“নিজের স্যারের সাথে বিয়ে হওয়ার মতো জঘন্য কাজটা আমার সাথে হয়েছে। আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি বিষয়টা। আজ-ও মেনে নিতে পারি না। আর কোনোদিন এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভবও হবে না। একদিন না একদিন তো আমি ঠিকই উনাকে ডিভোর্স দেবো। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
“উনি তোমার কলেজের স্যার ছিলেন?”
“নাহ। উনি আমার ট্রেনিং অফিসার ছিলেন। আমি যখন এয়ার ফোর্সের জন্য ট্রেনিং নিয়েছিলাম, তখন থেকে উনাকে চিনি। বিয়ে কিভাবে হয়েছে, সেই ঘটনা আরেকদিন বলবো। তবে, আমি আমার পরিবারের মানুষদের কখনোই ক্ষমা করবো না। তারা জেনেশুনে অমন একজন গম্ভীর, রগচটা লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছে আমার। তাদের জন্যই সবকিছু হয়েছে। তাদের সবসময় ইচ্ছা ছিল, আমাকে এয়ার ফোর্সের অফিসার বানাবে। অথচ আমার স্বপ্ন ভিন্ন। তবুও তারা জোর করে আমাকে ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ায়। সেখানে যখন চান্স হলো না, তখন এয়ার ফোর্সে আবেদন করতে বলে। করলাম তাদের কথামতো আবেদন। টিকে গেলাম সেখানে। এরপর ট্রেনিং। ট্রেনিং ব্রাঞ্চের বাইরে হতেই একদিন উনার মা আমাকে দেখেছিলেন। এরপর আমার বাসায় প্রস্তাব পাঠানো। আর রাতারাতি দুই সপ্তাহের মাথায় বিয়ে। আমার পরিবারের তো এয়ার ফোর্সের অফিসার খুবই পছন্দ। ছেলের পেশা যখন তাই-ই, তখন না করে কীভাবে? যাইহোক, বিয়েটা হুটহাট হয়ে গেল। এরপর তো আরো কতকিছু হলো আমার সাথে। সে এক বিশাল কাহিনী। আরেকদিন বলবো তোমাকে।”
রানিয়া উঠে দাঁড়িয়ে সাইড ব্যাগটা কাঁধে নিলো। টেবিলে তখনও ওর নতুন বান্ধবী মিশা বসে আছে। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছে মেয়েটা। মিশা উদ্বিগ্ন হয়ে রানিয়াকে বললো, “আরো কিছুক্ষণ বসে যাও। মাত্র তো এলে।”
“না মিশা। আজ সময় নেই। বাসায় মেহমান আসবেন সন্ধ্যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বোঝোই তো।”
মিশা রানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বড্ড বেজার গলায় বললো, “তোমার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে রানিয়া। এতোটুকু মেয়ে তুমি। সবে বয়স একুশ। এই বয়সে এটুকু একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিতে হলো পরিবারের চাপে পড়ে। তারওপর ট্রেনিংও ছেড়ে দিলে এসবের চক্করে।”
“ও নিয়ে আমার দুঃখ নেই মিশা। বরং খুব খুশিই হয়েছি। আমার স্বপ্ন অন্যকিছু। এয়ার ফোর্সে জব করার ইচ্ছা কখনোই ছিল না। সেই হিসেবে আমি ভীষণ খুশি।”
“তা তোমার হাসবেন্ডের বয়স কত?”
“আঠাশ-ঊনত্রিশ হবে।”
“নাম কী তার? কোন সেক্টরে?”
“শাহ আহমেদ আভিয়ান। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অব এয়ার ডিফেন্স এন্ড ওয়েপন কন্ট্রোল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স, সিলেট।”
“তারমানে তোমার হাসবেন্ড সিলেটে থাকছেন আর তুমি এখানে?”
“হ্যাঁ।”
“বিয়ের তিনমাস পরেও তোমরা আলাদা থাকছো? কথা হয় না তোমাদের?”
“তার ফোন নাম্বার, ফেসবুক আইডি, ইনস্টা আইডি, হোয়াটসঅ্যাপ — সবই আছে আমার কাছে। আমার ফোন নাম্বারও তার কাছে আছে। কিন্তু আমাদের কখনো কথাবার্তা হয় না। আমরা আর পাঁচটা স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মতো হতে পারিনি।”
কথা বলতে বলতে রানিয়ার চোখের কোণে জল আসলো। ও সেটা লুকিয়ে মুচকি হেঁসে মিশাকে বিদায় জানিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পরলো। একটা রিকশা নিলো ক্যাফের সামনে থেকে। আজ ঢাকা শহরে অন্যদিনের তুলনায় বড্ড বেশি যানজট। এই যানজট কাটিয়ে ওর আবার সাড়ে চারটার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে। শ্বশুরবাড়ি ওর ঢাকাতেই। তবে এলাকা ভিন্ন। কয়েক কিলোমিটারের তফাৎ। রানিয়ার শ্বশুরবাড়িতে নাকি আজ তার খালা শাশুড়ি বেড়াতে এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। রানিয়াকে দেখতে চাইছেন তিনি। যেহেতু এখনো আয়োজন করে শ্বশুরবাড়িতে তোলা হয়নি রানিয়াকে, তাই ও বাপের বাড়িতেই থাকছে। আজ সেখানে আসবেন ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বাসায় ফিরে তাদের অ্যাপায়নের ব্যবস্থা করতে হবে তো! মা’কে কাজে সাহায্য করতে হবে। বাসায় মানুষজন বলতে, বাবা আর ছোট ভাইটা। মা একা সব কাজ করে উঠতে পারবেন না।
.
.
রানিয়ার আজ সারাটা দিন বেশ ধকলের ওপরে গিয়েছে। তারওপর সন্ধ্যায় আরেকটা ফাঁড়া গেল। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তো আসার পর থেকে ওকে কাছছাড়া করতেই চাইছিল না। রানিয়ার শাশুড়ি মানুষটা বেশ ভালো। রানিয়া আপেল খেতে পছন্দ করে বলে ওর জন্য অন্যান্য উপঢৌকনের সাথে আপেলও মনে করে কতগুলো এনেছিলেন৷ তারা চলে যাওয়ার পরে নিজ ঘরে বসে এখন সেই আপেল খাচ্ছে রানিয়া। ওর মস্তিষ্কে এখন অনেককিছু চলছে। রানিয়ার শাশুড়ি বলে গেছেন, ওকে কিছুদিনের মধ্যেই ওই বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাবেন। অথচ রানিয়া এদিকে ডিভোর্সের পরিকল্পনা করছে! কিন্তু ডিভোর্সটা দেওয়া যায় কিভাবে? কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না রানিয়া। যা করার ওই বাসায় যাওয়ার আগেই করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে বললে কি আভিয়ান ডিভোর্সের বিষয়ে রাজি হয়ে যাবে? লোকটা সম্পর্কে যতোটুকু ধারণা আছে, তাতে রানিয়ার মনে হচ্ছে না, ডিভোর্স মেনে নেবে সে। তার আবার রেপুটেশন নিয়ে চিন্তা অনেক। ডিভোর্সি তকমা নিশ্চয়ই পেতে চাইবে না। একারণে হলেও রানিয়াকে ছাড়বে না লোকটা। নাহলে সম্পর্কের কোনো সুরাহা না হওয়ার কারণে এতোদিনে তো ছেড়েই দিতো। রানিয়া আপেল খেতে খেতে অনেকক্ষণ ভাবলো। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি আসলো। চট করে লাফিয়ে উঠলো ও। দ্রুত আলমারি খুলে ছোট একটা বক্স হতে সিম বের করলো। রানিয়া সিমটা ফোনে ঢুকিয়ে আভিয়ানের নাম্বার ডায়াল করলো। এই প্রথম, বৈবাহিক জীবন শুরু হওয়ার পরে এই প্রথম লেফটেন্যান্ট সাহেবকে কল দিচ্ছে রানিয়া। রিং হলো দু’বার। রিং হয়ে কল কেটে গেল। কি ব্যাপার? অপরিচিত নাম্বার দেখে কি কল রিসিভ করছে না? ভারী মুশকিল তো! রানিয়া একরাশ আশা-ভরসা নিয়ে তৃতীয়বার কল দিলো। এবার কল রিসিভ হলো। ও অপ্রস্তুত হয়ে ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটি গম্ভীর কন্ঠস্বর “হ্যালো” বলে উঠলো। এই গাঢ়, গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে রানিয়া আরো বেশি ঘাবড়ে গেল। এতোটা ঘাবড়ে যেতো ও ট্রেনিং সেন্টারে, যখন আভিয়ান স্যার ট্রেনিং করাতো। লোকটার ভয়ে সবসময় তটস্থ হয়ে থাকতে হতো। আভিয়ান স্যার হলেন, অতিরিক্ত ডিসেন্ট আর স্ট্রিক্ট লোক। আভিয়ানের সাথে কথা বলতেও ভয় লাগতো সবার। না পারতে কেউ একটা টুঁশব্দও করতো না। সেই লোকের সাথে কিনা রানিয়া আজ অপরিচিতের ন্যায় একটা জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছে! রানিয়া নিজেকে সামলে, শান্ত করে রুমালটা আরো ভালো করে মুখে চাপা দিয়ে বললো, “হ্যালো, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শাহ আহমেদ আভিয়ান বলছেন?”
“ইয়েস। হু আর ইউ?”
“রানিয়া মাহমুদাকে চিনেন নিশ্চয়ই? আপনার ওয়াইফ তাইনা?”
“ইয়েস। বাট হু আর ইউ? অ্যান্ড হোয়াই আর ইউ টকিং টু মি অ্যাবাউট হার? কে হন আপনি তার? আমার পার্সোনাল ফোন নাম্বার-ই বা কোথা থেকে পেলেন?”
শেষোক্ত কথাটা একটু কঠিন শোনালো৷ ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি কি রেগে গেছে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কন্ঠস্বর কেমন জানি। রানিয়ার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে স্থির হয়ে ও গলার স্বর আবারও ভিন্নরকম করে জবাব দিলো, “আপনি আমাকে চিনবেন না মিস্টার। তবে ধরে নিন, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনাকে কল দেওয়ার কারণ আছে। এক্সুয়ালি একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলার ছিল।”
“কী কথা?”
ফোনকলের মধ্যেও রানিয়া বুঝতে পারছে, ফোনের ওপাশের ব্যক্তি তার সেই বিখ্যাত ভ্রু কুঁচকানো প্রতিক্রিয়ার সহিত প্রশ্নটা করেছে। রানিয়া রুমালটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে রেখে জবাব দিলো, “আপনার ওয়াইফ রানিয়া, সে যে আপনার অনুপস্থিতিতে অন্য একটা ছেলে নিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে আপনার? আরে, আপনার ওয়াইফ তো আপনাকে ভালোবাসে না। অন্য আরেকটা ছেলেকে ভালোবাসে।”
“প্রমাণ?”
রানিয়া আভিয়ানের নিকট হতে আরো বেশি প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল এই বো’মা বিস্ফো’রণের পরে। কিন্তু নিজের কথার বিপরীতে এমন স্বাভাবিক প্রশ্ন পেয়ে আশ্চর্য হলো ও। লোকটা এখনো এতোটা শান্ত আছে কিভাবে! তা-ও এমন সেনসেটিভ কথা শোনার পরেও! রানিয়া কাঁপা স্বরে জবাব দিলো— “প্রমাণ. . . প্রমাণ সে তো আছেই। অবশ্যই আছে। একদম পাকাপোক্ত প্রমাণ।”
“রানিয়া মাহমুদা!”
“জি?”
আভিয়ানের রূঢ় কন্ঠস্বরে নিজের নামটা শোনামাত্র চমকে উঠলো রানিয়া। ভয় পেয়ে শুকনো ঢোক গিললো একটা। ওকে আরো ভয় পাইয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শাহ আহমেদ আভিয়ান কর্কশ স্বরে বলে উঠলো— “ইয়ার্কি হচ্ছে? ফাজলামি শুরু করেছো তুমি আমার সাথে? কী মনে করেছো হ্যাঁ? মুখে রুমাল চেপে ধরে ভয়েস চেঞ্জ করলে তোমাকে চিনতে পারবো না আমি? নিজের মতো বোকা ভাবো সবাইকে? একবার শুধু ঢাকায় আসতে দাও আমাকে। এসে তোমার এসব ইয়ার্কি ছুটিয়ে দেবো। আমাকে এখনো চিনতে পারোনি তুমি! ফোন রাখো ইডিয়ট!”
চলবে
গল্পের নাম— #উড়ালমেঘেরভেলায় [সূচনা পর্ব]
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
[নতুন গল্প এটা গল্পের সমাপ্তি হ্যাপি এন্ডিং হবে এবং সম্পূর্ণ গল্প ফেসবুকেই দেওয়া হবে। নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন। এটা সম্পূর্ণ রোমান্টিক একটা গল্প। আপনারা রেসপন্স করবেন প্লিজ। নিয়মিত আসবে গল্পটা।]
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৪
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৭
-
উড়াল মেঘের ভেলায় গল্পের লিংক
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৯
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৩
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১০