা অলরাউন্ডার।
আজকের এই মিশনে আবারও মেজবাহ’র সাথে দেখা হয়ে যাবে—এই ব্যাপারটা আভিয়ান একদমই আশা-ই করেনি। ভেবেছিল, মেজবাহ’র হয়তো বদলি হয়ে গেছে। তবে শুনলো, এতো ভালো একজন অফিসারের এতো সহজে বদলি হচ্ছে না এখান থেকে। এখানকার অপকর্ম রোধ না করে যাচ্ছেও মেজবাহ।
আভিয়ানের অথোরিটি জরুরি ভিত্তিতে এখানকার সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের নিকটে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছেন। তারা-ই এই অভিযানে আভিয়ানের টিমকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনীকে পাঠিয়েছেন। তা-ও বাঘা বাঘা কয়েকজন অফিসারকে।
আভিয়ান সুযোগ বুঝে আরেকবার কমান্ড দেওয়া মাত্রই সকলে একে একে নিঃশব্দে সতর্ক পা ফেলে ভবনের দিকে এগোতে শুরু করলো। আভিয়ান আর মেজবাহ পাশাপাশি। অপর পাশে তাফসির এবং আরেকজন আর্মি আফিসার মেহেরান। আভিয়ান ওদেরকে চোখ দ্বারা ইশারা করতেই ওরা দু’জনে আস্তে-ধীরে ভবনের পেছন দিকে গিয়ে পজিশন নিলো। এমনটা করা হলো কারণ যাতে একটা অপরাধীও পালাতে না পারে। শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না রাখতে পারলে কখনোই শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব না। আভিয়ান মেজবাহকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ওদের পেছনে বাকি টিমমেটরা।
.
.
রানিয়ার আজ পরপর দু’বার বমি হয়েছে। ও এখনো হসপিটালে। বেডে শুয়ে আছে। ওর শাশুড়ি এখানে আসা সত্ত্বেও রানিয়াকে এখনো বাসায় নেননি তিনি। রানিয়ার শারীরিক অবস্থা হঠাৎ করেই প্রচন্ড খারাপ হতে শুরু করেছে। আশফি বেগম ডাক্তারের নিকট হতে প্রেগন্যান্সির খবরটা পেয়েছেন মাত্রই। তবে আনন্দিত আর হবেন কি! সেই সুযোগটাও পেলেন না তিনি। তার আগেই রানিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলো। বৌমার এই অবস্থা দেখে ভীষণ চিন্তিত হচ্ছেন আশফি বেগম। তার ছোট বোন আর ভাবি এসেছে সাথে। ছোট মামি নার্সের সাথে কথা বলছেন। ছোট মামা বাইরে বেরিয়েছেন কলা-রুটি আনতে। এখন এগুলো খাইয়ে রানিয়াকে মেডিসিন দিতে হবে। আর তারপর ইনজেকশন। ডাক্তার জানিয়েছেন, রানিয়ার প্রেশার বেড়ে গেছে। কোনোকিছু নিয়ে হয়তো অতিরিক্ত চাপ পরেছে মেয়েটার ওপর। তাই এমন অবস্থা। আশফি বেগম চুপ করে আছেন। কি বলবেন তিনি! খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন, তার বৌমা ঠিক কি নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পরেছে!
ছেলেটার কোনো খোঁজ-খবর নেই। তাফসির-ই তো তাকে এখানে পাঠিয়েছে রানিয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আভিয়ান তো রানিয়াকে এখানে নিয়ে এসেছিল। তাহলে হঠাৎ করে হসপিটাল থেকেই ছেলেটা তার কোথায় উধাও হয়ে গেল! আশফি বেগম নিজ ছেলেকে খুব ভালোভাবে চেনেন। নিশ্চয়ই কোনো একটা জরুরি কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। নাহলে রানিয়াকে এখানে রেখে হঠাৎ যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আভিয়ান গিয়েছেটা কোথায়! ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। রিং বাজছে, কিন্তু ফোন রিসিভ করছে না। এদিকে রানিয়া প্যানিকড হচ্ছে, তবু মুখ ফুটে স্পষ্টভাবে কিছু বলছে না। আশফি বেগম আরেকটিবার আশা ধরে গেলেন ছেলে-বৌর কাছে। রানিয়া তখন মাথা চেপে ধরে বসে ছিল। প্রচন্ড বমি পাচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে, এখুনি হড়হড় করে বমি করে দেবে এখন-ই। পেটের মধ্যে বাচ্চাটা লাথি দিচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে ওর৷ আদতে তা না। আসলে রানিয়ার আবারও ভ্রম হচ্ছে। আশফি বেগম ওকে ধরে রাখলেন। নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “বলো মা, আমার ছেলে কোথায় গেছে? তোমাকে তো নিশ্চয়ই বলে গেছে। বলো না মা, কোথায় গেছে আভিয়ান?”

“আপনার ছেলে, আপনার ছেলের বিপদ আম্মা। উনাকে নিয়ে আসেন। আমার কাছে নিয়ে আসেন—”

রানিয়া বিরবির করে বলতে লাগলো। তবে আশফি বেগমের তীক্ষ্ণ শ্রবণ ইন্দ্রিয় তা ভালোভাবেই শুনতে পেল। ছেলে অন্ত-প্রাণ তিনি আঁতকে উঠলেন তৎক্ষনাৎ। রানিয়াকে জড়িয়ে ধরে রেখে বললেন, “আমার ছেলের বিপদ মানে? কী হয়েছে ওর? কোথায় গেছে আভিয়ান?”

রানিয়া আর কোনো জবাব দিলো পারলো না। চুপ করে রইলো। ও নিজেও জানে না, আভিয়ান আসলে কোথায় গেছে। ছোট মামি এগিয়ে এসেছেন ধারে৷ সকলেই অনেক বেশি চিন্তিত। আশফি বেগম নিজেই অসুস্থ হয়ে পরেছেন। তিনি একটা চেয়ারে বসে দোয়া-দরুদ পরতে লাগলেন। হঠাৎ রানিয়ার ফোনে মেসেজের টিউন বেজে উঠলো। রানিয়া এতোক্ষণ পাগলের মতো করছিল। ফোনে মেসেজ এসেছে দেখে ভাবলো, বোধহয় আভিয়ানের কোনো খবর এসেছে। রানিয়া তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিলো। লক খুলে হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করতেই দেখলো, ওপরের কনভারসেশনে আভিয়ানের মেসেজ। রানিয়া মেসেজটা পড়তে শুরু করলো। মেসেজে লেখা — “রানিয়া, মেসেজটা আমি প্রচুর রিস্ক নিয়ে লিখছি। হঠাৎ মনে হলো, তোমাকে বলা উচিত। মেসেজটা লিখতে আমার এক মিনিট সময় লাগবে৷ আর এই এক মিনিট-ই আছে আমার হাতে। আমার ফিরে আসার নিশ্চয়তা খুবই কম। যদি আর ফিরে না আসি, তাহলে আমার সন্তানকে দেখে রেখো। ওকে আমার আদর্শে বড় কোরো। মেয়ে হলে ওকে আগলে রাখবে। নিরাপদে রাখবে। ওকে যেন কেউ ছুঁতেও না পারে। আর যদি ছেলে হয়, তাহলে আমার একটা কথা রাখবে। আমার স্বপ্ন, আমার ছেলে একজন আর্মি অফিসার হবে। সেই স্বপ্নটা পূরণ কোরো। তোমাকে ভীষণ —”

আভিয়ান আরো কিছু একটা লিখতে গিয়েছিল বোধহয়। কিন্তু লিখে উঠতে পারেনি। হয়তো বাঁধা পরেছে। রানিয়া একধ্যানে মেসেজটা পরলো। এরপর কিয়ৎক্ষণ অসাড় হয়ে বসে রইলো। পরমুহূর্তেই একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো রানিয়া।

চলবে

নোটবার্তা: আপনারা কি জানেন? আমি এই পর্বে আমার পরবর্তী গল্পের নায়কের কথা উল্লেখ করেছি? বলুন তো, তার নাম কি? দেখি, আপনারা কতোটা বিচক্ষণ!

আর… আভিয়ানকে কি করি দেখা যাক। মেরেও ফেলতে পারি।

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply