#আড়ালে_তুমি |৬২|
#_সাইদা_মুন
মেঘ আর কোনোকিছু না শোনেই বেড়িয়ে পড়ে। তার পিছে পিছে রিকও বের হয়,
-“আরে বইন দাড়া, কোন মেডিকেলে আছে না জেনে কোথায় যাবি?”
রিকের কথায় থেমে যায় মেঘ, ছলছলে চোখে অসহায় কণ্ঠে বলে,
-“প্লিজ রিক খুঁজ নে কোথায় আছে উনি, ঠিক আছে তো? আমি যাবো উনার কাছে..”
রিক মেঘকে শান্ত করে পিহুকে কল লাগায়। পিহু কিছু বলতেই আড়চোখে একবার মেঘের দিকে তাকায়। তারপর তাকে নিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী বেড়িয়ে পড়ে। তারা দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেলের সামনে। মেঘ চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। নামতেই সে দৌড়ে যায় রিসেপশনের কাছে,
-“এক্সকিউজ মি, রুদ্র…রুদ্র চৌধুরী নামের পেসেন্ট কোন কেবিনে আছে?”
সেখানের একজন মহিলা নাম চেক করে বলে দেয় কোন কেবিনে আছে। মেঘ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না, দু’তলার দিকে হাঁটা দেয়। পেছন পেছন রিকও আসছে। মেঘ যত এগোচ্ছে তার হার্টবিট তত বাড়ছে। নির্দিষ্ট কেবিনের সামনে এসে পা স্লো হয়ে যায়। একবার রিকের দিকে তাকায়, রিক মাথা দিয়ে ইশারা করে ঢুকতে। মেঘ বড়সড় একটা ঢোক গিলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ভেতরে ঢুকেই যেন অবাক হয়ে যায়। রুদ্র, সায়ান, শান্তরা বসে আছে। মোবাইলে কিছু একটা করছে, একেকজন বলা বলি করছে,
-“আরে এনিমি মার মার,”
-“তুই বা*ল মুখের সামনে ওয়াল মারলি কেন…”
-“আরে ভাই আগে আমারে রিভাইভ দে লুট সব যাবেগা…”
মেঘ এদের অবস্থা দেখে বলে উঠে,
-“কি হচ্ছে..”
মেঘের কণ্ঠ পেয়েই রুদ্র চমকে তাকায়। দরজার দিকে চোখ যেতেই যেন সে নির্বাক হয়ে যায়। হাতের মোবাইলটা বেডে পড়ে যায়। এতোদিন পর তার মেঘকে দেখছে সে। তার এখন কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। মেঘ এতো সহজেই ধরা দেবে ভাবেনি। এদিকে মেঘ রুদ্রকে দেখে আরও বেশি চমকে উঠে। নিজের অবস্থা কি করেছে রুদ্র। চুল উস্কোখুস্কো, দাড়ি অনেকদিন কাটেনি মনে হয়, বড় হয়ে গেছে। চোখের নিচে হালকা কালো কালো দাগ। মেঘের বুকের ভেতর কেমন এক ব্যথা শুরু হয়। তার পরিপাটি রুদ্রের একি হাল হয়েছে।
তার এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কেউ তাকে ঝরের গতিতে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এটা যে রুদ্র ছাড়া অন্য কেউ নয়। মেঘ চুপটি করে রুদ্রকে অনুভব করছে। আজ কতদিন পর একটু শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারছে। এই বুকেই তো তার সব শান্তি। এর মধ্যেই শান্তরা তাদের প্রাইভেসি দিতে বেড়িয়ে যায়।
এভাবেই বেশ কয়েক মিনিট যায়, রুদ্রের মুখে কোনো কথা নেই, মেঘও বলছে না। হঠাৎ মেঘ নিজের ঘাড় ভেজা অনুভব করে চমকে যায়। রুদ্র তার জন্য কাঁদছে? অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকানোর চেষ্টা করে তবে রুদ্র তার মুখ মেঘের ঘাড়ে গুঁজে আছে।
-“আমাকে ছাড়া এতোদিন থাকলে কি করে বউ…?”
রুদ্রের কণ্ঠে যন্ত্রণা, অভিমান, ভয় সব মিলিয়ে কথাটি মারাত্মকভাবে এসে লাগে মেঘের বুকে। তবুও সে চুপ থাকে। তার চোখেও পানি, সেও অভিমান করে আছে। মুহূর্তেই মনে পড়ে রুদ্রের তো গুলি লেগেছে। সাথে সাথে চিন্তিত হয়ে তাকে নিজের থেকে ছাড়ায়,
-“এই আপনার কোথায় লেগেছে, বেশি কিছু হয়নি তো? দেখি কোথায়?”
মেঘকে এভাবে তার জন্য চিন্তিত হতে দেখে রুদ্র নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা হাসে দুই পকেটে হাত গুঁজে বলে,
-“এই দেখো, আমার তো কিছু হয়নি। একদম ফিটফাট…”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
-“তাহলে খবরে যে…..”
রুদ্র মুচকি মুচকি হাসছে। তা দেখে মেঘ যা বোঝার বুঝে যায়। রাগে, দুঃখে, টেনশনে কেঁদে উঠে,
-“আপনি আপনি একটা মিথ্যাবাদি, চিটার, বাটপার। অনেক খারাপ লোক। আবারও আমার মন নিয়ে খেলেছেন। আমাকে টেনশনে রাখতে, আমাকে কষ্ট দিতে আপনার অনেক ভাল্লাগে তাই না। আমি আর কোনোদিনও আপনার সামনে আসবো না। চলে যাবো অনেকদূর…”
মেঘের কথা শোনে রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। শান্ত কণ্ঠে হুমকি ছুড়ে,
-“আর একবার যাওয়ার কথা মুখে আনলে ঠ্যাং ভেঙে বাসায় বসিয়ে রাখবো। তোমার সাথে অনেক হিসাবনিকাশ বাকি। অনেক জ্বালিয়েছো, এবার নিজেও জ্বলতে প্রস্তুত হও…”
মেঘ দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে দরজা খুলতে নেয়। দেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। একবার রুদ্রের দিকে তাকায় তো একবার দরজা ধাক্কায়। রুদ্র মুচকি হাসছে,
-“এবার আর আমার থেকে পালাতে পারবে না। দরকার হয় খাঁচায় বন্দি করে রাখবো। এই রুদ্রের থেকে দূরে যাওয়ার কোনো পথই আমি রাখবো না।”
-“আমি আপনার কাছে থাকতে চাই না। যান না যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তাকে নিয়ে থাকুন।”
দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে হঠাৎ দরজা খুলে যায়। মেঘ আর দিকবেদিক না তাকিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে পড়ে। রুদ্র সাথে সাথে বেরোতে নেয়, শান্তকে দেখে রাগি চোখে তাকায়,
-“বো***** দরজা খুললি কেন..”
শান্ত আমতা আমতা করে বলে,
-“ভেবেছি তুই ধাক্কাচ্ছিলি..”
-“তোকে তো পড়ে দেখছি। আবার যদি মেঘকে হারাই তোর বংশের বাতি নিবিয়ে দিবো…”
বলতে বলতেই সে মেঘের পিছু নেয়। মেডিকেল থেকে বেড়িয়েই মেঘ একটা রিকশায় উঠে পড়ে। তা দেখে রুদ্র দ্রুত নিজেও বাইকে করে রিকশার পিছু নেয়।
রিকশা চলছে, তার পিছু পিছু রুদ্রের বাইকও ধীরে ধীরে চলছে। কিছুদূর যেতেই বাইকের শব্দে মেঘ পিছে তাকায় দেখে রুদ্রকে। বাইক নিয়ে তার পিছে পিছেই আসছে, হেলমেট পড়ায় মুখ ঢাকা, শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে। তার তাকানো দেখেই রুদ্র একটা চোখ টিপ মারে। তা দেখে সাথে সাথে মেঘ মাথা ঘুরিয়ে নেয়। রিকশার ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে বলে,
-“মামা দ্রুত চালান..”
এভাবেই এগোচ্ছে, রুদ্র তার পিছু পিছু যাচ্ছে। একটু পর পর সে তাকিয়ে দেখছে, আর রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছে। বেশ কিছুদূর যেতেই বাইকের শব্দ না শোনে চলে গেছে ভেবে মেঘ পিছে তাকায় আবার। তবে সাথে সাথে আঁতকে উঠে “রুদ্রের বাইক রাস্তার সাইডে পড়ে আছে আর রুদ্র তার পাশে”। তা দেখে দ্রুত রিকশা থামাতে বলে,
-“মামা রিকশা থামান, রিকশা থামান..”
রিকশাওয়ালা সাথে সাথে থামায়। মেঘ এক মুহূর্ত দেরি না করেই পাগলের মতো ছুটে যায়। রুদ্র এক্সিডেন্ট করেছে ভেবে। তবে এই নির্জন রাস্তায় আর তো গাড়ি তেমন নেই কিসের সাথে বাড়ি লেগে পড়লো।
মেঘ সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখে রুদ্র অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, হেলমেট মাথায় এখনো। মেঘ তো ভেবেছে সত্যি কিছু হয়েছে। তার শরীর ঝাঁকিয়ে পাগলের মতো ডাকছে। আশেপাশে মানুষ দেখছে না। রিকশাওয়ালাকে সাহায্যের জন্য ডাকবে ভেবে তাকাতেই দেখে সেও নাই। অবাক হয়ে বলে,
-“রিকশাওয়ালা কোথায় গেলো?”
পাশ থেকে কেউ একজন বলে,
-“সে ভয়ে পালিয়েছে, এক্সিডেন্ট কেইসে ফাসঁবে নাকি….”
মেঘ রুদ্রের কণ্ঠ শোনে, ফট করে পাশে ফিরে তাকায় দেখে রুদ্র বসে আছে। মেঘের তাকানো দেখে রুদ্র বলে উঠে,
-“সারপ্রাইজ…”
মেঘ এবার আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারে না। রুদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। বাচ্চাদের মতো জুড়ে জুড়ে কান্না শুরু করে। কাঁদছে আর রুদ্রের বুকে কিল ঘুষি দিচ্ছে,
-“এসব কোন ধরনের ফাইজলামি। আপনি আসলেই খারাপ একটা লোক। জঘন্য লোক, স্বার্থপর লোক। বারবার আমার আবেগ নিয়ে খেলছেন।”
মেঘের কথা শোনে রুদ্র হেসে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়,
-“সরি বউ, আম রিয়েলি সরি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও, আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না। তোমার আমার প্রতি রাগ আছে, অভিমান আছে, যত যা আছে। সব কিছুর শাস্তি তুমি আমার কাছে থেকেই আমাকে দাও। আমি সব মাথা পেতে নিবো। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেও না। তোমাকে ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার। তুমি আমার একমাত্র চাঁদ। তুমি থাকলে আমার জীবন আলোকিত হয়ে থাকে। এই রুদ্র চৌধুরী ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ে তুমি ছাড়া, প্লিজ।”
রুদ্রের গলা পাকিয়ে আসছে একটু থেমে মেঘের মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে চোখ মুছে দিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
-“প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি যেমন চাইবা ওমনই হবো। তুমি যেভাবে বলবা আমি ঠিক সেই ভাবেই থাকার চেষ্টা করবো। ভুল হলে শাসন করো, বকা দিও, তারপরও আমারে ছেড়ে যেও না। আমি অসম্ভব ভালোবাসি তোমাকে। তুমি ছাড়া দ্বিতীয় নারীর অস্তিত্ব নেই আমার জীবনে। বিশ্বাস করো জানন..”
রুদ্রের চোখে পানি চিকচিক করছে, মেঘের চোখ দিয়েও অঝোরে পানি পড়ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“বিশ্বাস করুন আমিও আর পারছি না। আপনাকে ছাড়া আমার বুকের ভিতর কি চলতেছে একটা বার যদি দেখাতে পারতাম।”
রুদ্র আলতো করে মেঘের কপালে গালে নাকে নিজের অধরজোড়া ছোয়ায়। মেঘ ও আবেশে চোখ বুঝে নেয়।কিছুক্ষনপর রুদ্র উঠে দাঁড়ায়, মেঘকেও টেনে তুলে। তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলে,
-“আর এক ফোটাও কষ্ট দিবো না তোমাকে বউজান।”
গাড়ি টেনে তুলে নিজে উঠে, মেঘকে ইশারা করে উঠতে। মেঘও চুপচাপ উঠে রুদ্রকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে বসে। নিজের বুকের উপর মেঘের দুই হাত দেখে মুখে প্রখর হাসির রেখা ফুটে উঠে, গাড়ি স্টার্ট দেয়। বাইক চলছে বাড়ির উদ্দেশ্যে, রুদ্র আস্তে করে বলে,
-“ভালোবাসি বউ…”
মেঘও মিনমিনিয়ে বলে উঠে,
-“আমিও আপনাকে ভালোবাসি…”
মেঘের মুখে ভালোবাসি শোনে রুদ্র দুষ্টু হেসে গান ধরল,
” যদি তুমি ভালোবাসো,
ভালো করে ভেবে এসো,
খেলে ধরা কোনো খানে রবে না..
আমি ছুঁয়ে দিলে পড়ে,
অকালেই যাবে ঝরে,
গলে যাবে যে বরফ গলে না….
আমি গলা বেচে খাবো,
কানের আশেপাশে রবো,
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কথা হবে না…”
রুদ্র গান শোনে মেঘ বুঝে যায় কিসের ইঙ্গিত। তার কাঁধে হালকা থাপ্পড় মেরে বলে,
-“অসভ্যলোক, চুপচাপ গাড়ি চালান।”
———
চৌধুরী বাড়িতে আজ খুশির আমেজ। বাড়ির বউ এতোদিন পর ফিরে এসেছে বাড়িতে। সিদ্দিকা বেগম তো মেঘকে বুকে নিয়ে সে কি কান্না,
-“আমাকে ছুঁয়ে কসম করে বল, আর কোনোদিনও আমাদেরকে ছেড়ে যাবি না। আমার ছেলেটা কেমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো তোকে না পেয়ে। আর এমন শাস্তি দিস না মা।”
মেঘ মাথা নেড়ে বলে,
-“আর কখনো যাবো না তো আপনাদের ছেড়ে। আপনারা ছাড়া আমার আর কে আছে এই দুনিয়ায়।”
মেঘের কথায় সিদ্দিকা বেগম তার কপালে চুমু দিয়ে বলেন,
-“এইতো আমার লক্ষ্মী মেয়ে।”
বাড়ির সবাই তাকে নিয়ে মেতে আছে। যেন কত বছর পর বাড়ি ফিরেছে সে। তবে পিহু নেই জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে ভার্সিটি গেছে যে এখনো আসেনি। মেঘের জন্য ভালোমন্দ রান্না বসিয়ে দিয়েছেন সিদ্দিকা বেগম। মেঘ সবার সাথে টুকটাক কথা বলে রুমে চলে আসে। এতক্ষন সবাই মিলে বলেই যাচ্ছিলো রুদ্র কি কি পাগলামি করেছে তাকে না পেয়ে। শোনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলো সে।
রুদ্র তাকে রেখেই কোথায় যেন বেড়িয়ে গেছে। রুমে ঢুকতেই মেঘের নাক কুঁচকে আসে। সিগারেটের গন্ধ পুরো ঘরে ছড়িয়ে আছে। নিচে সিগারেটের পুরো প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রুমের অবস্থা নেই। বারান্দারও একই অবস্থা। ফুঁস করে শ্বাস ফেলে কোমরে কাপড় বেঁধে শুরু করে কাজ। সব গুছিয়ে ঘরটাকে মানুষ করে চলে যায় গোসলে। গোসল সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠে, আজ কতদিন পর শান্তি লাগছে। নিজের ঘর, নিজের সংসার, এসব আবার ফিরে পেয়ে। তবে মনে প্রশ্ন থেকেই যায়, সাফা আর রুদ্র এমন নাটক করলো কেনো কাকে ধরতে।
———
রুদ্র কারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অর্নব। রুদ্র তাকে ভয় পেতে দেখে বলে,
-“ইউ নো হো আই এম ?”
-“র..রুদ্র, প্লিজ ভুল হয়েছে…”
-“উহুহ রং,…”
অর্নব মাথা তুলে রুদ্রের দিকে তাকায়। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে,
-“উইর যম….”
অর্নব চমকে যায়। রুদ্র অস্বাভাবিকভাবে শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কেন করলি এমন? তোর ধারনা আছে আমি এখন তোকে কি করবো?”
অর্নব চুপ থাকে। কোনো উত্তর না দেখে রুদ্র চিৎকার করে উঠে,
-“বল কেন এমন বিশ্বাসঘাতকতা করলি? এতোদিন কি দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি। বন্ধু হয়ে বন্ধুর পিছেই ছুড়ি মারলি? ফারহান আর আমার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করলি। তারপর এখন আমার মেঘের পিছে পড়েছিস।”
অর্নব থমথমে মুখে বলে,
-“আ..আমি শুধু মেঘকে…”
সাথে সাথেই এগিয়ে এসে নাক বরাবর এক ঘুষি মারে। নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে অর্নব নাকে হাত দিয়ে দু’কদম পিছিয়ে যায়। রুদ্র রেগে বলে,
-“আবারও মিথ্যা বলছিস…”
এবার অর্নবও চিৎকার করে উঠে,
-“হ্যা আমি সব করিয়েছি। তুই সবসময় সবকিছুতে আগে থাকতি, তোর পিছে যেন বাকিরা চাকর? হ্যা, টাকা দিয়ে কিনে রেখেছিলি চাকর আমাদের? সেই স্কুল লাইফ থেকে তুই সবকিছুতে প্রায়োরিটি পেয়েছিস। স্যার-ম্যাম থেকে শুরু করে ফ্রেন্ডদের মাঝেও তুই সবসময় আগে। তোর কথায় সবাই ডিসিশন নিত। আমি সমান ভালো রেজাল্ট করেও কারো আগ্রহ পাইনি। সবাই তোকে অলরাউন্ডার বলতো। তোর জন্য আমি কোনোদিন আমার প্রতিভা দেখাতে পারিনি। সবাই দেখেও ইগনোর করতো। তারপর আসি ফারহানের কথায়। রাহুল-ফারহান তোর বেস্টফ্রেন্ড, মানলাম। কিন্তু ফারহানেরও তো তোর মতো অবস্থা। কই রাহুল তো সাদাসিধা ছিলো, তোদের এতো গুণ দেখাতে কে বলতো? পুরো স্কুলে তোরা দুজনই ক্রাশ ভয় ছিলি। তোদের জন্য কেউ পাত্তাই দিত না। কলেজেও সেইম অবস্থা। মেনে নিয়েছি। কিন্তু তুই আর ফারহান সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করিস কেন? এসব মেনে নিতে পারছিলাম না। তোদের এতো ফেইম এতো মাখো মাখো বন্ধুত্ব আমার তো সহ্য হচ্ছিলো না। তাই তোদের মধ্যে ঝামেলা লাগিয়েছি। ভেবেছিলাম একটু নষ্ট হবে, পরে দেখি শত্রুতে পরিণত হয়েছিস… হাহাহাহা”
রুদ্র রাগে থরথর করে কাঁপছে। উঠে এসে অর্নবের কলার চেপে ধরে,
-“তারমানে এসব তুচ্ছ কারণে তুই আমার আর ফারহানের মাঝে এসেছিলি? আমি কোনো কারণ ছাড়াই ফারহানকে তোর কথায় যা নয় তা বলেছিলাম সেদিন। সে এতোবার বুঝাতে চেয়েছিলো, আমি শুনিনি। শুধু তোর কথায় ভরসা করেছিলাম। আর তুই বলছিস তুই আমাদের কাছে ইম্পর্ট্যান্ট ছিলি না? আরে বোকা, তুইও আমাদের সবার কাছে সমান ইম্পর্ট্যান্ট ছিলি। আমি আর ফারহান যাই মত নিতাম, তোদের কথা শুনেই নিতাম। নিজের উপর ঘৃণা আসছে তোর মতো বিশ্বাসঘাতককে বন্ধু নয়, ভাই ভেবে মেনে নিয়েছিলাম।”
অর্নব নিশ্চুপ। রুদ্র আবার বলে,
-“মনে আছে, একবার তুই মেডিকেল ভর্তি ছিলি। আমরা সবাই তোর চিন্তায় নিজেদের কাজ ফেলে তোর সাথে ছিলাম। তোর প্রতিটা জন্মদিনে আমরা সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছি। যেকোনো সেলিব্রেশন, ট্রিপ, সবকিছু মিলেমিশেই করেছি। কখনো তোকে বাদ দিয়েছি কিছুতে? বন্ধুত্বের মাঝে স্বার্থ থাকে না। কিন্তু তুই স্বার্থ খুঁজেছিস বলেই তোর কাছে সব তুচ্ছ মনে হয়েছে।”
বলেই রুদ্র তাকে ধাক্কা মেরে ছেড়ে দেয়। অর্নব তাচ্ছিল্য করে বলে,
-“আচ্ছা, এটা নাহয় আমার ভুল ছিলো। আমি গিলটি ফিল করেছি এ নিয়ে। কিন্তু তারপর কি করলি? আমার ভালোবাসাও কেড়ে নিলি? সব মেনে নেবো আমি?”
রুদ্র অবাক চোখে তাকায়। মাথায় ঢুকছে না, কার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে সে।
-“কিসব বলছিস, মাথা ঠিক আছে?”
-“হ্যা ঠিক আছে। জীবনের প্রথম অনুকেই ভালোবেসেছিলাম। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই পছন্দ করি। সাহস হয়নি বলার। কিন্তু ও তোকে ভালোবাসতো, তোকে চাইতো…”
অর্নবের গলা ভেঙে আসে, চোখে পানি চিকচিক করছে। নিজেকে সামলে বলে,
-“তুই আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে সুখে থাকবি ভাবলি? তাই আমি তোর লাইফ থেকে তুই যাকে ভালোবাসিস তাকেও সরাতে চেয়েছি। হ্যা, আমি সব করিয়েছি। আমি তোর মেঘকে মেরে ফেলবো। তোর থেকে যখন তোর ভালোবাসা দূরে যাবে, তখন বুঝবি আমার কষ্ট। আমি একা কষ্ট পাব কেন? তোকেও পেতে হবে।”
রাগের কপালের রগ ফুলে উঠে, রুদ্র আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। ঝাঁপিয়ে পড়ে, অর্নবকে উরাধুরা মারতে থাকে। দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে অর্নব মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রুদ্র আরও মারতে যেয়েও থেমে যায়। এরমধ্যেই পুলিশ এসেছে, রুদ্রই কল করেছিলো। কারন তার হাতে থাকলে বড়সড় কিছু হয়ে এতে পারে।
রুদ্র অর্নবের কলার ধরে বলে,
-“তুই যদি আমার ফ্রেন্ড না হতিস, তোকে এতোক্ষণে খুন করতাম। তবে আমি অমানুষ হতে পারিনি। আজকের পর যেন তোকে চোখের সামনে না দেখি।”
পুলিশ অর্নবকে নিয়ে যায়। রুদ্র ফুটপাতে বসে পড়ে। চোখে ভেসে উঠে তাদের বন্ধুদের কাটানো মুহুর্তগুলো এভাবে যে তাদের গ্রুপ একে একে শেষ হয়ে যাবে জীবনে কল্পনাও করেনি। বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অর্নবের বলা কথাগুলো। কাকে সে এতো বিশ্বাস করেছিলো। ঠিক তখনই একটা নাম্বার থেকে কল আসে। রিসিভ করতেই ভড়কে যায়।
———
ফারহান বিছানায় শুয়ে কালকের ঘটনাগুলো ভাবছিলো। চোখে ভাসছে পিহুর কান্নাভেজা মুখ। বুকের ভেতর ব্যথা করছে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে, আবার মনে হচ্ছে সঠিকও করেছে।
হঠাৎ মোবাইলে কল আসে। খেয়াল করে দেখে পিহুর নাম্বার থেকে ৪/৫টা মিসড কল। সে টেরই পায়নি। দ্রুত কল ব্যাক করে, কিন্তু রিসিভ হয় না। আবার কল দিতে থাকে। লাস্ট কলেই রিসিভ হয়।
-“কি হয়েছে কল ধরছিলে না কেন, ঠিক আছো তো?”
অপরপাশ থেকে অন্য কারো গলা ভেসে আসে,
-“এই মোবাইলের মালিকের এক্সিডেন্ট হয়েছে। অবস্থা খুব ক্রিটিকাল। উনার পরিবারের কেউ হলে দ্রুত সরকারি মেডিকেলে চলে আসুন। অনেকবার কল করেছি, এখনো কেউ আসেনি। দ্রুত আসুন…”
ফারহান স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রথম দু’লাইনই তার কানে ঢোকে, বাকিটা আর শুনতে পারে না। “পিহু…” ভাবতেই অন্ধকার নেমে আসে চোখে মুখে। নিশ্বাস ভারি হয়ে উঠে,
-“না না, আমার পিহুর কিচ্ছু হতে পারে না।”
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে। তার এভাবে ছুটে যাওয়া দেখে বাসার সবাই চিন্তিত সায়ান পিছু নেয় তার। ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে ফারহান। হাত-পা কাঁপছে। প্রায় আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যায় মেডিকেলে। ভেতরে ঢুকেই নার্সকে জিজ্ঞেস করে,
-“একটু আগে যে এক্সিডেন্ট রোগী এসেছে, তিনি কোথায়?”
নার্স তাকায় ফারহানের দিকে,
-“আপনি উনার পরিবারের লোক?”
ফারহান দ্রুত মাথা নাড়ায়। নার্স ইতস্তত করে বলে,
-“উনি আর নেই। মেডিকেলে আনতে আনতেই মারা গেছেন। ওই যে ভীড় জমেছে, তার লাশ দেখতেই…”
ফারহান কয়েক সেকেন্ড বোবা হয়ে থাকে। নার্স কি বলছে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মাথায় ঢুকছে না কিছু। কয়েক সেকেন্ড যেতেই কথাটি তার ভেতর নাড়া দিয়ে তুলে। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠে,
-“পিহু…..”
দ্রুত ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায়। সামনের সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশের কাছে ছুটে যায়। সামনে যেতেই পা থেমে যায়। ফারহান কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
-“না না, এ আমার পিহু হতে পারে না। কাপড় সরান, ফেইস দেখান।”
ডাক্তার শান্তভাবে বলে,
-“মুখে আঘাত বেশি পেয়েছে, থেতলে গেছে। দেখে চেনা সম্ভব নয়।”
পাশ থেকে একজন ব্যাগ আর ফোন এগিয়ে দেয়,
-“এগুলো উনার থেকে পেয়েছি, দেখুন।”
ফারহান সেদিকে তাকিয়েই চমকে উঠে,
-“এ তো প..পিহুর…”
মুহূর্তেই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। শরীরে যেনো শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। শরীর থরথর করে কাপছে, ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে লাশের দিকে। এটা পিহুর? পিহু আর নেই? কাঁপা হাতে কাপড় ছুঁয়ে বলে,
-“প..পিহু এটা তুমি?”
কোনো উত্তর নেই। সে আবার বলে,
-“এই, উত্তর দাও না কেন?”
সায়ান কাঁধে হাত রাখে। ফারহান ভাঙা কণ্ঠে বলে,
-“দেখ, পিহু কথা বলছে না। নাটক করছে। মরার নাটক করছে। বলনা ওকে আমার জীবন নিয়ে যতখুশি নাটক করতে, তবুও এসব না করতে।”
চারপাশের সবার চোখে পানি। ফারহানের চোখ দিয়ে ঝরঝরিয়ে পানি পড়ছে। সে সায়ানকে বলছে,
-“ওকে বল না উঠতে। আমার বুক ব্যথা করছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।”
সায়ানের চোখও ভিজে আসে। সবাই বলাবলি করছে, “আহারে মেয়েটাকে মনে হয় অনেক ভালোবাসতো, মরে গেলো কিভাবে সহ্য করবে..”
ফারহান গর্জে উঠে,
-“চুপ! আমার পিহুর কিছু হয়নি। ওর কিছু হতে পারে না।”
দ্রুত হাতে সে লাশটাকে ঝাঁকাতে শুরু করে ডাকতে থাকে,
-“এই জান, উঠো না প্লিজ। মজা করছো তাই না? আমার উপর রাগ হয়েছে? এই দেখো কানে ধরছি। আর এমন করবো না, একদম তোমার মনের মতো হয়ে যাবো…”
দুই হাত কানে ধরে অনুনয় করছে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। এবার ফারহানের বুক যেনো ফেটে যাচ্ছে । সারাক্ষন বকবক করতে থাকা মেয়েটি এখন একটা শব্দ ও উচ্চারণ করছে না। সে এতো ডাকছে তাও উঠছে না। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনা তাকে একেবারে কাবু করে ফেলেছে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে,
-“এই মেয়ে, উঠ না রে। ছেড়ে যাবি তো ভালোবাসা জন্মালি কেন? এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো……
চলবে……
[ফারহানের লাইন গুলো লিখতে যেয়ে নিজেরই চোখ ভিজে আসছিল কেনো জানি। যাই হোক সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করে পাশে থাকবেন। হ্যাপি রিডিং।]
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬৪
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬০
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৩
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬১
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৩৭
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২০
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৬
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪০
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৮
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪১