#আড়ালে_তুমি |৫৯|
#_সাইদা_মুন
মাঝরাতে মেঘের চোখে ঘুম নেই। ভীষণ অস্থির লাগছে। এদিক-ওদিক করছে, আর পারছে না, তার একটু শান্তি দরকার। হঠাৎ উঠে বসে, ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে রুদ্রের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজা লাগানো নাকি খোলা দেখতে হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। ড্রিমলাইটের আলোয় দেখা যায় রুদ্র বিছানায় শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মেঘ আস্তে করে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। গুটিগুটি পায়ে এগোয়। কিছুটা যেতেই রুদ্রের ঘুমন্ত মুখটা ভেসে ওঠে। কী স্নিগ্ধ, কী মায়া লাগছে। এই ছেলেটির মাঝেই তো ডুবে গেছে সে। সব কিছুর পরেও তার কাছেই ছুটে আসতে চায় এই অবাধ্য মন। এতো কষ্ট দিচ্ছে তাও তাকে ঘৃণা করতে পারছে না।
মেঘ আস্তে ধীরে বিছানায় উঠে রুদ্রের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মুহূর্তেই রুদ্র তাকে জড়িয়ে নেয়। চমকে মাথা তুলে তাকায় মেঘ, রুদ্র কি জেগে আছে? কিন্তু না, চোখ বন্ধ। হয়তো ঘুমের ঘোরেই ধরেছে। মেঘের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়। তবে ভালোই লাগছে, তার যেন এখন একটু শান্তি লাগছে। কিন্তু এই ভেবেই কান্না আসছে যে এই বুকটা আর তার একান্ত নেই। ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখতে চাইলেও পারে না। রুদ্রের বুকেই ফুপিয়ে ওঠে। কান্নার সাথে সাথে শরীর কেঁপে উঠছে বারবার, যা অন্য এক বুকের ভেতরেও কম্পন তুলছে। এভাবেই কেটে যায় বাকি রাত।
ফজরের আজান পড়ছে, তবুও মেঘের চোখে ঘুম নামে না। সাবধানে আস্তে-ধীরে উঠে বসে, যেন রুদ্র টের না পায়। তারপর চলে যায় নিজের রুমে। অযু করে বসে পড়ে জায়নামাজে।
———
-“কেনো করলেন এমনটা আমার সাথে…?”
সকাল সকাল ঘর থেকে বের হতেই মেঘের মুখোমুখি পড়ে রুদ্র। চোখ-মুখ ফোলা ফোলা, হয়তো সারারাত ঘুমায়নি। চোখের নিচে কালি পড়েছে। প্রশ্ন শুনে থেমে যায় রুদ্র, কাঠ-কাঠ গলায় বলে,
-“Because you deserve it…”
বলেই হাঁটা ধরলে, পেছন থেকে মেঘের কান্না-মেশা গলায় ভেসে আসে কিছু কঠিন কথা,
-“অভিশাপ অভিশাপ লাগবে, আলাদা করে দিতে হবে না। আমার চোখের প্রতিটি ফোঁটা পানি থেকেই লাগবে। ধ্বংস হয়ে যাবেন আপনি। আমাকে কষ্ট দিয়ে কোনোদিন শান্তিতে থাকতে পারবেন না…”
প্রতিটি শব্দ রুদ্রকে নাড়িয়ে তুলছে। এতোটা ঘৃণা জন্মেছে তার প্রতি। সেদিন সারাদিন কেটে যায়, মেঘ নিজের ঘরেই থাকে। খাওয়ার সময় শুধু একবার পিহু জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আবার রুমে ঢুকে আর বের হয়নি।
সন্ধ্যার দিকে রুদ্র বাসায় ফেরে। গাড়ি পার্ক করতে করতে হঠাৎ নজর যায় ছাদের দিকে। সাইডে কেউ বসে আছে। ভালো করে দেখতেই লম্বা চুল ঝুলতে দেখা যায়। সহজেই বুঝে যায় এটা মেঘ ছাড়া আর কেউ নয়। ভড়কে যায়, সে কি উল্টাপাল্টা কিছু করতে চাইছে। এ ভাবতেই বুকের ভেতর ভয় জমে ওঠে। ছুটে যায় ছাদে। কর্নারে গিয়েই এক টানে টেনে নামিয়ে বলে,
-“স্টুপিড! কী করতে যাচ্ছিলে?”
মেঘ নিরব চোখে তাকায় রুদ্রের দিকে। তারপর নিজে থেকেই হাত ছাড়িয়ে মুচকি হেসে বলে,
-“বাব্বাহ! আমাকে নিয়েও চিন্তা করেন। চিন্তা নেই, মরতে আসিনি। এমনি খোলা আকাশের নিচে একা কিছুক্ষণ সময় কাটাতে ইচ্ছে করছিল।”
রুদ্র গম্ভীর গলায় বলে,
-“তোমার চিন্তা নেই, তোমার কিছু হলে আমাদের ঝামেলা বইতে হতো তাই…”
বলেই নেমে যায় ছাদ থেকে। আর মেঘ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে, ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।
———
কেটে যায় আরও তিনদিন,
এই তিনদিনে রুদ্র মেঘের আর কোনো কথা হয়নি। মেঘ একেবারেই চুপসে গেছে, রুদ্রের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যা হয়েছে তা ভাগ্যে ছিলো ভেবে মেনে নিয়েছে হয়তো। কারো সাথে ‘হ্যাঁ-না’ ছাড়া কথাই বলে না। সারাক্ষণ একা বসে থাকে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়েই দিয়েছে প্রায়। বাড়ির সবাই মিলে তাকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। হাসিখুশি মেয়েটার এই অবস্থা কেউই মানতে পারছে না।
সন্ধ্যার দিকে পিহু জোর করে টেনে নিয়ে আসে ড্রয়িংরুমে। সবাই মিলে হরর ফিল্ম দেখবে বলে। বাড়ির পুরুষেরা তখন বাইরে। টিভি অন করতেই খবরের চ্যানেল ভেসে ওঠে। কর্তারা হয়তো আগেই দেখছিল। চ্যানেল পাল্টানোর আগেই স্ক্রিনে এক ছবি ভেসে ওঠে, রুদ্র আর সাফা হাত ধরে দাঁড়িয়ে, অন্যপাশে মেঘ। হেডলাইনে লেখা,
“বউকে ছেড়ে দিয়ে প্রেমিকাকে আপন করলেন রুদ্র চৌধুরী।”
মেঘ অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে। সবাই হকচকিয়ে মেঘের দিকে তাকায়। দ্রুত চ্যানেল পাল্টে ফিল্ম আনে।
সবাই ডুবে যায় সিনেমায়। এক মেয়ে খালি ঘরে হাঁটছে, অদ্ভুত শব্দে সামনে এগোচ্ছে… একের পর এক ছায়া দ্রুত পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে। সবার বুক ধড়ফড়, এই বুঝি ভূত এসে পড়বে। ঠিক সেই উত্তেজনার মাঝেই হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। সবাই ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। এমন মুহূর্তে কলিংবেলের শব্দ যেন কোনো হরর মুভির ভৌতিক সাউন্ডের থেকেও ভয়ঙ্কর লাগলো। বাইরে থেকে বারবার বেল চাপা শুরু হয়।
মেঘ উঠে গিয়ে দরজা খুলে। ভেতরে ঢুকে রুদ্র, হন্তদন্ত হয়ে,
-“কি হয়েছে?”
রুদ্রকে দেখে পিহু বিরক্ত হয়ে বলে,
-“ধুর ভাইয়া, ভয় পাইয়ে দিলে।”
রুদ্রের সাথে সাফাও ঢোকে। সাফাকে দেখে মেঘ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, বাকিরাও প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকায়। রুদ্র সবার চোখ বুঝে নিয়ে বলে,
-“পিহু, তোরা রেডি হয়ে নে। মার্কেটে যাবো।”
পিহু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-“কেনো?”
-“বিয়ের মার্কেট করতে…”
-“বিয়ে মানে…?”
-“হ্যাঁ, আমার বিয়ে এই শুক্রবারেই…”
সিদ্দিকা বেগম চমকে উঠে বলেন,
-“রুদ্র, কি বলছিস এসব?”
-“যা শোনেছো তাই। এ নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না।”
বলেই রুদ্র ঘরে চলে যায়। মেঘ একইভাবে দাঁড়িয়ে, তার কোনো হেলদোল নেই। সাফা এগিয়ে গিয়ে সিদ্দিকা বেগমকে সালাম করতে চাইলে তিনি উঠে চলে যান। দাদীর কাছেও গেলে তিনি এড়িয়ে যান। রুদ্রের ছোট চাচীও সরে যায়। রয়ে যায় মেঘ, সামিয়া আর পিহু। সাফা তাদের সাথে টুকটাক কথা বলে মেঘের কাছে গিয়ে বলে,
-“কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তুমিও রেডি হও, আমাদের সাথে যাবে।”
মেঘ একবার তাকিয়ে কোনো জবাব না দিয়েই গেস্টরুমে চলে যায়। আধা ঘণ্টা পর পিহু, সামিয়া আর সাফা বের হয় শপিং মলের উদ্দেশ্যে। মেঘকে নিতে চাইছিলো তবে সে যায়নি।
গাড়ির সামনে এসে রুদ্র ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দেয়। সাফা মুচকি হেসে উঠে বসে। রুদ্র নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে স্টার্ট দিতে যাবে, ঠিক তখনই অপরিচিত নম্বর থেকে মেসেজ আসে। ওপেন করে দেখে,
-“সব পেলে নষ্ট জীবন… তাই সব পেতে নেই, কিছু না কিছু হারাতে হবেই তোকে…”
রুদ্র মেসেজ দেখে হালকা হেসে ফেলে। তার জালে পা দিয়েছে তাহলে। কাউকে মেসেজ দিতেই রিপ্লাই আসে,
-“ইয়েস, পেয়েছি। ৫ মিনিট টাইম দে, ডিটেইলস বের করছি। তুই দ্বিতীয় প্ল্যান নিয়ে কাজ শুরু কর।”
মোবাইল রেখে একবার বারান্দার দিকে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,
-“বউ, আর একটু সহ্য করো। আমি তোমাকে আর কখনো কষ্ট দিবো না…”
এদিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন গভীর মনোযোগে সবকিছু দেখছে। নিজের স্বামীকে অন্য কারো হতে। অশ্রু গড়িয়ে কখন গাল ভিজে যাচ্ছে, তা টেরও পাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে শক্ত করে নেয়। আজ সে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে বেড়িয়ে টেবিলে বসে খাতা-কলম হাতে। গভীর মনোযোগে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে লিখছে একটি চিঠি। সেখানে শুধু শব্দ নয়, মিশে আছে মনের অনুভূতি আর চোখের পানি। কাগজটা সুন্দর করে ভাঁজ করে মুঠোয় নেয়। রুদ্রের ঘরে গিয়ে চারদিকে ভালো করে চোখ বুলায়। ভেসে ওঠে গত সাত মাসের প্রতিটি মুহূর্ত। টেবিলে চিঠিটা রেখে নীরবে বেরিয়ে যায়। কেউ জানে না মেঘ কোথায় যাচ্ছে।
হাতে আছে কিছু খুচরো টাকা। এগুলো দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে, তবে ফেরার কোনো উপায় থাকবে না। আসলে সে ফিরতেও চায় না। বেড় হতেই সিএনজি পায় তা নিয়ে রওনা হয় নিজের গন্তব্যে। প্রায় ৩০ মিনিট পর পৌঁছে যায়। নির্জন রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে এক কবরস্থানে। বাজে তখন সাতটা। এমন সময়ে কোনো সাধারণ মানুষ কি এখানে আসে?
মেঘ ধীরে ধীরে বাবার কবরের সামনে বসে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আলতো স্বরে বলে,
-“আব্বু, তোমার বুকে মাথা রাখতে ইচ্ছে করছিলো…”
বলতে বলতেই কবরের উপর মাথা হেলিয়ে দেয়। এক হাতে মাটির উপর হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
-“এখানেই তো শান্তি। মনে হচ্ছে তোমার বুকে মাথা রেখে আছি। আব্বু, তোমার মেয়ে স্ট্রং হয়ে গেছে। আজ তাদের একসাথে দেখেও নিজেকে সামলে নিয়েছি। বিয়ের কথা শোনার পরও সামনে চোখের পানি ফেলিনি। যেন কষ্টই লাগেনি। সব ছেড়ে চলে এসেছি। উনাকে ডিভোর্স দিতে পারবো না। তাই সরে এসেছি। বাকি জীবন একাই কাটাবো, তার নাম নিয়েই।”
একটু থেমে হেসে আবার বলে,
-“দেখো, আমি ভীতুও নই। একা একা কবরে বসে আছি তোমার কাছে। আমার বাঁচার ইচ্ছেই নেই আর। আল্লাহ যদি তাড়াতাড়ি তোমার কাছে নিয়ে যেতেন, তাহলে তো তোমাকে পাশে পেতাম।”
অশ্রু অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে মেঘ। কান্নার বেগ বাড়তেই থাকে। একসময় চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,
-“হে আল্লাহ, সে যখন আমার নয়, তাহলে কেনো আমার মনে তার জন্য ভালোবাসা দিলে? ঘৃণা দিতেও পারতে! তাহলে অন্তত থাকতে পারতাম। এত কষ্ট নিয়ে পারছি না তো… বুকের ভেতর যেন পাথর ঝুলে আছে, ভার ভার লাগে। চিনচিনে ব্যথা থেকে হঠাৎ তীব্র ব্যথা শুরু হয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সে আমার নয় ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। কেনো আমাকে এই পরীক্ষায় ফেললে? আমি ধৈর্য ধরে থাকতে পারছি না…”
কতক্ষণ যে এভাবে কেটে যায়, সে নিজেও জানে না। তারপর আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ায় হাঁটতে থাকে। কোথায় যাবে জানে না, কারন তার যাওয়ার জায়গা নেই।তবে যাবে অনেক দূরে। যেখানে রুদ্রের ছায়াও থাকবে না। নিরিবিলি রাস্তায় মাঝে মধ্যে একটা-দুটো গাড়ি যাচ্ছে। মেঘ মাথা নিচু করে চিন্তায় ডুবে হাঁটছে। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়ে তার উপর। মাথা তুলে তাকাতেই আঁতকে ওঠে…
———
রুদ্ররা শপিং মলে আসতেই সায়ানরাও সেখানে উপস্থিত হয়। মূলত রুদ্রই তাদের আসতে বলেছিল। একে একে সবাই শপিং মলে ঢুকে পড়ে। সাফা বিয়ের জন্য লেহেঙ্গা দেখছে। সামিয়া পিহু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কাহিনি দেখছিল। বিরক্ত হয়ে পিহু বলে, “ওয়াশরুম থেকে আসি,” বলেই সেখান থেকে চলে যায়।
যেতে যেতে হঠাৎ একটা দোকানের বড় টেডিবিয়ারের দিকে নজর যায়। তা দেখতে দেখতেই এগোচ্ছিল। তবে পথিমধ্যে হঠাৎ কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগে। পড়ে যেতে যেতে সামনের ব্যক্তির টিশার্ট টেনে ধরে নিজেকে ব্যালেন্স করে নেয়। ছেলে মানুষ দেখে, দ্রুত হাত ছেড়ে সামনে তাকাতেই থমকে যায় পিহু। সামনের দিকে ফারহান দাঁড়িয়ে, গভীর চোখে তাকিয়ে আছে। পিহু দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায়, একবারও পেছন ফিরেও তাকায় না। হয়তো তাকালে দেখতো, কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। ফারহান হয়তো পিহুর থেকে এতটা ইগনোর আশা করেনি।
রুদ্র এদিক সেদিক নজর রাখছিলো আর বারবার ফোন চেক করছিল। বেশ কিছুক্ষণের পর কাংখিত কল আসে। সঙ্গে সঙ্গে তা রিসিভ করে,
-“হ্যা বল কি খবর, খুঁজ পেয়েছিস?”
-“হ্যা, তবে শকিং নিউজ হলো, লোকেশন তোদের ওখানেরই দেখাচ্ছে।”
রুদ্র চমকে যায়,
-“হোয়াট…”
-“হ্যা, লোকেশন তোদের আশেপাশেই।”
রুদ্র চিন্তিত হয়ে বলে,
-“তার মানে সাফা ঠিক বলেছে? আমাদের ফ্রেন্ডদের মধ্যেই কেউ একজন…”
-“হ্যা…”
-“আর রাহুলের ফোন কলের রেকর্ড? এখনো বের করতে পারিসনি?”
-“নারে, বারবার আপডেট হয়ে লাস্টে গিয়ে মারা খাই। ওইটা ট্রাই করেই যাচ্ছি, দেখি…”
-“ট্রাই করতে থাক, যত দ্রুত সম্ভব…”
কথা শেষ করে কল রাখে। শান্ত সায়ান, অর্নব, ফারহান এদের দিকে জহুরি চোখে দেখতে থাকে। ফারহান এর সাথে দ্বন্ধ চলে, এছাড়া তো আর কারো সাথে ঝামেলা নেই। তাহলে কি ফারহান..? কিন্তু ফারহান তাকে বা মেঘকে মারতে চাইবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত। চিন্তা করছে, হিসাব মেলাতে চাইছে, তবে পারছে না কে হতে পারে। মেঘের সাথে সমস্যা নাকি আমার সাথে।
ঘোর কাটে বাড়ি থেকে কল আসায়। কল রিসিভ করতেই রুদ্র চমকে যায়,
-“কি বলছো মা। দেখো বাসায়ই কোথাও আছে..”
সিদ্দিকা বেগম কাদতে কাদতে বলেন,
-“নেই নেই, এই নিয়ে কতোবার পুরো বাসা খুঁজেছি। মেঘ কোথাও নেই। মেয়েটা কোথায় গেল এই রাতে? কোনো খারাপ চক্করে না পড়ে।”
রুদ্রের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কোনোদিকে না তাকিয়েই ছুটে যায় গাড়ির দিকে। এদিকে পিহুরা সবাই অবাক হয়ে দেখছে রুদ্রের যাওয়া। হঠাৎ কি হলো তারা বুঝে উঠছে না। পাগলের মতো ড্রাইভ করছে রুদ্র। ১৫ মিনিটের রাস্তা ৫ মিনিটে আসে, গাড়ি কোনোমতে বাড়িতে ঢুকিয়ে ছুটে যায়।
আবারো সে পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে, তবুও পায়নি। মেঘ কি রাগ করে চলে গেছে? না, রাত হয়ে গেছে, যদি কোনো বিপদে পড়ে। হঠাৎ মাথায় আসে, মেঘের কাছে তো মোবাইল আছে। তাড়াতাড়ি কল দিলে সাউন্ড আসে তার ঘর থেকে। গিয়ে দেখে, বিছানায় মোবাইল রাখা আছে মেঘের। বুকটা ধক করে উঠে, নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। ভেতরে এক শূন্যতার বোধ। মেঘ কি তাকে ছেড়ে চলে গেল। না না তার এতো সাহস নেই।
সিদ্দিকা বেগম কাদছেন,
-“সব হয়েছে তোর জন্য মেয়েটাকে এতো কষ্ট অবহেলা দিয়েছিস। সে এখন বাড়ি ছেড়েই চলে গেছে..”
রুদ্র সেসবে কথা কানে না নিয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হয়। এদিকে বাড়ির বাকি পুরুষরাও মেঘকে খুঁজতে বেড়িয়ে যায়। একেকজন একেক দিকে যায়। আশেপাশের সব জায়গা খুঁজে দেখে। তবুও মেঘকে পাওয়া যাচ্ছে না, ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছে। ক্লান্ত হয়ে মাঝ রাস্তায় বাইক থামিয়ে দেয়। শরীর আর চলছে না। কাপা কাপা স্বরে উচ্চারণ করে,
-“ওর যেনো কিছু না হয়…”
এক দল ছেলে লাগিয়ে দিয়েছে মেঘকে খুঁজতে আশেপাশের এলাকায়। সেও আর দেরি না করে মেঘের মা এর বাসায় ছুটে যায়। পৌঁছেই কলিং বেল বাজানো শুরু করে। মাহমুদা বেগম দরজা খুলতেই রুদ্র প্রশ্ন ছুড়ে,
-“ম..মেঘ এসেছে? মেঘ?”
মাহমুদা বেগম চমকে যায়, রুদ্রের ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে, আবার মেঘের কথা জিজ্ঞেস করছে। চিন্তিত হয়ে কিছু বলার আগেই রিমি বলে,
-“মেঘের এই বাড়িতে থাকার যোগ্যতা নেই, তাই ভুলেও আসবে না।”
রুদ্রের চোখ লাল হয়ে ওঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। মাহমুদা বেগম রিমিকে চুপ করিয়ে বলে,
-“না তো, মেঘের কি হয়েছে? ঠিক আছে?”
রুদ্র ভারী গলায় রিমির উদ্দেশ্যে বলে,
-“আসলেই মেঘের এই বাড়িতে থাকার যোগ্যতা নেই। তার যোগ্যতা চৌধুরি বাড়ির মতো উচ্চ বংশে থাকার মতো। হিরেকে তো আর যেখানে সেখানে মানায় না।”
রিমি রাগে ফুসে ওঠে, অপমান বোধ করছে। রুদ্র এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। হঠাৎ মনে পড়ে, রোডের সামনের সিসিটিভি ফুটেজ চেক দিলে তো পাওয়া যাবে। আর দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
ফুটেজে দেখে মেঘ একটা সিএনজিতে উঠেছে। রুদ্র দ্রুত ভিডিও আটকে জুম করে দেখে, এটি তাদের বাড়ির সামনের স্ট্যান্ডের সিএনজি। নাম্বার মোবাইলে তুলে হঠাৎ পায়ে বেরিয়ে যায়। সিএনজি স্ট্যান্ডের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তারা সেই সিএনজি ওয়ালাকে নিয়ে আসে। তাকে দেখেই রুদ্র চিন্তিত কন্ঠে বলে,
-“ওই যে, একটা মেয়েকে সিএনজি করে নিয়ে গেছেন। তাকে কোথায় নিয়ে গেলেন?”
লোকটি ব্রু কুচকে বলে,
-“কতো মাইয়া মানুষই তো যায়। এখন কাকে জিজ্ঞেস করছেন, কেমন কমু?”
রুদ্র দ্রুত মেঘের ছবি বের করে দেখায়,
-“এই যে, এই মেয়েকে..”
লোকটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ বলে,
-“আরে হো, এই মাইয়াই তো সন্ধ্যার সময় নিয়েছিলাম। বাপরে, কি সাহস একা একা কবরস্থানে গেছে, তাও রাতের বেলা।”
লোকটির কথায় রুদ্র বুঝে যায়, মেঘ কোথায় গিয়েছে। আর দেরি না করে বাইক নিয়ে ছুটে যায় সেদিক। এটাই শেষ আশার আলো। এখানে না পেলে মেঘকে আর কোথায় খুঁজবে? ভাবতেই চোখ ঝলতে শুরু করে। প্রায় ২০ মিনিট পর সেখানে এসে পৌছায়। বাইক রেখে হাটা শুরু করে মেঘের বাবার কবরের দিকে। পা থেমে থেমে যাচ্ছে, মনে মনে দোয়া করছে মেঘ যেনো এখানেই থাকে। তবে নেই, এখানেও মেঘ নেই।
রুদ্রের পুরো দুনিয়া অন্ধকার মনে হচ্ছে। আশেপাশেও মানুষের ছিটেফোঁটাও নেই। দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আশেপাশের রাস্তায় খুঁজে তাও নেউ। রুদ্র একদম ভেঙে পড়েছে, রাস্তায়ই হাটু গেড়ে বসে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। মেঘকে হারানোর আতঙ্ক ও ভয় সব মিলিয়ে তাকে কুড়ে খাচ্ছে। নিজের চুল মুঠো করে ধরে চিৎকার করে উঠে,
-“কোথায় তুমি বউ, কোথায় খুঁজবো তোকে এখন। তোর কিছু হলে আমি মরেই যাবো রে…….
চলবে…..
[কেমন হয়েছে অবশ্যই মন্তব্য করতে ভুলবেন না।]
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৮
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৫
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৮
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১১.১
-
আড়ালে তুমি পর্ব -২৯
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৫২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪৫
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৯