#আড়ালে_তুমি |২৯|
#সাইদা_মুন
কিছু দূর যেতেই মেঘের ওড়না নিচে পায়। তা দেখে রুদ্রের শরীর কাঁপতে শুরু করে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। দ্রুত আরও সামনে এগিয়ে যায়। মনে মনে দোয়া করছে,
-“হে আল্লাহ আমার মেঘের কোনো ক্ষতি কোরো না, আমার পবিত্র ফুলে আঁচ লাগতে দিও না..”
আরেকটু সামনে যেতেই রুদ্রের চোখ-মুখে আগুন জ্বলে উঠে। পাশে একটা লাঠি পায়, তা হাতে নিয়েই দৌড়ে যায়।
এদিকে আসিফ মেঘকে জোর করে গাছের আড়ালে ধাক্কা দিয়ে ফেলে, যার ফলে কোমরের দিকে ধারালো কিছু লেগে অনেকটা জায়গা কেটে যায়। নিজের শার্ট খুলতে খুলতে এগোয়। মেঘ ভয়ে ব্যথা ভুলে পিছিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ মাথায় আঘাতে সে দাঁড়িয়ে যায়, মাথায় হাত দিতেই রক্ত হাতে আসে। পেছন ফিরতেই রুদ্রের মুখ ভেসে উঠে। রুদ্র কিছু না বলেই এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। রুদ্রের এমন হিংস্র রূপ দেখে বাকি ছেলেগুলো পালিয়ে যায়। একসময় লাঠিটি ভেঙে যায়। হাত থেকে ফেলে আসিফের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে তার রক্তাক্ত মুখে, আগুনের ফুলকির ন্যায় চোখ রেখে বলে উঠে,
-“তুই আবারও রুদ্রের জিনিসে হাত দিয়েছিস.. আগেরবার তোর আঙুল কেটেছি, এবার তোর কি অবস্থা হবে তুই ভাবতেও পারবি না..”
আবারও মারতে যায়, তবে আসিফ রুদ্রের বুকে ধাক্কা মারে যার ফলে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। সেই সুযোগে আসিফও পালায়।
রুদ্র মেঘের দিকে ফিরে, মেয়েটির এলোমেলো চুল, কাঁদনভেজা চেহারা দেখে বুকটা মুচড়ে উঠে। কেউ যেন রুদ্রের কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলছে, এমন যন্ত্রণা হচ্ছে। পা আটকে আছে, সামনে এগোনোর শক্তি পাচ্ছে না।
মেঘ কোনোভাবে উঠে পা টেনে টেনে রুদ্রের কাছে আসছে। রুদ্র দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন একটু হালকা হলেই কেউ নিয়ে যাবে। মেঘের পা হাওয়ায় ভাসছে, সেও রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। মেঘ কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,
-“আপনি এত লেট করলেন কেন? আরেকটু হলে আমাকে…”
ঢুকরে কেঁদে উঠে। রুদ্র মেঘকে আরও টাইট করে ধরে গলায় মুখ গুঁজে বলে,
-“না না, তোমার কিছু হত না, আমি হতে দিতাম না…”
-“আ… আমার খুব ভয় করছে, ওরা আবার আসবে, আমাকে বাজেভাবে ছুঁয়ে দেবে, ব… বাসায় যাবো..”
মেঘের শরীর ভীষণভাবে কাঁপছে। মেঘের চুলের ভাঁজে নিজের মুখ ডুবায়। দু-ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে চোখ বেয়ে।
-“কিছু হয়নি, আর কেউ স্পর্শ করবে না। তোমার প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে শুধু আমার স্পর্শ থাকবে, আর কারো না, জান।”
এভাবেই প্রায় ১০ মিনিট পর মেঘের মাথাটা তুলে মুখটা দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে নেয়। চোখের পানি মুছে দেয়, কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়,
-“ভয় পেও না, আমি আছি তো, কিছু হতে দিব না। আমি থাকতে কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না মেঘ, কেউ না…”
আবারও মেঘের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে। বুকটা ব্যথা করছে, অশান্তি করছে। একমাত্র এই মেয়েই সারাতে পারবে।
মেঘকে ছেড়ে নিজের ব্লেজারটা তার শরীরে দিয়ে ওড়নাটা দিয়ে কাটা পা বেঁধে দেয়। ধারালো কিছু লেগে কেটেছে হয়তো। অতঃপর পাজাকুলে তুলে নেয়। মেঘ রুদ্রের গলা জড়িয়ে চুপটি করে তার বুকেই পড়ে থাকে।
কোনো কিছু না ভেবেই ভরা ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়েই মেঘকে নিয়ে তার গাড়ির কাছে আসে। আশেপাশের সবাই অবাক “রুদ্রের কোলেতে মেঘকে দেখে”। পিহুরা রাহুলরা ছুটে আসে, সবাই চিন্তিত হয়ে বলে,
-“কি হয়েছে ওর?”
অনু দ্রুত বলে,
-“তুই ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
রুদ্র একবার তাদের দিকে তাকিয়ে পিহুকে বলে,
-“আমি মেঘকে নিয়ে যাচ্ছি, তোর জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিবো..”
বলেই গাড়িতে উঠে পড়ে, ড্রাইভারকে হাসপাতালে যেতে বলে। এদিকে মেঘ রুদ্রের বুকে চুপটি মেরে লেগে আছে।
পা ড্রেসিং করিয়ে মেঘকে নিয়ে বাসায় চলে আসে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, পড়ে ব্যথা পেয়েছে। তাকে রুমে নিয়ে আসে। মেয়েটি এখনো ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে।
রুদ্র ব্লেজারটা খুলে দেখে জামার অনেক জায়গা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আছে। চোখটা অফ করে জুড়ে একটা শ্বাস নেয়।
-“আই সোয়ার, আমি তোর এমন অবস্থা করবো যে তুই নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পাবি…”
ওয়ার্ডরোব থেকে মেঘের কাপড় বের করে মেঘকে ডাক দেয়,
-“মেঘ, চেঞ্জ করে আসো.. “
তবে মেঘের সাড়াশব্দ নেই। আবারও ডেকে উঠে,
-“মেঘ…”
এবার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠে ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়,
-“প্লিজ, না না..”
রুদ্র দ্রুত গিয়ে তাকে ধরে,
-“হেই মেঘ, আমি রুদ্র, রুদ্র। তুমি এখন বাসায় একদম সেফ আছো..”
মেঘ রুদ্রের কথায় তার গা ঘেঁষে বসে। ক্লান্ত শ্বাস ফেলে। রুদ্র শান্ত স্বরে বলে,
-“ফ্রেশ হয়ে আসো, ভালো লাগবে..”
মেঘ মাথা নাড়ে, তা দেখে রুদ্র তাকে পাজাকুলে নিতে যায়। ওয়াশরুমে এগিয়ে দিতে মেঘ হঠাৎ “আহ” করে উঠে। রুদ্র চিন্তিত হয়ে তাকে বসিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পা এদিক-সেদিক করে দেখছে,
-“কি হয়েছে মেঘ? দেখি পায়ে ব্যথা করছে..?”
মেঘ চোখ-মুখ কুঁচকে আছে, মাথা নেড়ে না করে,
-“তো আর কোথায় লেগেছে, দেখি..”
-“কোমরে, পেছনের দিকে ব্যথা করছে..”
রুদ্র উঠে সেদিকে চোখ যেতেই হাত মুঠিবদ্ধ করে ফেলে। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে বসে,
-“কাপড় খুলো…”
মেঘ এই অবস্থার মধ্যেও রুদ্রের কথায় চোখ বড় বড় করে তাকায়। রুদ্র তার তাকানো দেখে থতমত খেয়ে বলে,
-“আই মিন, এদিকের কাপড়টা একটু সরাও, ড্রেসিং করে দিবো..”
-“না না, আমি করে দিবো, নে..”
রুদ্র আর কিছু না বলে নিজেই সরিয়ে সেই জায়গা পরিষ্কার করতে থাকে। মেঘ দাঁত চেপে জ্বালা সহ্য করছে। ব্যান্ডেজ করে দিয়ে রুদ্র হঠাৎ সেখানে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মেঘ চোখ বুজে নেয়, “কই, এই ছোঁয়া তো আমার একটুও বাজে লাগছে না, অস্বস্তি হচ্ছে না”।
রুদ্র উঠে মেঘের হাতে কাপড় দিয়ে বলে, এখানেই চেঞ্জ করতে, সে বাইরে আছে। মেঘ মাথা নেড়ে চেঞ্জ করে নেয়। কিছুক্ষণ পর রুদ্র খাবার নিয়ে হাজির হয়। যত্নসহ মেঘকে খাইয়ে ব্যথার ওষুধ খাইয়ে দেয়।
মেঘ চুপচাপ এসব পর্যবেক্ষণ করছে। অবাক হচ্ছে রুদ্রের আচরণে। সে তাকে নিয়ে এত ভাবে..?
এর মধ্যে বাড়ির সবাই এসে মেঘকে দেখে গেছে। মেঘ চুপচাপ শুয়ে আছে।
রুদ্র গোসল করে বেরিয়েছে মাত্রই। মেঘের পাশে নিজেও শুয়ে পড়ে, চোখ বুজতেই মেঘের হঠাৎ কথায় পাশ ফিরে তাকায়,
-“আপনি কি আমাকে ছেড়ে দিবেন..?”
-“কি কারণে?”
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
-“এই যে আমাকে অন্য ছেলে ছুঁয়েছে, আমি এখন অপবিত্র। এমন মেয়ে তো কেউ পছন্দ করে না বউ হিসেবে… সমাজে আবর্জনা। আপনিও নিশ্চয় খারাপ ভাবছেন..”
মেঘের চোখের কোনা বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। রুদ্রের বুকে গিয়ে লাগে কথাগুলো। মেঘ নিজেকে আবর্জনার সাথে তুলনা করছে। তার মাথায় তো এমন ধরনের কথাই আসেনি।
এক টানে মেঘকে নিজের বুকে নিয়ে আসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-“আমার মাথায় এসব চিন্তাও আসেনি মেঘ। বিলিভ মি, আমি তোমার টেনশনে ছিলাম।”
একটু থেমে আবার বলে উঠে,
-“তুমি আমার কাছে স্নিগ্ধপরি, আমার পবিত্র বোকাফুল। তোমার চরিত্রে কোনো দাগ লাগেনি। আমি জানি তুমি নির্দোষ, তোমার শরীরে যেই নোংরা ছোঁয়া লেগেছে তা আমি মুছে দিবো, বউ।”
মেঘ আবেশে চোখ বুজে ফেলে। রুদ্রের ‘বউ’ বলে সম্বোধন করাটা যেন তার সব খারাপ লাগা এক নিমিষেই শেষ করে দিয়েছে। হঠাৎ রুদ্র নিজের হাত আলগা করে বলে,
-“আমি যে ছুঁয়েছি, তোমার কি খারাপ লাগছে? বলো তাহলে..”
রুদ্রের বাকি কথা সম্পূর্ণ করার আগেই মেঘ রুদ্রের বুকে আরও মিশে যায়। রুদ্রের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, মেঘের উত্তর সে পেয়ে গেছে।
সন্ধ্যার দিকে রুদ্র কালো শার্ট, কালো প্যান্ট পরে রেডি হচ্ছে। মেঘ ঘুম-ঘুম চোখেই তাকিয়ে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-“কোথায় যাচ্ছেন..?”
রুদ্র হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বলে,
-“একটি কাজ আছে, চলে আসবো। তোমার কিছু লাগলে পিহুকে নয়তো মাকে ডেকো…”
———————
ভাঙা জানালা দিয়ে রাতের হাওয়া ঢুকে হু হু শব্দ তুলছে। ছাদের নিচে ঝুলে থাকা একটা মাত্র বাল্ব, যা প্রতি কয়েক সেকেন্ড পর পর ঝিকমিক করে জ্বলছে। প্রতিটি ঝিকমিকির সাথে ভেতরের ছায়াগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে-একবার দেখা যায়, আবার মিলিয়ে যায়।
গুদামের মেঝেতে পুরোনো রক্তের দাগ শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। ভাঙা কাঠের ক্রেট ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। বাতাসে পচা ধাতু আর শুকনো রক্তের তীব্র গন্ধ।
দূর থেকে শোনা যায় ভারী বুটের মাপা শব্দ।
ঠক… ঠক… ঠক…
প্রতি পা ফেলার সাথে সাথে গুদামের নীরবতা যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে, বাতাস ভারী হয়।
অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে এক অবয়ব। কালো শার্টের হাতা গোটানো, হাতে কালো গ্লাভস, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই – শুধু বরফ ঠান্ডা দৃষ্টি। হাঁটার ভঙ্গি শান্ত, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে অদৃশ্য হুমকি ছড়িয়ে যায়।
ভারী গলার সব্দ ভেসে আসে,
-“I’m back….”
গুদামের মাঝখানে দড়িতে বাঁধা এক মানুষ। গায়ের কাপড় ছেঁড়া, শরীর কাঁপছে। কপাল ঘামে ভিজে, ঠোঁট শুকিয়ে সাদা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, বুক উঠানামা করছে হাপরের মতো। চোখে এমন আতঙ্ক, যেন মৃত্যুর ছায়া সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অবয়বটা কিছুক্ষণের জন্য থেমে তার সামনে দাঁড়ায়। কোনো শব্দ নেই। শুধু বাল্বের ঝিকমিক আর বাঁধা মানুষের হাপরের শব্দ।
ঠান্ডা গলায় বলে,
-“Scared? I haven’t even started yet…।”
চলবে………
[গল্পে নতুন কিছু আসতে চলেছে…]
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫২
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩১
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৭
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬০
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৫২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৫
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৮
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩৩