অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (৩২)
সোফিয়া_সাফা
জঙ্গলের শেষ প্রান্তে তিনটি ট্রাক সারি বেধে অপেক্ষমান। কয়েক মিটার দূরে চারটি বাইক থামল। হেলমেট খুলে একে একে নেমে এলো উদ্যান, লুহান, মেলো ও রিদম। তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশ পরখ করল উদ্যান। চাপা গলায় বলল,
“এগুলো কি মেলো? ভোর রাতে এমন নির্জন জায়গায় চেকপোস্ট এলো কোত্থেকে। তুই ইনফরমেশন কালেক্টে গড়মিল করেছিস?”
থতমত খেয়ে গেল মেলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ফোন বের করে কালেক্ট কৃত তথ্যে চোখ বুলিয়ে বলল,
“এখন পর্যন্ত এখানে চেকপোস্ট থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সামথিং ইজ ফিশি হিয়ার।”
দ্রুতপায়ে হেটে মেলোর পাশাপাশি এসে দাঁড়ায় রিদম। ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে, “ড্রপ ইয়োর মেলোড্রামা। দেয়ার’স নাথিং ফিশি গোইন অন হিয়ার। ডোন্ট ট্রাই টু হাইড দা মেস ইউ মেড।”
একমুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল মেলো। পিছিয়ে পড়ল বাকিদের থেকে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো রিদমের পিঠের দিকে। কিয়ৎক্ষণ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রিদমের পিঠে কিল মেরে দিল।
“ডোন্ট কল মি মেলোড্রামা।”
রিদম উল্টো ঘুরে আচমকা মেলোর হাত মুচড়ে ধরল।
“আই উইল কল ইউ মেলোড্রামা। বিকজ দ্যাট’স এক্সাক্টলি হোয়াট ইউ আর।”
“আহহহ…” মেলোর গোঙানির শব্দে লুহান পেছনে ঘুরল। ছুটে এসে রিদমকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রিদম?”
উদ্যান পেছনে ফেরার প্রয়োজন বোধ করলো না। ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল। মেলোর ফর্সা হাত লাল হয়ে গেছে। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে রিদমের পানে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে ব্যথার ছাপ। রিদমের আচরণে বিন্দুমাত্র অনুতাপ পরিলক্ষিত হলো না। উল্টো মেলোর দূর্বলতার মজা উড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। কর্কশ গলায় মেলোর উদ্দেশ্যে বলল, “তুই এখনও এতো দূর্বল?”
হড়বড়িয়ে গেল লুহান। “তোর গলায় কি হয়েছে?”
মুহুর্তেই হাসি মিলিয়ে গেল রিদমের। উল্টো ঘুরে হাটা ধরল। সন্দিহান চোখে ওকে অনুসরণ করতে লাগল মেলো ও লুহান,
“ওর শরীরে এতো শক্তি এলো কোথা থেকে?” মেলো বিড়বিড়িয়ে বলল।
“তার চেয়েও অবাক হলাম ওর বিহেভিয়ার দেখে। সামান্য কারণে তোর হাত ভেঙে ফেলতে নিয়েছিল।” লুহান মেলোর হাত ধরতে গেলে সরে দাঁড়ায় মেলো। ওকে উপেক্ষা করে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়।
চেকপোস্টের সামনে একাধিক পুলিশের উপস্থিতি। তাদের সাথে কথা বলছে সোহম,
“ট্রেডিং লাইসেন্স নিয়ে আমার সহকর্মীরা এখনই এসে পড়বে।”
চেয়ারে বসে থাকা পুলিশ বললেন, “নতুন কিছু বলুন গত দেড় ঘন্টা যাবত একই এক্সকিউজ দিচ্ছেন।”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সোহমের। পুলিশের বাচনভঙ্গি ওর মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তন্মধ্যেই উদ্যান গিয়ে সোহমের পাশে দাঁড়ায়। পকেটে হাত গুজে আরেক হাত পেছনে বাড়িয়ে দিতেই লুহান একখানা কাগজ ধরিয়ে দিল। কাগজ হাতে নিয়ে স্থির চোখে পুলিশের দিকে চেয়ে রইল উদ্যান। তার চাহনি দেখে শুকনো ঢোক গিলল পুলিশ কর্মকর্তা। তবুও কপালের ঘাম মুছে যতটা সম্ভব রাগী গলায় বললেন,
“ট্রেডিং লাইসেন্স দেখান। অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি আমরা। অন্যান্য ক্ষেত্রে এতো সময় দেওয়া হয়না।”
টেবিলের উপর একহাতে ভর রেখে আয়েসি ভঙ্গিতে দাঁড়াল উদ্যান। ঠান্ডা গলায় বলল,
“আপনি বলতে চাইছেন আমরা স্পেশাল?”
“ম…মানে?” কথা জড়িয়ে যাওয়ায় হতাশ হলেন পুলিশ।
উদ্যানের ঠোঁটের কোণ কিঞ্চিৎ প্রসারিত হলো। “দেখুন আপনাদের হাতে অনেক সময় থাকলেও আমার সময় লিমিটেড। চটজলদি আপনাদের পুলিশ আইডি কার্ড দেখান।”
চারদিকে নীরবতা ভর করল। পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করছে। ঠাস করে টেবিলের উপর বাড়ি মারে উদ্যান,
“তাড়াতাড়ি করুন। ট্রেডিং লাইসেন্স বাড়িতে রেখে এসেছিল। এখন আপনারা আবার বইলেন না আইডি কার্ড বাড়িতে রেখে এসেছেন।”
পুলিশ কর্মকর্তা জোরপূর্বক হেসে বললেন, “হ্যাঁ বাড়িতেই রেখে এসেছি।”
বিরক্ত হলো উদ্যান, “সবাই বাড়িতে রেখে এসেছেন?”
হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে সবাই। উদ্যান এবার সোহমের উদ্দেশ্যে বলে, “নিজের কাজ কর, কুইক।”
মাথা নেড়ে চলে যায় সোহম। ইঞ্জিনের শব্দ চালু হওয়া মাত্রই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “লাইসেন্স না দেখিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে কেন?”
কাগজটা লুহানকে ফিরিয়ে দেয় উদ্যান। বুকে হাত ভাঁজ করে বলে,
“লাইসেন্স আমি নিজে। আমাকে দেখার জন্যই তো অপেক্ষা করেছিলেন।” উদ্যান ঝুঁকে গেল কিছুটা, ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল,
“আমাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাত বিরেতে বসে ছিলেন। সত্যিই আমি ইমপ্রেস হয়েছি। সেই জন্যই চলে এলাম।”
পুলিশ কর্মকর্তা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনটা ট্রাকই শো শো শব্দে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওনা দিল। সোহম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাকিদের কাছে যায়,
“ধ্যাৎ আপনাদের মতো নকল পুলিশের জন্য কিনা পুরো দেড় ঘন্টা লস হয়ে গেল আমার! কতোগুলো মশার কামড় খেয়েছি জানেন? ইচ্ছা তো করছে আপনাদের টুকরো টুকরো করে কেঁটে মশাদের খাওয়াই।”
পুলিশের লোকেদের চেহারার রঙ উড়ে গেল। দুপা পিছিয়ে একজোটে দৌড় লাগালো।
“আরে ধর শালাদের।” কথাটা বলে পিছু নেয় সোহম।
“গার্ডস না নিয়ে এসে ভুল করলাম।” আফসোসের সহিত উচ্চারণ করে লুহান নিজেও দৌড় দিল। কথায় কথায় মেলোও ছুটে গেল।
থেকে গেল উদ্যান আর রিদম। ঘাড় বাকিয়ে রিদমের পানে তাকায় উদ্যান। রিদম একভাবে দাঁড়িয়ে আছে, উদ্যান কিছু বলার পূর্বেই ফোন বেজে ওঠে। কল রিসিভ করে উদ্যান। অন্যপাশ থেকে অনি বলে,
“সরি তোকে কল করার জন্য। বাকিদের নিয়ে কোথায় গিয়েছিস তুই?”
বিরক্ত হলো উদ্যান, “ইয়ার্কি করছিস? তুই জানিস না কোথায় এসেছি?”
হাসিমাখা কণ্ঠে অনি বলল, “আরে লং ড্রাইভে গিয়েছিস? বলে যেতে পারতি। এখনো ছন্নছাড়া ভাবে চলাফেরা করলে হবে? ঘরে বউ আছে, অ্যাটলিস্ট ওকে বলে যেতে পারতি। মেয়েটা শুধু শুধু চিন্তা করছে।”
থমকে গেল উদ্যান। ঠোঁট নেড়ে অবিশ্বাসী সুরে বলল, “ওয়েট ও তোর কাছে গেছে?”
আবারও হেসে উঠল অনি। নীচু গলায় বলল, “অনিলার কাছে গিয়েছিল। তারপর ওকে নিয়ে আমার কাছে এসেছে। রীতিমতো জেরা করছে। এখনও রাগী চোখে চেয়ে আছে।”
শূন্য দৃষ্টিতে অদূরে তাকায় উদ্যান। এখান থেকে শহরের আলো ঝলমলে দৃশ্য দেখা যায়। অনি ফোনটা ফুলের দিকে এগিয়ে দিলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ফুল, ভাবনা চিন্তা না করেই বলে ফেলে,
“অনি স্যার, আমি যে আপনার কাছে এসেছি বললেন কেন?”
ইশারায় চুপ থাকতে বলে অনি। কিন্তু তার আগেই কল কেটে দেয় উদ্যান। অনি কীভাবে বোঝাবে? ফুলের কথা না বললে উদ্যান খেয়ে ফেলতো তাকে। কারণ ওরা কোথায় গেছে আর কেন গেছো সবকিছুই জানে অনি। তবুও ফুল জিজ্ঞেস করার পর বলে ফেলেছিল জানেনা সে। কল কেটে দিয়ে পেছনে ঘোরে উদ্যান ঠিক তখনই বুকপকেট থেকে একটা ছুরি বের করে উদ্যানের বুকে ঢুকিয়ে দেয় রিদম। ঘটনার আকস্মিকতায় চারপাশের আবহ বদমে গেল নিমিষেই। স্তম্ভিত চোখে রিদমের হাসোজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উদ্যান। চাঁদের নির্মল আলোয় রিদমের হাসি ভয়ঙ্কর দেখালেও বিন্দুমাত্র উদ্বেগ পরিলক্ষিত হলো না উদ্যানের মাঝে। বরং নির্লিপ্ত, স্থির চোখে চেয়ে রইল,
“হাহ রঙ টার্ন। পেছনে ঘুরলি কেন? তোর বুকের বাম পাশে ঢোকাতে চেয়েছিলাম।”
ছুরি টেনে বের করার লক্ষ্যে হাত বাড়ায় রিদম। তার আগেই উদ্যান ছুরিটা বের করে দূরে ফেলে দেয়। রেগে যায় রিদম,
“ইউ কার্সড বিস্ট। কোথায় ফেলেছিস?”
একহাতে রিদমের গলা চেপে ধরে উদ্যান। শান্ত গলায় হিসহিসিয়ে বলে,
“প্রার্থনা কর আমি যেন ম’রে যাই। নইলে তোর মৃ’ত্যু অবধারিত। তেহজিব বেঈমানদের ঘৃণা করে।”
লাথি মেরে উদ্যানকে ফেলে দিল রিদম। নিচে থাকা পাথরে বাড়ি খেয়ে মাথা ফেটে যায় উদ্যানের। জ্ঞান হারায় সঙ্গে সঙ্গে। আরেকটা পাথর তুলে নেয় রিদম, ধীর পায়ে এগিয়ে যায় উদ্যানের দিকে। তন্মধ্যেই আকাশ ভেঙে বর্ষণ শুরু হলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে মেঘের গর্জন। রিদম পাথর মারার আগেই লুহান এসে ওর মুখ বরাবর ঘুষি মেরে দেয়।
“কু’ত্তার বাচ্চা, কি করেছিস তেহুর সাথে?”
বিকট শব্দে হেসে ওঠে রিদম, “ও আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, আমি শুধু ওর জান কেড়ে নিতে চাই। ওকে বাচাতে পারবি না তোরা। আমার চ্যালেঞ্জ।”
রিদম কোনোমতে দৌড়ে পালিয়ে গেল। লুহান ওর পেছনে যেতে নিলে সোহম বাধা দেয়।
“তেহকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। আমি একা পারবো না, যাস না ওইদিকে। ওর সাথে আরও লোক থাকতে পারে। একা যাওয়া বিপজ্জনক।”
থেমে যায় লুহান। গায়ের শার্ট খুলে উদ্যানের মাথা বেধে দেয়। বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে চলেছে ক্রমশই। মেলো কিছুটা দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। উদ্যানের সাথে তার থাকা উচিৎ ছিল। একা রেখে যাওয়া ঠিক হয়নি।
কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে ফুলের। পিটপিট করে চোখ মেলে দেখে কয়েক ইঞ্চি দূরে তান দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। ঘুম ছুটে যায় ফুলের। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে বর্তমানে উদ্যানের রুমে আছে। মনে পড়ে যায়, অপেক্ষা করতে করতে কাউচেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঢোক গিলে কাউচের সাথে সিটিয়ে যায় ফুল। পা বাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,
“হুশ… হুশ। আমার কাছে এসো না।”
কিন্তু তান কি সেসব বোঝে? জিভ বের করে ওর দিকে তাকিয়ে অনবরত ঘেউ ঘেউ করছে। গলা শুকিয়ে আসে ফুলের। ইতোমধ্যেই ঘেমে গেছে সে। বাইরে তখনও বৃষ্টি, রুমে এসির শীতল হাওয়া বিরাজমান। তবুও কেন এতো গরম লাগছে? তান একপা দুপা এগিয়ে গিয়ে ফুলের পা ঘেঁষে বসে পড়ে। সমগ্র শরীর কেঁপে ওঠে ফুলের। চোখ বন্ধ করে বড়বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। হাতের কাছে থাকা বালিশ ছুড়ে মারল দূরে। আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল,
“যাও ওটা নিয়ে এসো।”
কয়েকমূহুর্ত চুপচাপ বসে থেকে সেদিকে চলে যায় তান। এই সুযোগে উঠে দাঁড়ায় ফুল। ওকে আর পায় কে? প্রাণ হাতে নিয়ে কোনোরকমে নিজের রুমে চলে যায়। এদিকে তান কামড়ে ধরা বালিশ সহ ওর পেছন পেছন ছুটে গেল কিন্তু নাগাল পেলো না। বন্ধ দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে হাপাচ্ছে ফুল। শাড়ির আঁচলে কপাল মুছে নিজেকে ধাতস্থ করল। তখনই কেউ দরজায় নক করে।
“ফুল… ঘুম ভাঙেনি এখনও?”
অনিলার কণ্ঠ শুনে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ফুল। কাঁপা হাতে দরজা খুলে মলিন হেসে বলে,
“ভেতরে এসো আপু।” উল্টো ঘুরে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে রওনা হয় ফুল। কিন্তু অনিলার কথায় থেমে যায়।
“ভেতরে আসবো না। হসপিটালে যাচ্ছি, তুমি যাবে?”
অবাক চোখে তাকায় ফুল। খানিকটা চিন্তিত সুরে বলে,
“হসপিটালে কেন আপু, তুমি কি অসুস্থ, কি হয়েছে তোমার?”
ফুলের ফ্যাকাশে মুখ দেখে বলে উঠতে পারেনা অনিলা। ওর নিস্তব্ধতায় খটকা লাগে ফুলের। অনিলার কাঁধ ঝাকিয়ে, একগাল হেসে বলে,
“কি ব্যপার আপু? সুখবর আছে নাকি?”
হকচকিয়ে গেল অনিলা। বোকা হেসে বলল, “ভুলে গেলে অনি আর আমি আলাদা রুমে থাকি।”
ঠোঁট ফুলিয়ে, অনিলার পেট বরাবর তর্জনী আঙুল ছোয়ায় ফুল। নরম গলায় বলে, “তাতে কি আপু? মনে করে দেখো, বাই অ্যানি চান্স… আচ্ছা তোমার পিরিয়ড হয়েছিল গত মাসে?”
ভাবনায় পড়ে গেল অনিলা। ফুলের কথায় সে যেন মুখ্য ব্যপারটা ভুলতেই বসেছে, ফুল তো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। উদ্যানের বিষয়টা ভাবনার দরজায় কড়া নাড়তেই চমকে ওঠে অনিলা,
“ওহ নো, এসব বেহুদা কথা রাখো। আমার সাথে গেলে রেডি হয়ে নেও।”
“ঠিক আছে, তুমি বসো আমি শাড়ি চেঞ্জ করে আসছি।” দুপা এগিয়ে গিয়ে আবারও থেমে যায় ফুল। এবার স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করে,
“নিজের জন্য যাচ্ছো না… তাহলে কার জন্য যাবে? কার কি হয়েছে?”
ছোট্ট শ্বাস ত্যাগ করল অনিলা। কোমল গলায় বলল, “আমি সঠিকভাবে জানিনা। কয়েক মিনিট আগে, অনি হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে গিয়ে বলল, ‘তেহকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। আমি সেখানেই যাচ্ছি।’ আমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ টুকুও দেয়নি। চলে গেছে।”
নিঃশ্বাস আটকে এলো ফুলের। শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এখন সময় সকাল ৬:২৩ মিনিট। বহু কষ্টে ফুল উচ্চারণ করল,
“উনি হসপিটালে আছে আর তুমি জিজ্ঞেস করছো আমি যাবো কি; যাবো না?” হেসে উঠল ফুল। “একদম হসপিটাল পর্যন্ত লং ড্রাইভে গিয়েছিল?”
“তুমি যাবেনা?” অনিলা অবাক গলায় বলল।
“অবশ্যই না।”
“দেখো ফুল, আমি সঠিকভাবে জানিনা তেহুর কি হয়েছে। কিন্তু, জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য কারো নেই। আমার মনে হয় ওর অবস্থা গুরুতর।”
গলা শুকিয়ে এলো ফুলের। তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অনিলা বুঝতে পারল ফুলকে বলে লাভ নেই। অনিলা চলে যেতে উদ্যত হতেই ফুল পিছু ডাকে,
“যাবো আমিও। হসপিটালে থাকাকালীন আমাকে একবার দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। তাই আমিও একবার গিয়ে দেখে আসবো।”
অনিলার আগে আগে হাটা ধরল ফুল। মৃদু হাসে অনিলা, “সেই টপিকে বলতে গেলে, তেহুর জন্যই কিন্তু তোমাকে তিন সপ্তাহ হসপিটালে কাটাতে হয়েছিল। ও যদি চার্লসকে অনুমতি না দিতো রিদমের সাহস ছিলোনা তোমার রুমে ওকে পাঠানোর।”
ভ্রুক্ষেপ করলো না ফুল।
“অন্তত শাড়ি চেঞ্জ করে, রেডি হয়ে এসো।”
এতোক্ষণ কাঠিন্যের খোলসে নিজেকে আড়াল করে রাখলেও এবার অনিলার হাত চেপে ধরল ফুল,
“তাড়াতাড়ি চলো। শাড়ি চেঞ্জ করতে গেলে আরও দেরি হয়ে যাবে।”
হসপিটালের করিডরের চেয়ারে বসে আছে ফুল। বাকিরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে উদ্যানকে। মাথায় সেলাই করা সম্পন্ন হয়েছে, বুকে সার্জারী করা লাগবে। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার জানিয়েছে সার্জারী করার পর ইমিডিয়েট রক্ত লাগবে।
“রক্তের ব্যবস্থা হয়েছে?” অনির প্রশ্নে না বোধক মাথা নাড়ে সোহম।
“দেশের কোনো ব্লাড ব্যাংকে A- গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায়নি। বাইরে থেকে আনতে গেলে অনেক সময় লাগবে।”
অনবরত পায়চারী করছে লুহান, “কু’ত্তার বাচ্চাকে পেলে কাচা চিবিয়ে খাবো আমি। ওই মাদার** এগুলো কীভাবে করছে বুঝতে পারছিনা। ওই মেলো, ঠিকঠাক পোস্ট করেছিস?”
দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল মেলো। লুহানের কথার পৃষ্ঠে ফোন বের করে বলে, “হ্যাঁ পোস্ট করে দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কল করেনি।”
চিন্তায় চিন্তায় সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত, ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললেন,
“আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। এ নেগেটিভ না পেলে ও নেগেটিভ খুঁজুন।”
ডাক্তারের কথা শুনে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে ওরা।
“নেগেটিভ গ্রুপেই ভেজাল। সিকফুলকে বাচানোর জন্য সেইবার কতো ছোটাছুটি করে ও নেগেটিভ রক্ত জোগার করেছিলাম।”
সোহমের আফসোস পূর্ণ কথায় আবহ বদলে গেল।
লুহান বলল, “কি বললি?”
“বললাম সিকফুলের জন্যও দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছিল।”
অনি বলল, “না, কোন গ্রুপের কথা বললি?”
ভাবনাটা মাথায় আসতেই স্তম্ভিত চোখে সবাই তাকাল ফুলের দিকে। ফুল তো একমনে নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে বসে আছে। ওরা ৪ জন ছুটে গেল ফুলের কাছে,
“ফুল তোমার ব্লাড গ্রুপ ও নেগেটিভ?”
উপরনিচ মাথা দোলায় ফুল৷ ওর হাত ধরে টেনে ওঠায় মেলো,
“উফফ তাড়াতাড়ি চলো।”
“ওনার এই অবস্থা কীভাবে হলো সেটা আগে বলুন।” ফুলের ভাবলেশহীন কথায় বিরক্ত হলো সবাই। এখানে আসার পর থেকে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে মেয়েটা।
“এখন এসব বলার সময় নয়।” লুহান হম্বিতম্বি করে বলল। হাত ছাড়িয়ে নেয় ফুল,
“ঠিক আছে, আমি রক্ত দেবো না।”
সোহম এবার না পেরে বলেই ফেলে। “রিদম করেছে।”
শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে হাটা ধরল ফুল। অবশ্য রিদমের অনুপস্থিতিতে সন্দেহ জেগেছিল ওর মনে। ডক্টর ফুলের প্রাথমিক চেক-আপ করে বললেন,
“ওনার ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিকের তুলনায় লো। এই অবস্থায় (RBCs) ডোনেট করা ওনার জন্য ঝুঁকিপূর্ন। তার উপর, দুই ইউনিট রক্ত লাগবে পেশেন্টের।”
চিন্তায় পড়ে গেল সবাই। অনিলা বলে উঠল, “অন্য কোনো রাস্তা নেই?”
“দেখুন যা করার দ্রুত করুন।” ডাক্তারের কথার পৃষ্ঠে ফুল মলিন হেসে বলল,
“উনি একবার বাচিয়েছিলেন আমায়। যদিও ওনার জন্যই পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। সেসব বাদেও ওনার বাপ দাদার টাকায় লাইফলিড করেছি আমি এবং আমার মা। সেসবের কৃতজ্ঞতা স্বরুপ আজ আমি রক্ত ডোনেট করবো ওনাকে।”
সন্ধ্যা ৭টা, ডিউটি শেষে বাড়ি ফিরছিল উর্বী। চোখেমুখে ক্লান্তি, একহাতে কার ড্রাইভ করছে। আরেকহাতে পেট চেপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ করেই পেটে ব্যথা অনুভব করছে সে। এরই মধ্যে ফোনে টুং শব্দে মেসেজ আসে। পাশের সিটে ফেলে রাখা ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ সিন করে উর্বী। ‘মিস্টার ছন্দ’ নামে সেভ করে রাখা নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে,
“দেখা করতে চাইছি। আর ইউ ফ্রী?”
উর্বী খুব একটা ভাবল না। বিগত কয়েকমাসে রিদমের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। উর্বীর ধারণা লোকটা ভীষণ পজিটিভ মাইন্ডের। গাড়ি ঘুরিয়ে নিল উর্বী, মেসেজে জানিয়ে দিল,
“ঠিক আছে, ক্লাবে দেখা করছি।”
ক্লাবের সামনে গাড়ি থামায় উর্বী। আসার পথে ড্রেসিং রুমে গিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে এসেছে। পার্স হাতড়ে লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে নেয় সে। কারো নজর আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে নয়; বরং কনফিডেন্স বাড়ানোর জন্য। পোনিটেল করা চুলগুলো ঠিকঠাক করে গাড়ির বাইরে পা রাখা মাত্রই রিদম চলে আসে সামনে। তাড়াহুড়ো করে বলে,
“নামতে হবেনা, উঠে বসো। আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।”
‘তুমি’ সম্মোধনে অদ্ভুত শিহরণ জাগল উর্বীর মনে। তৎক্ষনাৎ ভ্রু কুচকে গেল। এর আগে রিদম তাকে ‘তুমি’ করে বলেনি কখনও।
“কি হলো, এতো কি ভাবছো? উঠে বসো।”
মাথা নেড়ে পুনরায় বসে পড়ল উর্বী। রিদম বিরক্ত হয়ে বলল,
“আমি ড্রাইভ করবো। পাশের সিটে গিয়ে বসো।”
উর্বীকে একপ্রকার ঠেলেঠুলে উঠে বসে রিদম। বাধ্য হয়ে পাশের সিটে সরে বসে উর্বী। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে ড্রাইভিং সিটে বসা রিদমের দিকে। আজ যেন অন্যরকম লাগছে তাকে। উর্বী যেন খারাপ কিছু হওয়ার পূর্বাভাস পাচ্ছে। মন বলছে পালিয়ে যেতে। কিন্তু কেন? কিসের জন্য এমন লাগছে বুঝে উঠতে পারছে না। তবুও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আমার খুব পেটে ব্যথা করছে রিদম। আজ না গেলে নয়?”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রিদমের। সরু চোখে তার গতিবিধি অনুধাবন করছে উর্বী। হুট করেই বিকট শব্দে হেসে ওঠে রিদম,
“একটা মেসেজ পেয়েই চলে এসেছো। আর এখন বাহানা খুঁজছো? পেটে ব্যথা কেন করছে শুনি… পিরিয়ড হয়েছে নাকি?”
রিদমের মন্তব্যে নড়েচড়ে বসল উর্বী। কেন যেন মনে হচ্ছে পাশে কোনো অপরিচিত এবং খারাপ চিন্তাধারার লোক বসে আছে।
“কি হলো? একটু পরপর কোথায় হারিয়ে যাচ্ছো? পিরিয়ড হয়েছে তোমার?”
থতমত খেয়ে গেল উর্বী। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল একেবারে। মাথা নীচু করে ফোন অন করে ‘আরাফাত সানির’ নম্বরে মেসেজ পাঠাতে যাবে তার আগেই রিদম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একহাত বাড়িয়ে ওর মুখ বরাবর এক ধরনের লিকুইড স্প্রে করে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সিটে মাথা এলিয়ে জ্ঞান হারায় উর্বী।
(হসপিটাল)
করিডরের চেয়ারে বিমূঢ় হয়ে বসে আছে ফুল। একদিনেই ওর চেহারা নিজের উজ্জ্বলতা হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। খোপা ঢিলে হয়ে চুলগুলো উসকোখুসকো রূপে ছড়িয়ে আছে। পাশে বসে থাকা অনিলা আঁড়চোখে ওকে দেখছে আর ভাবছে,
“ঘৃণা করেও এই হাল? ভালোবাসলে বোধহয়, তেহুর আগে মেয়েটাই গডের প্রিয় হয়ে যেতো।”
চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকায় অনিলা। দেখে মেলো বাদে বাকি তিনজন নিজেদের মধ্যে কি যেন গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে। প্রাণহীন চোখে শুভ্র টাইলসের মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে ফুল। লুহান আর সোহম এগিয়ে এসে ফুলের ঠিক সামনে দাঁড়ায়।
“অনিলা হার্টফুলকে নিয়ে এস্টেটে ফিরে যাও। এখানের কাজ মিটে গেলে অনিকে পাঠিয়ে দেবো।”
ভ্রু উঁচিয়ে সোহমের পানে তাকায় অনিলা।
“মানে! শুধু অনি যাবে কেন? তেহুর জ্ঞান ফিরেছে?”
অনিলার প্রশ্নে ফুল রয়েসয়ে তাকায় সোহম ও লুহানের দিকে। যেন সেও এই প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। একনজর ফুলের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় লুহান। অশুভ কিছুর ইঙ্গিত পায় ফুল। ব্লাড ডোনেশনের পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়েটা। বমিও করেছে দু বার, ‘সুখবর’ বলে বলে ঠাট্টা করতে চাইলেও পরিস্থিতির চাপে অনিলা চুপচাপ ছিলো। ঠাট্টা বিদ্রুপ করার সময় নয় এখন। এখনও মাথা ঝিমঝিম করছে ফুলের, শরীরে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি না থাকলেও মনের জোরে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা।
“উত্তর দিচ্ছেন না কেন, জ্ঞান ফিরেছে উনার?”
লুহান বলল, “ফুল, আমি বলি কি তুমি এস্টেটে ফিরে যাও। তোমার শারীরিক কন্ডিশন ভালো নেই। খাওয়াদাওয়া কিচ্ছু করছো না, এভাবে থাকলে নিজেও যখন তখন সেন্স হারাবে।”
“উত্তর পাইনি আমি।” কণ্ঠ কাঁপছে ফুলের। আকর্ষণীয় ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। শাড়ির আঁচল ফ্লোর ছুই ছুই, নেত্রপল্লব বুজে আসছে।
সোহম বলে ওঠে, “আমি বুঝতে পারছি হোপফুল। তেহ তোমার কাজিন; সেই জন্য তুমি বাকিদের তুলনায় ওকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত। দেখো, ইতোমধ্যেই তুমি অনেক করেছো ওর জন্য। তোমার উচিৎ এখন নিজের কথা ভাবা।”
মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল ফুল, “ওনার জ্ঞান ফেরেনি এখনও তাইতো?”
লুহান-সোহম একে অন্যের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলল। সোহম ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলতে লাগল,
“ফেরেনি, মূলত সার্জারী সাকসেসফুল হলেও মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিল। ডাক্তার বলেছে…” থামিয়ে দিল লুহান। জোরপূর্বক হেসে বলল,
“ডাক্তার কিছুই বলেনি। তোমরা ফিরে যাও, আমরা তো আছিই এখানে।”
তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ফুল, “রিদমও তো আপনাদের মধ্যের একজন ছিল। আপনারা একসাথেই লং ড্রাইভে গিয়েছিলেন, তাহলে আপনাদের সামনেই রিদম কীভাবে উনার বুকে ছুরি চালিয়ে দিল? উনি হয়তো ভাবতেও পারেন নি রিদম এমন কিছু করবে। রিদম করতে পারলে আপনারা যে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না তার কি গ্যারান্টি আছে?”
ভড়কে গেল উপস্থিত সবাই। মেলো তেড়ে এসে বলল,
“তুমি আমাদের অবিশ্বাস করছো?”
চিল্লিয়ে উঠল ফুল, প্রচন্ড শকে মাথা ঠিক নেই ওর,
“হ্যাঁ করছি, রিদম ওনাকে মা’রতে সফল হয়নি। আবারও ওনার উপর অতর্কিত হামলা করবে। আপনারা আবারও প্রোটেক্ট করতে ব্যর্থ হবেন। আপনাদের মধ্যে কার কি মনোভাব, আমি বুঝে উঠতে পারছি না।”
মেলো এবার ফুলের কাঁধ ঠেলে বলল, “তোমার নিজের মনোভাব বোঝো তুমি? দুদিন আগেও বললে, তেহ মরে গেলেও তোমার কিছু যাবে আসবে না। সেখানে আজ দরদ উথলে পড়ছে কেন?”
ফুলের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। ক্ষীণ গলায় বলল,
“আমি ভেবেছিলাম ওনাকে প্রোটেক্ট করার জন্য আপনারা আছেন। ওনার বাচা মরায় আমার ফারাক না পড়লেও আপনাদের পড়বে। কিন্তু আমি একদম ভুল ছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আপনারা কেউ বিশ্বাসযোগ্য নন।”
মেলো দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়েছে। ফুলের গায়ে হাত তুলতে গেলে অনি এসে আটকায়,
“ওর মাথা ঠিক নেই, ছেড়ে দে।”
“হাহ মাথা ঠিক নেই? ও বলছে আমরা নাকি বিশ্বাসযোগ্য নই। তুমি সেই ১৫ বছর কোথায় ছিলে হ্যাঁ? জানো ওর সাথে কি কি হয়েছে? আমরা কতবছর একসঙ্গে আছি সেই সম্পর্কে ধারণা আছে? দুদিনের অতিথি হয়ে আমাদের দিকে আঙুল তুলছো কোন সাহসে?”
এইপর্যায়ে কেঁদে ওঠে ফুল। মাথা চেপে ধরে চিল্লিয়ে বলে, “আপনাদের সৌভাগ্য যে আপনারা অনেক গুলো বছর ওনার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। আমি পাইনি সেই সুযোগ। যদি পেতাম; উনি আর যাই হোক দানবে পরিনত হতো না।”
উক্ত কথায় চারপাশ নীরব হয়ে গেল। নীরবতা ভেঙে সোহম বলল, “হ্যাঁ ও দানবে পরিনত হয়েছে। আর তুমিও নিশ্চয়ই দানবের সাথে সংসার করতে আগ্রহী নও। এক কাজ করো, চলে যাও তুমি। আমি তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। সামনের হসপিটালে আবেশ আছে। ওর কাছে চলে যাও।”
অশ্রুসিক্ত নয়নে সোহমের পানে তাকায় ফুল। লুহান একই সুরে বলে,
“হ্যাঁ, এমনিতেও তেহুর বাচার চান্স খুব কম। বেচে থাকলেও ডাক্তার বলেছে কোমায় চলে যাবে। তুমি তো আবেশকে ভালোবাসো। তাই তোমার উচিৎ দানবের গুহা থেকে এই সুযোগে পালিয়ে যাওয়া।”
স্তব্ধ হয়ে গেল ফুল। লুহানের কথাগুলো সোজা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে আঘাত করল। কেঁপে উঠল পুরো শরীর। চোখ মুছে বলল,
“ডাক্তার এগুলো বলেছে? উনি সুস্থ হবেন না?”
বড়বড় শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় ফুল। অক্সিজেন সংকটে মুখ দিয়ে শ্বাসকার্য চালাচ্ছে সে। ধীরপায়ে গিয়ে দাঁড়ায় উদ্যানের কেবিনের সামনে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ প্যাচানো উদ্যানের। নীল রঙের চাঁদর বুক পর্যন্ত টেনে রাখা। অদ্ভুত একধরনের বিষন্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে রুমজুড়ে। দমিয়ে রাখা অনুভূতি গুলো যেন সমস্ত শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কাচের দরজায় হাত রেখে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ফুল। বাকিরাও ওকে অনুসরণ করে সেখানে চলে যায়।
“আমার খুব খারাপ লাগছে, দানবটার কবরের পাশে গিয়ে কাঁদার মতোও কেউ নেই। আমরা গিয়ে কাঁদব সেই সময়টুকুও পাবো না। উপরন্তু ওর জন্য কান্না আসবেও না, সুযোগ পেলেই পানিশট করে গেছে মাস্টার রূপে থাকা মনস্টার। সেসব মনে পড়লে কান্না নয় স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।”
ফুলকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বলল সোহম। ওর কথা শুনে ফুলের মন ভারী হয়ে গেল। চোখে পানি চিকচিক করছে, ঠোঁট চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে পুরোদমে। আঁড়চোখে ওর গতিবিধি পরীক্ষণ করে লুহান বলল, “Poor Monster. ওকে কোথায় দাফন করবো বল তো। সোলার এস্টেটের পাশে থাকা ঝোপঝাড়ে করে দেবো?”
অনি বলল, “আরে না, ও যেই ডেঞ্জারাস। দেখবি আত্মা হয়ে ঘুরেফিরে আমাদের ঘাড় মটকে দেবে।”
মিটিমিটি হাসছে সবাই। ফুল এবার দরজার সাথে কপাল ঠেকিয়ে হাটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল। কান্না জরানো গলায় চেচিয়ে বলল,
“আপনারা দয়া করে চুপ করুন। ওনার কিছু হবে না। দরকার হলে আমি ওনাকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবো।”
“কিন্তু তুমি তো আবেশের কাছে চলে যাবে তাইনা? আর আমরাও কেউ পারবো না ফাও ঝামেলা বয়ে বেড়াতে।” সোহমের নির্দয় কণ্ঠ শুনে ফুল কান্নায় ভেঙে পড়ল।
“আমি যাবো না আবেশ ভাইয়ের কাছে। ওর পাশে মা আছে। কিন্তু ওনার পাশে কেউ নেই।”
কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ালো সবাই। এতো কিছু বলেও ওর পেটের কথা বের করতে পারছে না। লুহান হাটু ভেঙে ফুলের সামনে বসল,
“আচ্ছা তুমি কেঁদো না। শুধু তোমার খাতিরে, আমি আর মেলো মিলে ওকে বিদেশ নিয়ে যাবো উন্নত চিকিৎসার জন্য। তুমি চলে যাও তোমার ভালোবাসার আবেশ ভাইয়ের কাছে। শুধু শুধু নিজের জীবন কেন নষ্ট করবে? মেলো ওকে সাহায্য কর, উঠে দাঁড়াতে… এক কাজ কর, তুই গিয়ে ওকে দিয়ে আয়।”
মাথা নেড়ে ফুলের হাত ধরে টেনে ওঠায় মেলো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ফুল,
“ছেড়ে দিন। যাবো না আমি।”
হাত ধরে নিচে বসে পড়ে ফুল। দাঁত খিচে সহ্য করে নিল মেলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“এটা মেয়ে নয় আস্ত এক আপদ। যাবেও না থাকবেও না।”
বিরক্ত হয়ে গেল বাকি সবাই। একসাথে বলল, “কেন যাবে না হোয়াই?”
উন্মাদনা ভর করল ফুলের মাঝে। মাথা নেড়ে বলতে লাগল, “কারণ আমি ভালোবাসি না আবেশ ভাইকে।”
মুখ ঘুরিয়ে হেসে দিল সোহম। আবার গম্ভীর গলায় বলল, “ঠিক আছে, তোমার মা-বাবার কাছে চলে যাও তাহলে।”
মাথা চেপে ধরে কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাপাতে লাগল ফুল। মুখাবয়ব লাল হয়ে গেছে ওর, ওষ্ঠযুগল তিরতির করে কাঁপছে। হৃৎপিণ্ড যেন বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে। মাথা ঘোরাচ্ছে,
“মেলো, ওকে ধরে বেধে ওর মা-বাবার কাছে রেখে আয়। মাথা খারাপ করে ফেলছে আমাদের।” লুহানের কথায় দাঁতে দাঁত পিষে মেলো বলে,
“আমি আর পারবো না। বিরক্ত হয়ে গেছি।”
বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করে মেলোর সামনে আসে লুহান। হাল্কা ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলে, “আরে ও তেহকে ভালোবাসার কথা স্বীকার করেনি এখনও।”
মেলো মুখ বাকিয়ে বলল, “ও ভালোবাসে নাকি যে স্বীকার করবে?”
“আর একটু চেষ্টা করে দেখি…”
‘ধপ’ করে শব্দ হলো। লুহান ঘাড় বাকিয়ে দেখল ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েছে ফুল। সেন্সলেস হয়ে গেছে বোধহয়। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাকি সবাই।
“ড্যাম ইট। এখন ওকে কোলে নেবে কে? মেলো তুই পারবি?” লুহানের কথায় চোখ বড়বড় হয়ে গেল মেলোর, অবিশ্বাসী ভঙ্গিমায় নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
“আমি? নো ওয়ে।”
চলবে,,,
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৮
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৭
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৭
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন গল্পের লিংক
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৭