Golpo romantic golpo অবাধ্য হৃৎস্পন্দন

অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৪


অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (০৪)

সোফিয়া_সাফা

“দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।”

উক্ত কথাটি শুনে ফুল টলমল নয়নে তাকাল সামনে বসে থাকা পাষণ্ড পুরুষটির দিকে। কম্পিত কন্ঠে বলল,
“আপনি ইচ্ছা করে এমন টা করেছেন তাইনা?”

উদ্যান উত্তর দিলোনা, উদ্দেশ্যেহীন ভাবে তাকিয়ে রইল সিলিংয়ের দিকে।

“ফুল…

ডাক শুনে ফুল দরজার দিকে তাকাল। আবেশ হন্তদন্ত হয়ে একছুটে ফুলের সামনে এসে বসল। ফুলের পায়ের অবস্থা দেখে তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তার পিছু পিছু মাহবুবা সুলতানাও এসেছেন কিন্তু দরজা পর্যন্ত এসেই থেমে গেছেন।
“এটা কিভাবে হলো ফুল?”

ফুল আঙুল দিয়ে ফ্লোরের দিকে ইশারা করে কান্নাজরিত কন্ঠে বলল,
“ফ্লোরে কাঁচ ভাঙা ছিল। নাচের একপর্যায়ে উনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি পিছিয়ে যেতেই পায়ে কাঁচ ঢুকে যায়।”

আবেশ বসা থেকে উঠে উদ্যানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“আপনি কি করেছেন ফুলের সাথে?”

উদ্যান অনূভুতি শূন্য চোখে আবেশের দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর বলে উঠল,
“সেটাই করেছি যেটা তুমি ওর সাথে করেছিলে।”

প্রথম বার উদ্যান কথা বলেছে আবেশের সাথে। আর এই প্রথম বারই আবেশ পুরোপুরি ভাবে উদ্যানের চোখজোড়া দেখতে সক্ষম হল। লোকটার চোখ মারাত্মক, চোখ দিয়েই যেন সবকিছু ভস্ম করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। আবেশ এসব আজগুবি চিন্তা বাদ দিয়ে বলল,
“মানে? আমি কি করেছিলাম ওর সাথে?”
“ড্যান্স করেছিলে। আমিও সেটাই করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তোমার বোন আমার সাথে স্টেপ মেলাতে ব্যার্থ হয়েছে।”

‘বোন’ শব্দটা শুনে আবেশের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। লোকটা যে তাচ্ছিল্য করে বোন বলেছে সেটা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে। উদ্যান আবেশের পা হতে মাথা অবধি সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“কারো রুমের ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হয় জানোনা?”

আবেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে জানে উদ্যান হয়তো ইচ্ছা করেই ফুলকে আঘাত করেছে কিন্তু তার কাছে প্রমাণ নেই তাছাড়া অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে মায়ের রাগ ভেঙেছে। এখন উদ্যানের সাথে তর্ক করতে গেলে মা আবারও রেগে যাবে। আবেশ পুনরায় ফুলের সামনে গিয়ে বসল। আলতো হাতে ফুলের ডান পা থেকে কাঁচের টুকরো টা একটানে বের করে ফেলল। তৎক্ষনাৎ ফুল আবেশের গলা জড়িয়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল, আবেশ তো ফুলকে সামলাতে ব্যস্ত কিন্তু উদ্যানের দৃষ্টি তাদের দিকেই স্থির ছিল। আর কেউ না দেখলেও মাহবুবা সুলতানা বিষয়টা লক্ষ্য করলেন।
আবেশ ফুলকে কোলে তুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পুরোটা দৃশ্য উদ্যান মনযোগ সহকারে দেখল। তারা চলে যেতেই মাহবুবা সুলতানার উদ্দেশ্যে উদ্যান বলে উঠল,
“আপনার ছেলে ভুল করে ফেলল। আপনার অন্তত ওকে সামলে রাখা উচিৎ ছিল।”

মাহবুবা সুলতানা সাহস সঞ্চয় করে উদ্যানের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
“আবেশের মা হয়ে আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি বাবা। তুমি ফুলকে ভিক্ষা দেও।”
“যেই জিনিস আমার নয় সেই জিনিস আমি ভিক্ষা দেব কিভাবে?”

মাহবুবা সুলতানা অবাক চোখে তাকালেন। ক্ষীণ স্বরে আওড়ালেন,
“তার মানে তুমি আবেশের থেকে ফুলকে কেড়ে নেবে না?”
“উহু!”

মাহবুবা সুলতানার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল কিন্তু উদ্যানের পরবর্তী কথাটা শুনে সেই উজ্জ্বলতা মূহুর্তেই ম্লান হয়ে গেল,
“কেউ যদি জেনেশুনে নিজের গলায় ছুরি চালাতে চায় আমি কেন বাধা দেবো? তাছাড়া আপনার ছেলে কে হয় আমার? আমি কেন তার ভালো চাইবো?”
“মানে?”
“মানেটা আপনার অজানা নয়। সব জানেন আপনি, আমি কি চাই সেই সম্পর্কেও ধারণা আছে আপনার। সবকিছু জানার পরেও যেচে পড়ে ছেলের জন্য মারণাস্ত্র ভিক্ষা চাইছেন। ভাবতেই ফানি লাগল।”

মাহবুবা সুলতানা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে অসহায় কন্ঠে বললেন,
“তুমি ফুলকে মে*রে ফেলতে চাও?”

ফ্লোরের উপর পড়ে থাকা রক্তের ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে উদ্যান অত্যন্ত শান্তকন্ঠে বলল,
“আমি ওকে বারবার মারতে চাই, প্রতি মূহুর্তে মারতে চাই। ওকে একবার মে*রে আমি তৃপ্তি পাবোনা।”

মাহবুবা সুলতানার আত্মা কেঁপে উঠল। উদ্যান চোখ সরিয়ে আবারও তার দিকে তাকাল,
“ওর সাথে যুক্ত থাকা প্রত্যেকেও সেই মরণ যন্ত্রণা ভোগ করবে। এখন চয়েজ আপনাদের।”

মাহবুবা সুলতানা ফ্লোরে বসে পড়লেন।
“ফুলের কোনো দোষ ছিলনা বাবা। তুমি ওকে শাস্তি দিওনা।”

উদ্যান তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“সর্বপ্রথম মাটির দোষ ছিল, তারপরের দোষটা ছিল গাছের। যেখানে পুরো ভিত্তিটাই দোষের মূল সেখানে ওর অস্তিত্বটাও মস্ত ভুল।”

উদ্যান উঠে দাঁড়াল। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে থেমে গিয়ে বলল,
“রুমটা ক্লিন করিয়ে রাখবেন। আমি ফিরে এসে যেন ফ্লোরে পড়ে থাকা নোংরা গুলো না দেখি।”

কোলবালিশ জরিয়ে ধরে ব্যাথা নিবারণের চেষ্টা করছে ফুল। কিন্তু আবেশ যতবার ক্ষতস্থানে মলমের প্রলেপ লাগাচ্ছে ততবারই সে ককিয়ে উঠছে।
“আর একটু সহ্য কর হয়ে গেছে।”

আবেশ ফুলের পায়ে ব্যান্ডেজ প্যাচিয়ে ফুলের সামনে এসে দাঁড়াল। ভেজা নেত্র দ্বয় মুছে দিতে দিতে বলল,
“কান্না করলে তোকে খুব বাজে দেখায়।”

ফুল চোখ তুলে আবেশের দিকে তাকায়। আবেশের চুলগুলো ততটা বড় নয়, আবার ছোটোও নয়। স্বাভাবিক স্টাইলে কাটিং করা, উদ্যানের মতো অদ্ভুত দেখায় না। চোখজোড়া স্পষ্ট দেখা যায়। মুখভর্তি খোচাখোচা দাড়ি। গায়ের রঙ ফর্সা, সবমিলিয়ে আবেশ সুদর্শন দেখতে। উদ্যানের মতো অতোটা লম্বা না হলেও আবেশের উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি।
“মনস্টার টা কবে যাবে আবেশ ভাই? আমাকে কবে মুক্তি দেবে?”

আবেশ ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল,
“জানিনা, তবে তুই চিন্তা করিসনা আমি থাকতে আর কেউ তোকে কষ্ট দিতে পারবেনা।”

ফুল নাক টেনে বাচ্চাদের মতো বলল,
“সত্যি বলছো? কিন্তু তুমি ওই মনস্টারকে কিছু বললে তো মামী তোমাকে বকবে। আমি চাইনা আমার জন্য মামী তোমাকে বকুক।”
“আমি মমকে সামলে নেবো। তাছাড়া ডেবিলটা তো বিয়ে করেই নিচ্ছে। তোর পেছনে লাগার টাইম পাবেনা”

আবেশ দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে নিল। এখন রাত ১টা বাজে।
“ডেবিলটা বিয়ে করে নেয়া মাত্রই আমি মমের কাছে একটা আবদার করবো।”

ফুলের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল,
“কি আবদার করবে তুমি মামীর কাছে?”
“আগে বল আমাকে তোর কেমন লাগে?”

ফুল লাজুক হেসে বলল, “এটা কেমন প্রশ্ন আবেশ ভাই?”

আবেশ একটু বিরক্ত মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আমি জানি আমাকে তোর খারাপ লাগেনা। কিন্তু আজকে আমার একটা জিনিস খারাপ লেগেছে।”
“কি জিনিস?”
“ডেবিলটা যখন তাচ্ছিল্য করে তোকে আমার বোন হিসিবে আখ্যায়িত করেছিল তখন আমার একটু খারাপ লেগেছে।”
“খারাপ লাগার কি আছে?”
“অবশ্যই আছে। তুই আমার ফুপাতো বোন, সেই হিসেবে আমি তোর সাথে নেচেছি বলে ওই ডেবিলটাও তোর সাথে নাচার সাহস পেয়েছে। আফটার অল ডেবিলটা আমার আপন ভাই। তাই তোর উপর আমাদের অধিকারটাও সমান। কিন্তু আমি এটা সহ্য করতে পারবোনা। আমি তোর উপর সর্বোচ্চ অধিকার চাই। যাতে আমি খুব সহজেই তোকে ডেবিলটার হাত থেকে বাচাতে পারি।”

আবেশের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল ফুল। আবেশের বলা কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে গেছে।
“একটু সহজ ভাষায় বলবে?”
“সহজ ভাষায় আপাতত বলছিনা। আগে মমকে বলবো তারপর তোকে,”

ফুল নিজের গালে থাকা আবেশের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“কিন্তু মনস্টার তো এই বাড়িতেই থাকবে তাইনা? তুমি যাই করোনা কেন মনস্টারের সাথে এক বাড়িতে আমি শান্তিতে থাকতে পারবো বলে মনে হয়না। আমি তো ঠিক করে নিয়েছি মনস্টার এই বাড়িতে থাকলে আমি মাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। নিজের বাড়ি বলে তোমার উন্মাদ ভাইয়ের অনেক দেমাগ। আমিও দেখবো এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আমাকে সে কিভাবে টর্চার করে।”

আবেশের ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি আরও প্রসন্ন হল। ফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ভুলে যাসনা ফুল আমিও এই বাড়ির ছেলে। সেই হিসেবে আমারও অধিকার আছে।”
“অবশ্যই আছে আবেশ ভাই। তোমার অধিকার আছে বলেই হয়তো মনস্টার টা তোমার সাথে বাজে বিহেভ করেনা।”
“আমার সেই অধিকার থেকেই তুই আর ফুপি এই বাড়িতে থাকবি ফুল। তবুও যদি কোনো কারণে থাকতে না পারি তাহলে আমি নিজেই তোকে আর ফুপিকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাবো।”
“না আবেশ ভাই তা হয়না। তুমি কেন আমাদের জন্য নিজের বাড়িঘর ছাড়বে?”

আবেশ ফুলের সামনে থেকে সরে ফুলের পাশে এসে বসল। এদিকে সে সরে যেতেই ফুলের নজর গেল দরজার দিকে। এতোক্ষণ আবেশের জন্য সে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা উদ্যানকে দেখতে পায়নি। উদ্যানকে দেখে ফুলের গলা শুকিয়ে এলো। উদ্যান অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে।

“আমি তোর জন্য সবকিছু ছাড়তে পারবো ফুল। আমি সবসময় তোকে আগলে রাখবো।”

কথাটা বলেই আবেশ ফুলের দিকে তাকায়। ফুলকে ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে নিজেও দরজার দিকে তাকাল। উদ্যানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবেশ নিজেও কিছুটা ঘাবড়ে গেল। কিন্তু উদ্যান কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করলোনা। ধুপধাপ পা ফেলে নিজ গন্তব্যে চলে গেল। সে চলে যেতেই ফুল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
“ডেবিলটা কিছু শুনেছে বলে মনে হয়না।”

আবেশের কথার সাথে ফুল একমত হতে পারলোনা। তার মনে পড়ে গেল তখন উদ্যান তার বিড়বিড় করে বলা কথাটাও শুনতে পেয়েছিল।


সকাল ৭ টা। আকাশের পূর্বদিকে সূর্য নিজের রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। বন্ধ জানালার পর্দা ভেদ করে সেই আভা রুমে প্রবেশ করতে পারছেনা। খাটের উপর ঘুমিয়ে আছে ফুল। নিস্তব্ধ রুমজুড়ে অন্ধকার রাজত্ব করছে। এমন সময় মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে ফুলের তন্দ্রায় বিঘ্ন ঘটে, পিটপিট করে চোখ মেলে সামনে কারো অবয়ব দেখে সে চিৎকার করতে যাবে তার আগেই সামনে বসে থাকা ব্যক্তিটি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেয়। নরম গলায় বলে,
“ভয় পাসনা, আমি এসেছি।”

মায়ের স্নিগ্ধ কন্ঠ শুনে ফুলের ভয় কেটে যায়। বিছানা থেকে উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।
“মা তুমি এসে গেছো?”
“হুম এসে গেছি।”

ফুল রেহানা বেগমকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল। অভিমানী সুরে অভিযোগ করতে লাগল,
“তুমি জানো তোমার অবর্তমানে তোমার মেয়ের সাথে মনস্টার টা কি কি করেছে?”

রেহানা বেগম চমকালেন না বরং বরাবরের ন্যায় শান্ত গলায় বললেন,
“জানি, ভাবী সব বলেছেন আমায়।”
“তুমি কি এবারও কিছু বলবেনা মা?”

রেহানা বেগম নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষন পর গম্ভীর গলায় বললেন,
“আমি যতদূর জানি উদ্যান বেশিদিন থাকবেনা। আমি চাইনা অশান্তি সৃষ্টি করতে। ভুলে যাসনা তাদের কাছে আমরা ঋণী। তারা না থাকলে আমরা বহুদিন আগেই বিলীন হয়ে যেতাম। আমাদের মতো আগাছা আর পরগাছার মতো মানুষদের মুখে প্রতিবাদ শব্দটা মানায় না।”

মায়ের এমন তিক্ত বাণী শুনে ফুলের চোখের কোণে পানি জমলো। রেহানা বেগম উঠে দাঁড়ালেন, দরজা অবধি এসে পুনরায় পিছু ফিরলেন,
“ফ্রেশ হয়ে নিচে যা। জানি পায়ে ব্যাথা, তবুও রুমে বসে থাকিস না।”

রেহানা বেগম রুম থেকে বের হতেই মাহবুবা সুলতানা বলে উঠলেন,
“মেয়েটাকে এভাবে না বললেও পারতে।”

রেহানা বেগম শ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি ওর ভালোর জন্যই বলেছি। উল্টো তুমিই আবেশকে এভাবে বলতে পারছোনা। এটা তোমার ব্যার্থতা, যদি প্রথম থেকেই সহ্য করা শেখাতে তবে আজকের দিনটা দেখতে হতোনা। তোমার ছেলে তো প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে ভাবী। কিভাবে সামলাবে তাকে? উল্টো তোমার ছেলের প্রতিবাদের জেরে আমার মেয়েটার জীবনে আরও অন্ধকার নেমে আসবে।”


ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ জানান দিচ্ছে এখন বেলা ১০ টা বাজে। কিছুক্ষণ পরেই উদ্যান আর মেলোর গায়ে হলুদ। উদ্যান আর মেলোর বললে ভুল হবে। কারণ উদ্যান তো বাড়িতেই নেই। সে অবশ্য পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিল এসব আজগুবি রীতিনীতি সে পালন করবেনা। শুধু বিয়েটুকুই করবে। তবুও মেলোর হলুদের আয়োজন বেশ তোড়জোড় সহিত করা হচ্ছে। লিভিং রুমের সোফায় বসে আছেন সুনেরার মা আর মাহবুবা সুলতানা।
“আপা উদ্যান খানজাদা এতো বছর পর টুপ করে কোথা থেকে এসে হাজির হলো?”

মাহবুবা সুলতানা হলুদের বাটি সাজিয়ে রাখছিলেন। মার্জিয়া বেগমের কথা শুনে তিনি বিরস মুখে বললেন,
“সেটা তো আমার থেকে ভালো তোর জানার কথা। ছেলেকে মেক্সিকোতে পাঠিয়েছিলাম তোর কাছে। তুই আমার ছেলের সাথে কি করেছিস তা তো তুই-ই ভালো বলতে পারবি।”

মার্জিয়া বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। হ্যাঁ এটা সত্যি যে উদ্যানকে তার কাছেই পাঠানো হয়েছিল কিন্তু তারা তো ১০ বছর আগেই সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। যদিও উদ্যানকে সে মাত্র একবছরই নিজের কাছে রেখেছিলেন। তারপর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এটা অবশ্য কেউ জানেনা। আর উদ্যানও মাহবুবা সুলতানাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেছে বলে মনে হয়না। উদ্যানকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পরেও মার্জিয়া বেগম প্রতি মাসে উদ্যানের খরচ চালানোর নাম করে দীর্ঘ চারটা বছর মাহবুবা সুলতানার থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। মাহবুবা সুলতানা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মার্জিয়া বেগম প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল,
“আচ্ছা আপা সৎ ছেলেকে এমন বড় গলায় নিজের ছেলে বলতে খারাপ লাগেনা? শুরুতে নাহয় দুলাভাইয়ের চাপে বাধ্য হয়ে বলতে কিন্তু এখনও বলার কারণ কী?”

মাহবুবা সুলতানার হাত থেমে গেল। চোখমুখ লাল বর্ণ করতেই মার্জিয়া বেগম জোরপূর্বক হেসে বললেন,
“ক্ষমা করে দেও। আমি ওভাবে বলতে চাইনি।”

মাহবুবা সুলতানা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,
“আমি জানিনা তুই উদ্যানের সাথে ঠিক কি কি করেছিস আর জানতেও চাইনা কিন্তু তুই একটু আগে যা বললি তা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করলে আমি তোকে পুলিশে দেবো।”

মার্জিয়া বেগম শুষ্ক ঢোক গিললেন। এরই মাঝে সুনেরা, মেহেক আর মাহি মেলোকে নিয়ে নিচে নেমে এলো। মেলোর পরণে হলুদ রঙের ভারী লেহেঙ্গা সেই সঙ্গে কাঁচা ফুলের গয়না। তাদের পেছনে আবেশ ফুলকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে, ফুলের পরণে বাকিদের মতো গোলাপি রঙা সিল্কের শাড়ি। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে একজোড়া এয়ারিং পড়েছে। এছাড়া তেমন কোনো সাজগোছ করেনি। আবেশ আলাদা করে গায়ে হলুদ উপলক্ষে বিশেষ কিছু পড়েনি। জাস্ট একটা নীল রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়েছে। আবেশ বিরক্তি মাখা কন্ঠে আওড়াল,
“কেন যে এই অবস্থায় নিচে নামতে চাইছিস কে জানে।”

ফুল ফিচেল হেসে বলল, “নিচে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে আর আমি উপরে বসে থাকবো তা কি করে হয় আবেশ ভাই?”

“হাহ ডেবিলের গায়ে হলুদ নয় মরিচ দেয়া উচিৎ।”

আবেশের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেও মেলো বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল,
“তেহ কে নিয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলবেনা।”

সবাই হাসি থামিয়ে দিলেও ফুল মুখ টিপে হাসছে। আবেশ হাল্কা কেশে বলল,
“তা আপনার তেহ কোথায়?”

মেলো উত্তর দিলোনা। তাকে স্টেজে বসিয়ে গায়ে হলুদের পর্ব শুরু করা হবে এমন সময়েই তার ফোনে একটা কল আসে। ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ‘তেহ’ লেখাটা দেখামাত্রই মেলোর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে তৎক্ষনাৎ কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরল। কিন্তু অপরপাশ থেকে উদ্যানের বলা কথাগুলো শুনে মেলোর মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। তবে এসবের মাঝেও তাকে বেশ কঠোর দেখাচ্ছে। সে এখানে এসেছে উদ্যানের কাজে সাহায্য করতে তাই উদ্যানের কথার অবাধ্য হতে পারবেনা। সর্বাবস্থায় তাকে উদ্যানের কমান্ড ফলো করতে হবে। উদ্যান কল কেটে দিলে মেলো কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। এমন সময়েই সুনেরা হাতে কিছুটা হলুদ নিয়ে মেলোর গালে ছোয়াতে উদ্যত হয়। কিন্তু মেলোর গালে হলুদ ছোয়ানোর পূর্বেই মেলো এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুনেরার হাতে থাকা হলুদটুকু গিয়ে ফুলের গলায় ছিটকে পড়ল। আশেপাশে থাকা প্রত্যেকে নিজেদের জায়গায় জমে গেল যেন। ফুল কাপা কাপা হাতে গলা স্পর্শ করল। তারপর হাতটা সামনে এনে লেগে থাকা হলুদ টুকুর দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। নিরবতা ভেদ করে ফুল গর্জে উঠল,
“আপনি এটা কেন করলেন?”

ফুলের প্রশ্নে বাকি সবার হুশ ফিরল। সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেলোর দিকে তাকাতেই মেলো বসা থেকে উঠে দাড়াল। কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একছুটে নিজের রুমে চলে গেল।
এদিকে ফুলের শরীর অবশ হয়ে আসছে। হলুদ লাগা অংশটুকু যেন জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে ফুল মেঝেতেই বসে পড়ল, সাথে সাথেই আবেশ তাকে ওঠাতে উদ্যত হয়। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে রেহানা বেগম ফুলের সামনে বসে পড়লেন। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে যত্ন সহকারে ফুলের গলায় লেগে থাকা হলুদ টুকু মুছে দিলেন। যদিও হলুদের দাগ পুরোপুরি উঠলোনা। ফুলের ফর্সা গলায় হলুদের দাগ যেন আরও চকচক করছে।

আজকে শুক্রবার, বাদ জুমার পর বিয়ের সময় ধার্য করা হয়েছিল। উদ্যান এখনও বাড়িতে ফেরেনি। মাহবুবা সুলতানা বেশ কয়েকবার কল দিলেও উদ্যান রিসিভ করেনি। একদিকে মেলো দরজা আটকে বসে আছে। আরেকদিকে বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন বাড়ির পাশের খোলা জায়গায় করা হয়েছে। আস্তে আস্তে লোকজন আসতেও শুরু করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে বিচ্ছিরি একটা পরিস্থিতি। হাজার জনের উপরে দাওয়াত করা হয়েছে। খানাজাদা বংশ খুব নামি-দামি বংশ। এই বংশের পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। সেই সময় এই বাড়িকে জমিদার বাড়ি হিসেবেই সবাই চিনতো। কালের বিবর্তনে সেই নাম হারিয়ে গিয়ে খানাজাদা নিবাস নামে পরিচিতি পেয়েছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল।
মাহবুবা সুলতানা ভাবনায় পড়ে গেলেন। এখন কি হবে? উদ্যান কি তবে তাদের মান সম্মান ধূলিসাৎ করে দেয়ার লক্ষ্যেই দেশে ফিরেছে? মাহবুবা সুলতানা আবারও মেলোর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিজেকে ধাতস্থ করে দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে যায়। মাহবুবা সুলতানা তাড়াহুড়ো করেই রুমে ঢুকলেন কিন্তু মেলো রুমে নেই। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেলোকে পাওয়া গেলনা। সবচেয়ে বড় ব্যপার হলো মেলোর জন্য কিনে রাখা বিয়ের বেনারসি গয়না সব অবলীলায় বিছানার উপর পড়ে আছে। এমন সময় সুনেরা হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকল,
“খালামনি নিচে উদ্যান ভাই এসেছে।”

সুনেরার কথা শুনে মাহবুবা সুলতানা কাঠকাঠ চোখে তাকালেন। সুনেরা জোরপূর্বক হেসে বলল,
“স্যরি খালামনি। ভুল করে ভাই বলে ফেলেছি।”
“তোরা এতো ভুল করিস কেন বলতো? জানিস তো ছেলেটা ভাই সম্মোধন সহ্য করতে পারেনা। যাক, আমার সামনে বলেছিস-বলেছিস ওর সামনে আমার বলে ফেলিস না যেন।”

সুনেরা হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে আশেপাশে তাকিয়ে মেলোকে খুঁজতে লাগল। তার ভাবসাব দেখে মাহবুবা সুলতানা তাকে একপ্রকার টেনেটুনে রুম থেকে বের করে দিলেন। তারপর নিজেও রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিল,
“মেলো রুমে নেই।”
“সেকি? কোথায় গেল?”
“দরজা ভিড়িয়ে রেখে ব্যালকনি দিয়ে পালিয়ে গেছে।”
“কিহ?”

সুনেরা প্রচন্ড শকড হয়ে গেল। মাহবুবা সুলতানা কয়েক কদম সামনে গিয়ে পিছু ফিরে বললেন,
“মেলো চলে গেছে এই খবরটা যেন দুকান না হয়।”

সুনেরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। মাহবুবা সুলতানা লিভিং রুমে এসে দেখলেন উদ্যান সোফায় বসে বসে ফোন টিপছে। মাহবুবা সুলতানা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন আত্মীয় স্বজন দূরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সে এসে উদ্যানের পাশে বসল,
“তোমার হবু বউ চলে গেছে। ব্যাপারটা তুমি জানো?”

উদ্যান মৃদুস্বরে বলল,
“হুম।”

মাহবুবা সুলতানা আশ্চর্য হলেন।
“তুমি ঠিক কি করতে চাইছো?”

উদ্যান ফোনটা রেখে মাহবুবা সুলতানার দিকে তাকায়। ঠিক তখনই স্যুট ব্যুট পড়া দুজন ভদ্রলোক বাড়ির ভেতর ঢুকল।

চলবে,,,

(পরবর্তী পর্ব পেতে লাইক কমেন্ট করে সাথেই থাকুন)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply