#আড়ালে_তুমি |১৫|
#_সাইদা_মুন
অন্যদিকে মেঘকে বাসায় এনেই তার মা সব রাগ তার শরীরের উপর ঝেড়েছে। কেউ কিছুই বলেনি। মিজানুর সাহেবও আজ এগিয়ে আসেননি। তিনি চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে বসে ছিলেন। একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে মাহমুদা বেগম মেঘের রুমের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে চলে যায়।
মেঘ অঝোরে কাঁদছে। আত্মহত্যা যদি মহাপাপ না হতো মেঘ হয়তো এতোক্ষণে সেই পথই বেছে নিতো। এক তো নিজের সম্মান, সাথে তার বড় বাবার — যেই মানুষটা তার জন্য লড়াই করে এসেছে। কোনোদিন কারো সামনে মাথা নিচু করতে দেখেনি। সেই ব্যক্তি আজ……
সারা শরীরের ব্যথা নিয়েও কষ্ট করে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসে পড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে,
-“আব্বু.. শোনছো? তুমি কেনো চলে গেলে আমায় একা রেখে? এই দেখো তুমি নেই বলে তোমার মেয়ের কি অবস্থা হয়েছে আজকে। আম্মু আমায় দেখতেই পারেনা। আমি কি সত্যি তারই মেয়ে? মায়েদের বুঝি সন্তানের কষ্ট সহ্য হয় না? কই, আমার মার তো আমার কষ্ট চোখেই পড়েনা। আমাকে একটু ভরসাও করল না। জানো বাবা, তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে মায়ের ভালোবাসা কেমন সেই স্বাদও ভুলে গিয়েছি। রিমিকে আম্মু কতো আদর করে, এখনো না খেতে চাইলে পেছন পেছন দৌড়ে খাইয়ে দেয়, রাতে ভয় পেলে তার সাথে ঘুমোয়, কোথাও যাওয়ার আগে তার কাপড় বের করে দেয়। আমি না অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখি। আমি কেনো এসব থেকে বঞ্চিত হলাম? বলো না আব্বু…..হাহ তুমিও স্বার্থপর, আমাকে এখানে ফেলে রেখে নিজে খুব আনন্দেই আছো জানি তো।”
মেঘের আর্তনাদ শোনার কেউ নেই। কাঁদতে কাঁদতে সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে মেঘ। পরের দিন তার মা এক হাতে খাবার আর অন্য হাতে শাড়ি নিয়ে হাজির। আদেশের সুরে বলে,
-“আজকে তোকে দেখতে আসবে, খেয়ে গোসল করে রেডি হয়ে থাকবি। এসে যদি দেখি রেডি না, কালকের কথা তো মনেই আছে?”
বলেই তিনি চলে যায়। তার হাতে ব্যান্ডেজ ছিলো কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চলে যান তিনি। মেঘ চুপচাপ তার কথামতো রেডি হয়ে নেয়। সে ভালোই বুঝেছে, তার ভাগ্যে এতোটুকু অব্দিই পড়ালেখা ছিলো।
.
.
.
সময়–২:৩০,
পাত্র পক্ষরা চলে এসেছে, মেঘকে তাদের সামনে নিয়ে যায়। মিজানুর সিকদারও নেমে আসে। কুশল বিনিময় করে বসেন তিনি। তিনজন এসেছে, দুজন বুড়ো-বুড়ি আর আরেকজন তাদের ছেলে হয়তো। দেখে বয়স ৪০+ মনে হচ্ছে। তিনি তাদের সাথে কথা বলেন। কথায় কথায় জানতে পারেন, তাদের নাকি মেঘকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে, এই শুক্রবারেই বিয়ের ডেট দিতে চান।
মিজানুর সিকদার হেসে জিজ্ঞেস করেন,
-“তা নাহয় হবে, তবে ছেলে কোথায়? দেখলাম না তো।”
তখনই বুড়ো মহিলা কপাল কুঁচকে বলে উঠে,
-“ওমা, ছেলে কোথায় মানে? ছেলে এইযে আপনাদের সামনেই বসে।”
সবাই হকচকিয়ে উঠেন। সাথে সাথে মাহমুদা বেগম তার ছোট জার দিকে তাকায়। সে তাকে টেনে নিয়ে যায় আড়ালে ,
-“এসব কী ছোটো? এই আধবুড়ো বয়সের লোকের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো?”
উনার কথায় সে মুখ মুচড়ে বলে,
-“এতোদিন তো আশ্রিতাদের মতো আচরণ করতে মেয়ের সাথে, আর এখন ‘আমার মেয়ে’? বুঝিনা বাপু তোমাদের কাহিনী। আর এই লোক আধবয়সি তো কি হয়েছে, যেই প্রভাবশালী! বউ মারা গেছে ২ বছর হয়েছে, সম্পদের অভাব নাই, রানি করে রাখবে।”
মাহমুদা বেগম কিছু ইতস্তত করে বলে,
-“তাই বলে..”
-“আরে রাখো তোমার চিন্তা। এই মেয়ে যেই কাজ করেছে, তা শুনে কেউ একে বিয়ে করবে? রাজি হয়ে যাও। নয়তো এর প্রভাব আমাদের রিমির উপরও পড়বে।”
কিছুক্ষণ পর মাহমুদা বেগম আসতেই সবার দৃষ্টি তার দিকেই। উনি হালকা হেসে বলে উঠেন,
-“তাহলে এই শুক্রবারেই বিয়ের ডেট ফাইনাল।”
মিজানুর সাহেব অবাক হয়ে বলেন,
-“মাহমুদা, তোমার মাথা ঠিক আছে?”
তিনি মাথা নিচু করে বলেন,
-“মাফ করবেন ভাইজান, তবে আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভেবেই নিয়েছি। আমাকে এখন আমার মেয়ের বিষয়ে ভাবতে দিন। আপনি অনেক করেছেন তার জন্য।”
মেঘ মাথা তুলে তাকায় তার মায়ের দিকে। “আমার মেয়ে” সম্বোধন করাটা কেনো জানি তার মুখে মানায়নি। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
তখনই বুড়ো মহিলা বলেন,
-“আমাদের মেয়ের বাড়ি থেকে কিছুই চাইনা। শুধু একটা ছেলে বউ লাগবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
কথা বার্তা ফাইনাল হতেই মেঘকে সেখান থেকে রুমে যেতে বলে। কিছুক্ষন পর তার মা তার রুমে আসে। চুপচাপ তার পাশে বসে বলল,
-“লোকটি অনেক প্রভাবশালী তোকে রানী করে রাখবে চিন্তা করিস না।”
মেঘ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
-“আমার জায়গায় রিমির জন্য যদি এরকম সম্মন্ধ আসে তাকেও দিয়ে দিবে?”
মাহমুদা বেঘমের মুখটা চুপসে যায়। কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই বসে উঠে চলে যায়। তিনি যেতেই মেঘ দরজা লাগিয়ে দেয়। তার ভীষণ মাথা ধরেছে একটু ঘুমানো দরকার।
.
.
.
পরেরদিন পিহু সুমনা ভার্সিটিতে আসে। রিকের হুদিস নেই। আর মেঘ আসবে কিনা সিউর না। পিহুর হাত এ বড় কেটবেরির প্যাকেট। দুজনেই খেয়ে খেয়ে গেট পেরিয়ে ঢুকছে,
-“সুমু রে আজকে কেমন খালি খালি লাগছে, রিকটাও লেট করছে আর মেঘ সে কি আসবে”
-“মনে হয়না আসবে। কালকে ওর মা যেভাবে রেগে নিয়ে গেছে। আর এই পরিস্থিতিতে কয়দিন না আসাই ভালো। “
কথা বলার মধ্যেই হঠাৎ পাথরের সাথে উস্টা খেয়ে পিহুর হাত থেকে চকোলেট এর প্যাকেটটা পড়ে যায়। সাথে সাথে দুজনেই অসহায় চোখে একে অপরের দিকে তাকায়। পিহু আফসোস নিয়ে বলে,
-“এই যা মাত্র দুইটা বাইট দিলাম আমার ফেভারিট চকোলেট…..”
-“দেখে চলতে পারিস না “
-“তুইও তো সাথে ছিলি বললি না”
পিহুর কথায় পাত্তা না দিয়ে সুমনা ফিসফিস করে বলে,
-“প্যাকেট তো পুরোটা খুলিসনি শুধু উপরের একটু। এক কাজ কর আমি আশেপাশে দেখছি তুই তাড়াতাড়ি তুলে ফেল। নোংরা জায়গা টা ফেলে দিবো”
তার কথায় পিহুও রাজি হয় অনেকক্ষণ এদিক সেদিক দেখে তারা তবে স্টুডেন্ট যাচ্ছে আসছে এসব এ সুযোগ হয়ে উঠছে না। প্রায় ৫ মিনিট পর একটু নিরিবিলি হতেই পিহু এদিক সেদিক তাকিয়ে চকোলেট টা শুধু হাতে নেয়। সাথে সাথে কেউ হর্ন বাজাতেই থতমত খেয়ে হাত থেকে ছুড়ে ফেলায় আর তা গিয়ে পড়ে সেই হর্ন বাজা গাড়ির সামনে।
পিহু মাথা তুলে দেখে একটি ছেলে বাইক নিয়ে মাত্রই হয়তো এসেছে হেলমেট পরা তাই চেহারা দেখতে পারছে না। ছেলেটি হেলমেট খুলতে খুলতে বলে,
-“ছি ছি সিনিয়র আপু শেষমেষ কিনা আপনি মাটি থেকে চকোলেট কুড়িয়ে খাচ্ছেন”
সেদিনের ছেলেটি পিহু কি বলবে না বলবে ভেবে বলে দেয়,
-“জি না আমি তো এটা উঠিয়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলতাম”
-“আচ্ছা তাই বুঝি তাহলে ওইযে ডাস্টবিন ফেলে দিন ওখানে”
পিহুর মুখটা চুপসে যায়। মনে মনে গালি দিচ্ছে এই বেডা আসলো কেনো,
-“হ্যা ফেলবো তো আপনি আপনার রাস্তায় জান”
পাশ থেকে সুমনা কানে কানে বলে,
-“তোকে সিনিয়র আপু বলল কেনো”
-“চুপ থাক এখন মুখ খুলিস না”
ছেলেটি বলে,
-“উমম আপাতত এখানেই থাকবো”
পিহু আর কিছু না বলে অসহায় ফেইস নিয়ে ধীরে ধীরে চকোলেট এর প্যাকেট টা তুলে পাশের ডাস্টবিন এর কাছে যায়। সুমনা পিহু একবার চকোলেট এর দিকে তাকায় আবার নিজেদের দিকে। এদিকে ছেলেটি এদের কান্ড দেখে হাসছে। সুমনা বলে উঠে,
-“থাক বইন আরেকটা কিনে নিবোনে”
সেটা ফেলে যেনো রাগ গিয়ে পড়লো সেই ছেলের উপর। পিহু রাগী লুক নিয়ে তার সামনে যায়,
-“এই তোমার তো সাহস কম না আমাকে সালাম দাও নাই”
ছেলেটি কিছুটা নাটকীয় ভাবে বলে,
-“আল্লাহ আমি তো ভুলেই গেছিলাম। সরি সিনিয়র আপু আসসালামু আলাইকুম”
তখনই রুদ্র ও আসে বাইক সাইড করে ছেলেটির কাছে যেয়ে একটা হাগ করে তারা। তা দেখে পিহুর ভ্রু কুচকে যায়। রাফান রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“শালা আসতে এতো দেরি করলি কেনো”
-“একটু কাজ পরে গেছিলো চল”
বলে যেতে নিয়েই পিহুকে দেখে ভ্রু কুচকে জিগায়,
-“তুই এখানে কি করিস ক্লাস নাই”
পিহু সেসব পাত্তা না দিয়ে তার ভাইকে পাল্টা প্রশ্ন করে,
-“ভাইয়া উনাকে তুমি চিনো ?”
রুদ্র অবাক হয়ে বলে,
-“আমার বন্ধুকে আমি চিনবো না? ও তো…”
রুদ্রের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রাফান মুচঁকি হেসে বলে উঠে,
-“আই এম রাত রাফান তালুকদার সন অফ ফারুখ তালুকদার”
রুদ্র পাশ থেকে বলে উঠে,
-“আমাদের প্রিন্সিপাল আই মিন ফারুখ আংকেল এর ছেলে রাফান চিনিস নি? অবশ্য ছোট থাকতে দেখেছিস এখন চিনার কথা না”
এদিকে পিহু লজ্জায় ভয়ে ইচ্ছা করছে মাটিতে ঢুকে যেতে মনে মনে নিজের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলেছে। তার বাপের কলেজে তার সাথেই কি ভাবটা নিলাম। এখন যদি ভাইয়াকে বলে দেয় তার মজা উরাবে।
রুদ্র হঠাৎ বলে উঠে,
-“তোর বান্ধুবিকে দেখছি না যে, “
-“না আসেনি । আচ্ছা আমাদের ক্লাস আছে যাই।”
তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে সুমনা কে নিয়ে।
এদিকে রাফান মাথা চুলকিয়ে হাসে মনে মনে আওরায় “নট বেড”।
চলবে……..
Share On:
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE