অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (৩০)
সোফিয়া_সাফা
খাটের উপর আড়াআড়ি হয়ে শুয়ে আছে ফুল। চুলগুলো খাট বেয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে আছে। জানালা দিয়ে হিমেল হাওয়া প্রবেশ করছে। শীত শীত করলেও কাথা জরানোর ইচ্ছে নেই। চাবির জন্য লুহানের কাছে গিয়েছিল কিন্তু লুহান চাবি দেয়নি। বলেছে, ‘আজ তেহুর রুমে যাওয়ার পারমিশন নেই। না যাওয়াটাই তোমার জন্য ভালো।’ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ফিরে এসেছে ফুল। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
“যাক ভালোই হয়েছে দানবটা আসল রূপে ফিরে এসেছে। নিজেকে বাচানোর শেষ সুযোগ পেয়ে গেছি। আর ভাববো না তাকে নিয়ে।”
মনকে স্বান্তনার বাণী শুনিয়েও ফলাফল শূন্য। ঘাড় বাকিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে গোপনে শ্বাস ফেলে ফুল। মুশলধারায় বৃষ্টি পড়ছে, বিছানা থেকে উঠে হাটাহাটি করতে লাগল সে। লক্ষ্য করলো এই রুমের অন্যদিকে কয়েকটা লাগোয়া রুম আছে। একটা রুমের দরজা খুলে উঁকি দিতেই চোখ শিথিল হয়ে এলো। সেটা একটা ডান্স রুম, আলতো পায়ে রুমে প্রবেশ করে ফুল। মাঝারি আকৃতির ডান্স রুমের একপাশ পুরোটাই আয়না দিয়ে তৈরী। সাদা মার্বেল ফ্লোরে হালকা গোলাপি রঙের আলো প্রতিফলিত হয়ে পুরো ঘরটাকে অদ্ভুত কোমল আভায় ঢেকে রেখেছে। ধীরপায়ে হেটে মিউজিক সিস্টেম অন করতেই গান বেজে ওঠে। ফুল এতোটাই শূন্য মস্তিষ্কে ছিল যে গান চেইঞ্জ করার ইচ্ছাটুকুও পেলো না, রুমটি হয়তো সাউন্ড প্রুফ। রুমের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে নাচার প্রস্তুতি নিতেই গানের কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে যায়,
একটু রাত ডুবে আসে
একটু আলো নিভে আসে
তুমি দূরে—একা লাগে
মধুর ওই চাঁদটাকে; এ্যালুমিনিয়াম লাগে
হাঁটি আমি চাঁদও হাটে
মরে যাব রে, মরে যাবো
কি অসহায় আমি একবার ভাবো
মরে যাব রে, মরে যাবো
কি অসহায় আমি একবার ভাবো
নাচতে আর পারলো না ফুল। সেখানেই চুপচাপ বসে রইলো। কানে বারবার বাজতে লাগল,
“আমি ভালোবাসি তোমাকে।”
মলিন হাসলো ফুল, “মিথ্যাও এতো শ্রুতিমধুর শোনায়?”
ঘন্টা খানেক হাটুতে গাল ঠেকিয়ে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় ফুল। আজ আর নাচ হবেনা তাকে দিয়ে। শরীরে শক্তি কই? ডান্স রুম থেকে বেরিয়ে আরেক রুমে ঢোকে ফুল। রুমটা আকারে ছোটো, ভেতরে ঢুকতেই প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল জানালার সামনে ঝুলে থাকা সুইং বেডটি। ছাদের কাঠের বিম থেকে মোটা দড়িতে বাঁধা বেডটি হালকা দুলছে, বেডটার গায়ে সাদা লিনেনের কভার, উপরভাগে এলোমেলো কয়েকটা নরম কুশন: হালকা পিঙ্ক, সি-গ্রিন আর আইভরি রঙের। ফুলের চোখ চকচক করে ওঠে, পাগলামি করে ডায়েরিতে এসবের কথাও লিখেছিল সে। ভাবতেও পারেনি কেউ একজন কল্পনা গুলোকে বাস্তবায়িত করবে, ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ফুল,
“মস্তিষ্কের কথা মেনে ওই ঘরে না গেলেই ভালো হতো। যেই লোক আমার ঘরে পরপুরুষ পাঠাতে কুণ্ঠাবোধ করেনা সেই লোকের চরিত্র আর কতোটাই বা ভালো হবে? শুধু শুধু আমাকে এনেছে কেন সেটাই বুঝতে পারছি না। আমাকে মুক্তি দিয়ে ওকে বিয়ে করে নিলেই তো পারে।”
চোখ বন্ধ করে নেয় ফুল। একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে বন্ধ চোখ থেকে,
“আমার মোটেও খারাপ লাগছে না। সে যা ইচ্ছা করুক গিয়ে। আমি আর ভাববো না তার কথা।”
দুপুর দেড়টায় সবাই একসাথে লাঞ্চ করতে বসেছে। উদ্যান বাড়িতে নেই। আকসারাকে নিয়ে বেরিয়েছে বোধহয়।
“ফুল খেয়েছে?” অনিলার প্রশ্নে নাবোধক মাথা নাড়ে নাদিয়া। সে খাবার নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু ফুল খায়নি।
“কি বলছো, খায়নি কেন?”
“তাতো জানিনা ম্যাম। বললো পরে খাবে।”
অনিলা প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ডাইনিং হলের দরজার দিকে চোখ যায়; সেদিকে তাকাতেই থমকে যায় সে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বাকিরাও তাকালো সেইদিকে। হলুদাভ রঙের শাড়ি পড়ে দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ফুল। মাথায় টানা ঘোমটা, হাতে কালো রঙের কাঁচের চুড়ি। তাকে এই সাজে দেখে উপস্থিত সবার চক্ষু চড়কগাছ। সোহম তো খাওয়া ছেড়ে অবচেতন মনে উঠে দাড়িয়েছে,
“আমি চোখে ভুলভাল দেখছি?”
ওকে টেনে বসিয়ে, মুখে খাবার ঢুকিয়ে দেয় রিদম।
“ঠিকঠাকই দেখছিস কিন্তু নজর দিস না; তেহুর বউ হয়।”
“তাই বলে এভাবে সেজেগুজে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে? আরে পুরুষ মানুষ আমরা; কোনো রোবট নই।”
সোহমের কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় লুহান, “তোর মতো শুদ্ধ পুরুষের মুখে এসব কথা ঠিক মানতে পারলাম না। মাথা নিচু করে খাবার খা।”
তাদের কথোপকথন শুনে অনির দিকে তাকায় অনিলা। অনি তো মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। লুহানও সেইম, বাকি আছে শুধু রিদম আর সোহম। রিদমও দু তিনবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। সোহম বেচারা তাকাবে না বলেও বারবার তাকাচ্ছে।
“কাউকে খুঁজছো ফুল?” অনিলায় কথায় কেঁপে ওঠে ফুল। না বোধক মাথা নেড়ে বলে, “নাহ! সরি আপনাদের বিরক্ত করার জন্য। আপনারা খান, আমি যাচ্ছি।”
“আরে চলে যাবে কেন? আমাদের সাথে খেতে বসো।” অনিলার কথায় থেমে দাঁড়ায় ফুল। আবারও উদ্বিগ্ন চোখে পুরো ডাইনিং হলে চোখ বোলায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানবটিকে খুঁজে পায়না৷ ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
“না আপু, আমি রুমে যাচ্ছি। নাদিয়া আপু তোমার কাজ শেষ হলে একটু কষ্ট করে আমার খাবার টা দিয়ে যেও।”
মিষ্টি হাসল নাদিয়া, “কষ্ট কিসের মিস্ট্রেসা? আমি নিয়ে আসবো আপনার খাবার।”
নাদিয়ার সম্মোধনে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজ কক্ষে চলে যায় ফুল। ঘন্টা খানেক পর নাদিয়ার সাথে খাবার নিয়ে ফুলের রুমে আসে অনিলা। নাদিয়া চলে গেলে অনিলা বলে,
“খাওয়া শেষে একসাথে বসে আড্ডা দেবো কেমন?”
সৌজন্যমূলক হাসে ফুল। মাথা নেড়ে খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।
কিছু সময় পর,
“চলো একটা গেম খেলি, আমি নিজের সম্পর্কে একটা সিক্রেট তোমাকে বলবো, তুমিও তোমার সম্পর্কে একটা সিক্রেট আমাকে বলবে। ঠিক আছে?”
অনিলার কথা খেয়াল করলো না ফুল। সে তো গোলগোল চোখে অনিলার রুম দেখছে। সামনের দেয়ালে বিরাট বড় টিভি ঝোলানো, সেখানে রোমান্টিক গান চলছে। বেডের সামনে কোল্ড ড্রিংকস রাখা।
“কি গো শুনেছো?”
সরল হাসলো ফুল। অনিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আপু শুনেছি। তুমি শুরু করো।”
লেমন ড্রিংকসে চুমুক দেয় অনিলা। ফুলের পরিধেয় শাড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“করছি কিন্তু তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে। হঠাৎ শাড়ি পড়ার কোনো বিশেষ কারণ আছে নাকি?”
ম্লান হাসলো ফুল, “তেমন বিশেষ কোনো কারণ নেই। রাতে সারাকে শাড়ি পড়তে দেখে ইচ্ছা করেছিল।”
“তুমি সারাকে দেখেছো? কই আমি তো দেখিনি। কখন এসেছে ও?”
“তাতো জানিনা, আচ্ছা তুমি সারার বিষয়ে কিছু জানো?”
খানিকক্ষণ ভাবল অনিলা, “বাংলাদেশে আসার পর সারাকে দেখিনি আমি। মেক্সিকোতে থাকাকালীনও সারাকে খুব একটা দেখা যেতো না। মাঝেমধ্যে আসতো।”
“কথা বলেছো কখনো ওর সাথে?”
“নাহ আসলে ও কথা বলতে পারে না।”
কিছুটা খারাপ লাগলো ফুলের, “অতো সুন্দর মেয়েটা কথা বলতে পারেনা?”
“হ্যাঁ আমার সাথে যখন প্রথম দেখা হয়েছিল আমি নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। মেয়েটা কোনো উত্তর দেয়নি, শুধু তাকিয়ে ছিল তারপর তেহ বলল, ‘ওর নাম আকসারা।’ আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।”
খাটের উপর পা তুলে বসল ফুল। কৌতুহলী কণ্ঠে বলল,
“আচ্ছা অনিলা আপু মাস্টারের চরিত্র কেমন? তুমি তো সাড়ে ৬ বছর ধরে আছো তাদের সাথে তাইনা? তার কি মেলো ম্যাম ছাড়া আর কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিল?”
ফুলের কথায় অবাক হয়ে যায় অনিলা, “এই দাঁড়াও, দাঁড়াও মেলো তেহুর গার্লফ্রেন্ড ছিল কবে?”
দ্বিগুণ অবাক হয় ফুল, “তোমরা জানো না? মাস্টার তো উনাকে নিয়ে বাড়িতে গিয়েছিল সবার সামনে বলেছিল, ‘মিট হার শি’জ মাই গার্লফ্রেন্ড।”
“হোয়াট! এই ব্যপারে তো কিছুই জানিনা আমরা। তেহ তোমাদেরকে মিথ্যা বলেছিল কেন?”
“মিথ্যা বলবে কেন? হয়তো তোমাদের কাছে বিষয়টা গোপন রেখেছিল। গতরাতে তো উনার চরিত্র সম্পর্কে বেশ ভালোই ধারণা পেয়ে গেছি আমি।”
মাথা নাড়ে অনিলা, “অসম্ভব! মেলোর সাথে তেহুর তেমন কোনো রিলেশন থাকতেই পারেনা। শুধু মেলো কেন কারো সাথেই নেই। থাকলে অবশ্যই জানতাম আমরা, আমাকে যেদিন প্রথম তাদের সামনে এনেছিল সেদিন সবার দৃষ্টি ছিল আপত্তিজনক শুধু তেহুর বাদে। তেহ আমার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত, শুধু বলেছিল, ‘ছাতার নিচে জায়গা দিয়েছে বলেই কি; বাড়িতে জায়গা দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে?’ তার সেই কথা শুনে কান্না থেমে গিয়েছিল আমার। বাকিরা তো অনেক আজেবাজে কথা বলেছিল।”
“তোমাকে অনি স্যার জোর করে তুলে এনেছিল তাইনা?”
“হ্যাঁ, সেদিন ছিলো এমনই এক বৃষ্টির দিন। বাসে করে চার্চে যাচ্ছিলাম মাকে ফিরিয়ে আনতে, বৃষ্টির জন্য আসতে পারছিল না। সেই বাসে অনিও ছিল, বাস থেকে নামার পর দেখি অনিও আমার সাথেই নেমেছে। ওর কাছে ছাতা ছিলো না। লোকটাকে ভিজতে দেখে আমার একটু দয়া হয়েছিল। তখন আমি বাংলা জানতাম না স্প্যানিশে বলেছিলাম, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’ সে বিরক্তি ভরা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘জাহান্নামে যাবো। রাস্তা কোনদিকে জানেন?’ ওর উত্তর শুনে হেসে ফেলেছিলাম আমি। ওর দৃষ্টি কেমন যেন অদ্ভুত ছিল, তখন তো আর জানতাম না শালা একটা ফা*কার। সরল মনে ছাতার নিচে জায়গা দিয়ে বলেছিলাম, ‘জাহান্নামের রাস্তা চিনি না আমি। চার্চের রাস্তা চিনি, সেখানেই যাচ্ছি; যাবেন?’ শয়তান লোকটা ঘোরলাগা গলায় বলেছিল, ‘সেখানে পার্সোনাল রুম পাওয়া যাবে?’ কথাটা শুনে কেঁপে উঠেছিলাম আমি। বুঝে গিয়েছিল ওর মন মতলব খারাপ। ছাতা নিয়ে চলে যেতে চাইলে আমার হাত ধরে ফেলে ও। বাধ্য হয়ে ছাতা রেখেই চলে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ও আমার পিছু ছাড়েনি, পরেরদিনই আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তখন ওদের থাকার জায়গাটা ততটাও ভালো ছিলো না। তেহ আর মেলোর আলাদা আলাদা রুম থাকলেও সোহম, অনি ও লুহান এক রুমেই থাকতো। আমি যাওয়ার তিন বছরের মাথায় তেহু নিজের টি’কে গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে, যা আজ মেক্সিকান ইন্ডাস্ট্রির নাম্বার ওয়ান গ্রুপ। তারপর থেকেই তেহুর উন্নতি আর উন্নতি।”
খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনেছে ফুল, “তুমি রিদম স্যারকে স্কিপ করলে কেন? তারা চারজন এক রুমে ছিল?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অনিলা। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল, “রিদম তো সাড়ে তিন বছর ধরে আমাদের সাথে আছে। তার আগে সে ছিলো না আমাদের সাথে। থাকলেও এক বাড়িতে ছিলো না।”
“কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো অনিলা আপু?”
“হ্যাঁ বলো।”
“অনি স্যারের চরিত্র ভালো ছিলো না তাইনা?”
উক্ত প্রশ্নে অনিলার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
“সরি আপু এমন একটা প্রশ্ন করে তোমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য।”
জোরপূর্বক হাসল অনিলা, “আরে না বিভ্রান্ত হওয়ার কি আছে? আমি তোমাকে নিজের বন্ধু ভেবেছি। মেলোর সাথে তিনবছর একরুমে থাকার পরেও আমাদের বন্ডিং ততোটা জমেনি। মেলোর ব্যপারে কিছুই জানিনা আমি। আসলে ওর কালচার আমার সঙ্গে ঠিক মেলেনা। আমি এমনিতে খোলামেলা, লাউডলি এক্সপ্রেস করি; আর ও সবকিছু থেকেই দূরত্ব মেইনটেইন করে চলে। খাবার থেকে লাইফস্টাইল পর্যন্ত, সবকিছুতেই আমাদের কন্ট্রাস্ট; নরওয়েজিয়ান কিনা।”
“মেলো ম্যাম নরওয়ের?” বিস্ময়ে হা হয়ে গেল ফুল।
“হ্যাঁ। তুমি জানোনা?”
ডানে বায়ে মাথা নাড়ে ফুল, “নরওয়ে আমার ড্রিম কান্ট্রি।”
“ওহ তাহলে সামনের বছর তোমার ড্রিম পূরণ হতে চলেছে।”
কথাটার মানে বুঝলো না ফুল, “কিভাবে?”
“এখানে আমরা এসেছি ছুটি কাটাতে। যেহেতু অনি, সোহম আর তেহ বাংলাদেশী সেহেতু একবছরের মতো আমরা এখানে থাকবো। যদিও এতোদিন থাকার প্ল্যান ছিলো না। হয়েছে কি আমরা একটা প্রোজেক্ট শুরু করেছি এখানে এসে সেটা করতেই এক্সট্রা টাইম লাগছে। ২ বছর আগে ছুটি কাটাতে আমরা ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম রিদমের দেশে। সামনের বছরের শেষের দিকে নরওয়ে যাবো মেলোর দেশে। এছাড়াও অল্প কয়েকদিনের জন্য বিজনেসের কাজেও অনেক জায়গাতেই যেতে হয় আমাদের।”
“ওহ বুঝলাম।” বিড়বিড় করে কথাটা বলে সফট ড্রিংকস খেতে লাগলো ফুল।
“অনির ব্যপারে জিজ্ঞেস করেছিলে।”
“থাক আপু। আমি হয়তো একটু বেশিই ব্যক্তিগত বিষয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলেছি।”
“আমি তোমাকে বলতে চাই ফুল। আমার মনে হয় আমরা খুব ভালো বন্ধু হতে পারবো। কারণ তোমার-আমার পরিস্থিতি খানিকটা সিমিলার। তোমাকেও যেমন তেহ জোরপূর্বক বিয়ে করে আটকে রেখেছে আমার সাথেও তেমন কিছুই ঘটেছিল। হয়তো আরও বিধ্বস্ত ছিল আমার গল্পটা।”
“কি হয়েছিল আপু তোমার সাথে?”
“শোনো তাহলে, তোমার অনি স্যার আমাকে বন্দি করে রাখলেও আমার সাথে খারাপ কিছুই করেনি, শুধু অবসর সময়ে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতো। আমিও তার প্রতি ধীরে ধীরে দূর্বল হচ্ছিলাম। সে একদিন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় আমি বলেছিলাম রাতে জবাব দেবো। সেদিন রাতেই ওর ডার্ক সাইড আমার সামনে আসে।”
“ডার্ক সাইড?”
“হ্যাঁ, ও আসলে প্লেবয় ছিল। মেয়েদের সাথে রাত কাটাত, আর কারও সাথেই দ্বিতীয়বার জড়াত না। মানে ও একজন ওয়ান-নাইট-স্ট্যান্ডার ছিল; ও মেয়েদের ছুঁতো, কিন্তু কাউকে হৃদয়ে জায়গা দিত না।”
ফুলের শরীর শিউরে উঠল। “এতো বড় সত্যিটা জানার পর কি করেছিলে তুমি?”
রুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে অনিলা বলল, “পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি, সেদিনই ও জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল আমায়।”
“কয়বছর হয়েছে তোমাদের বিয়ের?”
“প্রায় তিন বছর।”
“অনি স্যার এখনও তেমনই আছেন?” ফুলের কণ্ঠে কম্পন পরিলক্ষিত হলো।
“জানিনা, দুবছর হতে চললো ও আসেনা আমার কাছে। এলেও সাধারণ কথাবার্তা বলে চলে যায়। প্রথম একবছর অনেক অত্যাচার করেছে। আমিও জেদ করতাম, প্রতিবাদ করতাম কিন্তু একসময় পর চুপ হয়ে যাই। আর আমার চুপ থাকাটাই ওর কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। নিজে থেকেই রুম আলাদা করে দেয়। বলেছে আর কখনও জোর করবে না। তবুও আমার মনে হয়না সে ভালো হয়ে গেছে।”
শ্বাস ফেলে ফুল, “জানো আপু, আমরা একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষ ভালো না খারাপ বিচার করতে পারিনা। কারণ নিজের জায়গায় বসে আরেকজনের অনুভূতি, পরিস্থিতি, প্রতিকূলতা বোঝার ক্ষমতা নেই আমাদের।”
চমকে তাকায় অনিলা। ফুল আবারও বলে, “তুমি কখনও অনি স্যারের অনুভূতি, পরিস্থিতি, প্রতিকূলতা বোঝার চেষ্টা করেছো? কখনও প্রশ্ন করেছো ‘তোমার মনটা আজকে কেমন আছে?”
তাচ্ছিল্য পূর্ণ হাসে অনিলা, “আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছে যে তাকে আমি জিজ্ঞেস করবো তার মন কেমন আছে? হাসালে ফুল। মাঝেমধ্যে আমি তোমাকে হিংসা করি।” থামল অনিলা, ভ্রু কুচকে তাকায় ফুল। অনিলা পুনরায় বলে, “তোমার সাহস দেখে হিংসা হয় আমার। চার্লসের থেকে বাচার জন্য তুমি যেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছো, আমি যদি পারতাম নিজেকে শেষ করে দিতে। তাহলে এতো কষ্ট, পীড়া, যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হতো না।”
ফিক করে হেসে দিল ফুল। অনিলা অবশ্য বুঝলো ফুল ঠাট্টা করেই হেসেছে।
“তুমি স্বামীর স্পর্শ থেকে নিজেকে বাচানোর জন্য আ’ত্মহ’ত্যা করতে না পেরে আফসোস করছো?” “হেসো না ফুল। তুমি পুরোপুরি বুঝবে না আমার কষ্ট, তোমার স্বামী আর যাই হোক ফাকার নয়।”
মুহুর্তেই ফুলের মুখটা চুপসে গেল। “আমিও সেটাই ভেবেছিলাম কিন্তু সে আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।” কথাগুলো নীচু গলায় বলেছে ফুল,
“কিছু বললে?”
কথা ঘুরিয়ে ফেলে ফুল, “বলেছি, সে ফা*কার না হলেও বউকে বিলিয়ে দিতেও দুবার ভাববে না। বউকে প্রোটেক্ট করতে জানেনা সে। অবশ্য তার মতো পাথর মানবের থেকে এসব আশা করাটাও বাড়াবাড়ি।”
“তুমি তেহকে ঘৃণা করো তাইনা ফুল?”
“সেটাই স্বাভাবিক নয়কি?”
“তাহলে তুমি কি তোমার আবেশ ভাইকে ভালোবাসো?”
থমকে গেল ফুল। অনিলা বলল, “মেলো তখন আবেশ ভাইকে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করায় তুমি তেহকে মলম লাগাতে রাজী হয়ে গিয়েছিলে। তুমি কি ভালোবাসো আবেশ ভাইকে?”
উদ্যানকে ঘৃণা করে সেটা বলে দিতে পারলেও আবেশকে ভালোবাসে সেই কথাটা কিছুতেই ফুলের মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা। আসলে, অনিলা তাকে বন্ধু ভেবে এতো এতো কথা বলেছে সেখানে ফুল কিভাবে পরপর মিথ্যা কথা বলে দেবে? ফুলকে নীরব থাকতে দেখে গোপনে শ্বাস ফেলে অনিলা,
“ঠিক আছে তুমি বলতে না চাইলে সমস্যা নেই।”
“আরে না না আপু, তেমন কিছু না। আমি যা বলবো তুমি কি তাই বিশ্বাস করে নেবে?”
ফুলের হাতের উপর বিশ্বাসপ্রবণ হাত রাখে অনিলা, “হ্যাঁ অবশ্যই, আমি বিশ্বাস করবো তোমার কথা।”
শুকনো ঢোক গিলল ফুল। যেখানে অনিলা তার মুখের কথা বিশ্বাস করে নেবে সেখানে ফুল অন্তত এই বিষয়ে তাকে মিথ্যা বলতে পারবে না।
“আমি ভালোবাসি না আবেশ ভাইকে।”
কথাটা শুনে মুচকি হাসে অনিলা। “তাহলে তখন মেলোর ব্ল্যাকমেইলে প্রভাবিত হলে কেন?”
অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকায় ফুল, “আবেশ ভাইকে ভালোবাসি না প্রেমিক হিসেবে। তাই বলে ওর চিকিৎসা বন্ধ করে দেবে তাতেও আমি প্রভাবিত হবো না? যেই ছেলেটা আমাকে ভালোবেসে আমার জন্য মার খেয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে তার বিষয়ে প্রভাবিত হবো না?”
“হ্যাঁ তাও ঠিক। আবেশ ভাই বলে যেহেতু ডাকো সেহেতু সম্পর্ক আছে কোথাও না কোথাও, কি তাইতো?”
মাথা নিচু করে নেয় ফুল, “ছোটো বেলা থেকে আবেশ ভাইকে নিজের কাজিন, বেস্ট ফ্রেন্ড, বড় ভাই মনে করে আসছি। দুনিয়ার সামনে আমাদের সম্পর্কের নাম ছিলো কাজিন; মামাতো-ফুপাতো ভাই-বোন কিন্তু এতগুলো বছর পর জানতে পারলাম সে মামার সৎ ছেলে। খানজাদা বংশের কেউ নয়।”
“এই কথা জানার পরেও টান কাজ করছে?”
বিস্মিত চোখে তাকায় ফুল, “তোমাদের কাছে প্রেম-ভালোবাসা, রক্তের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কারো জন্য টান থাকাটা কি অন্যায় আপু? বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথেও কিন্তু রক্তের সম্পর্ক থাকেনা তবুও তাদের জন্য আমরা টান অনুভব করি। মায়া কাজ করে, আমারও আবেশ ভাইয়ের প্রতি মায়া কাজ করে। ছোটো বেলা থেকেই মায়ের কাছেও আবদার করার সাহস পাইনি আমি। সবসময় বলেছে ‘খাওয়ায় পড়ায় সেটাই তো অনেক, আমাদের মতো পরগাছাদের স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খা থাকতে নেই; থাকা অন্যায়।’ আমার সব আবদার পূরণ করেছে আবেশ ভাই। যেই মানুষটা আমার কথা চিন্তা করে, আমাকে নিয়ে ভাবে, আমার চোখের জল সহ্য করতে পারেনা সেই মানুষটার প্রতি মায়া জন্মানোটা কি অন্যায় আপু?”
“অন্যায় নয় ফুল কিন্তু সে তো তোমাকে ভালোবাসে তাইনা? সেই ভালোবাসার সুযোগ নেওয়াটা অন্যায় হবে। তোমার উচিৎ নিজের অনুভূতি গুলো ব্যক্ত করা। তাকে সরাসরি বলে দেওয়া যে তুমি প্রেমিক হিসেবে ভালোবাসো না তাকে।”
“আমি জানতাম না যে সে আমাকে ভালোবাসে। আমার কখনোই তেমন কিছু মনে হয়নি। আমাদের মাঝেকার সম্পর্ক টা তেমন ছিলো না কখনও। ওর অনুভূতি সম্পর্কে জানার পর যেই সাতটা মাস আমি ওর সাথে ছিলাম সেই মাসগুলোতে আমি বিমূঢ়, হেল্পলেস, অসহায় ছিলাম। একদিন ও ভেঙে পড়েছিল আমি ওকে সামলানোর জন্য কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম দানবটাকে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করে নেবো ওকে। সেই সময় মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলাম আমিও। এর বাইরে আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি ওকে। আর সত্যি বলতে আমি এখনও মানসিক ভাবে সুস্থ নই। আমাকে মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলেছে তোমাদের তেহ। আমি যে কি যন্ত্রণায় আছি তা কাউকে বোঝাতে পারবো না। সাহসী আর কোথায় হলাম? আমার মতো মেয়েদের তো ম’রে যাওয়া উচিৎ।”
হঠাৎ করেই ফুলের দমবন্ধ লাগতে শুরু করলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ফুল,
“আমি এখন যাই আপু। পরে কথা বলবো তোমার সাথে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় অনিলা। পরপরই ফুল দ্রুতপায়ে রুম ত্যাগ করে। ফুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে অনিলাও বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সানরুমে বসে ছিল অনি, লুহান, রিদম ও সোহম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে অনিলা, রুক্ষ গলায় বলে,
“আবেশের প্রতি ফুলের কোনোপ্রকার ফিলিংস নেই তাই আবেশের ক্ষতি করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো সবাই। তোমাদের তেহকে রেখে ফুল আর যাবেনা আবেশের সাথে।”
“ডাউটফুল বললো আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে?” সোহমের কথায় তেঁতে ওঠে অনিলা,
“তোমাদের সবার এতো ট্রাস্ট ইস্যু আছে কেন? মেয়েটাকে কি আবারও নিজের পেটে ছুড়ি চালিয়ে প্রমাণ দিতে হবে?”
অনিলার মেজাজে বোকা বনে গেল সবাই। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অনি বলে ওঠে,
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে চটে যাচ্ছো কেন? বিশ্বাস করে নিয়েছি আমরা।”
চলবে,,,
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৮
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৫(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৫
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৮