উড়ালমেঘেরভেলায়
লেখনীতে— #ঝিলিক_মল্লিক
পর্ব_১৪
[কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।]
গোধূলি লগ্ন।
সূর্যদেব তখন ডুবতে বসেছে পশ্চিমাকাশে। আবছা আঁধারে ছেয়েছে চারিপাশ।
সফেদ রঙা মাইক্রোবাস দু’টি তখন শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করেছে সবে। তারা যে শ্রীমঙ্গল এসে পৌঁছেছে, সেটা বোঝা গেল রাস্তার পাশের মাইলফলক দেখে। এই আবছা আঁধারের মাঝেও ইংরেজিতে “আই লাভ শ্রীমঙ্গল” লেখা স্থাপনাটা বেশ ভালোভাবেই নজর কাড়লো গাড়িতে বসা সবার। সবাই উচ্ছ্বসিত হলো। যাক, অবশেষে দীর্ঘ জার্নির পরে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছানো গেল তবে।
পিচের সরু রাস্তা। তার দুপাশে সাই সাই বন-জঙ্গল পেরিয়ে যাচ্ছে। বিশাল বিশাল চা-বাগানও চোখে পরছে কিছুক্ষণ পরপর।
গাড়ির মধ্যে প্রত্যেকের চোখে-মুখে তখন ক্লান্তির ছাপ। সবাই ঘুমে ঢুলছে। শুধুমাত্র আভিয়ান-ই জেগে আছে। শক্ত মুখে ফোনে কিছু কাজ করছে। ওর কাঁধের ওপরে রানিয়ার মাথা মিশে আছে৷ ও ঘুমিয়ে পরেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। আভিয়ানের আর ইচ্ছা হয়নি ওকে জাগিয়ে দিতে। এরইমাঝে হঠাৎ রানিয়ার ঘুমন্ত মুখশ্রী এসে ওর ঘাড়ে পরেছে। আভিয়ান প্রতিক্রিয়াহীন চাহনিতে শুধু একবার দেখেছে ওই মুখশ্রী। মুখের ওপরে লেপ্টে থাকা সামনের ছোট চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়েছে। ওর গায়ে শালটা আরো ভালোভাবে টেনে দিয়েছে৷ তবে নিজে সরে আসেনি। রানিয়া যাতে আরামে ঘুমাতে পারে, সেই দিকটা খেয়াল রেখেছে। বারবার ওর ঢুলে পরা মাথা কাঁধে তুলে নিচ্ছে।
.
.
শ্রীমঙ্গলের একটি সুন্দর গ্রামের নাম রাধানগর।
এই গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর। প্রতিটা মানুষের স্বপ্নের বা ছোটবেলায় অঙ্কন খাতায় আঁকা সেই দৃশ্যের ন্যায়।
রানিয়ার ঘুম ভেঙেছে সবেমাত্র। ঘুম ঘুম চোখে তখন ও বাইরের পরিবেশটা দেখছে৷ সূর্য ডুবলেও জোছনার আলো মিয়মান রয়েছে। পরিবেশটাকে অসম্ভব সুন্দর করে তুলেছে। সামনে বসা আলিশারা বলাবলি করতে লাগলো, কালকে ওরা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে আসবে। আজ যেহেতু দেরি হয়ে গেছে, তারওপর ওরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত; তাই আজ আর সম্ভব নয়। রানিয়ার এবেলায় মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল অনেক। মনের মধ্যে সেই ক্ষীণ যন্ত্রণাটা আর উপলব্ধি হচ্ছে না এখন। রানিয়া চাইছেও না উপলব্ধি করছে। যেচে পড়ে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয় না৷ বরং, এতো সুন্দর একটা জায়গায় এসেছেই যেহেতু, তাহলে সব ভালোভাবে ঘুরেফিরে দেখবে, এই ট্যুরটা উপভোগ করবে দারুণভাবে৷ আভিয়ানকে আর গুরুত্ব-ই দেবে না। সাইকোলজি খুব একটা বোঝে না রানিয়া। তবে এতটুকু ও এই ক’দিনে বুঝে গেছে, আভিয়ান লোকটা মারাত্মক জেদি। নিজের জেদ বজায় রাখতে আভিয়ান যা খুশি করতে পারে। যেকোনো পর্যায়ে যেতে পারে।
রানিয়ার এখন আর দুঃখবোধ হচ্ছে না। আভিয়ানের নিকট হতে সমস্ত জবাব সে আজ স্পষ্টভাবেই পেয়ে গেছে। যেখানে ভালোবাসা আর সম্মান নেই; সেখানে অবস্থান করারও কোনো মানে নেই। বরং, প্রস্থান করা-ই শতগুণে ভালো।
রানিয়া জানালা হতে মুখ সরিয়ে বসলো৷ আড়চোখে একবার আভিয়ানকে দেখলো। আভিয়ান তখন সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গাড়ির সামনের গ্লাসের দিকে। সম্ভবত কিছু একটা ভাবছে গভীর মনোযোগ সহকারে। রানিয়া মাথা ঘামালো না। হঠাৎ ওর ফোনের রিং বেজে উঠলো। আজ সারাদিনের জার্নিতে ফোন খুব একটা হাতে নেওয়া হয়নি ওর। সকালে বের হওয়ার সময় ফোনে মায়ের সাথে কথা বলেছিল। জার্নিতে আছে বলে বাসার কেউ খুব একটা কল করেনি। তখন ওকে বলেছে, সিলেট পৌঁছে তাদের কল করতে। কলে যেহেতু তেমন কারো সাথে কথাবার্তা হয়নি, তাই এতোসময় ফোন ধরারও প্রয়োজন পরছিল না ওর৷ এখন ফোনের রিং বাজতেই সাইড ব্যাগ হতে ফোনটা তাড়াহুড়ো সহকারে টেনে বের করলো রানিয়া। ফোন স্ক্রিনে জাহিনের নামটা স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে। ও কল দিয়েছে দেখে উচ্ছ্বসিত হলো রানিয়া। সঙ্গে সঙ্গে আর দেরি না করে কল রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে একটা চিক্কুর শোনা গেল।
“দোস্তো রে. . .”
“হ্যাঁ দোস্তো, বল।”
রানিয়া একগাল হেঁসে পাল্টা জবাব দিলো। ফোনের ওপাশ থেকে জাহিন বলে উঠলো, “তোকে খুব মিস করছিলাম রে দোস্ত।”
রানিয়া ঠোঁট উল্টে বললো, “আমিও তোকে অনেক মিস করছিলাম। কই ছিলি ব্যাটা? তোর কোনো খোঁজ-খবর নেই কেন?”
“আর বলিস না, এক্সামের চক্করে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি। ক’টা দিন তো ফোন-ই ধরা হয়নি তেমন। আজ এক্সাম শেষ হলো৷ তাই ফোন অন করে এসে সবার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। তারপর বল, তোর কী খবর? ভালো আছিস?”
“এরকম জাঁদরেল লোক পাশে বসে থাকলে ভালো আর থাকি কিভাবে!”
রানিয়া কথাটা আস্তে আস্তে বিরবির করলো৷ তবে জাহিন শুনতে পেল না। রানিয়া পুনরায় বললো, “আমি ঢাকার বাইরে দোস্ত। সিলেট এসেছি আজ।”
“সিলেট? সিলেট কেন? কার সাথে? বললি না তো কিছু।”
রানিয়া জবাব দিতে যাবে, তার আগেই ঘাড় ঘুরিয়ে বিপরীত পাশে তাকাতেই দেখলো, আভিয়ান ওর দিতে কঠোর চাহনিতে তাকিয়ে আছে। রানিয়া একটু থতমত খেলো। ওর নজর গেল আভিয়ানের ডান হাতের দিকে। হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে সিটের ওপরে ফেলে রাখা। শক্ত করে চেপে ধরে আছে সিট। রানিয়া সামান্য থতমত খেলেও পরমুহূর্তেই স্বাভাবিক হলো। হাবভাব এমন করলো, যেন কিছুই যায় আসে না ওর, আভিয়ানকে মোটেও পরোয়া করে না। এতোক্ষণ রানিয়া মুচকি হেঁসে কথা বলছিল৷ এবার ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো, “তোকে আমি অনেক বেশি মিস করছিলাম। শত হোক, ফ্যামিলির পরে তুই-ই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমার মনে তোর যেই জায়গা, সেই জায়গা তো আমার স্বামীও নিতে পারবে না।”
রানিয়া কথাটা বলে আড়চোখে আভিয়ানকে দেখলো। সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিলো ও। চোখ লাল হওয়ার কী আছে? যতদূর জানে, নেশা করলে মানুষের চোখ লাল হয়। কিন্তু এই লোককে দেখার পরে ওর ধারণা বদলেছে। ইনি তো দেখি মারাত্মক রেগে গেলেও চোখ লাল হয়! আভিয়ানের এই হাল দেখে রানিয়া মনে মনে প্রচন্ড খুশি হলো। আভিয়ান বোধহয় কিছু একটা বলতো তৎক্ষনাৎ। কিন্তু রানিয়ার সৌভাগ্য, গাড়ি তখনই মামাবাড়ির উঠোনের সামনে এসে থামলো। গন্তব্যে পৌঁছানো মাত্রই ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। এতোক্ষণ গাড়ির মধ্যে আটকা থেকে সবকটার বেহাল দশা। ওরা জলদি জলদি গাড়ি থেকে নেমে পরলো। মাইশা বের হয়ে রানিয়াকে বের করে নিয়ে এসে ওর হাত জড়িয়ে ধরে রাখলো। ঠকঠক করে দাঁত কাঁপতে কাঁপতে বললো, “ভাবি আমার শীত করছে। সিলেটে কোনোবছর খুব বেশি শীত পরে না। কিন্তু এবার তো দেখছি ভালোই ঠান্ডা পরেছে৷ রানিয়ারও ঠান্ডা লাগছিল বেশ। ও দুই হাত দিয়ে বাহু ঘষতে ঘষতে শিরশিরে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললো, “অনেক ঠান্ডা মাইশা। চলো আমরা ভেতরে যাই আগে।”
ড্রাইভার তখন টিকি থেকে লাগেজ বের করছিল। আভিয়ান আর তাফসির সেখানেই তদারকি করছে। বড়দের গাড়িটা সামনে দাঁড় করানো ছিল। হিয়া রানিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। রানিয়া ওকে সাথে নিয়ে ওর শাশুড়িদের পেছন পেছন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।
এই বাড়ির কোনো গেইট নেই। চারিদিক থেকে উন্মুক্ত। বাড়ির চারপাশে উঠোন। সামনেই একটা ঘিয়ে রঙ করা সুবিশাল দোতলা ভবন দেখা যাচ্ছে। তার বিপরীতে পাশে একটা ছোটখাটো জঙ্গল। সেই জঙ্গলের দিকে চোখ গেলেই ওপাশে আরো একটা বাড়ি দেখা যায়। তবে সেটা কাঠের দোতলা বাড়ি। আঙুল উঁচিয়ে রানিয়াদের সেই বাড়িটা দেখিয়ে আলিশা বললো, “ওই দেখো তালগাছের পাশে যেই বাড়িটা না? ওই বাড়িতে আমরা প্রতিবার এসে থাকি। ওটা মামিদের আরেকটা বাড়ি৷ আগে তারা ওখানে থাকতেন। নতুন বিল্ডিং তোলার পর এখানে এসে থাকছেন।”
রানিয়া আবছা অন্ধকার ওই জঙ্গলের ওপাশে তাকিয়েই ভয় পেল৷ রাতে ওখানে থাকবে ঠিক আছে, কিন্তু পাশে যে তালগাছ! ও শুনেছে, তালগাছে ভূত থাকে। ওর আবার ভূতের ভয় মারাত্মক। পৃথিবীর অন্য যেকোনো ভয় এই ভয়ের নিকটে একেবারেই তুচ্ছ ওর ক্ষেত্রে।
.
.
আভিয়ানরা বৈঠকখানায় বসে আছে৷ এই মাঝারি আকৃতির ঘরে শুধুমাত্র একটা পুরোনো আমলের পালঙ্ক, এক সেট সোফা আর একটা কাঠের আলমিরা।
সোফায় আভিয়ানের পাশে তাফসির বসে ফোনে গেইম খেলছে। আভিয়ান ওর বড় মামা, খালু, মামাতো ভাই আর বড় মামির ভাইদের সাথে গল্প করছিল। ওর আম্মা,খালারা মামির সাথে পাকঘরে গিয়েছেন। পাকঘরটা উঠোনে, খড়ের তৈরি৷ বিশাল পাকঘরে বসে সবাই গল্প করছে। বিয়েটা বেশ বড় অনুষ্ঠান করেই হচ্ছে। তাই কাছের আত্মীয়রা বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বিয়েবাড়িতে আসতে শুরু করেছেন। এই যেমন আজ আভিয়ানরা আর মামির বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়রা আসতে শুরু করেছেন। আগামীকাল নাকি মামির মায়ের দিকের আত্মীয়রা আর মেজো মামারা আসবেন। তারা রাতের ট্রেনে উঠছেন যশোর থেকে। সকালের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন সম্ভবত।
রানিয়ারা নতুন বিল্ডিংয়ের নিচতলার বৈঠকখানার পালঙ্কে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। দরজা-জানালা সব খোলা। তাই ঠান্ডা হাওয়াও পাল্লা দিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকছে। রানিয়া, হিয়া, আলিশা আর মাইশা— চারমাথা এক জায়গায়। ওরা বসে বসে গল্পস্বল্প করছে। তা-ও যে-সে গল্প নয়। ভয়ংকর ভূতের গল্প। গল্প বলছে হিয়া। রানিয়া ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গল্প শুনছে। পেছনের জানালার পাল্লা আবার খোলা।
খাটের সামনাসামনি হাত তিনেক দূরের সোফায় বসে পুরুষেরা সবাই আলোচনা করছে। তাদের সাথে আভিয়ান আর তাফসিরও সামিল আছে।
বড় মামি এসে মাত্রই রানিয়াদের আসরের মাঝখানে নারকেল-গুড়-মুড়ি দিয়ে গেলেন। ওরা লুটোপুটি করে খেতে লাগলো। এমন মজাদার খাবার ছাড়া যায় না। রানিয়ার তো ভীষণ পছন্দ। আড্ডা-মজা আর হাসি-ঠাট্টার মাঝে দিন-দুনিয়া প্রায় ভুলতেই বসেছিল রানিয়া। ও আগের রানিয়া হয়ে উঠেছিল। সেই হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছল মেয়েটি। হঠাৎ হাসতে হাসতে রানিয়ার চোখ গেল সোফায় বসা আভিয়ানের দিকে। ওর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পরলো৷ ওর হাসির শব্দ শুনে আভিয়ান ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। তবে তার মুখের ভাব-গতিক সুবিধের ঠেকলো না রানিয়ার। কেমন গুমোট, গম্ভীর। যেন ঝড়ের আগের পূর্বাভাস!
.
.
রাতের খাবার খেয়ে এগারোটার দিকে কাঠের বাড়িতে এসেছে রানিয়ারা। রানিয়া, আলিশা, মাইশা আর হিয়া একসাথে এসেছে। ওদের পেছনে ছিল আভিয়ান, তাফসির, কাঁকন আর আভিয়ানের বড় মামার মেজো ছেলে শাফিন।
নিচতলায় একটা খোলাঘর। সেই ঘরের সাথে দোতলার সিঁড়ি। খোলা ঘরের চারপাশে আরো চারটা শোবার ঘর। তাফসির, কাঁকন আর শাফিন আগেই ঝটপট একটা ঘরে গিয়ে শোবার ব্যবস্থা করতে লাগলো। ওরা সবক’টা ঘুমে ঢুলছে। তিনজনে মিলে মশারি টাঙিয়ে নিলো। এই বাড়িতে আত্মীয়রা আসলে মামিরা নতুন ভবনে আত্মীয়দের থাকার ব্যবস্থা করে এখানে এসে থাকেন। তবে এবার হয়েছে উল্টো। আত্মীয়রা-ই এই সুন্দর কাঠের বাড়িতে এসে থাকছে। ছোটখালা এসে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে গেলেন, সকালে উঠে বিলের ওধারের কাশিম নানার বাড়িতে যেতে। সেখানে পিঠা বানানো হবে।
হিয়া, আলিশা আর মাইশাকে ছোট খালা নিচতলার একঘরে নিয়ে গেলেন। বাকি রইলো আভিয়ান আর রানিয়া। রানিয়াকে ছোট খালা ওই ঘরে নিয়ে যাননি ওদের সাথে। রানিয়া ঠিক বুঝতে পারছিল না, কি করবে। একা দাঁড়িয়ে ছিল খোলা ঘরে। আভিয়ান ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে কাঠের দোতলায় উঠে গেছে। লোকটা নাকি একা থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে৷ কোলাহল পছন্দ করে না, আর ঘুমে ডিস্টার্বও না। তাই দোতলার ছোট ঘরে গিয়ে শুয়ে পরেছে।
রানিয়া দাঁড়িয়ে ইতস্তত বোধ করছিল। তখনই ছোট খালামণি আলিশাদের বিছানা পেতে দিয়ে দরজা ভেড়িয়ে দিয়ে বাইরে আসলেন। রানিয়াকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “ওমাহ, বৌমা। তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? দোতলায় যাও। আভিয়ান গেল তো। তোমাকে নিয়ে যায়নি?”
“দোতলায় কেন যাবো খালামণি? আমি আলিশাদের সাথে ঘুমাই?”
রানিয়া আমতা আমতা করলো। ছোট খালামণি বারণ করে বললেন, “না না! সে কী করে হয়? তুমি থাকবে আভিয়ানের সাথে। তোমরা স্বামী-স্ত্রী। ঘর যখন খালি আছে তাহলে কষ্ট করে গাদাগাদি করে আলাদা ঘরে থাকবে কেন?”
ছোট খালামণি ঠেলেঠুলে রানিয়াকে দোতলায় উঠিয়ে দিলেন। ও খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই মেঝের ওপরে পা পরলো ওর। দোতলায় প্রথমে বৈঠকখানার মতোই একটা ঘর। তবে বড় ঘরটাতে একটা খাট আর জিনিসপত্র। এরপর বাঁয়ে তাকালেই আরেকটা মাঝারি আকৃতির ঘরের দরজা। দরজাটা ভেড়িয়ে দেওয়া। তারমানে আভিয়ান ওই ঘরেই আছে৷ রানিয়া একবার ভাবলো, ভেতরের ঘরে যাবে না। বরং, এখানেই পালঙ্কে শুয়ে পরবে। কিন্তু এখানে কোনো কাঁথা-কম্বল না দেখে ভেতরের ঘরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ও। অন্তত বাচ্চার জন্য হলেও নিজেকে কষ্ট দেবে না রানিয়া। ওর ক্ষতি মানেই বাচ্চারও ক্ষতি।
রানিয়ার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো। সেই ইতস্তত বোধ নিয়েই ধীর পায়ে ওঘরের দিকে এগোলো ও। দরজার পাল্লা হালকা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে তো বাতি আছে। তাহলে নিভিয়ে রাখার কী দরকার? ভূতের ভয়ে ভীতু রানিয়ার কেমন গা ছমছম করতে লাগলো, ভয় পেল ও। হাতে থাকা ফোনের টর্চটা অন করে ডানে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, সেখানে পালঙ্কে আভিয়ান উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘরটা খুবই ছোট। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ— উভয় দিক থেকেই। এজন্যই তো একটা খাট লম্বাভাবে রেখেও প্রস্থে এটে গেছে পুরো ঘরে৷ ফ্ল্যাশ ওদিকে পরা স্বত্ত্বেও আভিয়ান একবারও উঠে তাকায়নি ওর দিকে। রানিয়া কৌতূহলী হলো। মানুষটা ঘুমিয়ে পরলো নাকি? তাহলে তো ভালোই হয়। রানিয়াও এককোণে গিয়ে শুয়ে পরবে। আভিয়ানের মুখোমুখি হতে হবে না, তার সাথে কথাও বলতে হবে না৷
রানিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পালঙ্কের ওপরে গিয়ে উঠে বসলো। আভিয়ান যেই পাশে শুয়ে ছিল, তার অপর পাশে গিয়ে শুয়ে পরলো। পালঙ্কটা বেশ ছোট। এজন্য চাইলেও ও দূরে সরে গিয়ে শুতে পারলো না৷ আর তো সরার জায়গা নেই। আভিয়ান আর ওর মাঝে মাত্র কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব।
রানিয়া আরেকটা বালিশ টেনে নিয়ে শুয়ে পরলো৷ কম্বল আর কাঁথা দু’টো ছিল। দু’টোই আভিয়ানের গায়ে। বেশ লম্বা সেগুলো। রানিয়া টেনে একটা নিতে পারলো না। তাছাড়া, একটাতে শীতও নিবারণ হবে না। কাঠের ঘরে ঠান্ডা বেশ ভালোই। বিল্ডিং হলে ভিন্ন কথা ছিল।
রানিয়া ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে কম্বলের ভেতরে আভিয়ানের গা ঘেঁষে শোয়া মাত্রই আভিয়ান আচনক পাশ ফিরে তাকালো৷ রানিয়া চমকে উঠলো। অন্ধকারে ঠিক বোঝা না গেলেও এটুকু আন্দাজ করতে পারলো, আভিয়ান ওর মুখশ্রী অবলোকন করছে। চোয়াল শক্ত করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ রানিয়া সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আভিয়ান ওর পেটে হাত রেখে চেপে ধরলো। হাতটা রাখলো তাও বাচ্চাটা যেখানে অবস্থান করছে, ঠিক সেখানে। রানিয়া অসাড় হয়ে গেল যেন। আজ ওকে আভিয়ান মেরে-টেরে ফেললেও তো কেউ বাঁচাতে আসবে না, এমনকি কেউ জানতেও পারবে না। শুকনো ঢোক গিললো ও। না, আজ আর কোনো তর্ক-বিতর্ক নয়৷ আভিয়ান যা কিছু বলুক, রানিয়া আজ রাতে চুপচাপ থাকবে৷ দরকার হয় জবাবটা দিনের আলোতে দেবে।
রানিয়ার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আভিয়ান। এই অন্ধকারেও ওর দৃষ্টি দারুণ তীক্ষ্ণ! রানিয়ার মুখমন্ডলী স্পষ্ট পড়তে পারছে যেন। ওর ভয়টাও টের পাচ্ছে। ওকে আরো বেশি ভয় পাইয়ে দিয়ে ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরে নিজের শক্তপোক্ত পেটালো শরীরের সাথে মিশিয়ে আভিয়ান ধরা গলায় বললো, “কী যেন বলছিলে তখন? ‘আমার মনে তোর জন্য যেই জায়গা, সেই জায়গা তো আমার স্বামীও নিতে পারবে না’— এটাই তো? ফাক অব দিস! আসো, আজ ক্লিয়ারলি তোমার মন-মস্তিষ্কে, শরীরে আর তোমার জীবনে আমার জায়গাটা বুঝিয়ে দিই।”
চলবে
🔺 আজ আমি লিখতে চাইনি। তবুও আপনাদের এতো আগ্রহে আপনাদের জন্যই এতোক্ষণ বসে এতোবড় পর্ব লিখলাম। আর একটা কথা, যাদের এই গল্পটা বা নায়ক-নায়িকা কোনো একজনকেও ভালো লাগবে না, তারা প্লিজ এড়িয়ে যাবেন। পড়বেন না৷ গল্পটা আমি বড় করবো। এবং ভালোই বড় করবো। কারণ, অনেক কাহিনী আছে এই গল্পে। এখন আমরা সিলেটের কাহিনীতে প্রবেশ করেছি, তাই এটা উপভোগ করুন। বাকি কথা পরে হবে।
Share On:
TAGS: উড়াল মেঘের ভেলায়, ঝিলিক মল্লিক
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৭
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৩
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ২
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৫
-
উড়াল মেঘের ভেলায় গল্পের লিংক
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১৫
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৬
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ১১
-
উড়াল মেঘের ভেলায় পর্ব ৯