#আড়ালে_তুমি |২২|
#_সাইদা_মুন
মেঘ ছাদের কোণায় বসে আছে, বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময়। আকাশে রোদ নেই বললেই চলে, চারপাশে হালকা মেঘলা একটা আবহাওয়া—না পুরো অন্ধকার, না পুরো আলো। বাতাসে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, গাছের পাতাগুলো আস্তে আস্তে দুলছে।
দিগন্তে সূর্যের শেষ রঙগুলো ফিকে হয়ে গিয়ে মেঘের গায়ে হালকা সোনালি আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই আলোয় মেঘের চুলগুলো হালকা হাওয়ায় উড়ছে, তার মুখে এক ধরনের শান্ত কিন্তু গভীর ভাব। চারপাশ নিঃশব্দ, মাঝে মাঝে শুধু দূরের পাখির ডাক শোনা যায়।
ঠিক তখনই ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিক ফিরে তাকায় মেঘ। সামিয়া এসেছে হাতে দুই কাপ কফি। তাকে দেখে হেসে এগিয়ে আসে,
-“মেঘ একা একা কি করছো ছাদে?”
মেঘ কিছুটা অবাক হয়, আজ অব্দি সামিয়াকে তার সাথে হেসে কথা বলতে দেখেনি। সামিয়া ফের বলে উঠে,
-“তোমাকে মেঘ বলে ডাকায় মাইন্ড করোনি তো আবার। আসলে বয়সে তুমি আমার ছোট তাই নাম ধরেই ডাকছি। “
মেঘ হালকা হেসে বলে,
-“না আপু সমস্যা নেই। “
সামিয়া এক কাপ কফি মেঘের দিকে এগিয়ে দেয়। মেঘ চুপচাপ কফি হাতে নেয়। সামিয়া তার পাশে দোলনায় বসে পড়ে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর সামিয়া হঠাৎ তার হাতের ব্রেসলেটটা মেঘকে দেখিয়ে বলে,
-“দেখো তো কেমন এইটা? “
মেঘ হালকা হেসে তাকিয়ে বলে,
-“অনেক সুন্দর.. “
সামিয়া হেসে আবার বলে,
-“এইটা রুদ্র ভাই আজকে আমায় গিফট করেছে।”
মেঘ চুপচাপ সামিয়ার কথা শোনছে। সামিয়া আবার বলে,
-“তোমাকে কি কি গিফট দিয়েছে রুদ্র ভাই?”
মেঘের মুখটা চুপসে যায়। তাকে তো আজ অব্দি কিছুই দেয়নি সে কি বলবে। মেঘকে চুপ থাকতে দেখে সামিয়া কিছুটা আন্দাজে ঢিল মারতে বলে,
-“কিছু দেয়নি তো? আমি জানি।”
মেঘ বিষ্ময়ভরা চোখে তাকায় সামিয়ার দিকে “রুদ্র তাকে কিছু দেয়নি সে কি করে জানে? “
-“আমি জানি তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক নেই।”
মেঘ চমকে যায় সামিয়াকে অবাক সুরে বলে,
-“আপনি কি করে জানেন?”
সামিয়া মুখটা অন্ধকার করে বলে,
-“রুদ্র ভাই তোমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় সেদিন বিয়ে করলেও, তোমাকে মেনে নিতে পারছে না কেনো জানো?”
মেঘ প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে সামিয়ার পানে,
-“কেনো?”
-“কারণ রুদ্র ভাই আমাকে ভালোবাসে…”
আশেপাশের পরিবেশের সাথে মেঘও থমকে যায়। ঝড় আসার আগের ধমকা হাওয়া। বাকরুদ্ধ হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে সামিয়ার দিকে। “রুদ্র সামিয়াকে ভালোবাসে, এটা কি সত্যি?”
-“কি বিশ্বাস হচ্ছে না তো? খেয়াল করলেই দেখবে রুদ্র ভাইয়া সবসময় আমার হাতের কফি খায়। আমার সাথে হেসে কথা বলেন। এই যে আমায় কয়দিন পর পর গিফট কিনে দেন। এগুলো ভালোবাসা নয় কি? কিন্তু তুমি মাঝে এসে সব নষ্ট করে দিলে। আমাদের মধ্যে এসে ঢুকলে। দেখো না রুদ্র ভাই তোমাকে চায় না, এতোদিনে এখনো বউয়ের অধিকার দিয়েছে? দেয়নি তো.. দিবেও না। প্লিজ মেঘ আমাদের লাইফ থেকে দূরে চলে যাও। থার্ড পারসন হয়ে থেকো না।”
মেঘের চোখে পানি টলমলাচ্ছে। সামিয়ার বলা প্রত্যেকটা কথা তিরের ন্যায় বুকে বিঁধছে। সত্য কথাই তো রুদ্র আজ অব্দি তাকে টাচ তো দূর উল্টো বউয়ের অধিকার দেখাতে না করেছে। তবে কি সে সত্যি তাদের মাঝে ঢুকেছে? রুদ্র সামিয়ার জন্যই তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখে?
-“প্লিজ মেঘ, তুমি জীবনে আরও ভালো কিছু পাবে দেখো। যা চেয়েছো তার থেকে দ্বিগুণ পাবে। “
মেঘ ভেজা চোখেই সামিয়ার কথায় হেসে ফেলে,
-“আমার আর জীবনের কাছে কিছু চাওয়া নেই আপু। “
একটু থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“জীবনে যা চেয়েছিলাম তার থেকেও দ্বিগুণ পেয়েছি। এরকম শ্বশুরবাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, যেই ভাগ্য অল্প দিনের হলেও আমার হয়েছিল। তবে কিছু কিছু পাওয়া বা চাওয়া আমাকে চায়নি। শ্বশুর শাশুড়ির মনের মতো হলেও তাদের ছেলের মনের মানুষ অন্য কেউ। স্বামীর ভালোবাসা পাওয়া প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া। সেই কপালই যেহেতু আমার নেই তাহলে আর আপনাদের মাঝে থেকে কি করবো। উনি যদি আমাকে ছাড়তে চান আমি ছেড়ে দিবো। “
সামিয়া কিছুটা বিচলিত হয়ে বলে,
-“না তুমি ছাড়তে বলবে, এভাবে সম্পর্ক থাকে নাকি। “
মেঘ জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ায়, তপ্ত শ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলে,
-“আপু আমার মুখ ফুটে বলার সাধ্য নেই, উনি যেদিন বলবে সেদিন উনার লাইফ থেকে চিরকালের জন্য চলে যাবো। “
——————
ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে মেঘ, চোখ দিয়ে তার পানি ঝরছে। রুমে প্রবেশ করতেই খাটের উপর রুদ্রকে দেখতে পায়। রুদ্র হঠাৎ কারো আগমনে দরজার দিকে ফিরতেই মেঘের কঁন্দনরত চেহারা দেখে ঘাবড়ে উঠে আসে। মেঘের সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”
মেঘ কান্না থামাতেই পারছে না। রুদ্র অন্য কাউকে ভালোবাসে কথাটা সে হজম করতে পারছে না। রুদ্রকে দেখে সামিয়ার বলা কথা বার বার কানে বারি খাচ্ছে। কোন বউই তার স্বামীর ভাগ অন্যকে দেয়? সেখানে তার স্বামীর মন জুড়ে অন্য কেউ আছে। তাদের বিয়ে অল্প দিনের হলেও রুদ্রের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। হবেই না কেনো তার অধিকার আছে, সে হালাল রুদ্রের জন্য। রুদ্রের মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে সে, হঠাৎ এক অদ্ভুত ইচ্ছে জাগলো, সাথে সাথে করুন সুরে বলে উঠে,
-“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন? একটুর জন্য..?”
রুদ্র থমকে যায়, মেয়েটির গলা কেমন জানি লাগছে। তার বুকে কেমন করে উঠে এমন আকুতি ভরা কন্ঠের কথায়। এমন আবদার সে ফেলতে পারেনি। দ্রুত মেঘকে নিজের বুকে চেপে ধরে। মেঘ ফুপিয়ে উঠে, রুদ্রের বুকে যেনো কেউ ভীষণ জোরে আঘাত করছে, মেয়েটির কান্না সে সহ্য করতে পারছে না। মেঘকে আরও টাইট করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“কি হয়েছে মেঘ? কেউ কিছু বলেছে.. আমাকে বলো “
মেঘ কিছুই বলে না, সেভাবেই কিছুক্ষণ থেকে রুদ্রের বুক থেকে মাথা তুলে তার মুখপানে তাকায়। রুদ্রের বুকটা মুচড়ে উঠে। কি করুন সে চোখ, কান্নার ফলে মুখ লাল হয়ে আছে। রুদ্র তার দুই হাতের মাঝে মেঘের মুখটা আগলে নেয়,
-“কি হয়েছে কাঁদছো কেনো, খারাপ লাগছে? “
রুদ্রের আদুরে কথায় মেঘের আরও কান্না পাচ্ছে। তবে সে নিজেকে শক্ত করে, এভাবে রুদ্রের প্রতি আরও দুর্বল হলে চলবে না ভেবে তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে যায়।
এদিকে রুদ্র হতভম্ব হয়ে আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে। সে ভাবছে মেয়েটির হঠাৎ কি হলো।
এরপর আর মেঘের দেখা পায়নি রুদ্র। পিহুর রুমেই ছিলো মেঘ।
রাতে খাবার সময় সবাই নিচে নামতেই রুদ্রও নেমে আসে। এতোক্ষণে মেঘের দেখাও পায় সে, তার মায়ের সাথেই রান্নাঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই টেবিলে উপস্থিত হয়। খাওয়া শেষে এরশাদুল চৌধুরী সবার উদ্দেশ্যে বলেন,
-“কাল বিকালে একটা পার্টিতে আমাদের ফুল ফ্যামিলি ইনভাইটেড। সেখানে উপর মহলের সব লোকেরা আসবে। আমরা সবাই ও যাচ্ছি কাল। সেখানেই রুদ্রকে সবার সাথে পরিচয় ও করিয়ে দিবো, যদিও সে পরিচিত মুখই। “
তার কথায় সবাই রাজি হতেই তিনি চলে যান। বাকিরাও নিজেদের ঘরে চলে যায়। এদিকে রুদ্র ঘরে এসে মেঘ আসার অপেক্ষায় বসে আছে। তখন কি হয়েছিল, আবার সন্ধ্যা থেকে তাকে এতো ইগনোর করছে কেনো সেসব প্রশ্নের উত্তরের আশায়।
ঘড়ির কাটায় ১২ টা বেজে গেছে, এখনো মেঘকে আসতে না দেখে রুদ্র বেড়োয়। দেখে নিচে কেউ নেই, সবাই হয়তো শুয়ে পড়েছে। তবে মেঘ কোথায় গেলো, পিহুর রুমে নয় তো? তা ভেবে সেদিকে এগোয়। পিহুর রুমে নক করতেই সে দরজা খুলে রুদ্রকে দেখে ভ্রু কুঁচকায়,
-“কি চাই.. “
-“মেঘ কোথায়?”
পিহু দুষ্টু হেসে বলে,
-“কি বউকে ছাড়া একটুও থাকতে পারছো না বুঝি। “
-“এক চড় দিবো, যা বলেছি উত্তর দে। “
-“হুহ, মেঘ আজ আমার সাথে ঘুমাবে বলে। “
রুদ্র সাথে সাথে বলে উঠে,
-“কেনো?”
-“আমি কি জানি, তোমার বউকেই জিজ্ঞেস করো। “
তখনই মেঘ দরজার সামনে আসে, রুদ্রকে দেখে বলে,
-“আজ পিহুর সাথেই ঘুমাবো। “
রুদ্র কি বলবে কিছুই বুঝছে না, এখানে রেখে যেতে মন চাচ্ছে না। তবে মেঘকে যে আসতে বলবে সেরকম সম্পর্কও তাদের হয়ে উঠেনি। তাই বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে চলে আসে। বিছানায় শোতেই কেমন খালি খালি লাগে। এই কয়দিনে মেয়েটি তার অভ্যাস হয়ে গেছে। কোনোরকমে সেই রাত পার করে রুদ্র। নিজেও জানে না কেনো এমন হচ্ছে।
রাত পেড়িয়ে সকাল হতেই রুদ্রের এ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলতেই পাশে তাকায় তবে রোজকার মতো আজ মেঘ নেই। তপ্ত শ্বাস ফেলে সকালের বাতাসটা উপভোগ করতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। শান্তির একটা শ্বাস নিতে যাবে অমনি নজর যায় সামনের বাগানের বড় আম গাছের ঢালে। কিছু একটার আতংকে দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে ছুটে চলে বাগানের উদ্দেশ্যে….
চলবে…..
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪০
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬
-
আড়ালে তুমি আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৯
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৩৩
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩৭
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২০
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪৩
-
আড়ালে তুমি পর্ব -২৯
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৬