অর্ধাঙ্গিনী ( দ্বিতীয় পরিচ্ছদ)
নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -২৬
“কিছু মানুষ থাকে না যারা সারাজীবন সুখের অপেক্ষায় থাকে? অতঃপর একদিন সুখ আসার আগেই তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। দেখবি, আমার সাথেও এমন হবে। একদিন সুখ এসে দেখবে, আমি আর পৃথিবীতে নেই। আচ্ছা নয়ন, মানুষ মৃত মানুষের জন্য ভালোবাসা দেখায়, জীবিত মানুষকে অবহেলা করে কেন? রূহ কবজ হওয়ার পর কদরের কি কোনো মূল্য থাকে?”
“চুপ কর তো! সারাদিন কী আজেবাজে বকিস! একদিন তুই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হবি। আচ্ছা, তোর বাবার কাছে তুই সব কেন বলিস না?”
“কথায় আছে না, মা মরলে বাপ হয় তালই। একবার বলেছিলাম, তারপর আমাকে চড় দিয়ে গালে আঙুলের ছাপ ফেলে দিলো। এরপর আর কখনো বলিনি। দুঃখের ভারে অনেক বেশি ওজন রে, নয়না। দুঃখের ভার সইতে না পেরে মানুষ অকালে মরে যায়। পৃথিবীতে সুখের চেয়েও দুঃখ জমা রাখবে এমন মানুষ দরকার।”
“আমি আছি তো।”
“যতটুকু বলি, ততটুকু প্রকাশ করার মতো; বাকিটুকু হৃদয়ে জমা হয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।”
“কেন জমাচ্ছিস দুঃখ! চল, আজ আমার বাসায় সব দুঃখ আমাকে বলবি। মন খালি করে ফেল, দুঃখের গোডাউন বের করে।”
“মানুষ অনেক কথা বলতে চায়, কিন্তু জানিস, ভেতর থেকে সেই কথাগুলো কখনো শব্দ হয়ে বের হয় না।”
নয়না জিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “কেন সুখ আসার আগেই তুষি চলে গেলো! কেন সুখের দরজার কাছে এসে ওর আর সুখ ছুঁয়ে দেখা হলো না! কেন এমনটা হলো ওর সাথে?”
“মৃত্যু হলো সবচেয়ে কঠিন সত্য। মেনে নাও, সুনয়না। এভাবে ভেঙে পড়ো না। জীবনের আয়ু ফুরিয়ে গেলে আর বেঁচে থাকার কোনো উপায় থাকে না।”
“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কী করে মেনে নেবো, ওইটুকু প্রাণ আর পৃথিবীতে নেই! এইটুকু জীবনে পাহাড় সমান দুঃখ জমিয়ে চলে গেছে পরপারে। সুখ, তুমি বড্ড দেরি করে ফেললে।
আমার মোবাইল থেকে ওর বাবাকে একটা কল করো। ওই লোকটার জন্যই ওর আজ এই অবস্থা। বাবা কি শুধু শব্দ? এই শব্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মমতা, দায়িত্ব। অথচ কোনোদিন নিজের মেয়ের কথা শোনেনি। কল করে বলো, তার জীবন থেকে তুষী বিদায় হয়েছে। এবার আর তুষী তাকে কোনোদিন বিরক্ত করবে না।”
🌿
জাহানারা বেগম সোফায় বসে আছে, নীলাঞ্জনার ছেলেকে কোলে নিয়ে।
মাহবুব তালুকদার দ্রুত পায়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করে বলে, “জাহানারা, তুষি আর নেই।”
জাহানারা বেগম অবাক চোখে মাহবুব তালুকদারের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “নেই মানে!”
“তুষি আমাদেরকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে গেছে।”
জাহানারা বেগম খানিক থমকে গেলেন। তারপর নিম্ন স্বরে বললেন, “নিজের ছেলেকে হত্যা করার পর কোনোদিন তোমার চোখে এইটুকু মমতাও দেখিনি। আচ্ছা, নিজের সন্তানকে হত্যা করে কী করে বেঁচে আছো, মাহবুব?”
নীলাঞ্জনা কিচেন থেকে বাবুর জন্য খিচুড়ি রান্না করে এনে বাবুকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে।
মাহবুব তালুকদার জাহানারা বেগমের সামনে বসে বললেন, “জাহানারা, তোমার-আমার বিয়ে হয়েছে ওই সন্তান জন্মের তিন বছর পর। এর আগে আমরা নিজেরাই জানতাম না আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে।”
জাহানারা বেগম গর্জে উঠে বললেন, “ভবিষ্যৎ জানতেন না, কিন্তু প্রেমের নাম করে দেহের সুখ মিটিয়েছেন! তার মানে আপনার ভালোবাসা ছিলো টাইমপাস। ভবিষ্যৎ ভালো হলে ভালো, না হলে নাই। ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর—আপনার মতো একটা মানুষের সাথে রাতের পর রাত এক বিছানায় কাটিয়েছি। আমি আপনাকে বারবার বলেছিলাম প্রেম করবো না। কুকুরের মতো আমার পিছু ঘুরেছেন। আর যখন আমি বললাম আমার গর্ভে আপনার সন্তান বড় হচ্ছে, তখন কী বললেন? ‘এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলো! পেটের মধ্যে ছোট একটা প্রাণ মেরে ফেললে সেটা তো আর খুন হয় না।’ মনোরঞ্জন করেছেন, কিন্তু সেই মনোরঞ্জনের ফসল হলো ভুল। যখন আমার শরীর গিলে খেয়েছেন, তখন মনে ছিলো না এসব ভুল। আজকের পর থেকে আপনার মতো মানুষের সাথে আমার কোনো রকম সম্পর্ক থাকবে না। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আপনি জানতেন না। আজ আমি জানাচ্ছি আপনাকে, ভবিষ্যতে আমি জাহানারা আপনাকে ডিভোর্স দেবো। আপনার বিরুদ্ধে আমার সন্তান হত্যার কেস ফাইল করবো। লোকে জানলে আপনার নাম খারাপ হবে। বংশের নাম খারাপ হবে। এই ভয় ছিলো তো আপনার। এখন সবাই জানবে আপনার কুকীর্তি।”
জাহানারা বেগম নিজের ঘরে গিয়ে বোরকা পরতে শুরু করলেন।
মাহবুব তালুকদার বাইরে থেকে গেট লক করে চলে গেলেন।
🌿
নয়না বসে আছে তুষির কবরের পাশে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কবরের দিকে। যেনো নয়নাকে তুষি ডেকে বলছে, “দেখলি তো নয়ন, সুখ আসার আগেই আমার মৃত্যু চলে এলো। এই নয়ন, তুই কাঁদিস না। অত সুন্দর চোখে অশ্রু মানায় না।”
নয়না চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
অন্তর এসে দেরি করে পৌঁছেছে। পাগলের মতো ছুটে এসে কবরের মাটি হাত দিয়ে সরাতে লাগলো। পাগলের মতো বলতে লাগলো, “এই তুষি, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো না। তুমি কথা দিয়েছিলে আমাদের সুন্দর একটা সংসার হবে। তোমাকে আমি এভাবে যেতে দেবো না। কথা না রেখে তুষি চলে যেতে পারবে না।” দুহাতে কবরের মাটি খামচে তুলছে আর বিড়বিড় করছে।
জিয়ান অন্তরকে চেপে ধরে বলে, “শান্ত হও, অন্তর। মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসতে পারে না।”
অন্তর ধাক্কা দিয়ে জিয়ানকে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে, “আমার তুষি মৃত না। তুষি মরতে পারে না। ও জীবিত।” আর কিছু বলার আগেই অন্তর জ্ঞান হারালো। তিনটা দিন ধরে খাওয়া নেই, ঘুম নেই। পাগলের মতো ছুটেছে তুষীর সন্ধানে। অথচ সেই মানুষটা আর কোনোদিন তার কাছে ফিরে আসবে না। কোনোদিন বলবে না, “তোমাকে আমার চেয়ে কেউ বেশি ভালোবাসতে পারবে না। আমার মতো বাসবে কে তোমায় ভালো, বলো?”
তুষির বাবা যখন এলো, তখন এখানে আর কেউ নেই। তুষির লাশও উত্তোলন করে নিয়ে গেছে ফরেনসিক তদন্তের জন্য। আশেপাশের মানুষের মুখে মুখে যতটুকু শোনার, শুনেছে।
🌿
মেহনুর মিতা বেগমের পাশে বসে আছে।
মিতা বেগম বললেন, “তোকে আমি আবার বিয়ে দেবো, ভালো ছেলে দেখে। জাহিনকে ডিভোর্স দিয়ে দিবি তুই। ওরকম হাসব্যান্ড দরকার নেই।”
মেহনুর মিতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আম্মি, এখন যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি যে জড়িয়ে গেছি ওই খারাপ মানুষটার সাথে। এখন কীভাবে আলাদা হবো বলো?” বলেই মিতা বেগমের হাত নিজের পেটের উপর রাখলো।
মিতা বেগম এমন খুশির সংবাদ শুনেও মুখটা যেনো চুপসে গেলো তার। চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল, “কেন এ শেকড়ে আটকে ফেললি নিজেকে! এই সুখের পরিণাম কী হবে?”
মেহনুরের চোখের কোণ গড়িয়ে অশ্রু পড়লো মিতা বেগমের কাঁধে। নিম্ন স্বরে বলল, “আম্মি, আমি জানি না কী হবে ভবিষ্যতে, তবে আমি শুধু চাই আমার মতো জীবন যেনো আমার সন্তান না পায়। আমি তাকে পিতা-মাতা উভয়ের ভালোবাসায় লালন-পালন করতে চাই। তুমি আমার জন্য না হলেও আমার সন্তানের জন্য জাহিনের উপর দয়া করো। আমি কথা দিচ্ছি, আমি ওকে শুধরে নেবো।”
“আমি কথা দিতে পারছি না। কারণ আমি এখনো জানি না ওর পাপের বোঝা কত ভারী। যদি নয়নার সাথে করা অন্যায় পর্যন্ত সমাপ্ত থাকে, তাহলে হয়তো সম্ভব। নয়তো ওর কর্মের ফল ওকে ভোগ করতেই হবে।”
জিয়ান নয়নাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে প্রাইভেট হাসপাতালের বেডে। ছোট একটা বেডে দু’জন একদম একে অন্যের মধ্যে মিশে আছে। অন্তরকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। জিয়ান একটা ভিআইপি কেবিন বুক করেছে। কারণ দু’রাত ধরে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না তাদের। রাতটা এখানেই কাটাতে হবে। তাই ঘুমের ব্যবস্থা করলো। সময়ের সাথে চলতে হলে শক্ত হতে হয়। সবাই ভেঙে পড়লে পরিস্থিতি সামলাবে কে?
নয়না গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জিয়ান নয়নার কপালে চুমু দিয়ে বলে, “তোমার চোখের পানি আমি বৃথা যেতে দেবো না, বাটার মাশরুম। জাহিনকে আমি কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেবো। আমি তোমাকে সুখে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুঃখের জঞ্জালে আটকে দিয়েছি। কথা দিচ্ছি, খুব শিগগিরই তোমাকে সুখের সমুদ্রে বাসিয়ে নিয়ে যাবো—যেখানে দুঃখ তোমাকে কখনো স্পর্শ করতে পারবে না।” নয়নাকে আরো কিছুটা গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে, ঠোঁটে আলতো ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, “ভালোবাসি।”
চলবে
Share On:
TAGS: অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২, নুসাইবা ইভানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৮
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১৮
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১১
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ২
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৯
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৬
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৫
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৪
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ১৩
-
অর্ধাঙ্গিনী সিজন ২পর্ব ৭