#আড়ালে_তুমি |৬০|
#_সাইদা_মুন
কেটে গেছে ১ সপ্তাহ,
মেঘকে পুরো শহর খুঁজেও পায়নি। রুদ্রের বুকের ভেতর প্রতিনিয়ত এক অজানা ভয় “সে কি আর কোনোদিন মেঘকে পাবে না?” প্রতিটি জায়গায় মেঘকে খুঁজে বেড়ায়, চেনা রাস্তা থেকে শুরু করে সব অলিগলি। এই সাতদিনে রুটিন হয়ে গেছে, অফিস থেকে এসেই বেরিয়ে পড়া মেঘের খোঁজে। তবে লাভ হয় না, কোথাও খুঁজে পায় না৷ পুলিশ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাবে কী করে, যখন কেউ নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তাকে কি পাওয়া যায়?
রুদ্র প্রতি মুহূর্তে নিজের ভেতরে ধ্বংসের অনুভূতি টের পাচ্ছে। মেঘ চলে গেছে মানেই জীবন যেনো ফাঁকা হয়ে গেছে। অপরাধবোধে ভুগছে সারাক্ষণ “কেন আমি তাকে কষ্ট দিলাম, কেন এমন করলাম?” সবার সাথে রূঢ় বিহেভ করে, মনে হয় মেঘকে হারানোর জন্য চারপাশের সবাই দায়ী। কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলে না, খাওয়া-দাওয়া করে না। নিজের যত্ন নিতে ভুলেই গেছে যেনো, চেহারায় অদ্ভুত ক্লান্তি। আয়নায় তাকালেই নিজের ভেতর এক অচেনা ভাঙাচোরা মানুষকে দেখতে পায়। এতো মানুষের ভিড়েও মনে হয় সে একা, একেবারেই একা। এক মুহূর্তে বিশ্বাস করে মেঘ ফিরে আসবে, পর মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে। এক ভয়ংকর শূন্যতা তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে।
কেবলমাত্রই রুদ্র হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরেছে। সিদ্দিকা বেগম ছেলের এই হাল আর মেনে নিতে পারছেন না। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললেন,
-“আয় বাবা বস, আমি শরবত নিয়ে আসি।”
বলেই রুদ্রকে ধরে সোফায় বসান। উঠে যেতে নিলে রুদ্র তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে দেয়। তারপর নিজের মাথা মায়ের কোলে রেখে কাঁপা গলায় বলে,
-“আম্মু তোমার ছেলে কি খুব খারাপ?”
সিদ্দিকা বেগমের বুক কেঁপে ওঠে। ছেলের কণ্ঠে কষ্ট স্পষ্ট। উনি আর ছেলের এই দশা মেনে নিতে পারছেন না। তার ছেলেটা যে কতোটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা প্রতিটি মুহূর্তে বুঝতে পারেন। ছেলের মুখের দিকে তাকালেই তার চোখে পানি চলে আসে। হাসি-খুশি আদরের ছেলেটির কী অবস্থা হয়েছে, ভাবলেই তার নিজের গলা দিয়ে খাবার নামে না। রুদ্রের কপালে হাত বুলিয়ে চুমু দিয়ে বলেন,
-“একদম না, আমার ছেলে সব থেকে বেস্ট ছেলে। খারাপ হতেই পারে না।”
এবার রুদ্র ঢুকরে কেঁদে ওঠে,
-“আম্মু মেঘকে এনে দাও না, আমি আর পারছি না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। নিজেকে স্ট্রং রাখতে পারছি না তো। এই সাতটা দিনে আমি প্রতি সেকেন্ডে পুড়ছি মেঘকে হারিয়ে। ও কি ঠিক আছে? ওর কিছু হয়নি তো? ওর কিছু হলে আমি কি নিয়ে থাকবো আম্মু? মেঘ অনেক অভিমান করেছে আমার উপর তাই না? তার তো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না আপন বলতে। এসব জেনেও আমি তাকে কষ্ট দিয়েছি। আমি আসলেই অমানুষ, আমাকে ও ক্ষমা করবে না, করবে না…”
সিদ্দিকা বেগম চুপচাপ নিজেও কাঁদছেন। এই কদিনে ছেলেটা যেনো সেই ছোটবেলার রুদ্র হয়ে গেছে। যে খেলায় হারলেও সবার সামনে স্ট্রং দেখাতো, তবে আড়ালে এসে মায়ের কোলেই শুয়ে ইচ্ছে মতো কাঁদতো। তবে দিন দিন বড় হতে হতে এই অভ্যাসও বাদ দিয়েছিলো। হঠাৎ করেই তার সেই ছোট্ট ছেলেটি ম্যাচিউর হয়ে উঠেছিলো। আর এখন যেনো আবার বদলে গেছে এই সাতটা দিন মেঘকে খুঁজে না পেয়ে। খালি হাতে বাসায় ফিরে মায়ের কোলের মাথা ফেলে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ফেলে। মেঘকে ভীষণ ভালোবাসে তার ছেলে, ছেলের কষ্টে পুরো চৌধুরী পরিবারই শোকে।
করিডোরের কোনায় দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ে দেখছে রুদ্রকে। পিহু ভাইয়ের কান্না দেখে নিজেও কেঁদে ফেলে। এরশাদুল চৌধুরী মেয়েকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেন। তার চোখও ছলছলে, একমাত্র ছেলের এই দশা দেখে। পিহু কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“আব্বু, ভাইয়াকে মেঘ এনে দাও না। ভাইয়ার কষ্ট আমি আর মানতে পারছি না। আমার ভাইয়াটাকে আজ কতোদিন ধরে একটু হাসতে, আমাদের সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে দেখিনি। আমার আগের রুদ্র ভাইকে এনে দাও না। আমার ভাই শেষ হয়ে যাচ্ছে যে।”
এরশাদুল চৌধুরীর বুকের ভেতর যেনো জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে ছেলের জন্য। সে কম তো চেষ্টা করছে না। যদি কেউ আশা দিতো যে, তার জান দিলেই মেঘকে খুঁজে পাওয়া যাবে, তাহলে উনি তাই করতেন, শুধু যেনো ছেলেটা একটু ভালো থাকে। তবে মেঘ নিজে থেকে আড়ালে গেছে, তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভবই হয়ে উঠছে না।
———
রুদ্র হাঁটতে হাঁটতে এক গলিতে চলে আসে। আশেপাশে দেখছে, এখানেই তো মেঘকে দেখেছিলো। পাগলের মতো চারপাশে ডাকতে থাকে “মেঘঘঘ!” “মেঘঘঘ!” দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ দেখতে পায় একটি মেয়ে দ্রুত এক বাসার গেইট দিয়ে ঢুকছে। পেছন দেখেই রুদ্র চিনে ফেলে এটি মেঘ ছাড়া আর কেউ না। সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে ডেকে ওঠে,
-“মেঘঘঘঘঘঘঘঘহহহ!”
মুহূর্তেই সামনের মেয়েটির পা থেমে যায়। কাঁপা শরীর নিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। দেখে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে মেঘকে দেখেই রুদ্রের প্রাণে যেনো পানি ফিরে আসে। ভেতর থেকে শান্তির নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। কোনো দিকে না তাকিয়েই ছুটে আসে তার দিকে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে মেঘ দ্রুত বলতে থাকে,
-“একদম কাছে আসবেন না, আমার জীবনে আর আপনার প্রয়োজন নেই…”
রুদ্র তাল হারিয়ে এসে মেঘকে ঝাপটে ধরে নিজের বুকে আগলে নেয়। কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
-“কিন্তু আমার জীবনে তোমাকে প্রয়োজন। ভূমিহীন প্রতিটি মুহূর্তে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
রুদ্রের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মেঘও কাঁদছে তবে নীরবে। রুদ্র একটু থেমে ভাঙা গলায় অপরাধীর স্বরে বলে ওঠে,
-“আমাকে মাফ করে দাও…”
মেঘ শক্ত কণ্ঠে জিদ নিয়ে বলে,
-“কখনোই না…”
রুদ্র মিনতি ভরা কণ্ঠে আবারও বলে,
-“প্লিজজজ বউ…”
মেঘ অভিমানের স্বরে বলে,
-“না, আপনার সঙ্গ লাগবে না আর…”
রুদ্র মেঘকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। অসহায় সুরে বলে,
-“আমার তো লাগবে তোমাকে…”
বলতে বলতেই হঠাৎ কেউ তার মাথায় জোরে আঘাত করে। সাথে সাথে সে মেঘকে ছেড়ে মাথায় হাত দেয়। এই ফাঁকে মেঘ তার থেকে দূরে চলে যায়। মেঘ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। রুদ্র মাথায় হাত দিয়ে বারবার অনুনয় করছে,
-“মেঘ যেয়ো না, আমি মরেই যাবো। আমাকে এতো শাস্তি দিও না। একটু মায়া দেখাও, আমি আর পারছি না। মেঘঘঘ মেঘঘঘগ….”
তবে মেঘ রুদ্রের কথা শুনছে না। সে আস্তে আস্তে অনেক দূরে সাদা ধোঁয়ার সাথে মিশে যায়। একেবারে চোখের আড়াল হতেই রুদ্র জোরে চিৎকার করে ওঠে,
-“মেঘঘঘঘঘঘঘহ…”
চোখ খুলে আশেপাশে তাকাতেই দেখে কেউ নেই। এদিক-সেদিক মেঘকে খুঁজছে, তবে নিজের রুম দেখে শান্ত হয়ে যায়। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। এদিকে তার “মেঘ” বলে চিৎকারে বাড়ির সবাই উঠে আসে। সিদ্দিকা বেগম হন্তদন্ত পায়ে ছেলের ঘরে ঢুকে যান। রুদ্রকে মাথা ধরে বসে থাকতে দেখে বলেন,
-“কি হয়েছে আব্বু?”
রুদ্র মাথা তুলে মা সহ বাকিদের দেখে অল্প স্বরে বলে,
-“কিছু না, তোমরা উঠে এলে কেনো? যাও ঘুমাও।”
তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সবাই বুঝতে পারে মেঘকে নিয়ে হয়তো কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। সাদ, সামিয়া, পিহু থাকতে চাইছিলো রুদ্রের সাথে একটু কথা বলতে। তাকে ঠিক করতে। তবে রুদ্র ধমকে পাঠিয়ে দেয়,এতো রাতে কিসের কথা এসব বলে।
সামিয়া রুমে এসেই রাফানকে কল করে,
-“আসসালামু আলাইকুম…”
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম, তা কোথায় গিয়েছিলেন ম্যাম…”
সামিয়া তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,
-“রুদ্র ভাইয়ের রুমে।”
রাফান চিন্তিত হয়ে বলে,
-“কেনো? ওর কিছু হয়েছে নাকি?”
-“মেঘ বলে চিৎকার করছিলো, হয়তো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। জানেন, রুদ্র ভাই মেঘকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মেঘ না অনেক লাকি, এমন ভালোবাসার মানুষ পেয়ে।”
রাফান আফসোস নিয়ে বলে,
-“রুদ্রের এই সময়ে পাশে থাকতে পারলাম না…”
-“আপনি দেশে আসবেন কবে?”
-“বেশি না, আর ৫/৬ দিন পর…”
-“তাড়াতাড়ি আসবেন…”
সামিয়ার কথায় রাফান দুষ্টু স্বরে বলে,
-“মিস করছেন বুঝি…”
সামিয়া হালকা লজ্জা পেয়ে বলে,
-“রাখছি, ঘুমাবো।”
———
-“মেঘ, তুই এমন করছিস কেনো? দেখ, রুদ্র ভাই কেমন দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছেন তোকে না পেয়ে…”
মেঘ আস্তে করে উঠে দাঁড়ায়, জানালার সামনে গিয়ে পর্দা সরিয়ে রাতের আকাশের পানে চেয়ে বলে,
-“মেয়েরা তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের জন্য অস্থির হতে, ছটফট করতে দেখতে পছন্দ করে…”
-“তাই বলে এতো? দেখছিস না ছেলেটার অবস্থা? আর কতো শাস্তি দিবি?”
-“দেখা যাক…”
চলবে…..
[আপনাদের রিকোয়েস্ট ফেলতে না পেরে এই পর্ব দ্রুত করে লিখেছি। নয়তো আজকে আর পর্ব দেওয়ার কথা ছিলোনা। তাই ছোট হয়েছে বলে কেউ লজ্জা দিবেন না ধন্যবাদ। ]
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৮
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৬
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪৩
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৬
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৬
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৩
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪১
-
আড়ালে তুমি আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১