Golpo romantic golpo অবাধ্য হৃৎস্পন্দন

অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৪


অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (৩৪)

সোফিয়া_সাফা

​টেরেসের গোলাকৃতি টেবিলের চারপাশে বসে আছে উদ্যান, সোহম, অনি, লুহান ও মেলো। পরিবেশ দেখে অনুমান করা যাচ্ছে ওরা সিক্রেট মিটিং করছে।

​“তথ্য পাচারকারীকে সর্বপ্রথম খুঁজে বের করতে হবে।” লুহানের সঙ্গে সবাই একমত হলেও উদ্যান দ্বিমত পোষণ করে বলল, ​“তথ্য পাচারকারীকে খুঁজে বের করার তাড়া নেই। সময় হলে নিজে থেকেই আত্মপ্রকাশ করবে। আমাদের রিদমকে খুঁজে বের করার ওপর ফোকাস করা উচিত।”

​সোহম বলল, “কিন্তু রিদমকে কোথায় রেখেছে জানব কীভাবে? তার চেয়ে স্পাইকে খুঁজে বের করে ওকে কাজে লাগিয়ে রিহান পর্যন্ত পৌঁছানো সহজ হবে।”

​লুহান তাল মেলায়, “হ্যাঁ, আমিও সেটাই মনে করি।”

​উদ্যান বুকে হাত গুটিয়ে রাশভারী কণ্ঠে বলল, “স্পাইকে খুঁজে বের করলেও আমরা রিহান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব না। কেননা, বসের ঠিকানা সম্পর্কে স্পাই সদস্যদের আহামরি ধারণা থাকে না। দু-একটা স্পাই সদস্যকে মে’রে ফেললেও রিহানের ক্ষতি হবে না। তাই অযথা স্পাই খোঁজার পেছনে টাইম ওয়েস্ট না করে, আমাদের উচিত ওদেরকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা।”

​নীরবতা ভেঙে অনি বলল, “আমরা কীভাবে স্পাইদের ব্যবহার করব? ওরা রিহানের লোক হয়ে নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবে না।”

​মনে মনে কুটিল বুদ্ধি এঁটে ফেলল উদ্যান। “রিহানের স্পাই সদস্যই রিদমকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।”

​ভাবনায় পড়ে গেল লুহান, “কী করতে চাইছিস বলবি?”

​ঘাড় কাত করল উদ্যান, “রিহানের নেক্সট টার্গেট কে জানিস?”

​অনি সঙ্গে সঙ্গেই বলল, “ওর কোনো নেক্সট-টেক্সট টার্গেট নেই। ওর অনলি টার্গেট তুই। আমি সিওর ও তোকে মেরে ফেলার চেষ্টা বারংবার করবে।”

​উদ্যানের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়নি অনি সঠিক অনুমান করতে পেরেছে। টেবিলের ওপর থাকা রেড ওয়াইনের গ্লাস হাতে তুলে নেয় মেলো। এক নিঃশ্বাসে সবটুকু গিলে আওড়ায়, ​“রিহানের নেক্সট টার্গেট হলো ফুল। যেহেতু এস্টেটে স্পাই আছে সেহেতু রিহান জেনে গেছে ফুল তেহুর কাছে ভ্যালুয়েবল।”

​প্রত্যেকের চোখে বিস্ময় ভর করল। উদ্যানের নির্লিপ্ততা বুঝিয়ে দিচ্ছে মেলো সঠিক অনুমান করেছে। অনির ভ্রু কুঁচকে গেল। উদ্যানের পানে তাকিয়ে বলল, “তুই জানিস যে রিহানের নেক্সট টার্গেট ফুল। এও জানিস, বাড়িতে স্পাই আছে। তারপরও কেন ফুলকে নিজের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিস? তখন টেবিলের চতুর্দিকে সার্ভেন্ট-গার্ডস ছিল। সবার সামনে ওর হাতে খাওয়ার ক্রেভিংস উঠেছিল কেন?”

​লুহান বলল, “হ্যাঁ, তুই জেনেশুনে কেন ওকে টার্গেটে ফেললি? তোর তো উচিত ওকে প্রোটেকশনে মুড়িয়ে রাখা। যেভাবে অনিলাকে রাখে অনি।”

​উত্তর দিল না উদ্যান। মেলোর উদ্দেশ্যে বলল, “রিহানের ব্যাপারে যতটা সম্ভব ইনফরমেশন কালেক্ট কর। যেইসব জায়গায় ওর আস্তানা থাকার সম্ভাবনা আছে সেইসব জায়গা মার্ক কর। যত দ্রুত সম্ভব রিদমকে খুঁজে বের করতেই হবে। আই’ম ড্যাম সিওর আমাকে মা’রতে না পেরে রিদমের ওপর ট’র্চার করবে ওরা।”

​“যেই তুই উনিশ-বিশ হলে যাকে-তাকে ধরে পানিশমেন্ট দিস সেই তুই ওকে নিয়ে এতো ওয়ারিড?” সোহমের কথায় শান্ত চোখে তাকায় উদ্যান। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ​“মাস্টার শাসন করে, শোষণ নয়। দুটো শব্দ কাছাকাছি শোনালেও অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত।”
​এক মুহূর্ত দাঁড়াল না উদ্যান। ধুপধাপ পা ফেলে নিচে চলে গেল।

​(খানজাদা নিবাস)

​চোখের পলকেই সপ্তাহ খানেক অতিবাহিত হয়ে গেছে। বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার পাঠ চুকিয়ে রাতের আঁধার নেমে এসেছে। পরিষ্কার আকাশের বুকে একফালি চাঁদ জ্বলজ্বল করছে।
​অন্ধকার রুমের দোর খুলে ভেতরে প্রবেশ করে মেহেক। হাতে ট্রে ভর্তি খাবার। ডিম লাইট জ্বালিয়ে খাটের দিকে তাকিয়ে নিরাশ হলো সে। মোলায়েম গলায় ডাকতে লাগল, ​“আবেশ ভাই, কোথায় তুমি?”

​খাটের পাশের ফ্লোরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল আবেশ। মেহেকের কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকায়। আবেশের চাহনি দেখে অপ্রস্তুত হলো মেহেক। পরিধেয় জামা ঠিকঠাক করে আলতো পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। ট্রে রেখে পা ভাঁজ করে আবেশের ঠিক সামনে বসল। ​“কী হলো, আবেশ ভাই? সাড়া কেন দিচ্ছো না?”

বাচ্চাসুলভ ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নেয় আবেশ। অভিমানী সুরে বলে, “আমি তোর সাথে কথা বলবো না। তুই সারাদিনে একবারও আমাকে দেখতে আসিস না।”

​মেহেক খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখতে শুরু করল। ঠোঁট নেড়ে আওড়াল, “তোমাকে বলেছি আবেশ ভাই, দিনের বেলায় আমি আসতে পারব না। তবুও কেন জেদ করছো? শুনলাম, আজ তুমি নিয়মমতো খাবার, ঔষধ কোনোটাই খাওনি। দেখো, তুমি এমন করলে কিন্তু আমি রাতেও তোমাকে দেখতে আসব না।”

​চকিত নয়নে আবেশ তাকায় মেহেকের দিকে। হাত নেড়ে নেড়ে বলে, “কে বলেছে আমি ঔষধ খাইনি? আমি খেয়েছি। তুই ওদের কথা বিশ্বাস করিস না। ওরা কেউ ভালো নয়। শুধু মিথ্যা কথা বলে।”

​ম্লান হাসল মেহেক। কথায় কথায় আবেশকে খাইয়ে দিচ্ছে সে। কতো কথা যে আবেশ বলে ওর সাথে। এর আগে এতো কথা বলেনি কখনও। খাবার খাওয়া শেষে আবেশ বাচ্চাদের মতো ওর ওড়নার আঁচল মুঠোয় নিয়ে মুখ মুছে নেয়। উদাসীন কণ্ঠে বলে, ​“তুই কেমন যেন বদলে যাচ্ছিস, ফুল।”

​আবেশের ‘ফুল’ সম্বোধনে মেহেকের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। এতোক্ষণ যাবত স্বাভাবিক লাগলেও নিমিষেই সবকিছু বিস্বাদ লাগছে। কেন আবেশ ওকে ফুল বলে ডাকে? কেন ওর মাঝে ফুলকে খুঁজে ফেরে? শুধু কি ওর মাঝেই… আজকাল আবেশ নিজের প্রতিবিম্বেও ফুলকে খোঁজে।

​“আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবি?”

​ঝাঁকুনি খেয়ে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে আসে মেহেক। মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, তুমি খাটে শুয়ে পড়ো।”

​বাধ্য ছেলের মতো বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আবেশ। মেহেক হাত ধুয়ে ওর মাথার কাছে বসে পড়ে। আবেশের মাথায় হাত রাখতে গিয়ে দ্বিধাবোধ করে সে। যদিও আবেশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। একটা ১০-১২ বছরের বাচ্চা আর আবেশের মাঝে পার্থক্য নেই। কিন্তু মেহেক তো বাচ্চা নয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে পুনরায় ভাবনার জগতে হারিয়ে যায় মেহেক। শান্তি না পেয়ে আবেশ হাঁসফাঁস করছে। ইদানীং কোনো কিছুতেই শান্তি খুঁজে পায় না সে। মনে হয় ম’রতে পারছে না বলেই বেঁচে আছে। ওর অস্থিরতা মেহেক টের পেল, ​“কী হয়েছে, ঘুমাচ্ছো না কেন? তাড়াতাড়ি ঘুমাও, আমাকে যেতে হবে।”

​তৎক্ষণাৎ আবেশ মেহেকের হাত ধরে ফেলে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, “তাহলে আমি ঘুমাব না।”

​ছোট্ট শ্বাস ফেলল মেহেক, “আচ্ছা পরে যাব। ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

​দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন মাহবুবা সুলতানা। ছেলের কাছে যেতে পারেন না তিনি। তাকে দেখলেই আবেশ আক্রমণাত্মক আচরণ করে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর মেহেক ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে। দরজা ভেজিয়ে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

​“ও ঘুমিয়েছে?” মাহবুবা সুলতানা থিতু স্বরে জানতে চাইলেন।

​প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে নিজ কক্ষে চলে যায় মেহেক। দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে জামাকাপড় চেঞ্জ করে আসে। এই কয়েক দিন ফুলের ছদ্মবেশ ধরে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে সে। না জানি আরও কতগুলো দিন এসব করে যেতে হয়।

(সোলার এস্টেট)

​ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হাতে-গলায় বডি ক্রিম মাখছে ফুল। হঠাৎ করেই দরজা খুলে উদ্যান ভেতরে প্রবেশ করে। হতচকিত হয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকায় ফুল। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদ্যান।

​“আপনি এমন হুটহাট চলে আসেন কেন?”

​উদ্যান ভাবলেশহীন গলায় বলল, “দ্যাটস মাই হ্যাবিটস।”

​মাথায় ওড়না টেনে উঠে দাঁড়ায় ফুল, তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, “যে অন্যদের নক করা শেখায়, সে নিজেই নক করতে জানে না?”

​ফুলকে উপর-নিচ পরখ করে উদ্যান। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর গায়ে বেগুনি রঙের চুড়িদার। ঠোঁটে লিপগ্লোস। তার দৃষ্টি অনুমান করে ফুলও একইভাবে তার দিকে তাকায়। দানবটার গায়ে সোনালী রঙের সিল্ক শার্ট ও ব্ল্যাক রঙের ট্রাউজার। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গোলাপি বর্ণের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় অভিব্যক্তি। হাতে ব্ল্যাক ব্লেটের ঘড়ি, মাথায় হেডব্যান্ড। ব্যান্ডেজ খোলার পর থেকেই হেডব্যান্ড পরে লোকটা। কারণটা অবশ্য জানে ফুল, সেলাই করার সুবিধার্থে পেছনের দিকের কিছু অংশের চুল কেটে ফেলতে হয়েছিল। উদ্যানের সর্বাঙ্গে বিচরণের পর ফুলের মোহিত চোখ উদ্যানের চোখে আটকে যায়। তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নেয় ফুল। গম্ভীর কণ্ঠে উদ্যান বলে, ​“নক করতে জানি, কিন্তু প্রয়োজন বোধ করি না।”

​ফুল হাত কচলাতে কচলাতে বিছানায় গিয়ে বসে। ত্যাড়া গলায় শুধায়, “মেলো কিংবা অনিলা আপুর রুমে যাওয়ার আগেও নক করেন না?”

​ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ফুলের পাশে বসে পড়ে উদ্যান। খানিকটা তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলে, “ওদের রুমে আমি যাব কেন? দরকার হলে কল করে ডেকে নিই।”

​সরু চোখে তাকায় ফুল, “ওদের ঠিক কোন কাজে দরকার হয় আপনার?”

​“তা জেনে তুমি কী করবে? আমি ভালো আছি, না খারাপ আছি; সেইদিকে খেয়াল রাখার সময় আছে নাকি তোমার?”

​ঠেস লাগানো কথায় ফুল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অবচেতন মনে বেডশিট খামচে ধরে। ​“আপনি খারাপ থাকবেন কেন? কিসের অভাব আপনার?”

​ঠাস করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় উদ্যান। হেয়ালি করে বলে, “বউ ভালোবাসে না এর চেয়ে বড় খারাপ থাকার কারণ আর কী হতে পারে? টাকা-পয়সা, ক্ষমতা, সম্মানের অভাব না থাকলেও ভালোবাসার খুব অভাব।”

​তপ্ত শ্বাস ফেলল ফুল। আনমনেই বলল, “কেন, মেলো আপু আপনার একমাত্র গার্লফ্রেন্ড, আপনাকে ভালোবাসে না?”

​কিয়ৎক্ষণ নীরব রইল উদ্যান। সময় নিয়ে বলল, “ও আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল না।”

​অবাক হলো না ফুল, অনিলার কাছে শুনেছিল।
​“মিথ্যা বলছেন কেন? মেলো আপুকে তো আপনি নিজেই গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়েও করতে চেয়েছিলেন। শেষ সময়ে সে পালিয়ে গিয়ে সব পণ্ড করে দিয়েছিল।”

​“মেলো আমার পিএ। তোমাকে অবজার্ভ করার জন্যই ওকে গার্লফ্রেন্ড সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।”

​ফুলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আঙুল নিজের দিকে তাক করে অবিশ্বাসী সুরে বলল, “আমাকে অবজার্ভ করার জন্য মানে কী?”

​উদ্যান ভ্রু নাচিয়ে বলল, “মানে খুব সহজ, তুমি আমার শত্রু ছিলে তাই তোমাকে জ্বালানোর কোনো সুযোগ ছাড়তে চাইনি। মেলো আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের পাশাপাশি ইন্টেলিজেন্স হেড। সেই ঘটনার কথা মনে করে দেখো।”
​উদ্যানের ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় মুহূর্তেই ভাবনায় ডুবে গেল ফুল। মনে পড়ে গেল বছরখানেক আগের কথা—

​অতীত…

​খাবার টেবিলে ডিনার করতে বসেছে ফুল, আবেশ, মাহবুবা সুলতানা ও রেহানা বেগম। খাওয়ার একপর্যায়ে আবেশ বলল, ​“গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মেক্সিকোতে যাব আমি।”

​মাহবুবা সুলতানা ফুলকে তরকারি দিচ্ছিলেন, আবেশের কথায় থেমে গেলেন তিনি, ​“তুই উদ্যানের খোঁজে মেক্সিকো যেতে চাইছিস?”

​সরাসরি স্বীকার করল না আবেশ, “কতগুলো বছর ধরে ভাইয়া নিখোঁজ, আমি শুধু দেখে গেছি; বলিনি কিছুই। এখন মনে হচ্ছে তোমরা ভাইয়াকে খোঁজার চেষ্টাই করছ না। খালামণিও অনেক আগে দেশে ফিরে এসেছেন। তাহলে ওখানে তাকে খুঁজছে কে?”

​মাহবুবা সুলতানা আর রেহানা বেগম একে অপরের মুখপানে চাওয়াচাওয়ি করলেন। মেজাজ খারাপ হলো আবেশের। ফুল নিজেও চুপচাপ খাবার নাড়াচাড়া করছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মাহবুবা সুলতানা বললেন, “উদ্যান মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিল। একদিন হঠাৎ করেই তোর খালামণিদের বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে। তারপর কতগুলো বছর কেটে গেছে। তোর কি মনে হয়, ও বেঁচে থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত না?”

​চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আবেশের। “তুমি নিজেই বললে ভাইয়া ভারসাম্যহীন ছিল, তারপর আবার বলছ বেঁচে থাকলে যোগাযোগ করত? তুমি কেমন মম, অসুস্থ ছেলেটাকে নিজের কাছে না রেখে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছ।”

​খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে ফেললেন রেহানা বেগম। শান্ত গলায় বললেন, “চিকিৎসার জন্যই উদ্যানকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। এতে তোমার মমের কোনো দোষ ছিল না।”

​আবেশ খাবার শেষ না করেই উঠে দাঁড়ায়, “হয় ভাইয়াকে খুঁজে বের করো, নয় আমি আগামী বছর মেক্সিকো যাব—এটাই ফাইনাল।” ​কারও কথার তোয়াক্কা না করে ওপরে চলে গেল আবেশ।

ফুল কোনোমতে খাবার খেয়ে ডাইনিং রুম ত্যাগ করল। মাহবুবা সুলতানা উদ্বেগহীন ভঙ্গিমায় খাবার শেষ করলেন। রেহানা বেগম হাহুতাশ করে বললেন, “যেখানে অন্য কোনো বিষয়ে কিছুই মনে নেই, সেখানে উদ্যানের কথা কীভাবে যে আবেশের মনে আছে কে জানে। সবচেয়ে ভালো হতো উদ্যান মেক্সিকো গেছে সেটা আবেশের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলে।”

​দুজন সার্ভেন্টের সঙ্গে টেবিল গোছানোয় হাত লাগালেন মাহবুবা সুলতানা। তিরিক্ষি মেজাজে বললেন, “আমি কি জানতাম নাকি যে উদ্যান ওর বাপের মতো নিখোঁজ হয়ে যাবে। যদি জানতাম, তাহলে যেকোনো উপায়ে উদ্যানের কথা ভুলিয়ে ফেলতাম। আমি তো এখনও বুঝে উঠতে পারি না পঙ্গু লোকটা হসপিটাল থেকে নিখোঁজ হয়ে গেল কীভাবে।”

​“উদ্যান ভাইয়ের কথা কেন ভুলিয়ে ফেলতে, মামী?” আচমকা ফুলের কণ্ঠ শুনে দুজনই ঘাবড়ে গেল। জোরপূর্বক হেসে মাহবুবা সুলতানা বললেন, “তুই দেখছিস না আবেশ ‘ভাই’ এর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। সেই জন্যই ভুলিয়ে ফেলতাম। এক ছেলেকে হারিয়েছি, আরেক ছেলেও যদি ভাইয়ের শোকে হারিয়ে যায়, সহ্য করতে পারব না।”

​রেহানা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তুই না চলে গেলি, আবার ফিরে এলি কেন?”

​মিষ্টি হাসল ফুল। চেয়ারে পড়ে থাকা ফোন তুলে নিয়ে বলল, “ফোন রেখেই চলে গিয়েছিলাম।” উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিয়ে থেমে গেল, পুনরায় ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল, “মামার অ্যাক্সিডেন্টের বিষয়ে বেশিকিছু জানি না আমরা। আবেশ ভাইয়েরও মনে নেই। শুধু জানে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টে দুপা হারিয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর একদিন হসপিটাল থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান। উদ্যান ভাই কি সেই অ্যাক্সিডেন্টের পরেই মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন?”

​বরাবরই উদ্যানের প্রতি আবেশ ও ফুলের কৌতূহল চূড়াসম। সুযোগ পেলেই উদ্যানের ব্যাপারে এটা-ওটা প্রশ্ন করে। হরহামেশাই ফুল উদ্যানের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে ওঁত পেতে থাকে যেন। ফুলের প্রশ্নে মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এল। ফুল বুঝতে পারল এই প্রশ্নের উত্তর পাবে না সে। তাই সময় নষ্ট না করে নিজের রুমে চলে গেল।

​রাত ১১টা। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ড্রইং বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখছে ফুল। স্টোর রুমের দরজা খোলা পেয়ে এক ফাঁকে ঢুকে গিয়েছিল ও। সেখান থেকে উদ্যানের ছবি আর এই ড্রইং বইটা সংগ্রহ করেছে। যদিও উদ্যানের ছবি ও আরও কয়েক বছর আগেই সংগ্রহ করেছিল, তবুও আজ একটু বেশি সময় পেয়ে বেশ অনেককিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। তখনই এই দুর্লভ ছবিগুলোর সন্ধান পেয়েছে। ড্রইং বইয়ে তেমন কিছু পায়নি ফুল—শুধুমাত্র শুকনো ফুলের পাপড়ি ছাড়া। এটা ডায়েরি জাতীয় কিছু নয় যে উদ্যান সম্পর্কিত তথ্য পাবে। তবুও পাপড়িগুলো বেশ আগ্রহ সহকারে দেখে যাচ্ছে মেয়েটা।
তারপর ড্রইং বই সাইডে রেখে উদ্যানের ছবির ওপর চোখ বুলায় সে। এই ছবিতে উদ্যানের বয়স আনুমানিক ১৫-১৬ হবে। এর আগে যেই ছবিগুলো ফুল কালেক্ট করেছিল সেই ছবিগুলোয় উদ্যান বাচ্চা ছিল। তবুও উদ্যানের ছবিগুলো কোনো একভাবে ফুলকে আকর্ষণ করে। আজ যেন আরেকদফা উদ্যানকে দেখে ক্রাশ খেয়েছে অষ্টাদশী রমণী। ও লক্ষ্য করেছে যতবার উদ্যানের কথা ভাবে ততবারই ওর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। ছেলেটার মাঝে এমন কিছু আছে যা ফুলকে মুগ্ধ করে, সবচেয়ে মুগ্ধ করে চোখজোড়া। কেমন যেন রহস্য রহস্য ফিল পায় সে। যেই রহস্য উন্মোচনে মন ব্যাকুল হয়ে যায়। প্রায় অনেকক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে ফুল বুঝতে পারে উদ্যান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ইশ! কী লজ্জা, ফুলের গালে রক্তিম আভা ফুটে ওঠে।

ধিমে পায়ে উঠে দাঁড়ায় ফুল। চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসে পড়ে, নিজের পার্সোনাল ডায়েরি খুলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখে, ​“যেদিন শুনেছি আপনার নাম উদ্যান, সেদিনই হোঁচট খেয়ে থমকে গিয়েছিলাম। আগ্রহ জন্মেছিল আপনাকে একনজর দেখার, দু-দণ্ড বসে কথা বলার। সেই যে অপেক্ষা শুরু হয়েছিল আমার, আজও শেষ হয়নি। উল্টো অপেক্ষাগুলো অসহনীয় যন্ত্রণা দিচ্ছে। আপনাকে দেখার ইচ্ছা অসুখে পরিণত হয়েছে। কবে আমাদের দেখা হবে, ভাববিনিময় করব? আপনার আর আমার নামের পেছনে কোনো না কোনো ইতিহাস তো অবশ্যই আছে। আপনি নিশ্চয়ই সেই ইতিহাস সম্পর্কে অবগত? আমি অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। আমার মা বলেন না কিছুই, আপনার বিষয়ে একদমই বলেন না। আচ্ছা, সবাই আপনাকে এতো অবহেলা করে কেন? সবার সেই অবহেলা অগ্রাহ্যগুলোই বা আমাকে আপনার দিকে ধাবিত করে কেন? শুনুন না, আপনি কি আমাকে কখনো কোলে নিয়েছিলেন? আমাদের কি ভুলবশত চোখাচোখি হয়েছিল? আপনার চোখজোড়া বরাবরই আমাকে এলোমেলো করে দেয়। মনে হয় খুব চেনা ওই চোখ। কোথায় যেন দেখেছি। কেন আপনার প্রতি এতো আগ্রহ আমার?” এতটুকু লিখে হেসে উঠল ফুল।

​“আমি মোটেও ফ্লার্ট করছি না। হয়তো কিছুটা ক্রিঞ্জ শোনাতে পারে, কী করব বলুন, আপনার প্রতি অনুভূতিগুলোই যেখানে একপ্রকার উন্মাদনা সেখানে ম্যাচিউরিটি আশা করাটাও বোকামি। মাঝেমধ্যে ভাবি, আপনার বয়স তো অনেক হলো, বিয়ে-শাদি করে বাচ্চাকাচ্চার বাপও হয়ে গেছেন বোধহয়।” ​এইপর্যায়ে ফুলের মুখে আঁধার নেমে এল। শক্ত হাতে কলম ধরে লিখল, “পরক্ষণেই ভাবি, আপনি তো পাগল। মানসিক ভারসাম্যহীন লোককে কে বিয়ে করবে?”

​মলিন হাসল ফুল, ঠোঁট চেপে লিখল, “কোনো একভাবে ফিরে আসুন দেশে। আমি নিজে আপনার চিকিৎসা করাব। সুস্থ হয়ে যাবেন, তারপর একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দেব।”

​ফুল বুঝতে পারল আবারও উন্মাদনা চেপেছে মাথায়। এখন নিজেকে ধাতস্থ করে শুয়ে পড়াই ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ—উদ্যানের ছবি ড্রইং বইয়ের ভাঁজে ঢুকিয়ে পাশে রেখে, উঠে দাঁড়ায় সে। ডায়েরি অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। স্বভাবতই ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢোকে। তখনই ইনস্টাগ্রামের নোটিফিকেশন আসে। আনমনেই ক্লিক করে দেখে ড্যান্স ক্লাবে অডিশনের তারিখ জানিয়ে পোস্ট করা হয়েছে। সচরাচর ইনস্টাগ্রামে খুব একটা ঢোকে না ফুল। আজ কী মনে করে যেন স্ক্রোল করে রিলস দেখতে লাগল। এখন মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানো দরকার।
অনেকক্ষণ স্ক্রোল করার পর হঠাৎ একটা ইন্টারভিউয়ের রিলস সামনে আসে। মাঝে মাঝেই মেক্সিকো রিলেটেড সার্চ করায় আজ আপনা-আপনি এই ইন্টারভিউ সাজেশনে এসেছে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে এক মেক্সিকান ইন্টারভিউয়ার ইন্টারভিউ নিচ্ছে। তার সামনের চেয়ারে বসা এক যুবক। পরনে কালো শার্ট, ওপরে কালো জ্যাকেট। বোতাম খোলা নয়, তবু ফাঁক দিয়ে গলার হাড়ের রেখা স্পষ্ট। চুল কপাল ছুঁয়ে চোখ বরাবর নেমে এসেছে।

​(A/N: বোঝার সুবিধার্থে নিচের স্প্যানিশ সংলাপগুলো বাংলায় লেখা হলো।)

​ইন্টারভিউয়ার নরম হেসে বললেন, “আজ আমাদের সাথে আছে তেহজিব খানজাদা। Founder & CEO of TK Group. কিছুদিন আগে যিনি বিরাট অঙ্কের অর্থ দাতব্য সংস্থাগুলোতে ডোনেট করেছেন। কথা বলা যাক তার সাথে।”

​এবার উদ্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিস্টার খানজাদা, এবার যে ডোনেশন করেছেন, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আপনার অভিমত জানতে চাইছি।”

​উদ্যানের অভিব্যক্তিতে স্থিরতা। যতটা সম্ভব নরম কণ্ঠে বলতে চাইলেও ভীষণ গম্ভীর শোনাল, “যারা অসহায় তাদের কাছে মৌলিক জিনিস পৌঁছানোটা জরুরি। কে সাহায্য করল সেটা বড় বিষয় নয়।”

​ইন্টারভিউয়ার বললেন, “কিন্তু ফ্যানরা বলছে এটা ‘ইমেজ মুভ’। তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?”

​উদ্যান মাথা সামান্য নিচু করে বলে, “যারা খেতে পায় না তারা ফ্যান নয়; মানুষ। আমি ফ্যানদের থেকে বাহবা নয়, অসহায় মানুষের দোয়া পেতে সাহায্য করি।”

​ইন্টারভিউয়ার ইমপ্রেস হয়ে গেলেন, “এই ডোনেশন কি চলমান থাকবে?”

​ডান হাতে কপাল ঢেকে উদ্যান বলল, “আমি প্রতিশ্রুতিতে নয়, কাজে বিশ্বাসী।”

​রিলস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ফুল তখনও কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করছে। পোস্টে উদ্যানের ইনস্টাগ্রাম আইডি মেনশন করা ছিল। তৎক্ষণাৎ তার আইডি পেয়ে যায় ফুল। প্রোফাইলে এক যুবকের ঝাপসা ছবি। ফলোয়ার বেশি নয়, পৌনে দুই লাখ। আইডি ভেরিফাইড। দেরি করে না ফুল, নিজের আইডির নাম পাল্টে কাঁপাকাঁপা হাতে খামখেয়ালি পূর্ণ মেসেজ দিয়ে বসে। হৃৎপিণ্ড যেন হাতে চলে এসেছে। এমন অস্থির লাগছে যে এক স্থানে বসে থাকা দুষ্কর।

​“শান্ত হ, ফুল। আগে সিওর হয়ে নে যে এটাই উদ্যান তেহজিব খানজাদা।”

​ফুল কাউকে উদ্যানের আইডির বিষয়ে জানায়নি। কয়েক মাস পরেও যখন উদ্যান মেসেজ সিন করে না। তখন গিয়ে মাহবুবা সুলতানাকে উদ্যানের পোস্ট-ছবি দেখায়। ফুলের উপস্থিতিতে মাহবুবা সুলতানা বিরূপ রিঅ্যাক্ট করতে পারেন না। বিরক্তি চেপে বলেন, ​“আরে ফুল, আমার মনে হয় না ও আমার ছেলে উদ্যান। এই যুবককে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, ও উদ্যান হলে আমাদের কাছে ফিরে আসেনি কেন?”

​ফুল আশা করেছিল মাহবুবা সুলতানা অনেক আগ্রহ দেখাবেন, কিন্তু তেমন কিছুই ওনার মাঝে পরিলক্ষিত হয়নি।

​“মামী, আমার মনে হচ্ছে উনিই উদ্যান ভাই। দেখো বাম গালে তিল আছে।”

​রেহানা বেগম মেয়ের উৎসাহ দেখে অবাক হলেন, “উদ্যানের বাম গালে তিল আছে তুই জানলি কীভাবে?”

​ফুল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। আড়ষ্ট হয়ে বলল, “ছ… ছবিতে দেখেছিলাম। আচ্ছা, আমি আবেশ ভাইকে বলব ওনার সাথে যোগাযোগ করে দেখতে।”

মাহবুবা সুলতানা ধড়ফড়িয়ে বললেন, ​“নাহ, তুই আবেশকে এই ব্যাপারে বলিস না। ও এমনিতেই ভাইকে খুঁজে ফিরছে। এই যুবককে দেখে আমার ছেলে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে।”

​“কিন্তু…” ফুলকে থামিয়ে রেহানা বেগম বলেন, “ভাবী সঠিক বলেছে। তুই আবেশকে বলিস না। আর নিজেও এসব থেকে দূরে থাক। মন দিয়ে লেখাপড়া কর, সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।”

​ফুল আলগোছে হতাশার শ্বাস ফেলল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে নিজ কক্ষে ফিরে গেল। কয়েকদিনের চেষ্টায় সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে উদ্যানের বিজনেস কনট্যাক্ট নম্বর কালেক্ট করতে সক্ষম হয়। ফোন দিলে মেলো রিসিভ করে। প্রথম প্রথম মেলো বিশ্বাস করে না যে ফুল উদ্যানের কাজিন হয়। তারপর কোনোমতে মাহবুবা সুলতানার সাথে কথা বলার পর মেলো উদ্যানকে এই বিষয়ে জানায়।
এতো বছর পর অবশেষে উদ্যান আর মাহবুবা সুলতানা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে, যদিও তাদের কথাবার্তা ছিল সংক্ষিপ্ত। উদ্যান সুস্থ আছে জেনে আবেশও খুশি হয়ে যায়। যদিও সে ভাইয়ের সাথে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করেনি, হয়তো ভাইয়ের প্রতি অভিমান জন্মেছিল। নয়তো সে চেয়েছিল ভাই যেন ওর খোঁজ করে কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। প্রত্যেকবার কল দিলে প্রথমে মেলো রিসিভ করে, তারপর উদ্যান ফ্রি থাকলে ওর কাছে দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই উদ্যান বিজি থাকে।
এদিকে মাহবুবা সুলতানাও চিন্তায় পড়ে গেলেন। সে ধরেই নিয়েছিলেন উদ্যান বেঁচে নেই। কিন্তু হঠাৎ উদ্যানের খোঁজ পেয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে গেছেন। ফুলের সামনে মুখ ফুটে বলে উঠতেও পারেন না যে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় সে। আজও তেমনটাই হলো—ফুল উদ্যানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া মাত্রই মাহবুবা সুলতানার কাছে নিয়ে এসেছে, ​“আরে ধরো মামী, কথা বলো।”

​জোরপূর্বক হেসে বাধ্য হয়ে ফোন সামনে নিলেন আবেশের মা। ভিডিও কলে উদ্যানের অর্ধেক চেহারা দেখা যাচ্ছে। এপাশ থেকে কিছু বলার আগেই উদ্যান বলে, “কী ব্যাপার, এতোবার কল দিচ্ছেন কেন? বেশি মিস করলে চলে আসি?”

​উদ্যান ফিরে আসুক তা চান না মাহবুবা সুলতানা, কিন্তু ফুল ইশারায় বলতে বলছে ‘হ্যাঁ, যত দ্রুত সম্ভব চলে আয়। কেমন তুই হ্যাঁ? এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে ছিলি কেন? আমাদের কথা মনে পড়ে নি?’ ফুলের ইশারা সতর্কতাসহ উপেক্ষা করলেন মাহবুবা সুলতানা, ​“এতো বছর যখন আসার প্রয়োজন মনে করোনি, এখন আমাদের কথায় আসবে কেন?”

​উদ্যান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “আমি ফিরলে নিজের ইচ্ছায় ফিরব। পরীক্ষা করে দেখলাম আপনি আমার ফেরা নিয়ে কতোটা এক্সাইটেড।”

​ফুল হাত দিয়ে ইশারায় কিছু বলতে বলছে, কথা খুঁজে না পেয়ে মাহবুবা সুলতানা সেগুলোই বললেন, “বিয়ে-টিয়ে করেছ নাকি কাজেই ডুবে থাকো সারাক্ষণ?”

​সময় নিয়ে উদ্যান বলল, “করিনি এখনও, কিন্তু আপনার আগ্রহ দেখে করে ফেলতেও পারি।”

​চোখ বড় বড় হয়ে গেল ফুলের। কখনও উদ্যানের সঙ্গে কথা বলে না সে। কেমন যেন জড়তা কাজ করে, যেখানে আবেশই ভাইয়ের সাথে কথা বলে না, সেখানে সে কোন সাহসে বলবে? ফুলের ইশারা এড়িয়ে গিয়ে মাহবুবা সুলতানা স্বাভাবিক গলায় বলেন, “হ্যাঁ, বিয়ে করে ওখানেই সেটেল্ড হয়ে যাও।”

​রাগে ফুঁসে উঠল ফুল। খপ করে ফোন টেনে নিয়ে গেল। বিক্ষিপ্ত গলায় বলল, “তুমি এগুলো কী বলছ মামী? উনি ওখানেই সেটেল্ড হয়ে যাবেন, মানে কী? আবার বিয়েও করে ফেলতে বলছ কেন? উনি বাঙালি হয়ে কোন দুঃখে বিদেশিনী বিয়ে করবেন? দেশে কি সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছে?”

​“তুই হঠাৎ এমন আচরণ করছিস কেন? আমি তো ওর ভালোর জন্যই বলেছি, তুই তো জানিসই ও একাধিক কোম্পানির মালিক, দেশে ফিরে কী করবে?”

​ফুলের চোখ ছলছল করে উঠল। ঠোঁট চেপে নিজেকে সংযত করে বলল, “আমি যতদূর জানি মেক্সিকান মেয়েদের গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা হয় না। সেখানে মেলো নামের মেয়েটাকে কোত্থেকে জুটিয়েছে কে জানে। কেমন মুলা আর রসুনের মতো দেখতে, আমার মনে হয় ওই মেয়েটার সাথে তোমার ছেলের চক্কর চলছে। যখনই কল দিই, ওই মেয়ের মুখটাই আগে দেখি। বিয়ে করলে ওই মেয়েকেই করে নেবে দেখো। তখন তোমার নাতি-পুতিরাও ধবল রোগীর মতো দেখতে হবে।”

​মুখ ঢেকে হেসে উঠলেন মাহবুবা সুলতানা। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ফুল রীতিমতো কাঁপছে, তখনই ফোনের অপরপাশ থেকে শিস বাজানোর শব্দ ভেসে এল। ফুলের মনে পড়ে যায় সে কল কাটতেই ভুলে গিয়েছে। ব্যাপারটা অনুমান করে জমে গেল ফুল। কল কাটতে যাবে কিন্তু তার আগেই উদ্যান কল কেটে দেয়।
এর কয়েকমাস পরেই উদ্যান মেলোকে নিয়ে খানজাদা নিবাসে অনুপ্রবেশ করে। গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, রীতিমতো ফুলকে টর্চার করতে শুরু করে। যেদিন উদ্যান মেলোকে বিয়ে করার ইচ্ছা জানায় সেদিনই ফুল নিজের ইনস্টাগ্রাম আইডি ডিলিট করে দেয়। এবং ডায়েরির অনেকগুলো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে।

বর্তমান…

হঠাৎ কোমরে কারও জোরালো চাপে কাল্পনিক জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে ফুল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উদ্যান ওর কোমর পেঁচিয়ে নিজের কাছে টেনে নেয়। ভারিক্কি গলায় ত্যক্ত কথা বলতে গিয়েও ফুল থেমে যায়। উদ্যান ঘুমিয়ে গিয়েছে।

​“এই বজ্জাত দানব এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেল কীভাবে? সবাই তো তাকে নিশাচর প্রাণী হিসেবেই চেনে। আজ তবে কী হলো?”

​উদ্যানের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফুলের কোমরের পেছনের অংশে আছড়ে পড়ছে। স্বাভাবিক থাকতে চেয়েও থাকতে পারছে না। প্রায় ঘণ্টাখানেক একভাবে বসে রইল ফুল। পা ঝিমঝিম করছে, খুব ঘুমও পাচ্ছে। বুকভরে শ্বাস নিয়ে উদ্যানের হাতের ওপর হাত রাখে সে। দানবটা কেমন করে যে এক ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, কে জানে।
ফুলের হাতের নরম ছোঁয়া পেয়ে নিমিষেই উদ্যানের তন্দ্রাভাব কেটে যায়। মুখ কুঁচকে হাত টানটান করে, তারপর আচমকা উঠে বসে আশেপাশে তাকায়। চোখদুটো ফোলা, যেন ঘুমের নরমতা ছাড়তে নারাজ। তেছরা চোখে তাকে একনজর দেখে শুকনো ঢোক গিলল ফুল। উদ্যান তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল, “আ… আমি এখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম?”

​তার কণ্ঠের মাদকতায় ফুলের নেশা ধরে গেল। কাঁচা ঘুমে বিঘ্ন ঘটায়, উদ্যানের চক্ষু লালবর্ণ ধারণ করেছে। হাই তুলে আওড়ায়, “হোয়াট হ্যাপেনড? চোখ খোলা রেখেই ঘুমিয়ে গেছো নাকি?”

​তৎক্ষণাৎ ফুল দৃষ্টি সরিয়ে, ডানে-বামে মাথা নাড়ে। ক্ষীণ গলায় বলে, ​“নিজের রুমে গিয়ে ঘুমান।”

​বিমর্ষচিত্তে খাট থেকে নামতে গিয়েও থেমে যায় উদ্যান। সময় নিয়ে ফুলের উদ্দেশ্যে বলে, “একসঙ্গে চন্দ্র বিলাস করার পরিকল্পনা ছিল। আজ আকাশ পরিষ্কার, যাবে আমার সাথে?”
​থতমত খেয়ে গেল ফুল। বেডসাইড টেবিলের ওপর থাকা গ্লাস হাতে নিল উদ্যান, পানি খেয়ে এক ঝটকায় ফুলকে টেনে ওঠাল।

​নিঃসঙ্গ রাতে ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়েছে যেন। অন্ধকার আকাশে অর্ধচন্দ্রের উপস্থিতি। চাঁদের আলো টেরেসের মোজাইক মেঝেতে উল্কির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ফুল। দৃষ্টি চাঁদের পানে স্থির, তন্মধ্যেই ফুলের ঠোঁট কাঁপল। ​“আপনি আমার ডায়েরির সবগুলো পৃষ্ঠা পড়েছেন, তাই না?”

​বুকে হাত গুটিয়ে তাকেই পর্যবেক্ষণ করছিল উদ্যান, ​“হুম, পড়েছি। চাঁদকে খুব কাছ থেকে দেখার আকাঙ্ক্ষা আছে তোমার।”

​গোপনে শ্বাস ফেলল ফুল। বিড়বিড় করে বলল, “ভাগ্যিস পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। নইলে…”

​হঠাৎ ফুলের হাতের ওপর হাত রাখে উদ্যান। ঝাঁকুনি খেয়ে বড় বড় চোখে তাকায় ফুল। ওর দিকে হালকা ঝুঁকে যায় উদ্যান, কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “আই’ভ মেইড সামথিং স্পেশাল ফর ইউ।”

​ভ্রু কুঁচকে তাকায় ফুল। উদ্যান যে ওর হাত ধরে রেখেছে, তা একপ্রকার ভুলেই যায়। উদ্যানের ঠোঁটের কোণ কিঞ্চিৎ প্রসারিত হলো। পকেট থেকে একটুখানি কাঁচের মতো ঝলমলে কিছু বের করল। ফুলের হাত উল্টে মুঠোয় রেখে বলল, “অনেক বছর পর শুধু তোমার জন্য পেটাল কালেক্ট করেছি। তারপর সেগুলোর সমন্বয়ে এটা বানিয়েছি। জানি না তোমার পছন্দ হবে কিনা।”

​মুঠো খুলে ফুল তাকায় পেন্ডেন্টটির দিকে। অর্ধচন্দ্র-আকৃতির স্বচ্ছ রেজিনের ভেতরে গাঢ় গোলাপি আর নরম লাল রঙের শুকনো পাপড়িগুলো জমে আছে। পাপড়ির মাঝে ছড়িয়ে আছে ক্ষুদ্র সোনালি কণিকা। ফুলের কুঁচকে থাকা ভ্রু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। সে পেন্ডেন্টে এতটাই ডুবে ছিল যে বুঝতেই পারল না; কখন উদ্যান ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আচমকাই উদ্যান উষ্ণ আলিঙ্গনের চাদরে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিল। ফুলের নিঃশ্বাস থেমে গেল মুহূর্তেই। হৃৎস্পন্দন হঠাৎই অচেনা তালে দপদপ করতে লাগল।
​ধীরে, অত্যন্ত ধীরে, উদ্যান ফুলের ঘাড় থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নিল। তার আঙুলের ছোঁয়া যেন ইচ্ছাকৃত। যেন প্রতিটি ছোঁয়ায় নিজের দাবি রেখে যাচ্ছে। চুলের বেণি এক পাশে সরিয়ে দেওয়ার সময় ফুলের মেরুদণ্ড বেয়ে শিহরণ নেমে যায়। ওর হাত থেকে পেন্ডেন্ট তুলে নেয় উদ্যান। ফুল কাঁপাকাঁপা নিঃশ্বাসে তাকায়। ওর চোখে প্রশ্ন, কিন্তু উদ্যানের চোখে উত্তর নেই, আছে শুধু এক অদ্ভুত গভীরতা। যা ফুলকে নড়তে দিচ্ছে না, পালাতেও দিচ্ছে না। উদ্যান ওর গলায় পেন্ডেন্টটি পরিয়ে দিল। পেন্ডেন্টের ঠান্ডা ধাতু চামড়া ছুঁতেই ফুলের চোখ অনিচ্ছায় বুজে এলো। উদ্যানের আঙুল গলার পেছনে গিয়ে বন্ধনী লাগানোর সময় ফুল নুইয়ে গেল, যেন শরীরের সমস্ত শক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।

​ফুল কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই উদ্যান নিঃশব্দে ওর কাঁধে নিজের থুতনি নামিয়ে রাখে। সেই ভারে ফুলের শ্বাস আরও অগোছালো হয়ে যায়। উদ্যানের বুকে জমে থাকা উত্তাপ ফুলের পিঠে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। অশ্রুজলে ফুলের চোখ ভরে উঠল, উত্তেজনা আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে উদ্যান ঘোর-লাগা কণ্ঠে হিসহিসিয়ে গেয়ে ওঠে,
​“জেগে থাকি চল তুই আমি, ভালোবাসি দুজনে।
প্রেমে প্রেমে আজ কব কথা, না হয় হল পাগলামি।
তুই জীবনে আমার শুধু জলে ভাসা ফুল।
তোকে পেয়ে ভুলে গেছি আজ কত শত ভুল।”

চলবে,,,

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply