উড়ালমেঘেরভেলায়
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
পর্ব_১৭
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সবাই এই পর্বটা পড়ুন। এটাই ১৭ নাম্বার পর্ব।]
কাশেম নানাদের বাড়ির উঠানে বড় বড় চারটা পাটি বিছিয়ে পুরো উঠোন ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে ছাউনি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন, শিশির পরে ঠান্ডা না লাগে। এখনো চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা। দূরে ধানক্ষেতগুলোর দিকে তাকালে শুধু কুয়াশা দেখা যায়। ঠান্ডাটা আজ মধ্যম পর্যায়ে আছে। গ্রামাঞ্চলে কুয়াশা কাটিয়ে আলো উঠতেই সকাল দশটা বেজে যায়। শহরে অবিশ্যি কুয়াশা বেশিক্ষণ থাকে না।
রানিয়ারা পাটির ওপরে একটা তোশক বিছিয়ে বসে আছে। ওদের পেছনে সারি সারি কতগুলো কোলবালিশ, যেন তাতে হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে পারে।
ওদিকে কাশেম নানার বউ আকলিমা খাতুন, যাকে সবাই নানিবু বলে ডাকে; তিনি গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী গোলপাতার ছাউনি আর বেতের বেঁড়া দ্বারা তৈরি পাকঘরে বসে পিঠা বানাচ্ছেন। তার সাথে সাহায্য করার জন্য আছেন, তার বড় বৌমা আর নাত বৌ। ছোট বৌমা আর তার মেয়ে-ছেলে বাইরে তদারকি করছেন। কারো কিছু লাগবে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখছেন। সবার যত্ন-আত্তিতে ব্যস্ত তারা৷ রানিয়াদের সাথে বড় মামার বৌমা, আর তার এক বোনও এসেছেন এখানে। আরো কয়েকজন মেয়েরা নাকি আসছে।
রানিয়ার মনটা সেই কখন থেকে ছটফট করছে। হিয়া মেয়েটাকে দেখার পর থেকে ওর একটুও ভালো লাগছে না। মনটা শুধু কু গাইছে ক্ষণে ক্ষণে। পাশে বসে আলিশা, মাইশা আর হিয়া ফোনে লুডু খেলছে। রানিয়ার ইচ্ছা ছিল না, তাই ও খেলছে না৷ তবে বসে বসে ওদের খেলা দেখছে খু্ব মনোযোগ সহকারে। তবু এর মাঝে কিছুক্ষণ পরপর ধ্যান সেই ভোরের নাস্তা করার সময়কার ঘটনার দিকে যাচ্ছে। মনে পরছে, কিভাবে ওই রিনি মেয়েটি আভিয়ানের সাথে ন্যাকা ন্যাকা কথা বলছিল! অমন ন্যাকা কথা বলার অধিকার বুঝি ওই মেয়ের? অথচ রানিয়া যদ্দুর জানে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পুরুষের সাথেই অমন ন্যাকা হওয়া যায়। তাহলে এ কোথাকার কোন প্রাণী উড়ে এসে জুড়ে বসলো? আর আভিয়ানও বা কেমন লোক? নিশ্চয়ই তার চরিত্রে সমস্যা আছে। নাহলে তো ওই মেয়ে পানির বোতল চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে বোতল এগিয়ে দেবে না! কই? রানিয়ার সাথে তো এতটা সহমর্মি নয় আভিয়ান। একমাত্র রাত বাদে কখনোই ওর খেয়াল রাখে না, ওর দিকে নজরও দেয় না। তবে ওই মেয়ের জন্য কেন? পুরোনো প্রেম জেগে উঠলো নাকি ওয়েস্টার্ন পরা ঢঙীকে দেখে?
ভাবলেই রানিয়ার মনে মনে রাগ হলো ভীষণ। জেদ বাড়লো ওর। সবকিছু অসহ্যকর লাগতে শুরু করলো হঠাৎ করে। তারওপর প্রেগন্যান্সির প্রভাবে ক্ষণে ক্ষণে মুড সুইং হতে লাগলো ওর। রাগটা মূলত ওই রিনি আর আভিয়ানের ওপরেই।
রানিয়া এসব নিয়েই ভাবছিল; তখনই দেখলো, দূরে ধানক্ষেতের আঁইল ধরে এগিয়ে আসছে রিনি নামক সেই মেয়েটি। পায়ে তার আবার পেন্সিল হিল।
কাশেম নানাদের বাড়ির চারপাশে গোলপাতার বেঁড়া দেওয়া। বাড়ির ভেতরে আসার পথের মুখটা সেই ধানক্ষেতের সোজাসুজিই।
রিনির সাথে বড় মামার মেয়ে ইশিতাও আছে। ইশিতারও খালাতো বোন রিনি। অথচ দেখলে বোঝাই যায় না। পোশাক-আশাকের আকাশ-পাতাল তফাৎ ওদের। দেখতে দেখতে রিনি চলে আসলো এই বাড়ির ভেতরে। রানিয়া আলিশাকে খোঁচা মেরে বললো, “এই মেয়ে এখানে এসেছে কেন রে আলিশা? এর কী কাজ এখানে?”
আলিশারা লুডু খেলায় মগ্ন ছিল৷ চারপাশে কোথায় কি হচ্ছে, সেইদিকে এতোক্ষণ কোনো খেয়াল-ই ছিল না ওদের। রানিয়ার কথা শুনে খেলা ছেড়ে সামনে তাকালো ওরা। রিনিকে আসতে দেখে বুঝলো, ওদের ভাবি এমন প্রশ্ন কেন করছে। ওরা কোনো জবাব দিতে যাবে, তার আগেই বাড়ির পেছন দিক থেকে আভিয়ানদের আসতে দেখা গেল। সাথে আছে— কাশেম নানার নাতি, বড় মামার ছেলে, কাঁকনসহ আরো কয়েকজন। আভিয়ানের হাতে কতগুলো ডাব। বাকিদের হাতেও রয়েছে। বাড়ির পেছনে সম্ভবত নারিকেল গাছ। সেখান থেকেই ডাব পেড়ে এনেছে ওরা। রানিয়াদের আগেই নিশ্চয়ই আভিয়ানরা এখানে এসেছে। এজন্যই তো খাওয়ার পরে আভিয়ানকে আর দেখতে পায়নি ও।
রানিয়া এবার একবার আভিয়ানকে দেখে, আরেকবার রিনিকে দেখলো। এরপর ও বুঝে গেল, রিনি এখানে কেন আসতে পারে। খুব সম্ভবত ওর ধারণা ভুল হবে না।
ঠিক তাই-ই হলো। রানিয়ার আন্দাজ সঠিক নিশানায় গিয়ে লাগলো। ওদেরকে ডিঙিয়ে রিনি পেছনে আভিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভরা মজলিসে বলে উঠলো, “কোথায় ছিলে ম্যান? তোমাকে কতক্ষণ যাবত খুঁজছিলাম জানো?”
আভিয়ান কোনো জবাব দেওয়ার আগেই পাশ থেকে কাশেম নানার নাতি ইরফান বলে উঠলো, “আমরা তো পেছনের বাগানে গেছিলাম ডাব পাড়তে৷ তো তুমি এনে ক্যা? ওইনে যেয়ে বসো। নানিবু পিঠা বানাচ্ছে, খেয়ি যেও।”
রিনিকে আর কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। ইতিমধ্যেই ইরফানের বউ এসে জোরপূর্বক রিনিকে টেনে এনে আসরের মাঝে বসিয়ে দিলো। রিনি আভিয়ানের সাথে কথা বলার নিমেষ মাত্র পেল না৷ রানিয়া বিরবির করে বললো, “বিবাহিত পুরুষ মানুষের সাথে বাইরের মেয়েমানুষের এতো কিসের কথা, বুঝি না বাপু!”
মাইশা পাশ থেকে ওর এই কথা শুনলো৷ ওর ভাবী যে যারপরনাই খুব রেগে আছে, সেটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ওরা৷ তবু সাহস জুগিয়ে মাইশা বললো, “রিনি আপি হয়তো ভাইয়ার বিয়ের কথা জানে না ভাবী।”
রানিয়া পাশ থেকে দাঁতে দাঁত পিষে জবাব দিলো, ”জানে না কে বলেছে তোমাকে? তোমাদের মতো বোকার হদ্দ নই আমি৷ আমার যেই অন্তর্দৃষ্টি, তা তোমাদের নেই। শুরুতেই খুব ভালোভাবে খেয়াল করেছিলাম, আভিয়ান যখন আমার প্লেটে খাবার তুলে দিলেন; তারপর থেকেই রিনি মেয়েটা আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল বারবার। সবার কথাবার্তা শুনে নিশ্চয়ই বুঝেছে, আমি আভিয়ানের ওয়াইফ। তবু ইচ্ছা করে বারবার তার কাছ ঘেঁষছে৷ ন্যাকা সাজছে!”
রানিয়ার রাগটা এই পর্যায়ে এসে আরো বেশি বেড়ে গেল৷ আর ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারলো না ও। আভিয়ানরা তখন পুকুর ঘাটে নেমেছে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য। রানিয়া পুকুরের পাড়ে গিয়ে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে কটমট চোখে দেখতে লাগলো ওকে। মনে মনে ভেবে নিলো, এই বিষয় নিয়ে আভিয়ানকে কিছু একটা বলেই ছাড়বে!
তবে রানিয়া ওকে কিছু বলার সেই সুযোগটাই পাচ্ছে না। আভিয়ানের সাথে সাথে সর্বক্ষণ কেউ না কেউ আছে। লোকটার মাঝে সকলে কি পায় কে জানে! তার সঙ্গ কেউ ছাড়তেই চায় না। রানিয়া হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত পুনরায় এসে আসরের মাঝে বসেছিল সবে। তখনই খেয়াল করলো, আভিয়ান ফোনে কথা বলতে বলতে কাশেম নানাদের ঘরের ভেতরের যেই ছোট্ট ঘরটি আছে, সেদিকে যাচ্ছে। রানিয়াও উঠে গেল সেদিকে। আভিয়ানের সাথে একাকী কথা বলতে হবে এই ব্যাপারে। সবার সামনে তো আর বলা যায় না। তাছাড়াও, এমন সুযোগ আর কখন পাবে, তা জানা নেই রানিয়ার। তাই ও হাতছাড়া করতে চাইলো না।
ছোটঘরে প্রবেশ করে দেখলো আভিয়ান পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। রানিয়া একবার দরজার বাইরে উঁকি মেরে দেখলো, সবাই গল্প করতে, বিভিন্ন কাজে মগ্ন। এদিকে কারো খেয়াল নেই৷ রানিয়া সন্তর্পণে দরজার কপাট দু’টো আঁটকে খিল টেনে দিলো। আওয়াজ হতেই আভিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। দেখলো, রানিয়া ওর সামনে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। এতো সময় ওকে অগোচরে কয়েকবার খেয়াল করেছে আভিয়ান৷ তবে মানুষজন থাকায় ওর কাছে যেয়ে কথাবার্তা বলা হয়নি আর৷ এখন ওকে একা পেয়ে ভালোই হয়েছে মনে করে এগিয়ে গিয়ে রানিয়ার কাঁধে হাত রাখা মাত্রই ও এক ঝটকায় আভিয়ানের হাত সরিয়ে দিলো নিজের কাঁধ থেকে। তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বিরবির করে বললো, “পরনারীর সাথে ঘষাঘষি করে এসে এখন আবার আমার কাছে আসা হচ্ছে!”
আভিয়ান ঠিকমতো শুনতে পেল না ওর কথা। কারণ, ওর কানে তখন হেডফোন লাগানো ছিল। আভিয়ান সেটা খুলে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “কিছু বললে?”
রানিয়া পুনরায় বিরবির করলো, “বলার মতো আর কিছু বাকি আছে নাকি!”
ও বিরবির করছে বলে ওর কোনো কথা-ই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না আভিয়ান। এবার ওর ভ্রু কপট আরো বেশি কুঁচকে গেল। বললো, “কিছু কি হয়েছে তোমার? রাতে ঘুম ভালো হয়নি? নাকি জ্বর এসেছে?”
কথাটা বলেই রানিয়ার কপালে হাত রেখে ওর জ্বর এসেছে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টা করলো আভিয়ান৷ রানিয়া আবারও ওর হাত টেনে সরিয়ে দিতেই এবার আভিয়ানের চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ও এবার জোরপূর্বক রানিয়ার হাতের বাহু চেপে ধরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে প্রশ্ন ছুঁড়লো— “কী সমস্যা তোমার? দূরে সরিয়ে দিচ্ছো কেন বারবার?”
রানিয়া মোচড়ামুচড়ি করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে জবাব দিলো, “দূরে সরুন অসভ্য, চরিত্রহীন লোক। আসলে লোকে ঠিকই বলে, আপনাদের প্রফেশনের মানুষদের অধিকাংশের-ই চরিত্রে সমস্যা। আমি-ই ভুল ভাবতাম এতোদিন।”
আভিয়ান রানিয়ার কাঁধ ঝাকিয়ে চাপা স্বরে প্রশ্ন করলো, “কীসব বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তো তোমার?”
রানিয়া এই প্রশ্নের বিপরীতে কিছু কড়া জবাব দিতে যাবে, তার আগেই মনে হলো, ওর পা ঘেঁষে পিচ্ছিল, স্যাঁতসেঁতে এবং লম্বাটে কোনোকিছু চলে গেল মাত্র৷ এবং এ-ও ধারণা হলো, যাওয়ার আগে জিনিসটা ওর পায়ে কামড় দিয়ে গেছে। রানিয়ার হঠাৎ কেমন জানি বোধ হলো৷ শরীর শীতল হতে শুরু করলো। আভিয়ান ওর মুখের আতঙ্ক লক্ষ্য করে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো, “কী হয়েছে রানিয়া?”
“সা-সাপ!”
রানিয়া কোনোরকমে জবাবটা দিয়েই যেন নেতিয়ে পরলো। হঠাৎ ওর পেটে বড় হতে থাকা বাচ্চাটার কথা মাথায় আসতেই রানিয়া চট করে পেটে হাত দিয়ে জোরে একটা চিৎকার দিলো, “আমার বাচ্চা!”
আভিয়ান অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে যেন। রানিয়াকে আঁকড়ে ধরে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “তোমার বাচ্চা মানে?!”
চলবে
🔹 দুঃখিত, আমি ভুলবশত ১৭ পর্বের জায়গায় অন্য পর্ব দিয়ে ফেলেছিলাম। পড়েও দেখিনি। সবাই এই পার্টটা পড়ে নিন। আর প্লিজ, রেসপন্স কমিয়ে দিবেন না। কি মিসটেক করে বসলাম! ধুর!
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৮
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১০
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৯
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৩
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৫
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৩
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৮