#আড়ালে_তুমি |৬১|
#_সাইদা_মুন
-“কোনো খবর মিললো…?”
-“আমার সাথে দেখা কর কাজ আছে…. “
-“আচ্ছা সন্ধ্যার পর আসবোনে…”
কল রেখেই রুদ্র মেঘের লেখা চিঠিটা হাতে নেয়। যা সে নিয়ম করে দিনে তিনবার পড়ে,
“প্রিয় রুদ্র সাহেব,
চিঠিটা যখন আপনার হাতে পৌঁছাবে, হয়তো তখন আমি অনেক দূরে। হয়তো এই শহরেই থাকব না, হয়তো আর কোনোদিনই আপনার কাছে ফিরব না। জানি না, আপনি কষ্ট পাবেন কিনা, তবে এইটা জানি আপনি অনেক খুশি হবেন। আমি আর সামলাতে পারছিলাম না নিজেকে। আপনি তো জানেন, আপনাকে ছাড়া আমার পৃথিবী কেমন ফাঁকা? অথচ আপনিই আমাকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলেন, যেখানে শ্বাস নেওয়াটাই কঠিন হয়ে উঠেছিল। আমি আপনার ভালোবাসায় থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে একটু জায়গা হলো না আমার জন্য। আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। আমার ভাগ্যই এমন, সুখ কপালেই নেই হয়তো। কারো ভালোবাসার যোগ্য নই আমি, কেউ আগলে নেয় না, ভালোবাসে না, একটু বোঝেও না। হয়তো আমি অতন্ত্য তুচ্ছ সবার জীবনে। এই কয়দিন আপনার প্রতিটি কথার আড়ালে আমি অনেকবার নিজেকে অচেনা মনে করেছি। অথচ আপনার হাতটা শক্ত করে ধরে বলার মতো সাহস আমার হচ্ছিলো না। কারণ আপনি হঠাৎ অন্য কারো হয়ে গেলেন। জানেন, আপনার সাথে না আমার একটা ছোট্ট সংসারের খুব সখ ছিলো। যেখানে আপনি আমি আর আমাদের একটা ছেলে আর একটা মেয়ে থাকবে। আমাদের মেয়েটা ঠিক আমার মতো হতো আর ছেলেটা আপনার মতো। অনেক সুখী একটা পরিবার হতো তাই না? ঝগড়া হতো, খুনসুটি হতো, ভালোবাসা থাকতো অবিরাম। তবে কিছুই হলো না, সব স্বপ্নই রয়ে গেলো। ভাগ্যের কাছে আবারও হেরে গেলাম আমি। আমার নাম যে মেঘ রেখেছে, ঠিকই রেখেছে। মেঘ যেমন অনেক সময় ধরে আকাশে জমে হঠাৎ ঝরে পড়ে, তেমন আমিও একটু সুখ পেলেই পরমুহূর্তেই ঝরে পড়ি। আজ চলে যাচ্ছি। কিন্তু তার মানে এই না যে আপনাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসা যদি কাউকে বেঁধে রাখার নাম হতো, আমি কখনো যেতাম না। আমি যাচ্ছি, কারণ আপনাকে মুক্তি দিতে চাই। আমি আগে থেকেই হার মেনে নিয়েছি, কারণ আমি আপনাকে ডিভোর্স দিতে পারবো না। বাকি জীবন নাহয় আমার নামের সাথে আপনার নামটুকুই নিয়ে বেঁচে থাকবো। চিন্তা করবেন না, আমি কোনো ঝামেলা করবো না। নিজের অধিকারের জন্য হাজির হবো না। আসবোই না আর আপনার সামনে। যাই হোক, যদি কোনোদিন আমাকে মনে করেন, তবে শুধু এটুকুই মনে রাখবেন,
একটা মেয়ে ছিল, যে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। যার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা শুধুই আপনি। যার বাবার পরে আপনিই একমাত্র আপন মানুষ ছিলেন।
ইতি
মেঘ….”
রুদ্রের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে,
-“আমিও তো তোমাকেই ভালোবাসি মেঘ। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা তুমিই তো। একবার ফিরে আসোনা বউ, আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। আমাদের অনেক সুখী একটা সংসার হবে…”
রুদ্রের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে বারান্দায় যায়। একটা সিগারেট ধরিয়ে মোবাইলের রেকর্ডার অন করে,
“দেখো মেঘ, যারা তোমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলো, তারা কিন্তু সক্ষম হয়েছে। তুমি আমাকে একটু বুঝলে না…. “
তারপর গাইতে শুরু করে,
“এত সহজে ছেড়ে দিলে হাত…
তুমি ছাড়া শূন্য শূন্য লাগে
ঠোঁটে আসে নাম তোমার বারেবারে,
বোঝায় কাকে, এ কেমন ব্যথা….
তুমি বড় প্রিয়, আমার প্রিয়,
তুমি আমার মনের আঙ্গিনায় থাকো,
তুমি এত প্রিয় আমার কাছে,
কত প্রিয় আমার কাছে,
এত প্রিয় আমার কাছে, জানোনা!”
গান গাওয়ার সাথে সাথে চোখ ভিজে আসছিলো বারবার। কণ্ঠে যেনো কষ্টের পাহাড় জমে আছে। রুদ্রের গান শেষ হতেই তা সে তার ফেসবুকে ছাড়ে। একটাই আশা মেঘ যদি একবার দেখে। তার ভেতরের দহন উপলব্ধি করতে পারে।
রুদ্রের পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই লাইক কমেন্টে ভরে উঠে তার নোটিফিকেশনে। মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় রুদ্রের গাওয়া গান সাথে প্রিয় মানুষের জন্য রেখে যাওয়া ছোট্ট একটি চিঠি। একেকজন আফসোস করছে, এমন ভালোবাসা পেয়ে কিভাবে একটা মেয়ে হারায়। অনেকে আবার নিজেদের সাথে মিল খুঁজে শেয়ার করছে, দুঃখ প্রকাশ করছে।
এদিকে একজন বারবার ভিডিওটা দেখে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বড় একটা শ্বাস ফেলে রুদ্রের ছবি বের করে ফোনটা বুকে চেপে ধরে,
-“পৃথিবীর যতগুলো আঘাত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর আঘাত হলো কথার আঘাত। মানুষ কথাতেই বাঁচে, কথাতেই মরে….”
———
পিহুরা আজ অনেকদিন পর ভার্সিটি এসেছে। মেঘকে ছাড়া তাদের বিচ্ছু দলের কেউই আসেনি এই কয়দিন। কারোই মনমানসিকতা ভালো নেই। সুমনা তো একদম ভেঙে পড়েছে। ছোট থেকে একসাথে ক্লাস করা, আড্ডা দেওয়া, কিছু হলেই সাথে সাথে শেয়ার করা, এমন বান্ধবীকে হঠাৎ হারিয়ে সে যেনো ভীষণ রকমের একা ফিল করছে।
-“ভাই তোরা এমন সেন্টি খাবি তো ভার্সিটি আসলি কেনো..?”
পিহু হতাশ হয়ে বলে,
-“বাসায় ভাইয়ার এসব দেখে দম বন্ধ লাগে। ভাবলাম এখানে আসলে হয়তো তোদের সাথে একটু ভালো লাগবে। কিন্তু এখন মেঘকে আরও বেশি মিস করছি…”
পিহুর কথা শুনে সুমনা তো কান্না করেই দেয়। তাকে কাঁদতে দেখে পিহু আগলে নেয়,
-“দূর পাগলি, কাঁদে না। আমাদের মেঘ আবার ফিরে আসবে আমাদের মাঝে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস….”
সুমনা নাক টেনে টেনে বলে,
-“কবে আসবে? ও ছোট থেকেই অবহেলা পেয়ে বড় হয়েছে। কষ্ট ছাড়া ভালোবাসা একটুও পায়নি। আমার সাথে যতক্ষণ থাকতো আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতাম তাকে বোনের মতো ট্রিট করতে। তার দুঃখ কষ্টের ভাগ নিতে চাইতাম। কিন্তু মেঘ ভীষণ চাপা স্বভাবের, কেউ তাকে মেরে গেলেও বলতো না। রুদ্র ভাই কেনো এমন করলেন…”
পিহুর চোখেও পানি জমে, নিজেকে সামলে বলে,
-“ভাইয়া মেঘের সেফটির জন্যই তো এমনটা করেছে..”
পিহুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুমনা রেগে উঠে,
-“সেফটির জন্য তো বলে করলে কি হতো? মেয়েটা কতটা খুশি ছিলো তার জীবনে ভালোবাসার মানুষ পেয়ে। সব এক নিমিষেই শেষ করে দিয়েছে। তোর ভাইয়ের দোষ, সব সব তোর ভাইয়ের জন্য হয়েছে…”
পিহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“কিছু সময় আমরা আপন মানুষের ভালো করতে গিয়ে, তার সব থেকে বড় ক্ষতিটাই করে ফেলি…”
রিক ফুসঁ করে বলে,
-“এতে আমি কারোর দোষই দিবো না। রুদ্র ভাইও সমান কষ্ট পাচ্ছেন, মেঘও পেয়েছে। এখানে শুধু বোঝার ভুল হয়েছে। রুদ্র ভাই বুঝতে পারেনি মেঘের সে ছাড়া আর কেউ নেই, আর মেঘ বুঝতে পারেনি রুদ্র ভাই তাকে কতটা ভালোবাসে।”
সবাই চুপসে যায়। আর কি-ইবা বলার। সুমনাও শান্ত হয়ে যায়, কারণ তারা নিজের চোখেই দেখছে রুদ্রের অবস্থা। সেদিন রাতে যখন ধুলোবালি মাখা জামা কাপড় আর এলোমেলো চুল নিয়ে তাদের বাসায় এসেছিলো মেঘের খোঁজে, সেদিনই সে নিজ চোখে দেখেছে রুদ্রের চোখে মেঘকে হারানোর তীব্র ভয়। তাকে না পেয়ে তার চোখে চিকচিক করা পানি। কেমন নিস্তেজ দেহ নিয়ে তাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো।
রিক এদের চুপ দেখে হঠাৎ বলে উঠে,
-“একটা গল্প শোনবি..? দেখিস মুড ঠিক হয়ে যাবে।”
পিহুরা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
-“কি..?”
-“তবে শুরু করি…”
সুমনা রিককে থামিয়ে বলে,
-“ফাউল গল্প হলে মুখ বন্ধ রাখ..”
-“আরে না রে মেরি মা, আগে তো গল্প শোন…”
তারপর রিক একটা বড় শ্বাস নিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলা শুরু করে,
-“এইটা কিছুদিন আগের ঘটনা। আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম যাচ্ছিলাম যাচ্ছিলাম..”
রিকের কথার মাঝে পিহু উঠে বলে,
-“পড়ের লাইন বল, যাচ্ছিলি বুঝছি..”
রিককে ডিস্টার্ব করায় বিরক্ত হয়ে বলে,
-“চুপ! বলছি তো… যাচ্ছিলাম যখন তখন হঠাৎ রাস্তার পাশে এক লোককে হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। লোকটি আশেপাশে কাউকে খুঁজছে। ভীষণ রাগান্বিত লাগছিলো, কেমন খেপে আছে লোকটি। যেনো যাকে খুজছে তাকে পেলেই লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিবে…”
এই পর্যায়ে পিহু-সুমনা বেশ সিরিয়াস হয়ে যায়। ভাবছে কোনো ক্রিমিনাল নাকি। রিক ফের বলা শুরু করে,
-“তারপর আমি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম এগোচ্ছিলাম, অমনি লোকটি আমাকে দেখে ফেলে। দেখেই জহুরি চোখে আমার যাওয়া দেখছে। আমি তো লোকটিকে দেখেই ভয়ে চেয়ে তার দিকে। চেয়ে চেয়ে একপা একপা হাঁটছি। লোকটিও আমাকে দেখছে, আমিও লোকটিকে দেখছি। সেও চোখ সরায় না, আমিও চোখ সরাই না। সেও তাকিয়ে, আমিও তাকিয়ে…”
রিকের এক কথাকে এতোবার পেঁচানো দেখে সুমনা ঝাড়ি মেরে উঠে,
-“চুপপপ! পড়ের লাইন বল, মাথা নষ্ট করে দিচ্ছিস…”
-“তারপর হঠাৎ লোকটি ‘পাইছি রে এএএ’ বলে লাঠি উঁচু করে আমার দিকে তেড়ে আসে। আমি তো জান বাঁচাতে দিকবিদিক না তাকিয়েই ভোঁ দৌড়। তারপর কোনো রকমে জান বাঁচিয়ে একটা বাসায় ঢুকি..”
পিহু চমকে যায়, তারা তো চিন্তিত হয়ে বলে,
-“পুলিশে বলিসনি? এইটা তো কোনো বড়সড় ক্রিমিনাল হবেই..”
সুমনাও চিন্তিত হয়ে বলে,
-“হ্যা হ্যা, তারপর তোর কিছু করেনি তো? মানুষ ডাকলি না?”
রিক সিরিয়াস হয়ে বলে,
-“আরে লোকটিকে এলাকার সবাই ভয় পায়। কেউ ভয়ে সামনেও যায় না,”
-“ওরে বাপরে! এতো তাইলে হেব্বি ডেঞ্জারাস লোক।”
সুমনার কথায় পিহুও বলে,
-“হুঁ, চিন্তায় পড়ে গেলাম। লোকটিকে পুলিশের আওতায় দেওয়া উচিত..”
এদের কথায় রিক ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“পাগলকে কি পুলিশ ধরে..?”
রিকের কথায় সুমনা-পিহু দুজনেই চমকে তাকায়,
-“মানে? ওইটা পাগল ছিলো..?”
-“আরে হুঁ, পাগলই তো..”
রিকের কথায় পিহুরা রেগে যায়, কটমট চোখে তাকায়। যেনো খেয়ে ফেলবে,
-“শা*লা! এইটা যে পাগল, প্রথমেই বললি না। আমরা ভেবেছি সিরিয়াস কোনো ক্রিমিনাল। মন দিয়ে শোনছিলাম। গর্দভ…”
তাদের রাগতে দেখে রিক দ্রুত বলে,
-“আরে টুইস্ট এখনো বাকি। শোন শোন, এবার মজা পাবি..”
রিক ফের শুরু করে,
-“তারপর পাগলটা ওখান থেকে যেতেই আমি বেড়িয়ে পড়ি। তাকিয়ে দেখি চারিপাশ অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আশেপাশে কোনো গাড়ি নেই, শুনশান রাস্তা। আমি আস্তে আস্তে হাঁটছি, রাস্তা পার হচ্ছি, বাড়িঘর পেরুচ্ছি। সাথে আমিও এগিয়ে যাচ্ছি গন্তব্যে। বেশ কিছুক্ষণ পর যেতেই হঠাৎ সামনে দেখতে পাই যে…”
লাস্ট লাইনটুকু শোনে পিহুরা ভয় পেয়ে যায়। হয়তো অনেক ভয়ংকর কিছু দেখেছে তাই এমন রিয়েক্ট করছে রিক। তারা চোখ বড়বড় করে অধীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“সামনে কি দেখেছিস..?”
রিক উঠে দাঁড়ায়,
-“সামনে দেখি যে….. আমার বাসা। তারপর বাসায় ঢুকে যাই।”
রিকের কথায় যেনো ওরা বলদ বনে যায়। তাদের যে রিক ইচ্ছে করেই বলদ বানিয়েছে বুঝতে পেরেই উঠে দেয় দৌড়ানি। রিকও হেসে সামনে দৌড় দেয়। তিনজনই হাসছে, দৌড়াচ্ছে, পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে। হয়তো মেঘ থাকলে তাদের সাথে এভাবেই এঞ্জয় করতো।
ক্লাস শেষ করে পিহু বেড়িয়ে পড়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আজ বাড়ির গাড়ি নিয়ে আসেনি। ড্রাইভার অসুস্থ, তাই রিকশার জন্য হাঁটছে। কিছুটা দূর যেতেই হঠাৎ পিহুর নজর যায় রাস্তার পাশের ফুচকার দোকানে। তাকে এখন আর কে আটকায়। সোজা গিয়ে ফুচকা অর্ডার দিয়ে আরামে বসে চেয়ারে। প্রায় কয়েক সেকেন্ড যেতেই সেখানে একটা গাড়ি থামে। পিহু ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই একটা মেয়ে নেমে আসে। সাথে সাথে ড্রাইভিং সিট থেকে ফারহানও নেমে আসে। ফারহানকে দেখে পিহু চমকে তাকায়। সে বিরক্তি নিয়ে সেখানে আসে। ফুচকা অর্ডার দিয়ে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় পিহু। তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
ফারহানের তাকানো দেখে পিহু দ্রুত চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সেখান থেকে যেতে নিলে দোকানদার আটকায়,
-“কি আপা, খাবেন না? বানানো তো শেষ কই জান..”
পিহু একবার ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ওদের দিয়ে দিন, আমি খাবো না..”
বলে চলে যেতেই ফারহান তার হাত ধরে ফেলে। পিহু পেছন ফিরতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে,
-“কেন খাবেনা?”
পিহু কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়,
-“পছন্দ না, তাই..”
ফারহান অবাক হয়ে বলে,
-“মজা করছো? তোমার না ফুচকা প্রিয়?”
পিহু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
-“বাব্বাহ এতো খুঁজ রাখেন? তবে আজ থেকে অপ্রিয় জিনিসের তালিকায় পড়ে গেছে..”
হাত ছাড়িয়ে সামনে এগোয়। রিকশা ডাকে, পরপর দুইটাই না করে দেয়। বিরক্ত হয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। তখন আবারও ফারহানের ডাকে থেমে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায়। ফারহানকে আর ওই মেয়েকে সহ্য হচ্ছে না তার।
-“কি সমস্যা আপনার?”
-“একা যাবে?”
-“জি..”
-“গাড়ি কোথায়?”
-“ড্রাইভার আংকেল অসুস্থ।”
-“চলো, আমি দিয়ে আসবো..”
-“প্রয়োজন নেই..”
-“এত কথা শুনতেই চাইছি না..”
পিহু কয়েক সেকেন্ড তাকায় ফারহানের দিকে, তারপর তার পেছনের মেয়েটির দিকে। মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। পিহু হালকা হেসে চোখের ইশারা করে বলে,
-“কে..?”
ফারহান নির্দ্বিধায় বলে,
-“স্নেহা..”
পিহুর বুক ধক করে ওঠে। ওইদিন এই “স্নেহা” নামই তো মোবাইলে ভেসেছিলো। তাহলে কি সে..? না, আর ভাবতে পারছে না। ধম আটকে আসছে। ফারহানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাঁটা ধরে। ফারহান কয়েকবার ডাকে, তবে শোনে না।
পিহু হাঁটতে হাঁটতে পার্কের সামনে এসে পৌঁছায়। একটু নিরিবিলি জায়গায় বসতে চায়। চুপচাপ গিয়ে একটি বেঞ্চে বসে পড়ে, পাশে ব্যাগ রাখে। আশেপাশে কত ছেলে-মেয়ে, কারো সাথে বউ, কারো সাথে গার্লফ্রেন্ড। সবাই নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে। তার যদি একটা ভালোবাসার মানুষ থাকতো, কি ক্ষতি হতো? বারবার ফারহানের সাথে সেই মেয়েটির দৃশ্য ভাসছে চোখে। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না,হালকা ফুপিয়ে উঠে,
-“কেন আমার হলেন না? আমার হলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো আপনার? আমি তো আপনাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিলাম। তাও কেনো পেলাম না? একজন ভালোবাসা হারিয়ে কাঁদে, আর একজন ভালোবাসা না পেয়ে কাঁদে। মেঘ আর রুদ্র ভাই তো একে অপরকে ভালোবাসে, তাই হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। তবে আমার এই কষ্টের কারণ কি বলবো? একতরফা ভালোবাসা?”
———
সন্ধ্যা ৬টা,
রুদ্র বসে আছে এক ক্যাফেতে, তার সামনে সাফি। এই ছেলের সাথে কাজের সূত্রে পরিচয়, তবে বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সাফি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
-“ঘটনা হচ্ছে, কল রেকর্ড হাতে পেয়েছি..”
সাফির কথায় রুদ্র চমকে তাকায়,
-“আগে বলিসনি কেন? দে শুনি! আজকে ওর কলিজা আমি ছিড়ে আনবো। এর জন্যই আমি আমার মেঘকে হারিয়েছি।”
-“কুল কুল! এই কারণেই আগে থেকে বলিনি। আগে থেকে পাঠালে এভাবে হাইপার হয়ে সব প্ল্যানে আবারও পানি ফেলতে..”
রুদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-“কি বলতে চাচ্ছিস?”
-“মেঘ কোথায় আছে জানিস?”
-“না..”
-“তুই যদি এখন তার উপর আক্রমণ করিস, সেও মেঘের উপর আক্রমণ চালাবে। মেঘ তোর আন্ডারেও নেই যে সেফ আছে সিউর হতে পারবি।”
সাফির যুক্তি শুনে রুদ্র কিছুটা নরম হয়। শান্ত কণ্ঠে বলে,
-“আগে ভয়েস শোনাও..”
রাহুলের কল রেকর্ড,
-“হ্যাঁ সাফা..”
-“কোথায় তুমি?”
-“এইতো আমরা আসছি, সারা মেঘ ওরা নাকি ফুচকা খাব…. মেঘঘঘ সরো…”
তখনই ঠাস করে মোবাইল পড়ার শব্দ।
-“হ্যালো! হ্যালো রাহুল! কি হলো রাহুল?”
কিছুক্ষণ পর শোনা যায় হালকা ভয়েস,
-“শীট, একটাকে টপকাতে গিয়ে আরেকটা গেছে উফ… আরে নিচে এইটা কার ফোন? রাহুলের নাকি? কলে কেউ শিট… টুট টুট..”
সবটা শোনার পর রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। শেষের কণ্ঠটা সে খুব ভালো করেই চিনে। চোখ লাল হয়ে ওঠে, ঘাড়ের রগ ফুলে যায়। এমন বিশ্বাসঘাতকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিলো, ভাবতেই ক্ষোভ দ্বিগুণ হয়। ধপ করে উঠে দাঁড়ায়। রুদ্রকে এমন দেখে সাফি ভড়কে গিয়ে তাকে চেপে ধরে,
-“আরে ভাই, কুল কুল! প্লিজ এখন কিছু করিস না। এতে তোর ক্ষতি হবে। মেঘের কথা চিন্তা কর।”
মেঘের নাম শুনতেই রুদ্র আবার নরম হয়ে যায়, বসে পড়ে। ভীষণ অসহায় লাগছে। একদিকে মেঘ নেই, আরেকদিকে এত কাছের বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা। কেন করেছে বুঝতে পারছে না। অসহায় কণ্ঠে বলে,
-“আমি এখন কি করবো?”
সাফি কিছু ভেবে বলে,
-“রাস্তা বের করছি।”
কথার মাঝেই রুদ্রের মোবাইলে মায়ের কল আসে।
-“হ্যালো রুদ্র,”
-“হুম, বলো..”
-“পিহু এখনো বাসায় ফেরেনি। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব টেনশন হচ্ছে। কলও ধরছে না, একটু দেখ না।”
মায়ের কথায় রুদ্র চমকে উঠে দাঁড়ায়।
-“কি বলছো? দুপুরে আসার কথা, সেখানে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা আর তুমি এখন বলছো? আচ্ছা রাখো, আমি দেখছি।”
রুদ্র সাথে সাথে রিক আর সুমনাকে ফোন দেয়। দুজনেই বলে, “ক্লাস শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যেই তো গিয়েছিলো।” চিন্তায় পড়ে যায় রুদ্র। পিহুর নাম্বারে বারবার কল দেয়, তবে রিং হয়ে কেটে যায়। রুদ্রকে চিন্তিত দেখে সাফি বলে,
-“লোকেশন চেক দে, ইজিলি পেয়ে যাবি।”
রুদ্র তাই করে। লোকেশন অনুযায়ী বেরিয়ে পড়ে।
———
-“আমাকে ভালোবাসলেন না কেন?”
-“পিহু দেখো, এখন সন্ধ্যা। এখানে অনেক আজেবাজে লোকের আড্ডা বসবে। চলো, তোমায় বাসায় পৌঁছে দেই।”
ফারহান হাত ধরতে গেলেই পিহু ঝারি মেরে ফেলে দেয়। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
-“আমার যা ইচ্ছে হোক, তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। দূরে থাকুন! চলে যান এখান থেকে। এসেছেন কেন? আমার মজা উড়াতে? এই যে কাঁদছি, চোখের পানি দেখে মজা নিতে? মজা নেওয়া হলো? এবার দয়া করে যান..”
ফারহান নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু শুনে যায়। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ পিহুর ঘাড়ে হাত রাখে। পিহু চমকে তাকাতেই রুদ্রকে দেখে, আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। ভাইয়ের বুকে ফুপিয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে। রুদ্র বোনকে আঁকড়ে ধরে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারহানের চোখে চোখ রেখে বলে,
-“ভালোবাসিস আমার বোনকে..?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ফারহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কোনো উত্তর দেয় না। রুদ্র আরও গলা বাড়িয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে। এবারও উত্তর না পেয়ে গর্জে ওঠে,
-“মাদ*** বল, আমার বোনকে ভালোবাসিস কিনা?”
ফারহান একবার পিহুর দিকে তাকিয়ে হালকা ঢুক গিলে বলে,
-“না..”
ফারহানের না শুনে রুদ্র আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। বোনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে। পিহু কাঁদছে, খুব কাঁদছে। ভাই তাকিয়ে আছে বোনের মুখে। আজ যেন ভাইবোন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভালোবাসার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। সে আগে থেকেই সন্দেহ করেছে পিহু ফারহানের প্রতি দুর্বল। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“ভাইয়া তোকে অনেক ভালো ছেলে এনে দিবো।”
পিহু মাথা নিচু করে থাকে, কিছু বলে না। রুদ্র আর দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
———
পরের দিন দুপুরে ৩ টা,
মেঘ রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রইংরুমে আসে, এক ভদ্রলোক নিউজ দেখছে। মেঘকে দেখে ডাক দেয়,
-“দাঁড়িয়ে আছিস কেন মা? আয়, বস..”
মেঘ মুচকি হেসে পাশে বসে নিউজে নজর দেয়। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটি খবর আসে, যা দেখে মেঘ চমকে ওঠে। ভদ্রলোকও হকচকিয়ে বলেন,
-“আরে, এ যে রুদ্র চৌধুরি! ওকে কেউ গুলি করেছে, মেডিকে…”
চলবে…
[ পড়ে অবশ্যই সুন্দর সুন্দর মন্তব্যের মাধ্যমে জানাবেন কেমন হয়েছে।]
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৯
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৯
-
আড়ালে তুমি (সারপ্রাইজ পর্ব প্রথমাংশ)
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩৭
-
আড়ালে তুমি গল্পের লিংক সাইদা মুন
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৮
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১৯
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪৫
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৯