Golpo romantic golpo আড়ালে তুমি সব পর্বের লিংক সাইদা মুন

আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪২


#আড়ালে_তুমি |৪২|

#_সাইদা_মুন 

বিকাল ৪টা বাজে, রুদ্র আর সাদ কাচা হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে নিচে সোফায় বসে আছে, বিরক্তি নিয়ে। উপরে মেঘরা রেডি হচ্ছে, একটু পরই সায়ানের গায়ে হলুদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে। তবে এদের শেষই হচ্ছে না। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলে,

-“এই সাজগোজ বের করছে কোন শা*লায়..? এরে পাইলে একদম…”

সাদ পাশ থেকে বলে,

-“কেউ কি জেনেশুনে নিজের বিপদ ডেকে আনে? শা*লা না শালিরাই বের করছে…”

কিছুক্ষণের মধ্যেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তারা নিচে নামে। রুদ্রর চোখ যেন অনায়াসে গিয়ে থামে তার বউয়ের ওপর। হলুদ শাড়ি, নিখাদ বাঙালি স্টাইলে পড়া,কোমরে সুন্দর একটা বিছা লাগানো। চুল ফ্রেঞ্চ বেনি করে পাম্প করে বাঁধা, যা কোমর ছাড়িয়ে আরও নিচে নেমে এসেছে। কানে কপালে ও হাতে গোলাপ ফুলের গহনা,যদিও আসল নয়, তবুও তার সাথে এমন ভাবে মানিয়েছে যে আসল-নকলের পার্থক্য খুঁজতে আসবে না কেউ। মুখে হালকা মেকআপ, ঠোঁটে কড়া খয়েরি লিপস্টিক। পিহু সামিয়াও সেইম সাজেই। 

তবে রুদ্রর চোখে তখন শুধু মেঘের দিকে। সে যেন নতুন করে তাকে আবিষ্কার করছে, একজন নারী, যাকে সে প্রতিদিন দেখে, তবু প্রতিটি মুহূর্তে নতুন রূপে চেনে। বউ তার কাছে শুধু ভালোবাসার মানুষ নয়, তার প্রতিটি উপস্থিতি যেন নিজের ভেতরের কোনো গভীর জায়গায় গিয়ে স্পর্শ করে। রুদ্র মনে মনে আওরায়, 

“এই নারী আমার। আর আমি তার প্রতিটি রূপে হারিয়ে যেতে চাই। সারাজীবন নিজের কাছে রেখে, তার নতুন নতুন রূপে নিজেকে ধ্বংস করতে চাই..”

রুদ্রকে এভাবে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদ ডেকে উঠল,

-“ও ভাইয়া, যাবেনা নাকী?”

সাদের ডাকে ধ্যান ভাঙে রুদ্র নিজেকে সামলে নেয়। মেঘ খুশি মুখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

-“কেমন লাগছে?”

রুদ্র বুকে হাত রেখে হাস্কি স্বরে বলল,

-“আমার সাহেবা লাগছে। “

মেঘ এক হাতে মুখ ঢেকে হেসে উঠল, তারপর বাড়ির বড়দের বলে গাড়ির দিকে এগোতে লাগল। রুদ্র মাথা চুলকে তাকিয়ে পিছু পিছু বেরিয়ে পড়ল। হঠাৎ নজর গেল মেঘের এক হাতে ফুলের গহনা নেই দেখে, ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“এই হাতেরটা কোথায়?”

মেঘ আফসোস করে বলল,

-“আর বলিয়েন না, পড়তে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে”

রুদ্র কিছু একটা ভেবে গাড়ির চাবি সাদের হাতে দিয়ে বলল,

-“তুই ওদের নিয়ে যা, আমি মেঘকে নিয়ে আসছি।”

সাদ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-“কেন? সবাই তো একসাথে যেতে পারবে।”

পিহু থামিয়ে বলল,

-“আরে গাধা, বোঝো না? একান্ত সময় কাটাতে চাচ্ছে। চল, আসো তো।”

বলেই সবাই গাড়িতে উঠে রওনা দিলো। মেঘ রুদ্রকে জিজ্ঞেস করল,

-“আমরা যাব না?”

রুদ্র বলল,

-“হ্যাঁ, যাব। দাঁড়াও, গাড়ি বের করে আসি।”

রুদ্র বাইক নিয়ে এসে মেঘকে নিয়ে রওনা দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচিত এক ফুলের দোকানের সামনে বাইক থামাল। মেঘ আশপাশ তাকিয়ে বলল,

-“এখানে কেন?”

রুদ্র মেঘের হাত ধরে দোকানের ভিতরে নিয়ে যায়, সেই একই ডিজাইনের ফুলের একজোড়া বালা বানিয়ে দিতে বলল। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি বালা বানিয়ে নিয়ে এল। মেঘ অবাক হয়ে দেখছিল, এজন্যই ওদের সঙ্গে যায়নি, বিষয়টা তার বেশ মনে ধরে। দোকানদার জিজ্ঞেস করল,

-“এখনই পড়বে, নাকি প্যাকেটে দিয়ে দেবো ভাই?”

রুদ্র বলল,

-“এখনই পড়বে।”

রুদ্রের কথায় দোকানদার হাত বাড়িয়ে বালা মেঘের হাতে পড়িয়ে দিতে গেলেই রুদ্র ধমক দিয়ে বলল,

-“স্টপ..”

ছেলেটি থতমত খেয়ে রুদ্রের দিকে তাকাল। রুদ্র চোখ লাল করে ছেলেটির হাত থেকে ফুল নিয়ে, টাকা দিয়ে, মেঘকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

-“আমার বউকে টাচ করার সাহস দ্বিতীয়বার দেখাবি না।”

বাইকের সামনে এসে মেঘের হাতে থাকা পুরোনো বালা খুলে ফেলল। সযত্নে নিজের হাতেই নতুন বালা জোড়া লাগিয়ে দিল। মেঘ মুচকি হেসে রুদ্রের এই যত্ন দেখে ভাবল, এমন কেয়ারিং স্বামীই তো সবাই চায়। মনে মনে বারবার মাশাল্লাহ বলল যেন তাদের নজর না লাগে। দুই হাত নাকের সামনে এনে চোখ বন্ধ করে ফুলের ঘ্রাণ নিল, এটা আসল ফুল।

রুদ্র বাইকে উঠতে গেলেই মেঘ তাকে থামিয়ে দেয়, রুদ্র ব্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,

-“কি হলো?”

হাতের ইশারা করে রাস্তার অন্যপাশের ফুচকার স্টল দেখাল। রুদ্র বলে,

-“এখানের এসব পচা পানি খাবে?”

মেঘ নাক ফুলিয়ে বলে,

-“এগুলো তো মুটেও পচা পানি না।”

রুদ্র বাইক সাইড করে মেঘের হাত ধরে রাস্তা পার করল। ফুচকার দোকানে ভিড় দেখে, মেঘকে পাশের কয়েকজন মেয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে নিজে যায় আনতে। মেঘ আশপাশ ঘুরে দেখতে লাগল, হঠাৎ পাশের মেয়েদের দিকে নজর গেলে ভ্রু কুঁচকে তাদের নজর অনুসরণ করে ফুচকার দোকানের দিকে তাকালো। মেয়েগুলো ওদিকে তাকিয়ে ফুসফুস ফুসফুস করছে। মেঘ তাদের কথা শোনার জন্য এদিক সেদিক করে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

এক মেয়ে বলে,

-“ভাই, ছেলেটা কী হ্যান্ডসাম, বডি দেখেছিস? জোস”

আরেকজন বলে,

-“আরে হ্যাঁ, হাঁটার স্টাইলেও কি অ্যাটিটিউড, চুলগুলো কী সুন্দর ব্রাশ করা, উফ্, ক্রাশড।”

মেয়েদের কথাবার্তা শুনে মেঘের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কটমট করে একবার তাদের দিকে আর একবার রুদ্রের দিকে তাকাল। মাস্ক পড়া রুদ্রের চোখে কালো চশমা, মুখ তো দেখাই যাচ্ছিল না, তবুও ওই মেয়েগুলো নজর দিচ্ছে। মেঘ রাগে ফুসফুস করছে কিছু করতে পারছিল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রুদ্র মেঘের কাছে এসে ফুচকার প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল,

-“বাপরে, মাত্র ৫০ টাকার ফুচকার জন্য এতোক্ষণ দাঁড়াতে হলো..”

মেঘ প্লেট হাতে নিয়ে একটার পর একটা মুখে দিচ্ছে, আর জিদের ঠেলায় চাবাচ্ছে, কারণ পেছনের মেয়েগুলো রুদ্রকে সামনে থেকে দেখে আরও ডং ডাং শুরু করেছে। মেঘ একটা ফুচকা রুদ্রের মুখে দিতে গিয়েও আবার পিছিয়ে নেয়, এখন মাস্ক খুললে শালিরা আরও নজর দিবে ভেবে। খাওয়ার পর প্লেটটা দিতে গেলে রুদ্র এসে নিয়ে গেল। এদিকে ছ্যাঁচড়া গুলো এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

রুদ্র টাকা মিটিয়ে মেঘকে নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু মেঘ আবারও থেমে গেল। রুদ্র আবারও জিজ্ঞেস করল,

-“কি হলো?”

মিষ্টি এক হাসি দিয়ে মেঘ বলল,

-“কাপল পিক তুলবো প্লিজজ্জ। এই দিকটা সুন্দর, এখানে একটা তুলবো প্লিজজ্জ।”

মেঘের আবদার শুনে রুদ্র বলল,

-“এখানে কে তুলবে? চলো সায়ানের বাড়িতে গিয়ে ইচ্ছেমতো তুলো।”

মেঘ রুদ্রের হাত ছাড়িয়ে বলল,

-“আরে, তুলবার মানুষের অভাব নাকি, আসেন আসেন…”

বলতেই ওই মেয়েদের কাছে গিয়ে ডং করে বলল,

-“আপু, আমাদের একটা কাপল পিক তুলতে পারবেন?”

মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,

-“উনি তোমার হাসবেন্ড?”

মেঘ হেসে বলল,

-“হ্যাঁ, আর বলিয়েন না আপু, আমার হাসবেন্ডটা অনেক রোমান্টিক। আমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের ছবি সে তুলে রাখে, যেমন ধরো বিছানা থেকে শুরু করে…”

রুদ্র পাশেই মেঘের কথায় হালকা কেশে উঠে, আর মেয়েগুলোর চোখ প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম। মেঘ আবার বলল,

-“এখন সে চাচ্ছে এই মুহূর্তটাও ক্যাপচার করতে, প্লিজ একটু হেল্প করুন।”

একজন মেয়ে থমথমে হয়ে বলল,

-“আ…আচ্ছা আপু, তুলে দিচ্ছি। মোবাইলটা দিন তো।”

মেঘ মোবাইল বের করে দিয়ে রুদ্রকে নিয়ে এক পাশে দাঁড়াল। রুদ্র মাস্ক খুলে মেঘের কোমড় ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে হেসে তার দিকে তাকায়। মেঘ হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক সেই মুহূর্তে কয়েকটা ছবি তুলে নিল। মেয়েটি মোবাইল দিতেই মেঘ এগিয়ে নিয়ে নিলো, সাথে কবিতার সুরে বলল,

 -“থাকিলে শরম, অন্যের জামাইর দিকে তাকানোর আগেই হয়ে যাবে লজ্জায় গাল গরম। তাও যদি না হয় শরম, আমার সুন্দর হাত দিয়ে থাপড়ে শক্ত গালকেও করে দিবো নরম। “

বলেই রুদ্রের হাত ধরে বলল,

-“চলুন…”

এদিকে রুদ্র তাজ্জব হয়ে গেল। মানে, তার বউ জেলাসি থেকে এমনটা করেছে। বেশ অবাক সে, কিভাবে মুহূর্তেই কবিতাও বানিয়ে ফেলল, বাহ, কি ট্যালেন্ট। হেসে আলতো করে মেঘের হাত ধরে রাস্তা পার করে বাইকে উঠে রওনা দিল। আজকের দিনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।

———

পিহুরা মাত্রই এসেছে, সায়ান এগিয়ে এসে তাদের ভেতরে নিয়ে যায়। রুদ্রের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে আসছে। সায়ান তার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সায়ানের মা, আফসানা বেগম, হাসিমুখে পিহু সামিয়ার সাথে গল্প জুড়েন । কিছুক্ষণ কথাবার্তার মাঝেই হঠাৎ পিহুর চোখ চলে যায় বাড়ির দ্বিতীয় তলার বারান্দার দিকে। মুহূর্তেই তার চোখ বড় হয়ে যায়, মুখ খানিকটা হা হয়ে যায়,’ফারহান’। 

সে সেখানে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কিছু টাইপ করছে। কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবির সঙ্গে সাদা প্যান্টে বেশ নজরকাড়া লাগছে। কিন্তু উনি এখানে কী করছে?

পিহুর হঠাৎ শুকনো কাশি উঠে আসে। যেন কাশিটা বিনা নোটিশেই এসে আক্রমণ করেছে। কাশতে কাশতে বেচারির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। সামিয়া আর আফসানা বেগম দুজন মিলে তার পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তাও কাশি থামছে না।

চিন্তিত হয়ে সামিয়া দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-“দাঁড়া আপু, আমি পানি নিয়ে আসছি।”

সে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে চলে যায় পানি আনতে। এদিকে ফারহানেরও নজর পড়ে পিহুর দিকে। তাকে এভাবে কাশতে দেখে কপাল কুঁচকে যায়। ঠিক তখন পাশ দিয়ে এক ওয়েটার জুস হাতে নিয়ে যাচ্ছিল, পিহুর কাশি দেখে সে তাড়াতাড়ি একটা গ্লাস এগিয়ে দেয়। ঠান্ডা জুস গলা ভিজাতেই কাশি থেমে আসে।

পিহু স্বস্তি নিয়ে আবার চোখ তুলে বারান্দার দিকে তাকায়, কিন্তু সেখানে ফারহান নেই। সে থমকে যায়। তবে কি ভুল দেখেছিল? মনের ভুলই হবে।

———

সামিয়া হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাঁটছে। শাড়ি পরায় স্বাভাবিকভাবে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। এক হাতে শাড়ি সামলে নিচের দিকে তাকিয়ে দ্রুত পা ফেলছে। ঠিক দরজা পেরোতে যাবে, এমন সময় সামনের দিক থেকে কেউ তাড়াহুড়ো করে ঢুকছে। দু’জনের কেউ কাউকে খেয়াল না করায় ধাক্কা লেগে যায়। সামিয়ার মাথা গিয়ে লাগে সামনের ব্যক্তির বুকে,যার ফলে লোকটা হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। গ্লাসের পানি পুরোটা তার গায়ে পড়ে, সামিয়া দু’পা পিছিয়ে সামলাতে গিয়ে গ্লাস হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা কাঁচের কিছু টুকরো পায়ে লাগতেই সামিয়া “আহ” বলে চিৎকার করে ওঠে।

রাফান চমকে উঠে দ্রুত বলে,

-“আম সরি… আসলে তাড়াহুড়ায় দেখিনি, লাগেনি তো?”

নিচে তাকাতেই দেখে সামিয়ার পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। ভড়কে গিয়ে সে দ্রুত সামিয়ার হাত ধরে পাশের সোফায় বসিয়ে দেয়। একজন কাজের লোককে জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলে, নিজে ছুটে যায় উপরে। কিছুক্ষণ পর ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে ফিরে এসে সামিয়ার সামনে মেঝেতে বসতে বসতে বলে,

-“আম এক্সট্রিমলি সরি….”

যেই পায়ে হাত দিতে যাবে, সামিয়া সঙ্গে সঙ্গে পা সরিয়ে নিয়ে অস্বস্তি নিয়ে বলে,

-“না না ভাইয়া, পায়ে হাত দেবেন না।”

-“হোয়াই?”

রাফান তাকায় সামিয়ার দিকে। সামিয়াও তাকিয়েছিলো তার দিকেই। চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে নাকি পরিচিত মনে হচ্ছে বলে তাকিয়ে বুঝাই যাচ্ছে না। সামিয়া একটু ভেবে বলে,

-“আপনি রাফান ভাইয়া না? প্রিন্সিপাল আঙ্কেলের ছেলে?”

-“হ্যাঁ, আর তুমি সামিয়া… রাইট?”

সামিয়া মাথা নেড়ে হালকা হাসি দেয়। রাফান মুচকি হেসে বলে,

-“বাহ, অনেক বড় হয়ে গেছো। আগে তো খেলায় হারলে এমন কান্নাকাটি করতে..”

আগের কথা তোলায় সামিয়া বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। রাফান ফের পায়ে হাত দিতে গেলে সামিয়া বলে,

-“ভাইয়া, আমি নিজেই করে নেব…”

পা পরিষ্কার করতে করতে রাফান হেসে বলে,

-“এতো ফরমালিটি করতে হবে না। শাড়ি পরে নিজে করতে পারবে নাকি? আর ভুল যেহেতু আমার, ঠিক করাও আমার দায়িত্ব।”

সে কটন দিয়ে পরিষ্কার করে ওয়ান-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়। ক্ষত তেমন গভীর নয়। সামিয়া চুপচাপ রাফানের কাজ দেখছিল। হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে রাফানের বুকে, চোখ বড় হয়ে যায়, হাত চলে যায় ঠোঁটে।

রাফান উঠে দাঁড়িয়ে সামিয়াকে রেস্ট নিতে বলে চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু সামিয়া তাড়াতাড়ি উঠে তার পথ আটকে দেয়। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে রাফানের বাম দিকের বুকে, যেখানে লিপস্টিকের দাগ লেগেছে, ঘষতে শুরু করে। অপ্রত্যাশিত স্পর্শে রাফান থমকে যায়, বুকের ভেতর কেমন যেন কেঁপে ওঠে। সামিয়া একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে দাগ মুছতে মুছতে বলে,

-“সরি..তখন হয়তো আমার ঠোঁট থেকে লিপস্টিক লেগে গিয়েছিল “

রাফানের কোনো উত্তর না পেয়ে সামিয়া মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তেই সে থমকে যায়। মুহূর্তেই বুঝতে পারে সে কী করছে সরে দাঁড়ায়। রাফান নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

-“সমস্যা নেই, চেঞ্জ করে নেব।”

বলেই সে উপরের দিকে চলে যায়। সামিয়া খানিকটা লজ্জা পেয়ে দ্রুত বেড়িয়ে আসে। পিহুর কাছে গিয়ে বসতেই পিহু  জিজ্ঞেস করে,

-“কই ছিলা এতক্ষণ?”

প্রশ্নে চমকে গিয়ে সামিয়া মনে করে, সে তো পানি আনতে গিয়েছিল। আবারও উঠতে উঠতে বলে,

-“শিট ভুলে গেছি, দাড়া..”

পিহু হাত টেনে বসিয়ে দেয়,

-“খেয়েছি আমি, লাগবে না বসো।”

এর মধ্যে রুদ্ররাও চলে আসে। রুদ্র নতুন বউ নিয়ে এসেছে শুনে সায়ানের পরিবারের সবাই হাজির হয়। রুদ্র একে একে সবার সঙ্গে মেঘের পরিচয় করিয়ে দেয়।

———

মেঘকে পিহুদের কাছে রেখে রুদ্র তার বন্ধুদের দিকে চলে যায়। মেঘ বসতে বসতে হঠাৎ সামিয়ার পায়ের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে,

-“আপু, পায়ে কী হয়েছে?”

মেঘের প্রশ্নে পিহুও তাকায় এবং সেও জিজ্ঞেস করে। সামিয়া শান্ত স্বরে বলে,

-“একটু কেটে গেছে।”

পিহু তৎক্ষণাৎ বলে,

-“বেশি কেটেছে? ব্যথা করছে? চলো বাসায় চলে যাই, এই অবস্থায় থাকতে হবে না।”

সামিয়া তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

-“আরে না, তেমন কিছু না। হালকা কেটেছে।”

ঠিক তখনই সুমনার গলা শোনা যায়। গেটের দিকে তাকাতেই দেখা যায় সুমনা আর রিক আসছে।

-“শা*লা, তোর জন্য হয়েছে বেয়াদব। ১০ টাকায় ঝালমুড়ি খাওয়া যেতো।”

রিক মুখটা ভোতা করে রেখেছে। তাদের দেখে পিহু আর মেঘ এগিয়ে যায়,

-“কিরে, এতো দেরি হলো কেন?”

সুমনা ফুঁসে উঠে বলে,

-“এই খবিশের জন্য আমার ১০ টাকা গেলো দেরিও হলো।”

রিক তেতে উঠে জবাব দেয়,

-“তুই টাকার বেলায় তো কিপটা প্রো-ম্যাক্স! খাওয়া-দাওয়াতেও একটু কিপটামি করিস না কেন?”

মেঘ ধমকের সুরে বলে,

-“এই, এটা বিয়েবাড়ি, বাচ্চাদের মতো ঝগড়া বাদ দে। কী হয়েছে, ঠিকঠাক বল।”

সুমনা বিরক্তি নিয়ে বলে,

-“আমি আধাঘণ্টা ধরে তর্ক করে ৭০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকায় নামিয়েছি। অর্ধেক রাস্তা আসতেই এই আপদ এসে রিকশা থামিয়ে উঠে পড়ে। এখানে এসে ড্রাইভার ৫০ টাকার কমে মানছেই না। সে নাকি দুজনকে নিয়ে এসেছে।”

পিহু আর মেঘ কথা না বাড়িয়ে সুমনাকে টেনে স্টেজের দিকে নিয়ে যায়। তারা আগের জায়গাতেই বসে, রিক চলে যায় রুদ্রদের কাছে।

হঠাৎ একদল মেয়ে এসে মেঘদের ঘিরে ফেলে। তাদের মধ্যে এক মিষ্টি দেখতে মেয়ে হাসি দিয়ে বলে,

-“হাই আপুরা, আমি সায়ান ভাইয়ার ছোট বোন।”

মেঘরা তার সঙ্গে পরিচিত হয়। মেয়েটি ভীষণ মিশুক, সঙ্গে সঙ্গেই বলে,

-“চলো এখন আমাদের সঙ্গে। আমরা সবাই এখন বউয়ের বাড়ি যাচ্ছি হলুদ নিয়ে।”

পিহুরা উঠে তাদের সঙ্গে যায়। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ সাদ এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। সাদকে দেখে সুমনা মুখ ভেংচায়, আর সাদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মেঘকে বলে,

-“ভাবি, এই মিনি হাতিটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। তোমার জন্য ভাইয়া অপেক্ষা করছে। আর পিহু, সামিয়া তোরা সায়ানের কাজিনদের সঙ্গে চলে আসিস।”

বলেই সুমনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় সাদ। সুমনা মুচড়ামুচড়ি শুরু করলে, অন্য হাতে রাখা আইসক্রিম তার দিকে এগিয়ে দিতেই চুপ হয়ে যায়। তা দেখে সাদ হতাশার শ্বাস ছাড়ে একে কেউ খাবার দিয়ে অনায়াসে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। গাড়িতে বসতেই সে আইসক্রিম খেতে শুরু করে।

সাদ বেশ কিছুক্ষন ধরে সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সুমনাকে। এমনিতেই গুলুমুলু, শাড়িতে যেন আরও গোলগাল লাগছে। তার চোখ চলে যায় সুমনার ঠোঁটের দিকে চারপাশে হালকা হালকা আইসক্রিম লেগে আছে।

খেতে খেতে সুমনা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

-“সমস্যা কী আপনার? আমাকে এখানে এনেছেন কেন? অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আমি যাই না।”

সাদ শান্ত গলায় জবাব দেয়,

-“তো অপরিচিত লোকের দেওয়া আইসক্রিম খাচ্ছ কেন?”

-“না খেলে গলে যেতো, খাবার নষ্ট করি না আমি..”

হঠাৎ সাদ একদম তার মুখের কাছে চলে আসে। খাওয়া থেমে যায় সুমনার। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে সাদের মুখ খুব কাছে, চোখেমুখে যেন অন্য কিছু লেখা।

সুমনা ভাবে সে হয়তো আইসক্রিম চাইবে, তাই এগিয়ে বলে,

-“খাবে?”

সাদ হাস্কি স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে,

-“হুঁ, তবে আইসক্রিম না, অন্য কিছু।”

তার ঠোঁটের দিকে সাদকে এগিয়ে আসতে দেখে সুমনার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। শ্বাস দ্রুত হয়ে যায়, নিজেকে সরিয়ে একদম সিটের সঙ্গে ঠেসে দেয়,

-“স..সাদ, ক…কি করছো?”

সাদ অনুরোধের সুরে বলে,

-“প্লিজ…. শুধু একবার?”

সুমনার শরীর শিউরে ওঠে, অনুভূতিগুলো যেন ভেতর থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। তবুও নিজেকে সামলে মাথা নিচু করে বলে,

-“প্লিজ না.. বিয়ের আগে না।”

সাদ আরও কোমল স্বরে বলে,

-“ওয়ান কিস অনলি।”

সুমনা মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার করলে সাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে জুড়ে ফুঁ দিয়ে শ্বাস ছাড়ে। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে,

-“বিয়েটা তাড়াতাড়ি করতে হবে।”

সুমনা লজ্জায় চুপসে যায়, সাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। আরচোখে বারবার তাকাতে তাকাতে সাদ। ভাবে এই প্রথম সে সুমনাকে লজ্জা পেতে দেখল। যে মেয়েটি সারাক্ষণ বাচ্চামি করে, লজ্জায় সে যে তাকে কত সুন্দর মানিয়েছে।

———

এদিকে দুইটা গাড়ি ফিলাপ হয়ে গেছে, সবাই উঠে পড়েছে। পিহু বেচারি জায়গা পায়নি। সেটা দেখে সামিয়া নেমে আসতে চাইলে সায়ানের এক কাজিন, যার সাথে তার ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাকে আটকে দিয়ে বলে,

-“তুই থাক। পিহু, ওই পেছনের কালো গাড়িটা দেখছো? ওইটাতে উঠে বসো। ওটাই করে ভাইয়া যাবে, তুমি বরং ভাইয়ার সাথেই যাও।”

পিহু মাথা নেড়ে সেই গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসে। অন্য গাড়িগুলো একে একে চলে যায়। সে মন খারাপ করে একা বসে ভাবছে, এই কোন ভাইয়া-ফাইয়া, শা*লা এখনো আসে না কেনো।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে তাকিয়ে দেখে, ড্রাইভিং সিটে ফারহান বসছে। তখনকার মতো এখনো ভুল দেখছে ভাবে, কিন্তু তাই বলে এতো কাছে দেখে যেন ভূত।সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠে,

-“আম্মুউউউ… ভ-ভূত।”

তার মেয়েলি চিৎকারে ফারহান চমকে পেছনে তাকায়, তারপর তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে ধরে,

-“এই, কী হয়েছে? এভাবে চিল্লাচ্ছো কেনো? মানুষ দেখলে উল্টা ভাববে।”

মুখ চেপে ধরায় পিহু চোখ বড় বড় করে তাকায়। স্পর্শে তো মানুষই মনে হচ্ছে। কনফিউজড হয়ে সে ফারহানের হাতে একটা জোর চিমটি কাটে।

-“আউচ..”

ফারহান সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয়,

-“তোমার মাথায় সমস্যা নাকি?”

পিহু অবাক হয়ে বলে,

-“মানে আপনি সত্যি?”

-“কী সত্যি-মিথ্যা?”

-“আপনি এখানে কী করছেন?”

নিজের গাড়িতে বসে কেউ এমন প্রশ্ন করলে কেমন লাগে ভেবে ফারহান বলে,

-“আমার গাড়িতে আমি থাকবো না তো কে থাকবে?”

পিহু ভ্রু কুঁচকে বলে,

-“কিন্তু সায়ান ভাইয়ার বিয়েতে আপনি কী করছেন?”

-“আমার ভাইয়ের বিয়েতে আমি না থাকলে কি হিরো আলম থাকবে? আর তুমি আমার গাড়িতে কী করছো?”

-“ওই গাড়িতে জায়গা হয়নি, তাই ফাহিমা আপু বললো এটাতে যেতে। কিন্তু এটা যে আপনার জানতাম না..”

পরক্ষনেই পিহুর মুখে খুশি ভাব,

-“তবে ভালোই হলো। কিন্তু আপনি সায়ান ভাইয়ার ভাই এটা তো জানতাম না। ওই ফাহিমা আপু কি আপনার বোন? নাম তো এক রকম।”

এতো প্রশ্ন শুনে ফারহান ধমকে বলে,

-“স্টপ! আমার সাথে যেতে হলে চুপচাপ যাবে, নাহলে এখানেই রেখে চলে যাবো।”

ফারহানের কথায় সাথে সাথে পিহু ঠোঁটে আঙুল চেপে দেয়। লুকিং গ্লাসে সেটা দেখে ফারহানের হাসি পায়, কিন্তু নিজেকে সামলে বলে,

-“আমাকে কি ড্রাইভার মনে হয়? সামনে এসে বসো।”

পিহু বাধ্য মেয়ের মতো সামনে গিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে নেয়।

———

রুদ্র মেঘকে নিয়ে বাইকে করে এসেছে। গাড়ি পার্ক করে গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে অমনি চোখ পড়ে ফারহানের গাড়ি এসেছে। থামতেই পিহু ফারহান বেড়িয়ে আসে। মেঘকে দেখে পিহু তার কাছে তাদের কাছে চলে আসে। পিহুকে ফারহানের সাথে দেখে রুদ্র একটু রেগে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-“এই, তুই আমার বোনকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? এতো সাহস কে দিয়েছে তোর?”

ফারহান বিরক্ত স্বরে জবাব দেয়,

-“আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই? তোর বোনকে নিয়ে ঘুরতে যাবো? সবাই ফেলে এসেছে তাই আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি।”

রুদ্র রেগে পিহুকে বলে,

-“সামিয়া কোথায়? ওদের সাথে না আসতে বলেছিলাম, তোকে রেখে এসেছে কোন আক্কেলে?”

পিহু দ্রুত বলে,

-“ভাইয়া, আপুর দোষ নেই। জায়গা হয়নি, তাই আমিই ফারহান ভাইয়ের গাড়ি করে এসেছি। সামিয়া আপু আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল।”

রুদ্র আর কিছু না বলে তাদের ভেতরে যেতে বলে, এগোতে নিয়ে সামনে ফারহান থাকায় মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে,

-“সামনে থেকে হাটটট….”

ফারহানও বিরক্তি নিয়ে সরে গিয়ে বলে,

-“ফুটটট….”

দুজন দুদিকে চলে যায়…

চলবে…..

[অনেক বড় করেই দিয়েছি আজ, মতামত জানাবেন]

Share On:

TAGS: , ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply