Golpo

আড়ালে তুমি পর্ব -৪০


#আড়ালে_তুমি

#সামিয়া_সারা

#কাজিন_রিলেটেড_গল্প

পর্ব -৪০

ভার্সিটির ওয়াশরুমের ধুলার আবরণ পড়া আয়নায় নিজের আবছা প্রতিচ্ছবি দেখছে ইনয়া। বাম হাতে কিছুক্ষণ আগে খুলে রাখা শাড়িটা গোল করে পেচিয়ে ধরে রয়েছে । ডান হাত দিয়ে নিজের পরনের নতুন জামাটা ঠিকঠাক করছে । কিছুক্ষণ পর ওড়না টেনে ঠিকঠাক করে  বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। ফ্যাকাশে মুখে নীলের হাতে শাড়িটা ধরিয়ে দেয় কোনো কথা ছাড়া। 

ভ্রু কুঁচকে ইনায়ার কর্মকাণ্ড দেখে নীল বলল,

-হয়েছে টা কী?

-কিছু না! 

রিসান গভীর মনোযোগ দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কী চলছে এখানে। নীলের মন মেজাজ দেখে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছে না । আবার ইনায়াও সেই তখন থেকে সাপের মতো মোচরাচ্ছে। 

ইনায়া হালকা রাগান্বিত হয়ে নীলকে বলল,

-শান্তি পেয়েছেন এখন?

-কেন?

-আমার শাড়ি টা খুলে শান্তি হয়নি?

রিসান বড় করে তাকিয়ে মুখে হাত দিল। বলল,

-ছি ভাই।আর কিছু বলতে দিস না। থামা। আমি চলে যাই।

ইনায়া অবাক হয়ে রিসানের দিকে তাকায়। 

বলল,

-ছি বলার কী হয়েছে?

নীল ইনায়াকে আড়াল করে দাঁড়ালো। 

দুহাত ভাঁজ করে মাথা হালকা কাত করে বলল,

-আমি আপনার শাড়ি খুলেছি?

-হ্যা আপনার জন্যই তো!  নাহলে খুলতাম?

বলেই ইনায়া থেমে গেল। পুনরায় দ্রুত বলল,

-ছি ছি! কী ভাবছেন আপনারা! আমি বলতে চেয়েছি আপনি জোড় করলেন বিধায় আমি শাড়ি খুলেছি।

নীল ইনায়ার কাছে আরেকটু এগিয়ে যায়। কন্ঠস্বর তুলনামূলক নিচু করে বলল,

-আমি খুলতে বললাম আর খুলে ফেললি?

নীলের এমন ফিসফিসানি আওয়াজ শুনে ইনায়া শুকনো ঢোক গিললো। চোখ বুজে বলল,

-নীল ভাই… একটু পিছিয়ে দাঁড়ান।

এদিকে রিসান সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে এক নাগাড়ে বলছে,

-তোরা থাক ভাই। এমনিতেই আগে পরে কোনো মানুষ নাই আমার, তারউপর যদি এইসব রং ঢং দেখতে হয়,আমি বাঁচমু কেমনে ক! 

নীলে ইনায়ার কথা শুনেও পিছায় না। বরং ডান হাত দেয়ালের রেখে মুখটা ইনায়ার ডান কানের থেকে সমান্য দূরত্ব রেখে বলল,

-না পিছালে কী হবে?

ইনায়ার মুখ দিয়ে আর আওয়াজ বের হচ্ছে না। চোখ টিপে বন্ধ করে রেখেছে। গলা শুকিয়ে আসছে আর বারবার করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। দেয়ালের সাথে একেবারে মিশিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইনায়া। কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে এক চোখ খোলে । নীল হালকা ঝুঁকে ডান হাত দেয়ালে রেখে একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইনায়া আবার চোখ বন্ধ করে নিল। তার মনের ভেতরে সুনামি হচ্ছে। 

মনে মনে বলল,

-নীল ভাই এর এই কণ্ঠস্বর হুইস্কি ওয়াইনকেও হার মানাবে। না না ,ইনু এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। কেটে পড়া যায় না? 

ভাবতে ভাবতে আনানের ডাক ভেসে আসে। নীল সেদিকে তাকিয়ে হাত নামিয়ে রিসানের মুখোমুখি দাঁড়ালে আনান ইনায়ার কাছে আসে। কপাল ভাজ করে বলল,

-এখানে কী?

-কিছু না ভাইয়া…

-শাড়ি খুলেছিস কেন?

-এমনি

আনান নীলের দিকে তাকায় আড় চোখে। পুনরায় ইনায়াকে বলল,

-এখানে কেন তুই? নিচে তোদের প্রোগ্রাম না?

নীল কপালে তর্জনী,মধ্যমা আর বৃদ্ধা আঙ্গুল রেখে আনানের দিকে না তাকিয়েই বলল,

-ওয়েট আনান! এখানে আমি থাকতে তুই ওর সাথে কথা বলছিস কেন? 

-কারণ আমার দরকার টা ওর সাথে বড় ভাইয়া।

-ভবিষ্যতে আমাকে ওর পাশে দেখলে ওকে আর কোনো প্রশ্ন করার দরকার নেই। অবশ্যই ও আমার অনুমতি বা আদেশ ছাড়া কিছু করবে না।

কথা গুলো বলতে বলতে আনানের মুখোমুখি হয় নীল। একটু আস্তে আস্তে বলল,

-Of course she won’t do anything without my permission or order. You know না?

আনান কোনো জবাব দেয় না। রিসানের কাছে গিয়ে বলল,

-রিসান ভাইয়া কখন এলে?

-এইতো কিছুক্ষণ আগেই।

-তুমি আইনের ছাত্র না?

-প্রায় আইনজীবী হয়ে গেলাম! আর এখন এটা  কি জিজ্ঞেস করলে!

-না না জানতামই। আসলে ইনুর একটা ফ্রেন্ড আমাকে অনেক জ্বালাতন করছে। আমি কী সাজেশন দিব বলো তো? আমিই ভাই লাফাতে লাফাতে এডমিশন জার্নি শেষ করেছি। 

ইনায়া কপাল কুচকে বলল,

-কোন বান্ধবী?

-ঐ যে সামিরা…

-উমমমমম…ভাইয়াআআআআ….

-কী? 

-বুঝেছি বুঝেছি… কী কী সাজেশন দিলে?

-এখনো দেইনি। আজ রিসান ভাইকে পেলাম। এখন দিব।

ইনায়া নাক শিটকে নীলের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আজ সাজেশন দেওয়ার কেউ নেই বলে পাবলিকে পড়ি না..হুহ!

নীল আড় চোখে ইনায়াকে দেখে। দাঁত চেপে বলে,

-খুব শখ না?

-কীসের?

নীল কড়া দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। 

.

আনান এদিকে কল দিয়েছে সামিরাকে। স্ক্রিনে আনানের নাম টা ভেসে উঠতেই বুকের ভেতর ধুক করে উঠে সামিরার।পানি খেয়ে গলা পরিষ্কার করে কাঁপা কাঁপা হাতে কল রিসিভ করে। কাঁপা গলায় বলে,

-হ্যা…হ্যালো…

রিসান অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দেয়,

-হ্যালো.. হ্যাঁ..

-কে?

-আমি..আমি রিসান…

সামিরা অসম্ভব রাগ নিয়ে ফোনের দিকে তাকায়। আইডি তে আনানের। তাহলে এই রিসান কীভাবে কথা বলছো। রেগে বলল,

-আপনি আনান ভাই এর আইডিও হ্যাক করেছেন?

আনান সামিরাকে কল করে লাউডে দিয়েই হুট করে রিসানকে ধরিয়ে দেয়। তবে আইডি হ্যাক করেছি কি না কথা টা শুনতেই ইনায়া আর আনান অবাক হয়ে তাকায় রিসানের দিকে। আনান অতি আগ্রহ নিয়ে বলল,

-ভাইয়া আইডি হ্যাক করো না কি?

রিসান নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। নীল অনেকক্ষণ ধরে এসব কাহিনী চুপচাপ দেখছে । তবে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় এবার। আনানের শার্টের কলার চেপে বলল,

-গেম খেলছিস আমার সাথে?

আনান গালে হাত দিয়ে বলে,

-কী বলছো ভাইয়া! তোমার সাথে গেম খেলার সাহস আছে আমার? 

ইনায়া এগিয়ে এসে নীলের হাত ধরে। আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-এভাবে শার্ট ধরেছেন কেন নীল ভাই? ছাড়ুন…

নীল ইনায়ার দিকে তাকায় না। আনানের চোখে চোখ রেখে বলে,

-সরে যা ইনু!

আনান ভয়ার্ত কন্ঠে ইনায়াকে বলল,

-সামিরার আইডি হ্যাক হয়েছিল তা আমি জেনে গেছি বলে এমন করছে মনে হয়।

ইনায়ার মাথায় কিছুই ঢুকছে না । তবে সে চট করে রিসানের হাত থেকে ফোন নেয়। সামিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-তোর আইডি কে হ্যাক করেছিল?

সামিরার থেকে জবাব আসে না। ইনায়া পুনরায় বলল,

-সামিরা! তুই যদি এখন সবটা না বলিস তাহলে আমি ভুলে যাব তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাদের আর সম্পর্ক থাকবে না…

-রি…রিসান ভাই…

ইনায়া রিসানের দিকে তাকায়। বলল,

-কেন? 

-জানি না আমি… সত্যি বলছি.. বিশ্বাস কর।

আনান নীলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কলার ঠিক করতে করতে ইনায়াকে বলল,

-ইনু,সামিন আইয়াজ কে জিজ্ঞেস কর তো।

ইনায়া একটু ঘাবড়ে গিয়ে নীলের দিকে তাকায়। নীল কপালে হাত রেখে ইনায়াকে দেখছে। দৃষ্টি কড়া। 

ইনায়া ভয়ে ভয়ে বলল,

-সামিন আইয়াজ কে সামিরা?

-তোর ….নীল ভাই।

সামিরার থেকে এমন জবাব পেয়ে ইনায়ার মনে হচ্ছে তার পায়ের নিচে মাটি নেই। কোনো রকমে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে বলল,

-কী বলিস? তোর কাজিন না?

-না। আমার বড় কোনো কাজিন নেই। 

ইনায়া নীলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে করে বলল,

-নীল ভাই? কিন্তু কেন?

সামিরা ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলল,

-সে সময়ে তুই বলতি তোর জন্য ছেলে খুঁজতে,সেজন্য ভাইয়া জানতে চেয়েছিল আসলেই ছেলে খুঁজে দিলে কি তুই তার সাথে সম্পর্কে যাবি নাকি….আর তাই আমাকে এই মিথ্যা পরিচয় দিতে বলে….নাহলে আমার আইডি আমাকে ফেরত দিবে না বলেছিল।

সামিরা এ পর্যায়ে কান্না করে দেয়। বলে,

-দোস্ত তুই তো জানিস আমার বাসার মানুষ কেমন,আইডি হ্যাক  এর কথা শুনলে আমাকে আর ফোন ধরতে দিত না..

ইনায়া আর কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেয়। নীলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,

-কিছু আড়ালে করতে খারাপ লাগে না নীল ভাই?

নীল কিছু একটা বলতে গেলেই ইনায়া আবার বলল,

-আপনি তো কথা দিয়েছিলেন আর কিছু আড়ালে রাখবেন না। 

নীলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল,

-কী বলতে চান আপনি? বলেন? এটা খুব সামান্য ছোট বিষয় তাইতো? ইহান ভাইয়া কে নিয়েও  তাই বলেছিলেন না নীল ভাই?

নীল পুরো থমকে যায়। রিসানের পাশে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু বলল,

-মামা,ওরে বোঝা!

তবে ইনায়া দাঁড়ায় না। হনহন করে হেঁটে চলে যায়। পেছন পেছন যায় আনানও।

.

.

.

ইনায়া বাড়িতে মুখ ভার করে ঢুকেছে। পেঁচিয়ে রাখা শাড়ি কোনো কথা ছাড়া ই শিমু জাহানের হাতে তুলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রেলিং ধরে। শরতের আকাশে ধূসর মেঘ। আকাশ পানে তাকিয়ে কিছুক্ষণ শক্ত করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। হালকা মেঘের গর্জনের সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ইনায়া এখনো চোখ বন্ধ করেই রেখেছে। বৃষ্টির পানি চোখ ছুঁয়ে যাচ্ছে।

ইনায়া বিড়বিড় করে বলল,

-তুমি কাঁদছো কেন আকাশ? দুঃখ তো আমার একার।

আলতো করে ডান হাত দিয়ে নিজের মুখ মুছলো ইনায়া। পুনরায় বলল,

-চোখের পানি শুকিয়ে যায় এক সময় তাই না?  যা পছন্দ করি না,তার বারবার হয় কেন? শাস্তির কোনো বিষয় আছে নাকি? এই ধরো দুনিয়ায় করা পাপের শাস্তি….

ইনায়া মুখ মুছে মাথা ধরে দাঁড়ায়। বেলকনি থেকে সোজা নিচের দিকে চোখ যায়। সুদর্শন ছয় ফুট লম্বা সুঠাম দেহের পুরুষ দুহাত বুকের উপর ভাজ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অবেলার বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছে। মুখমন্ডলে জলের ফোঁটা জমে আছে। তবে তার চোখ থেকে পড়েছে নাকি বৃষ্টির ফোঁটা তার বোঝা যায় না। অন্য কোনোদিন হলে হয়তো সে মানুষ টা ধমক দিয়ে বলতে,

-ইনু! ঘরে যা। জ্বর আসবে! দু সেকেন্ডে ভেতরে যাবি!

ইনায়া ভাবতে ভাবতে নীলের থেকে মুখ ফিরিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে যায়। মনে মনে বলে,

-জ্বর তো আপনারও আসবে নীল ভাই।

তবে মুখে কেউ কিছু বলে না কাউকে।

.

.

.

.

সারাদিন হয়ে গিয়েছে ,ইনায়া মুখে এখনো কিছুই তোলেনি।  দিন গড়িয়ে রাত হতে আনান বেশ কয়েকবার ডাকার পরে ইনায়া দরজা খোলে। ঘুম ঘুম চোখে বলল,

-খাব না আমি।

-সমস্যা কী তোর ইনু?

-তোমার সমস্যা কী আনান ভাইয়া? তোমাকে আমার বিরক্ত লাগছে! দয়া করে আমার সামনে আর এসো না। খাব না আমি,সবাইকে ইচ্ছে হলে জানিয়ে দিবে। আর আজ থেকে আমার সাথে কোনো ধরনের কথাই বলবে না।

ইনায়া ঠিক আগের মতোই দরজা বন্ধ করে দেয় আনানের মুখের সামনে। 

.

.

.

নীল শিমু জাহানের ঘরে। টকটকা লাল চোখে তাকিয়ে রয়েছে মায়ের দিকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

-জানো মা! তোমার মতো অনেক মা আছে,যে মা দুনিয়ার সবার সন্তানের ভালো চায়, কিন্তু নিজের সন্তানের ভালো চোখে দেখে না…..

নীলের বুক ভার হয়ে আসছে। কোনো রকমে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করে বলল,

-ইহানকে টেনে না আনলে হতো না মা? 

নীল হাটু গেড়ে শিমু জাহানের সামনে বসে পড়ে। মাথা নিচু করে বলল,

-আমি চেয়েছি শুধু ইনু যেন কষ্ট না পায় কোনোদিন। আমার সাথে কথা না বলুক,তবুও যেন ও কষ্ট না পায়। আর দেখ মা! আমি ওর পুরানো ক্ষ*ত তে আ*ঘাত দিয়ে র*ক্তাক্ত করলাম!

(চলবে……)

#Running 

#episode:40

Written by #Samia_Sara

Story name: #আড়ালে_তুমি

আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকারা, গল্পটি নিয়ে আপনাদের মন্তব্য শুনতে চাই। একদম সব্বাই কমেন্ট করে জানিয়ে দিন,কেমন লেগেছে আপনাদের কাছে। আর আগের পর্বে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা। ভালোবাসা নিবেন 🥺🫶🏻

Share On:

TAGS:



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply