Golpo romantic golpo উড়াল মেঘের ভেলায়

উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৬


উড়ালমেঘেরভেলায়

লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক

পর্ব_১৬

[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]

ভোর পাঁচটার সময়েই চোখে একরাশ ঘুম নিয়ে সবাইকে উঠে বাড়ির পেছনের বাগানে আসতে হয়েছে। রসুইঘর এখানেই অবস্থিত। বাড়ির পেছনে প্রথমে মাঝারি আকৃতির একটা উঠান, সেখানে রান্নাঘর ; তারপরে বিশাল বাগানের শুরু। এই বাগানটা গিয়ে শেষ হয়েছে ওপাশের বড় ক্ষেতগুলোর প্রান্তরে।
সেই সুবিশাল মাসকলাই, শিম, বরবটিসহ বিভিন্ন ফসলাদির ক্ষেতগুলোও বড় মামার-ই। এককালে বড় মামা চাকরির পোস্টিংয়ের জন্য সিলেটে এসেছিলেন বউ-বাচ্চা সহ। এরপর বেতনের জমানো টাকা এবং পেনশনের টাকা মিলিয়ে বিশ শতকের দিকে খুব অল্প দামে এখানে কয়েক শতকের ওপরে জমি কিনে রেখেছিলেন খুব সস্তায়। বর্তমান সময়ে এসে এই জমির দাম কাঠা প্রতি লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।
বড় মামা সেই সময়ে বাড়ি করে এখানেই বসবাস করা শুরু করেছেন। তিনি আর তার পৈতৃক ঠিকানা কেরানীগঞ্জে ফেরত যাননি।
রানিয়া একটা পিঁড়িতে বসে আছে উঠানের এককোণে। ওর পাশেই কতকগুলো পিঁড়ি পেতে বসে আছে আলিশা, মাইশা, হিয়া আর কাঁকন।

আভিয়ান আর তাফসির ভাই পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে বড় মামা ও রানিয়ার মামাতো দেবরদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। সম্ভবত আজকে মাছ মারতে বড় মামার ছেলেদের সাথে পুকুরে নামবে তারা। রানিয়া গাছ থেকে পেড়ে আনা চালতা খেতে খেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল ওদের। রানিয়া আলিশাকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে ওর মনোযোগ আকর্ষণ করে বললো, ”চালতা গাছটা কোথায় রে আলিশা?”

আলিশা জবাব দিলো, “চালতা তো ছোট মামি দিলো। ওপাশে নদীর ওপারে নাকি ইকরাম মামার বাড়ির গাছে ধরেছে। ইয়া বড় গাছ৷ এতো বেশি চালতা, যে কেউ খেয়ে কুল পায় না। কত-শত তো মাটিতে পড়েই নষ্ট হয়। আমরা এসেছি শুনে ইকরাম মামা আমাদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন মামির কাছে। ইকরাম মামাকে চিনেছো? তোমার নানা শ্বশুরের বন্ধুর ছেলে।”

রানিয়া ঘনঘন মাথা নাড়লো। সে কীভাবে চিনবে? তার তো চেনার কথা নয়৷ তবে ইকরাম মামা নাকি শুনেছিলেন, তার আব্বার বন্ধুর বড় মেয়ের একমাত্র ছেলে বিয়ে করেছে। আভিয়ানকে তিনি খুব ভালোভাবে চেনেন। পরিচয় আছে বেশ ভালোই৷ এজন্য তার বউ দেখার বড্ড সাধ ইকরাম মামার পরিবারের। এখানে এসেছে শুনে একবার যেতে বলেছেন ওদের।
আলিশার মুখ থেকে একথা শোনার পর উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠলো রানিয়া। আলিশা আর মাইশাদের ফিসফিস করে বললো, “চলো, তাহলে আমরা ইকরাম মামার বাড়ি যাই। উনাদের সাথে দেখা হবে, আর চালতাও নিয়ে আসবো ওখান থেকে।”

আলিশা রানিয়ার হাত চেপে ধরে বিরবির করে বললো, “কি বলছো ভাবি! ইকরাম মামাদের বাড়ি কতদূরে জানো তুমি?”

“কতদূরে?”

“প্রায় কয়েক কিলোমিটার। তা-ও এমন রাস্তা, যেখানে গাড়ি চলাচল করে না। হেঁটে যেতে হবে৷ সর্বনিম্ন আধ ঘন্টা তো হাঁটতেই হবে। এখান থেকে প্রথমে দশ মিনিটের সরু রাস্তা পেরিয়ে মূল সড়কে উঠতে হবে, যেখানে বাজারের শুরু। তারপর ওই রাস্তাটুকু পেরোলে ব্রিজ। ব্রিজের পরে একটা ছোটখাটো মাটির রাস্তা। সেই রাস্তায় হেঁটে ধুলোবালি খেয়ে নদীর ঘাট। এরপর ডিঙি নৌকায় উঠে নদী পাড়ি দিয়ে আরেকটা ছোট রাস্তা। সেই রাস্তার শেষ মাথায় ইকরাম মামার বাড়ি।”

রানিয়া একথা শুনে আরো খুশি হয়ে বললো, “তাহলে তো আরো ভালোই হয়। একটা ছোটখাটো অ্যাডভেঞ্চারও হয়ে যাবে।”

ওপাশ থেকে হিয়া বললো, “হ্যাঁ, এমন অ্যাডভেঞ্চার দারুণ লাগে। চলো যাই।”

আলিশা ভাবির মুখের ওপরে এবার আর কোনো কথা বলতে পারলো না। তবে ওরা যে সেখানে যাবে, এই কথা কাউকে বলা যাবে না। রানিয়াই একথা বললো যে, “কাউকে বলবো না আমরা। বললে তারাও যাবে সাথে। আমাদেরকে একা ছাড়বে বলে মনে হয় না। আর একা ঘোরার মজা-ই আলাদা।”

মাইশা একটু দ্বিধান্বিত হয়ে বললো, “আমাদের ভাইয়াকে অন্তত বলে যাওয়া উচিত ভাবি। নাহলে আভিয়ান ভাইয়ার যে রাগ, একবার জানতে পারলে আমাদের আস্ত রাখবে না।”

রানিয়া তখন তড়িঘড়ি করে বললো, “না, না! তোমাদের ভাইয়াকে তো বলাই যাবে না। উনি জানতে পারলে যাওয়াটা-ই ক্যান্সেল করে দেবেন।”

শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো, আভিয়ানকেও জানানো হবে না আর ওরা আজ দুপুরের খাবার খেয়ে সেখানে যাবে। আলিশা ঠোঁট উল্টে রানিয়াকে বললো, “আমার না অনেক ঘুম পাচ্ছে ভাবি। এতো সাত-সকালে কেন যে সবাই আমাদের টেনে উঠালো!”

রানিয়ার হঠাৎ মনে পরতেই বললো, “আমাদের না কাশেম নানাদের বাসায় যাওয়ার কথা? এজন্য বোধহয় তাড়াতাড়ি টেনে তুলেছে।”

হিয়া পিঁড়ি নিয়ে এসে রানিয়ার পাশে এসে বসে ওকে খোঁচা মেরে বললো, “ভাই দেখো।”

রানিয়া ওর কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো, একটা ধাড়ি মেয়ে, বয়স সম্ভবত বছর পঁচিশ হবে; সেই মেয়েটি ছোট্ট একটা হাঁটু সমান স্কার্ট আর একটা শর্ট স্লিভের বুক সমান গলা নামানো টপস পরে আছে। মাথার ওপরে একটা চশমা ফিট করে রাখা। চুল কতগুলো ঘোড়ার লেজের মতো। তাতে আবার ব্রাউন কালার করা। বেশ স্টাইলিশ মেয়েটি। হিয়া বিরবির করে বললো, “আমি কাজের সূত্রে শার্ট-প্যান্ট পরলেও তা-ও ঠিকভাবে পরি। কিন্তু এই মেয়েটা পরেছে কি! কেমন দেখাচ্ছে ওকে! ও নিজেকে আয়নায় দেখে না নাকি? এতগুলো পুরুষ মানুষের সামনে এসব পড়ে আছে! এর আবার উৎপত্তি হলো কোথা থেকে?”

পাশ থেকে মাইশা তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো, “আরে ও তো রিনি আপি। জানো ভাবি, রিনি আপি একসময় আভিয়ান ভাইয়াকে পছন্দ করতো।”

মেয়েটার বেশভূষা দেখে রানিয়ার ভ্রু আগে থেকেই কুঁচকে ছিল। মাইশার কথা শুনে এখন দুই ডাবল কুঁচকে গেল আরো। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হঠাৎ সতর্ক হলো। বুকের ভেতরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো। কেন, তা জানা নেই। রানিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো, “তোমার ভাইয়াও পছন্দ করতো নাকি?”

ওরা অজ্ঞের মতো জবাব দিলো— “সে তো জানি না। তবে তাদের বিয়ের কথাও উঠেছিল।”

“বিয়ে? বাবাহ! বিয়ে অবধিও গড়িয়েছিল তাহলে? তো, বিয়েটা হয়নি কেন?”

“সেই ব্যাপারেই ঠিক জানি না ভাবি।”

হিয়া মৃদু হেঁসে রানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ম্যাডাম রানিয়া জেল্যাস বুঝি?”

প্রশ্নটা শোনামাত্র রানিয়া তৎক্ষনাৎ মুখের বিরক্তিকর হাবভাব স্বাভাবিক করে জবাব দিলো, “জেল্যাস? কই না তো!”

“হু হু! তুমি না বললেও বুঝি।”

রানিয়া কথা ঘোরাতে বললো, “খিদে পেয়েছে। খেতে ডাকছে সবাই। চলো, খেতে বসি।”

ততক্ষণে ছোট মামি উঠানে আরেকবারের মতো ঝাঁট দিয়ে বড়বড় তিনটা মাদুর পেতে দিয়েছেন। সবাই বসে পরলো সেখানে। রানিয়ার পাশে হিয়া, এরপর আলিশা আর মাইশা। ওদের পাশে বড় মামার বৌমারা আর আরো কয়েকজন মেহমান মেয়ে আত্মীয়রা বসেছে৷ ছোটদের খাইয়ে তারপর নাকি বড়রা বসবেন খেতে।

ছোট মামি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন। সকালের খাবারের পদ হলো, ধানক্ষেতে চাষ করা লাল চালের আটার রুটি, চিনিগুড়া চালের গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি, ক্ষেতের গাছের সাদা বেগুন ভাজা, ঘিয়ে মাথা আলু ভর্তা, হাঁসের মাংস, ছিটা রুটি, শুঁটকি শিরা যেটাকে সিলেটিরা বলেন হুটকি শিরা_ এটা সিলেটের একটা ঐতিহ্যবাহী খাবার। আরো রান্না করা হয়েছে, কোরাল মাছের কালিয়া।
রানিয়ার পাতে প্রথমে হাঁসের মাংস আর ছিটা রুটি ও দুইটা লাল চালের আটার রুটি তুলে দেওয়া হলো। রানিয়ার কিছুদিন যাবতই বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে হাঁসের মাংসের সাথে রুটি বা ছিটা রুটি খেতে বড্ড ইচ্ছা করছিল। কিন্তু কাউকে দ্বিধায় বলতে পারেনি ও। আর এরমধ্যে তো ওর বাসায়ও যাওয়া পরেনি। নাহলে মা’কেই বলতে রান্না করে খাওয়াতো। হাঁসের মাংস আর ছিটা রুটি দেখে রানিয়ার মুখে যেই প্রফুল্ল ভাবটা ফুটে উঠলো, সেটা ওর মুখোমুখি সামনের সাড়িতে বসে থাকা আভিয়ান তীক্ষ্ণ নজরে খেয়াল করলো। রানিয়া মুহূর্তের মধ্যেই সবটুকু খেয়ে শেষ করে ফেললো। কোনোদিকে তাকাতাকি নেই ওর। আভিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরোটা সময় ওর খাওয়া দেখলো। এরপর খেয়াল করলো, রানিয়া প্লেটে হাত ঠুকছে বসে বসে। নখ কাটছে দাঁতে। ওকে অন্য খাবার দেওয়া হলেও ও সেটা খাচ্ছে না। আভিয়ান তৎক্ষনাৎ উঠে এসে ওর পাতে থাকা হাঁসের মাংস আর ছিটা রুটি রানিয়ার প্লেটে তুলে দিয়ে গিয়ে আবার মুহূর্তের মধ্যে নিজ জায়গায় বসে গেল। ছোট মামি ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তিনি হাঁসের মাংসের কসনটা নিয়ে এসে আভিয়ানের পাতে আরো কতগুলো মাংস দিতে দিতে বললেন, “মাংস লাগবে একবার আমাকে বললেই পারিস বাজান। এতো কাজের জন্য দিশা থাকে বাজান?”

আভিয়ান তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো, “আমার লাগবে না মামি। তোমার বৌমাকে দাও। আরো দু’টো রুটি দিও ওকে।”

“এইতো, এখুনি দিচ্ছি।”

ছোট মামি গিয়ে রানিয়াকে আরো কতোখানি মাংস আর দু’টোর জায়গায় চারটা রুটি দিলেন৷ রানিয়া এবার খুব খুশি হলো। একগাল হেঁসে সানন্দে খেতে লাগলো। আভিয়ান খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে ওকে দেখতে লাগলো।

রিনি মেয়েটা মেয়েদের সারিতে বসেনি। বসেছে ছেলেদের সারিতে। অথচ মেয়েদের সারিতে অঢেল জায়গা ছিল। রানিয়া ভ্রু কুঁচকে ওকেই দেখছিল। নেহাতই এখানকার প্রত্যেকটা পুরুষ ভীষণ ভদ্রলোক। এজন্যই ওকে একবারের জন্যও দেখছে না। অথচ মেয়েটা এমনভাবে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে বসেছে যেন, খেতে বসেনি বরং অ্যাটেনশন সিক করতে বসেছে। হঠাৎ ওপাশ থেকে রিনির কন্ঠস্বর শোনা গেল। খুবই চিকন গলায় চেঁচিয়ে বলছে, “ওমাউগড! এসব কেউ খায় নাকি? স্ন্যাকস কিছু নেই? এসব জিনিস আমি খেতে পারবো না। আমার ওয়েট গেইন হয়ে যাবে।”

সবার নজর এখন খাওয়া ছেড়ে রিনির ওপরে। রানিয়াও তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটা মাংস আর রুটির প্লেটটা টেনে সামনের দিকে সরিয়ে রেখে নাক কুঁচকাচ্ছে। ওকে নিয়ে আবার অনেকে আদিখ্যেতাও করছে। হঠাৎ আবারও রিনি বলে উঠলো, “ওমাইগড এখানে একটা মাছি বসেছে! এই খাবারটাও আমি খাবো না।”

রানিয়ার এবার বড্ড বেশি মেজাজ খারাপ হলো। ও রিনির দিকেই হা করে তাকিয়ে থাকা ননদগুলোর উদ্দেশ্যে বললো, “আলিশা এই ন্যাকাটাকে সরা আমার সামনে থেকে। সিরিয়াসলি বলছি, আমার ধৈর্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। এবার কিন্তু পেছন থেকে জুতা এনে ওর মুখে ছুঁড়ে মারবো!”

রানিয়া যেভাবে কথাটা বললো, তাতে ওরা আঁতকে উঠলো। আলিশা রানিয়ার হাতের বাহু চেপে ধরে বললো— “ভাবি, মাথা ঠান্ডা করো।”

এরইমধ্যে ওরা দেখলো, রিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে যাওয়ার পায়তারা করছে। তার আগে নিজের অবস্থান থেকে তিন হাত দূরে বসে থাকা আভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “হেই মাই আর্মি ম্যান, তোমার সামনে রাখা পানির বোতলটা দাওনা প্লিজ। আমার এই গ্লাসে পানি খেতে হেজিটেশন ফিল হচ্ছে।”

রানিয়া আরো বেশি অবাক হয়ে দেখলো, আভিয়ান একদম স্বাভাবিক মুখ করে রিনির দিকে পানির বোতলটা এগিয়ে দিলো। রিনি তৎক্ষনাৎ মুচকি হেঁসে বললো, “থ্যাংক ইউ হ্যান্ডসাম।”

রানিয়া কটমট চোখে আভিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে

🔹 দুঃখিত, আমি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পরেছি। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর থেকেই আমার প্রচন্ড হাঁপানি উঠে গেছে। শুধুমাত্র হাঁপানির রোগীরাই বুঝবেন, এর কষ্ট ঠিক কতোটা। তাই, মাফ করবেন দেরি করার জন্য। আর পর্বটাও একটুখানি ছোট হয়েছে৷ পরের দিন পুষিয়ে দেবো। আশা করি আপনারা বুঝতে পারবেন। আমাকে একটু রেস্ট নেওয়ার সময় দিবেন। আর আমার জন্য দু’আ করবেন।

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply