Golpo romantic golpo উড়াল মেঘের ভেলায়

উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৮


উড়ালমেঘেরভেলায়

লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক

পর্ব_১৮

[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]

রানিয়ার জ্ঞান ফিরেছে সবেমাত্র। ক্লান্তি জেঁকে বসেছে বেশ। শরীর বেশ দুর্বল লাগছে। পিঠে বেশ টনটনে নীলাভ ব্যাথা। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত ক্রমশই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে বলে বোধ হলো ওর। শরীর পুরো ঘেমে-নেয়ে একাকার। অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার জন্য এবং দুশ্চিন্তা করার কারণেই এই অবস্থা। ওর যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন চোখ খুলে একবার দেখেছিল, আভিয়ান বুকে হাত গুঁজে বসে আছে ওর সামনে৷ পাশে আরো কারা যেন ছিল। রানিয়াকে চোখ খুলতে দেখে আভিয়ান উঠে চলে গেল ঘরের বাইরে। এরপর রানিয়া পুনরায় চোখ বুঁজে শুয়ে ছিল৷ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতেই দেখলো, বিছানার ওপরে ওর পাশে ওর ননদেরা, হিয়া, কাশেম নানার নাত বৌ, নানিবু, মামি বসে আছেন। রানিয়াকে উঠতে দেখে তারা তড়িঘড়ি করে ধরে আস্তে-ধীরে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন ওকে। নানিবু একগাল হেঁসে ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হইসিলো গো নাত বৌ? অমনে চেঁচাইলা ক্যান?”

নানিবুর প্রশ্ন শুনে রানিয়ার তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে গেল কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা। চোখে-মুখে আতঙ্ক ফিরে এলো আবারও। ও আতঙ্কিত স্বরেই বললো, “সাপটা—”

“কোনো সাপ নাই গো। সব তোমার মনের ভুল।”

রানিয়াকে থামিয়ে দিয়ে কথাটা বললেন নানিবু৷ রানিয়া তবু বিশ্বাস করলো না। ওর পায়ের যেই স্থানে কামড় অনুভব করেছিল, সেখানে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো, “এইযে এই দেখুন—”

কিন্তু দেখা গেল, সেখানে কামড় কেন অন্য কোনো দাগের চিহ্নই নেই৷ রানিয়া অবাক হলো এবেলায়৷ নানিবু এবার বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সেই ঘরেরই মেঝে থেকে একটা রাবারের চিকন পাইপ তুলে রানিয়ার সামনে ধরে একগাল হেঁসে বললেন, “এইযে, এডা তোমার সাপ।”

সঙ্গে সঙ্গে ঘরময় হাসির রোল পরলো। রানিয়া হতবিহ্বল হলো। আবার লজ্জাও পেল বেশ। তাহলে শেষমেশ কিনা ও পাইপকে সাপ ভেবে ভুল করেছে! ছিছি! এর চাইতে লজ্জার আর কি হতে পারে! তবু রানিয়ার মনের দ্বিধা কাটলো না৷ ও উদ্বিগ্ন গলায় নানিবু’কে প্রশ্ন করলো, “তাহলে পায়ের কামড়টা?”

“কই কামড়? দেহাও দেহি।”

মূলত রানিয়ার মনের ভুল দূর করতেই নানিবু ওর পায়ের কাছে সবজায়গায় ভালোভাবে দেখলেন। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। তিনি ওকে আশ্বস্ত করে বললেন, “সব তোমার মনের ভুল ছিল বৌ। আমাগো এইনে কোনো বিষাক্ত সাপ তো দূর, নিরীহ সাপও নেই। হ, এক আছে জলঢোরা, তাও থাকে পানিতে৷ ওরা নিতান্তই নিরীহ। মাইনষেরে কামড় দেওয়া দূর, মনিষ্যি দেখলেই দশ হাত দূর থাইকা দৌড়ায়৷”

কথাটা বলে গাল পেড়ে হাসলেন তিনি। তার কথা শুনে রানিয়ার মনের শঙ্কা দূর হলো এবার৷ একটু আগে তো ভয়েই মূর্ছা গিয়েছিল৷ ভয়টা মূলত ওর সন্তানকে নিয়েই ছিল৷ যদি সাপের কামড়ে বাচ্চার কিছু হয়ে যেতো? তখন এই ভয় ছিল ওর মনে। বাচ্চার ব্যাপারে বড্ড বেশি সেনসেটিভ রানিয়া।

নানিবু বিছানা থেকে উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমার জন্য এক গেলাস গরম দুধ জাল দিয়ে আনি। তোমার শরীরডা অনেক দুর্বল। তোমার স্বামী তো তোমারে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি জেদ আর তোড়জোড় শুরু করসিল। আমরাই তারে শান্ত করলাম।”

রানিয়া মনে মনে বিরবির করলো, “যাক বাবা, বেঁচে গেছি!”

নানিবু তার বড় বৌমাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন৷ যাওয়ার আগে সবাইকে রানিয়ার খেয়াল রাখতে বলে গেলেন। সবাই রানিয়ার সাথেই বসে ছিল। রানিয়ার শরীর বড্ড দুর্বল লাগছে। অতিরিক্ত স্ট্রেস নেওয়া হয়ে গেছে। উঠে বসতেই পারছে না ও৷ চারিদিকে অন্ধকার দেখছে যেন। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। জোর পাচ্ছে না খুব বেশি। ও অসহায় মুখ করে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাগুলো ওর জাগ্রত মস্তিষ্কে স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। ভ্রমের কারণে রাবারের পাইপকে সাপ ভেবে ভুল করে বসেছিল ও। আর তার থেকেও বড় ভুল করেছে, আতঙ্কের কারণে মুখ ফসকে বাচ্চার কথা বলে ফেলে। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে, জ্ঞান হারানোর পূর্বে আভিয়ানের চোখে-মুখে দেখা সেই কৌতূহল। বাচ্চার কথা শুনে আভিয়ান ভ্রু কুঁচকে ফেলেছিল। আদতে কি ভেবেছিল কে জানে! রানিয়া মনে মনে শঙ্কিত হলো খুব। আভিয়ান যদি পরবর্তীতে ওকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে, তখন কি জবাব দেবে ও! রানিয়ার মনের শঙ্কা বোধহয় সত্যি হওয়ার-ই ছিল৷ অন্তত আভিয়ানের মতো তুখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি সামান্য একটা কথাও আমলে নেবেই। এ নিয়ে রানিয়াকে প্রশ্ন করতেও ছাড়বে না। রানিয়া মনে মনে ভেবে নিলো, ক’টা দিন ও আভিয়ানের কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে। এরপর ক’দিনের মধ্যে আভিয়ান সেসব কথাগুলো ভুলে গেলে তবেই ওর মুখোমুখি হবে। ও পাশে তাকিয়ে দেখলো, হিয়া ফোন স্ক্রল করছে। আলিশা আর মাইশা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে। বড় মামার বৌমা মাত্র ঘর থেকে বের হলেন। রানিয়া উঠে বাইরে যেতে চাইলো। তখনই দেখলো, দরজার সামনে আভিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। সাক্ষাৎ মূর্তমান। মাত্রই লোকটার কথা ভাবছিল রানিয়া। ও ধীরে ধীরে মুখ তুলে আভিয়ানের মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো যেন। মুখটা কেমন গম্ভীর, থমথমে। যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। নাহ, লোকটা ঠিক রেগেও নেই। বরং, কোনোকিছু নিয়ে সন্দিহান রয়েছে বোধহয়। মুখ দেখে তো তেমনই মনে হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে চরম আতঙ্ক গজিয়ে উঠলো রানিয়ার। সেই আতঙ্ক ওর চোখে-মুখেও ফুটে উঠলো দারুণভাবে। তবে, সহজেই ধরা পরার ভয়ে মুখের ভাবভঙ্গি যথাযথ চেষ্টায় স্বাভাবিক করে নিলো ও। বিছানা থেকে নামতে যাবে তাড়াহুড়োয়, তখনই আভিয়ান ঘরের ভেতরে থাকা সবাইকে গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিলো, বাইরে যাওয়ার জন্য। আভিয়ান বলামাত্রই সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল চটপট। ওদেরকে বেরিয়ে যেতে দেখে একা এই ঘরে আভিয়ানের মুখোমুখি হওয়ার কথা কল্পনা করে পুনরায় রানিয়ার আতঙ্কটা জেগে উঠলো। ও আভিয়ানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আভিয়ান সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতের কব্জি চেপে ধরে থামিয়ে দিলো। রানিয়ার বুক ধ্বক করে উঠলো। আজ ওকে কেউ বাঁচাতে পারবে না বোধহয়। ধরা পড়েই যাবে মনে হচ্ছে!
রানিয়াকে টেনে সামনে নিয়ে আসলো আভিয়ান। ওর বাহু টেনে ধরে সোজা দাঁড় করালো নিজের মুখোমুখি। এরপর ওর চোখে চোখ রাখলো। রানিয়ার চোখ কাঁপতে লাগলো। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। মাথা নত করে ফেললো। আভিয়ান প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাচ্ছো কোথায়?”

“কোথাও না, এমনি আরকি।”

“কোথাও না? তাহলে নামলে কেন বিছানা থেকে?”

“এমনি মানে—”

রানিয়া আমতা আমতা করতে লাগলো। সঠিক কোনো জবাব দিতে পারলো না। আভিয়ান তখন ওকে বিছানায় টেনে নিয়ে বসালো। নিজে ওর সামনে বসলো। এমনভাবে বসলো, যেন কোনো গুরুতর আলোচনা করবে। রানিয়া অপ্রস্তুত হলো। অস্থিরতায় জিভ দ্বারা ঠোঁট ভেজালো। আভিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, “তোমাকে হঠাৎ এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন? কারণ কী?”

“কই না তো।”

রানিয়া ঘনঘন মাথা নেড়ে না বোঝানোর চেষ্টা করলেও ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট উদ্বিগ্নতা টের পাওয়া যাচ্ছে। আভিয়ান সেটা লক্ষ্য করে কেমন ক্রুরভাবে হাসলো যেন। রানিয়া ওর ওই হাসি দেখে নড়েচড়ে বসলো। আভিয়ান হঠাৎ করে বলে উঠলো, “তো মিসেস রানিয়া মাহমুদা, তখন কি যেন বলছিলে?”

“কী বলছিলাম?”

রানিয়া বুঝতে পেরেছে, আভিয়ান ঠিক কি বিষয়ে প্রশ্ন করছে। তবু এড়িয়ে যাওয়ার জন্য না বোঝার ভান ধরলো ও। আভিয়ান এবার ওর হাতের বাহু দু’টো একটু শক্তভাবে ধরে গম্ভীর গলায় বললো, “ড্রামা আমার সাথে কোরো না, ওকে?”

“কই? কোনো ড্রামা করছি না তো!”

“উফ রানিয়া! তুমি কি তোমার মতো বোকা মনে করো সবাইকে?”

রানিয়া কোনো জবাব দিলো না। ভ্রু কুঁচকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আভিয়ানের দিকে। আভিয়ান ওকে এবার কঠোরভাবে জিজ্ঞাসা করলো, “কী বলছিলে তখন? বলো আবার।”

রানিয়া কোনো জবাব দিতে পারলো না৷ চুপসে গেল একেবারে। আভিয়ান ওর কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে পুনরায় বললো, “বলো রানিয়া। চুপ করে আছো কেন?”

রানিয়াকে এযাত্রায় বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্যই বোধহয় তখন ঘরে নানিবু আসলেন। তার হাতে দুধের গ্লাস। তাকে দেখে আভিয়ান রানিয়ার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে বসলো। নানিবু এগিয়ে গিয়ে দুধের গ্লাসটা আভিয়ানের হাতে দিয়ে বললেন, “এই নাও নাতিন, নাতবৌর লাইজ্ঞা দুধ গরম করে আনছি৷ তারে এইডা পুরো গেলাস খাওয়ায় দাও।”

আভিয়ান মৃদু হেঁসে জবাব দিলো, “আচ্ছা, খাইয়ে দিচ্ছি।”

নানিবু ঘর থেকে যেতেই আভিয়ান উঠে গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে এসে বসলো। রানিয়ার হাতে দুধের গ্লাস দিয়ে বললো, “পুরোটা খেয়ে শেষ করো।”

রানিয়া অনিচ্ছা স্বত্তেও সম্পূর্ণ গ্লাসের দুধটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে শেষ করলো। আভিয়ান এবার সোজা হয়ে বসলো ওর সামনে। শার্টের কলার টেনে সোজা করতে করতর আচনক বলে উঠলো, “দুপুরের খাবার খেয়ে রেডি হয়ে থাকবে।”

“কেন?”

রানিয়া ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করতেই আভিয়ান গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো, “তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।”

“হসপিটাল! কেন?”

ক্ষণিকের জন্য রানিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। আভিয়ান ওর প্রতিক্রিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করলো। বললো, “তোমার শরীর অনেক দুর্বল। ইমিডিয়েট হসপিটালে যাওয়া দরকার। কিছু চেক-আপ করাতে হবে।”

“হু?!”

এই শীতল দিনেও রানিয়া ঘামতে শুরু করলো। মুখ নীলবর্ণ ধারণ করলো ভয়ে। আভিয়ান ওর এহেন অবস্থা দেখে কপট হেঁসে বললো, “কী হলো? ভয় পেলে মিসেস রানিয়া মাহমুদা? ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। জাস্ট কিছু চেক-আপ করানো হবে!”

চলবে

🔹 আজকের পর্ব ছোট দিয়েছি কেন— এই নিয়ে কোনো কথা যেন না শুনি। যে বলবে, তাকে ব্লক দিবো। আমার মনের পরিস্থিতি ভালো নেই, তাই এটুকু পর্ব। আর এজন্যই লিখতে দেরি হয়েছে। ক্ষমাপ্রার্থী। সবাই দোয়া করবেন, আমি যা চাই; আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাকে তাই পাইয়ে দেন।

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply