অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (২৭)
সোফিয়া_সাফা
উদ্যানের মাঝে প্রতিক্রিয়ার লেশ মাত্র পরিলক্ষিত হয় নি। অগণিতবার বেল্টের নির্মম আঘাত গায়ে পড়ার পরেও, সে ঠিক সেই ভঙ্গিতেই বসে আছে যে ভঙ্গিতে মিনিট কয়েক আগে বসা ছিল। নড়াচড়ার নামগন্ধ নেই। যেন ব্যথা ওর শরীরের ভেতরে ঢুকতেই পারে নি।
অন্যদিকে ফুলের ভারাক্রান্ত হৃদয় উদ্যানকে প্রহার করা থেকে ঠেকাতে না পেরে অভিমানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার দ্বারপ্রান্তে। হাতে থাকা বেল্টটা তুলতেই পারছে না আর, আঙুল কাঁপছে, তালু ঘামছে, বাহুটা যেন হঠাৎ শক্তিহীন হয়ে গেছে। পাজোড়াও যেন শরীরের ভার বহনে অস্বীকার জানাচ্ছে। অভিমান, হতাশা, অপার অসহায়ত্ব একসঙ্গে তাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে। উদ্যানের ঠিক সামনেই, শক্তি ফুরিয়ে বসে পড়ে ফুল। চোখ দুটো ভারী, দৃষ্টি অস্পষ্ট; তবু তার সামনে বসে থাকা পুরুষটির মুখে একটুকরোও নড়াচড়া নেই। যেন ফুলের প্রতিটি চেষ্টা, প্রতিটি প্রহার, প্রতিটি শব্দ সব তার কাছে অর্থহীন।
নীরবতার গভীরতা অসহ্য হয়ে উঠতেই, উদ্যান ধীরে ধীরে পকেট থেকে কনসোল বের করল। একফোঁটা তাড়াহুড়ো নেই, একটুও উদ্বেগ নেই; কেবল শীতল, স্থির ভঙ্গি। নাদিয়ার পেজারে কল করে সে নিচু গলায় বলল,
“ব্রিং সাম সফট ড্রিংকস অ্যান্ড ওয়াটার।”
সেই কণ্ঠেও কোনো অনুভূতি নেই। যেন কিছুই ঘটেনি।
উদ্যানের এরূপ নিস্তব্ধতা ফুলের ভেতরটা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। উদ্যান কি এসব বুঝতে পারছে? হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘাম মুছে নেয় ফুল। সঙ্গে সঙ্গেই উদ্যান গম্ভীর গলায় বলে,
“হেই অ্যালেক্স, সেট এসি টু সিক্সটিন ডিগ্রিস।”
চমকিত নয়নে এদিক সেদিক তাকায় ফুল। বুঝে উঠতে পারেনা উদ্যান কাকে কথাটা বলল। মুহুর্তেই রুম জুড়ে শীতল হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে। ফুলের আর বুঝতে বাকি রইল না অ্যালেক্স উদ্যানের এসির নাম; মানুষের নয়।
“মাস্টার আপনি কোথায়?” নাদিয়ার কণ্ঠ ভেসে আসতেই উদ্যান ছোট্ট করে উচ্চারণ করে,
“হেয়ার, ইন দ্য ক্লোজেট।”
বলে রাখা ভালো উদ্যান কনসোল ব্যবহার করেও নিজের রুমের ডোর লক কিংবা আনলক করতে পারে। শেলফের সাথে ঠেস দিয়ে বসে আছে ফুল। বোঝার চেষ্টা করছে উদ্যান কি করতে চাইছে। নাদিয়া ট্রে ভর্তি বিভিন্ন সফট ড্রিংকস, জুস আর পানি নিয়ে এসেছে। উদ্যানের অবস্থা দেখে রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে নাদিয়া। গ্রে রঙের সিল্কের শার্টে রক্তের দাগ স্পষ্ট। কিছু কিছু জায়গা ফেটে চামড়ার ক্ষত পরিলক্ষিত। কে এমন নির্মম ভাবে আঘাত করেছে মনস্টার টাকে? কার এতো বড় দুঃসাহস? জানের মায়া নেই কি তার?
“নাদিয়া, ওকে পানি খাওয়া। অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে।” উদ্যানের কথায় হুশ ফেরে নাদিয়ার, চোখ সরিয়ে তাকায় ফুলের দিকে। মেয়েটা হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে মূর্তির মতো বসে আছে, দুহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নিজ হাঁটু। তার শরীরে কম্পন দৃশ্যমান। কাঁপছে নাদিয়াও, কাঁপা কাঁপা হাতে একগ্লাস পানি ফুলের দিকে এগিয়ে দিতেই ফুলের শরীর জ্বলে উঠল। মনে হলো কাঁটা ঘায়ে কেউ নুন চেপে ধরেছে। নাদিয়ার হাতে থাকা গ্লাস ঝাড়া মেরে ফেলে দিল ফুল।
এতোক্ষণ যাবত মাথা নিচু করে বসে থাকলেও এবার উদ্যান শান্ত চোখে তাকায়। উহু ফুলের দিকে নয়; নাদিয়ার দিকে। নাদিয়া দুপা পিছিয়ে গিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে ফুলের উদ্দেশ্যে বলে,
“স্যরি।” নাদিয়া জানেনা কেন সে স্যরি বলেছে। এখানে তার ভুল কি ছিল? কিন্তু উদ্যানের দৃষ্টি তাকে এমন ভাবে প্রভাবিত করেছে যে তার ঠোঁট স্বতস্ফুর্ত ভাবে স্যরি উচ্চারণ করেছে। উদ্যান রিএক্ট করতে যাবে তার আগেই ফুল হামলে পড়ে ওর উপর,
“কি হয়েছে আপনার? নাদিয়া আপুর দিকে ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমি ফেলে দিয়েছি গ্লাস, আমি আঘাত করেছি আপনাকে। একটা দুটো নয় পুরো ৬১ টি টা। আবেশ ভাইকে যতগুলো আঘাত করেছেন তার অর্ধেক। আমি আরও আঘাত করবো আপনাকে। মেরে ফেলবো, আপনার রাগ উঠছে না? পানিশট করতে ইচ্ছা করছে না? মারুন না আমাকে।”
বলেই উদ্যানের হাত ধরে ফুল, সেই হাত দিয়ে নিজের গালে আঘাত করতে চায় কিন্তু উদ্যান তার পূর্বেই নিজের হাত সরিয়ে নেয়।
“আমার রাগ উঠছে না তোমার উপর; নিজের উপরে উঠছে। আগে আমি যা কিছু করেছি সেসবের মাশুল কিভাবে দেবো জানিনা। তুমি চাইলে আমাকে আরও মারো, মেরে ফেলো। কিন্তু আমি তোমাকে আঘাত করতে পারবো না কারণ তুমি কোনো ভুল করোনি।”
উদ্যানের নরম কণ্ঠ শুনে ফুলের পৃথিবী উল্টে গেল। দুহাতে মাথা চেপে ধরে আবারও শেলফের সাথে লেগে দাঁড়াল। যেই উদ্যান তাকে শুরু থেকে ‘ব্লাডি মিস্টেক’ আর ‘ভুল’ নামে সম্মোধন করে আসছে। আজ অবধি অহংকারের বশে ফুলের নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি সেই স্বামী নামের আসামীর এতো বড় পরিবর্তন কিভাবে মেনে নেবে ফুল? পারছে না, এসব মেনে নিতে পারছে না। পুনরায় উন্মাদনা ভর করে ফুলের উপর, ঝুঁকে গিয়ে নিচে পড়ে থাকা বেল্ট টা হাতে তুলে নেয়। উদ্যান ভাবে, ফুল হয়তো আবারও তাকে আঘাত করবে। ফুলের অভিব্যক্তি বিশ্লেষণ করতে করতে উদ্যান সাবধানী গলায় বলে,
“নাদিয়া, ওগুলো রেখে চলে যা।”
আর যাই হোক সার্ভেন্টদের সামনে নিজের অসহায়ত্ব দেখাতে প্রস্তুত নয় উদ্যান। মাথা নেড়ে হাতের ট্রে টা রেখে স্থান ত্যাগ করে নাদিয়া। রুম থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, আজকে উদ্যান যেভাবে তাকিয়েছিল, ছাড় পাওয়াটা কল্পনাতীত ছিল। এসবের মাঝে নাদিয়া সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে উদ্যানের আচরণ দেখে। ফুল আঘাত করেছে উদ্যানকে? এও বিশ্বাসযোগ্য? মাথার মধ্যে চিন্তা ভাবনার সংঘর্ষ চলছে তখনই নাদিয়ার চোখ যায় লুহানের রুমের দিকে। হাটার গতি কমে যায় নাদিয়ার, লক্ষ করে রুমা কাঁদতে কাঁদতে লুহানের রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। শেষের কিছু কথা নাদিয়ার কানে আসে,
“ক্ষমা চাইলেই সব সমাধান হয়না। আপনার জন্য আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ক্ষমা করবো না আপনাকে।” নাদিয়াকে দেখে চুপ হয়ে যায় রুমা। আলগোছে চোখ মুছে বলে,
“মেলো ম্যাম আর লুহান স্যার বাদে বাকিরা ডিনার করবে। ডিনার সার্ভ করতে চল।”
রুমার গোপনীয়তা রক্ষায় সাপোর্ট করে নাদিয়া, “মাস্টারও হয়তো ডিনার করবেন না। উনার ওয়াইফ তো সুযোগ পেয়ে সবকিছুর প্রতিশোধ নিচ্ছে। অবশ্য নিবে নাই বা কেন, ওয়াইফ হওয়া সত্ত্বেও মাস্টার উনাকে আমাদের সাথে রেখেছিল, সার্ভেন্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আহ, ফুলকে মাঝেমধ্যে কতো ধমক দিয়েছি কাজের জন্য। মাস্টারকেই ছাড় দেয়নি আমাদের কি করবে গড নোস।”
মৃদু হাসে রুমা। কিচেনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দুজনেই,
“দেখলি নাদু, আমরা কিন্তু বেশ অনেক গুলো দিনই একসাথে ছিলাম তবুও ফুল থুক্কু এখন থেকে আর নাম ধরে ডাকা যাবেনা বুঝলি। মিস্ট্রেসা, হ্যাঁ মিস্ট্রেসা এতোদিন আমাদের সাথেই ছিলো তবুও আমরা ঘুনাক্ষরেও টের পেলাম না যে সে আমাদের মাস্টারের ওয়াইফ।”
থমকে গেল নাদিয়া। মনে পড়ে গেল সে পরিচয় জানার পরেও ফুলের নাম ধরে ডেকেছিল। ইশ ফুল যদি সেসব মনে রেখে তাকে পানিশট করে?
“কিরে কিছু বল।”
মৃদু ছন্দে শ্বাস ফেলে নাদিয়া। ভাবুক গলায় বলে, “উনার কথা বাদই দিলাম, আমরাও তো একে অপরের সাথে দীর্ঘদিন যাবত আছি। যেখানে আমারাই নিজেদের নামের বাইরে একজন আরেকজন সম্পর্কে কিছুই জানিনা সেখানে উনার ব্যপারে জানতে না পারাটা তেমন আর কি?”
চুপ হয়ে গেল রুমা। নাদিয়াও আর ঘাটায় না। বাকিটা পথ নীরবতায় ভর করেই কেটে যাবে।
কয়েক মুহুর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আবারও ফ্লোরে বসে পড়তে উদ্যত হয় উদ্যান। কিন্তু তার আগেই ফুল হাতে থাকা বেল্ট ঘুরিয়ে নিজের অন্য বাহুতে আঘাত করে। ঠাস শব্দ কানে যেতেই চকিত নয়নে ফুলের দিকে তাকায় উদ্যান। বেল্টের নিদারুণ আঘাতে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নেয় ফুল। নিজ হস্তে নিজেকে ততটা জোরে আঘাত করা না গেলেও ফুল ব্যথা পেয়েছে। ব্যপারটা অনুমান করে আরও আহত হয় ফুল। এতোক্ষণ যাবত শরীরের সব শক্তি খাটিয়ে উদ্যানের উপর নির্যাতন করেছে। উদ্যান যেভাবে বসে ছিল, ফুল ভেবেছিল উদ্যানের ব্যথা লাগছে না। এই বেল্টের আঘাত হয়তো রক্তকোষে আলোড়ন সৃষ্টি করেনা। বিষিয়ে তোলেনা আঘাতকৃত স্থানটিকে। কিন্তু হায়, সে কতোটা ভুল ছিল। ফুল আবারও নিজেকে আঘাত করার জন্য বেল্ট টা ঘোরাতেই উদ্যান শক্ত হাতে প্রতিরোধ করে। বেল্ট টা টেনে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়,
কাঁদতে কাঁদতে ফুলের নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে। ফোলাফোলা গাল আরও ফুলে গিয়ে মুখের আকার বিকৃত হয়ে গেছে। বুকের উপরে থাকা ওড়নাটা ধীরে ধীরে কাঁধ থেকে নেমে বাহুতে এসে ঝুলে পড়েছে। উদ্যান সন্তর্পণে ফুলের ওড়না ঠিকঠাক করে দিয়ে রাশভারী কণ্ঠে আওড়ায়,
“কি হয়েছে? নিজেকে আঘাত কেন করছো? কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে চালাক ভেবে নিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আবারও নিজেকে বোকা হিসেবে উপস্থাপন করলে।”
ফুলের পা জমে গেছে। সেই সাথে সবকিছু অর্থহীন লাগছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে,
“কেন এতো কষ্ট হচ্ছে আমার?” ফুলের কথার অর্থ বুঝতে পারেনা উদ্যান। স্রেফ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে।
“তোমাকে তো পেইন কিলার দেওয়া হয়েছিল। তাও ব্যথা করছে? কোথায় ব্যথা করছে?”
ফুলের ওষ্ঠদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে। জামার সামনের অংশ চোখের পানিতে ভিজে গেছে। অথচ যাকে সে এতোগুলো আঘাত করলো তার চোখে ব্যথার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই, কিভাবে সম্ভব? উদ্যানের প্রশ্নে মুখে কিছু না বলে তর্জনী আঙুল বুকের বা পাশে ঠেকায় ফুল। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,
“এখানে ব্যথা করছে।”
উদ্যান হয়তো বুঝতে পারল না কথাটা, “ওকে, আমি এক্ষুনি ডাক্তার ডাকছি।”
পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই ফুল টেনে নিয়ে যায়। একমুহূর্তের ব্যবধানে ফোনটার ঠাই হয় সবুজ রঙের টাইলস মোড়ানো ফ্লোরে। উদ্যান শুধু নিস্তেজ চোখে ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল। টু শব্দটিও করলো না। উদ্যানের এই নীরবতা যেন সুচের ন্যায় ফুলের শরীরে বিধে যাচ্ছে। হাঁটু ভেঙে ফ্লোরে বসে পড়ে ফুল। ধৈর্য নিঃশেষ হয়ে গেছে; ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে ফুল। তার আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। ওর ঠিক সামনেই বসে পড়ে উদ্যান,
“কাঁদছো কেন? বেশি ব্যথা করছে?”
অবুঝের মতো হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তে থাকে ফুল। আকস্মিক ভাবে উদ্যানের শার্টের গলার অংশ চেপে ধরে বলে,
“আপনি কাঁদছেন না কেন? আপনার কি কান্না করা উচিৎ নয়? এতোগুলো আঘাত করার পরেও আপনাকে কাঁদাতে পারি নি আমি। সেই জন্যই আমার কষ্ট হচ্ছে।”
ফুল জানে এসব মিথ্যা। ওর কান্না করার কারণ এটা নয়। উদ্যান একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো ফুলের অশ্রুসজল চোখের দিকে। ঠোঁট চেপে উদ্যানের রহস্যময় চোখের দিকে তাকাতেই থেমে যায় ফুল। অন্তস্থল থেকে অবাধ্য মন অকপটে উচ্চারণ করে,
“তার এই চোখজোড়াই একদিন তোকে গিলে খাবে; খুন করে ফেলবে নিঃশব্দে। ওই চোখজোড়া জীবন্ত এক গোলকধাঁধা। তোর অবাধ্য মন সেই গোলকধাঁধায় ঘর বাধার পরিকল্পনা করে ফেলেছে বহু আগেই। শুধু তোর মস্তিষ্কের একটু সাড়া প্রয়োজন।”
“স্যরি পেটাল, আমি কাঁদতে জানিনা। ডাক্তার অনেক চেষ্টা করেও আমাকে কাঁদাতে পারেনি।”
ফুলের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো,
“আপনি ব্যথা পাননি?”
“ব্যথা?” উদ্যান এমন ভাবে বলল যেন এটা শুধুমাত্র একটা শব্দ, কোনো অনুভূতি নয়। পরক্ষণেই নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলল,
“তুমি এতোগুলো আঘাত করার পর জিজ্ঞেস করছো ব্যথা পেয়েছি কিনা? দ্যাটস সো ক্রুয়াল ওয়াইফি। আমিও হয়তো এমন উদ্ভট প্রশ্ন করেছিলাম তোমাকে। তাই বলে তুমি সেটাও ফিরিয়ে দেবে?”
ফুলের চোখজোড়া পানিতে টলমল করছে। এতোটা সুন্দর লাগছে যে উদ্যান চোখ সরাতে পারছে না। সুন্দর লাগছে? হ্যাঁ উদ্যানের কাছে সুন্দর লাগছে বৈকি।
“ওয়াইফি, তোমার চোখজোড়া খুব সুন্দর। কাঁচের চেয়েও স্বচ্ছ। তার চেয়েও অধিক সুন্দর… উদ্যান থামল। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই ঠোঁটের কোণে বিরল হাসির রেখা ফুটে উঠল। হিসহিসিয়ে বলল,
“তোমার ঠোঁট।”
উদ্যানের কথা শুনে কেঁশে উঠল ফুল। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল।
“আপনাকে হাসতে কে শিখিয়েছে?”
“কেন?”
“তার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে। নির্ঘাত সেও আমার জাতশত্রু নয়তো সবচেয়ে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে আমাকে মারার অস্ত্র আবিষ্কার করতো না।”
আশেপাশের বাতাবরণ থমকে গেল মুহুর্তেই। উদ্যান আলগোছে ফুলের মুখ তার দিকে ফিরিয়ে নেয়,
“তুমি এভাবে বলতে পারলে? আচ্ছা আমি আর হাসবো না।”
“কেনো, মারবেন না আমায়?”
নাবোধক মাথা নাড়ে উদ্যান, “তোমাকে মারার ইচ্ছা আমার কোনোকালেই ছিলো না পেটাল। যদি থাকতো প্রথম সাক্ষাতেই মেরে ফেলতাম।”
“তাহলে এতো আয়োজন কেন? শুধুই কি আমাকে পোড়ানোর জন্য?”
ফুলের চুলগুলো খোলা ছিল। কিছু চুল গালের উপর পড়তেই উদ্যান শান্তচোখে তাকায় চুলগুলোর দিকে। মনে পড়ে যায় আবেশকে তখন এই চুলগুলোই টেনেছিলো।
“তোমার এতোই ভয় করলে আমাকেই আগে পুড়ে ফেলো। আমি পুড়ে ছাই হয়ে গেলে তোমাকে আর পুড়তে পারবো না।”
“আমি আপনাকে কিভাবে পুড়বো? এতোগুলো আঘাত করার পরেও একফোঁটা অশ্রু ঝরাতে সক্ষম হইনি।”
“তুমি আমার অশ্রু দেখতে চাও?”
“দেখতে চেয়েছি বলেই তো আঘাত করেছি। আমার ধারণা আপনার চোখের জলই আমার মনকে শান্ত করতে পারবে।”
“তোমার মনে হচ্ছেনা যে তুমি আমার মতো কথাবার্তা বলছো?”
ক্লান্ত হয়ে গেল ফুল। শেলফের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
“আমি চাই আপনি নিজের আগের রূপে ফিরে যান। যেই রূপটাকে আমি ঘৃণা করি। যাকে ঘৃণা করার হাজার টা কারণ ছিল। আপনি আমাকে প্রতিদিন টর্চার করলেও আমি মেনে নেবো। আর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো না। দয়া করে, এতোটা নির্দয় ভাবে আমাকে মারবেন না।”
চাপাশ্বাস ফেলল উদ্যান, “আমি মারবো না তোমাকে।”
উদ্যানের কথাটুকু শুনতে পায়নি ফুল। চেতনা হারিয়ে ফেলেছে হয়তো। কিছুক্ষণ বসে থেকে ফুলকে কোলে তুলে নেয় উদ্যান। বিরবির করে বলে,
“অদ্ভুত বউ আমার, নিজেই মারবে নিজেই কাঁদবে। সবশেষে আবার নিজেই জ্ঞান হারাবে। ওর জন্য আবার আমাকেই ডাক্তার ডাকতে হবে।”
গোলাপি রঙা চাঁদর মোড়ানো রাজকীয় খাটের উপর ফুলকে শুইয়ে দেয় উদ্যান। তারপর নিজের রুমে গিয়ে বেডসাইড ড্রয়ার থেকে আরেকটা ফোন বের করে ডাক্তারকে কল দেয়। মিনিট পাঁচেক পেরোতেই ডাক্তার এসে হাজির হয়। উদ্যানের রক্তাক্ত পিঠ ও বাহুদ্বয় দেখে ডাক্তার ভাবেন উদ্যান নিজের জন্যই তার তলব করেছে।
“মাস্টার আপনার এই রকম অবস্থা কীভাবে হয়েছে?”
উদ্যান কাঠকাঠ গলায় বলে, “দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস। চিকিৎসা করুন।”
ডক্টর নিজের মেডিক্যাল ব্যাগ নিয়ে উদ্যানের দিকে এগোতেই উদ্যান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায়,
“আমার দিকে কেন আসছেন?”
“আপানার চিকিৎসা করতে মাস্টার। আপনার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।”
ডক্টর একদম কাছাকাছি যাওয়ার পূর্বেই উদ্যান হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয়,
“ও হ্যালো! আপনার কি ধারণা? নিজের চিকিৎসা করানোর জন্য আমি আপনাকে মানে ফিমেল ডক্টরকে কল করেছি?”
হড়বড়িয়ে গেল ডাক্তার। আসলেই তো, যেখানে দু-দুটো মেল ডক্টর আছে সেখানে উদ্যান তাকে কেন ডাকবে?
“স্যরি মাস্টার।”
“আপনার স্যরি শুনতে বসে নেই আমি। নিজের কাজ করে বিদেয় হোন।”
মাথা নত করে ফুলের চেক-আপ করতে এগিয়ে যায় ডাক্তার।
“দূর্বলতার কারণে সেন্সলেস হয়ে গেছেন মিস্ট্রেসা। চিন্তার কিছুই নেই মাস্টার। শুধু সেন্স ফিরলে উনাকে খাবার খাইয়ে দিবেন।”
“আমাকে দিতে হবে?” এহেন প্রশ্নে হাসি পেয়ে গেল ডাক্তারের। উদ্যানের কপালে গভীর ভাঁজ পড়েছে। কোনো রকমে নিজের হাসি আটকে ডাক্তার বলে,
“আপনি চাইলে দিতে পারেন, আবার নাও দিতে পারেন। শুধু উনি যেন অভুক্ত না থাকেন সেটা নিশ্চিত করবেন।”
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল উদ্যান। বুঝতে পারলো অবান্তর কিছু বলে ফেলেছে।
“ওকে লিভ।”
ডাক্তার চলে গেল। খাটের সামনে থাকা টুলে বসে আছে উদ্যান। দৃষ্টি অবচেতন ফুলের উপর নিবদ্ধ। হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায় উদ্যান। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে, সেখান থেকে একটা মাঝারী আকৃতির কেঁচি হাতে তুলে নেয়। তারপর শিস বাজাতে বাজাতে ফুলের দিকে অগ্রসর হয়। ফুলের গা ঘেঁষে বসে পড়ে। অতঃপর ফুলের মুখ বরাবর ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলে,
“তুমি জানতেই পারবে না কিভাবে আমি সারাটাক্ষন তোমার উপরে নজর রেখেছি। এমনকি রেজিস্ট্রার পর্যন্ত আমার হাতের পুতুল ছিলো। সে শুধুমাত্র সময় নষ্ট করেছে যাতে তুমি কোনোভাবেই আমাকে ডিভোর্স দিতে না পারো। তোমাকে দিয়ে নকল পেপারে সাইন করিয়ে বলেছিল সেগুলো ডিভোর্স পেপার।”
কথাগুলো বলতে বলতেই ফুলের চুলে হাত দেয় উদ্যান। মাথার উপরিভাগের চুলগুলো সামনে এনে কনফিউজড চোখে তাকায়,
“ঠিক কোন চুলগুলো অবাধ্য হয়ে পরপুরুষকে আকৃষ্ট করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল?”
অনুমানের উপর ভিত্তি করে একঝাঁক চুল মুঠোয় নিয়ে নেয় উদ্যান। তারপর কেঁচি প্রয়োগ করে গোড়া থেকে কেঁটে ফেলে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও কনফিউজড হয়ে যায় উদ্যান। এবার মনে হচ্ছে সেই চুলগুলো নয় অন্য পাশের চুল ছিল। উদ্যান অন্যপাশের চুলে হাত দিতে যাবে তখনই নিজেকে সংযত করে নেয়। চোখ বন্ধ করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতের কেঁচিটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সে চলে যেতেই ফট করে চোখ মেলে তাকায় ফুল। উদ্যানের যাওয়ার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অবচেতন হাতে সদ্য কেঁটে ফেলা চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে; পরক্ষণেই হাতের দিকে তাকায় ফুল। হাত ভর্তি করে মেহেন্দি দিয়েছিল কিন্তু কিঞ্চিৎ পরিমাণে রঙ হয়নি। বিষয় টা ক্লোজেটে যাওয়ার আগেই লক্ষ করেছিল ফুল। তার উপর উদ্যানের কথাগুলো শুনে ফুল বুঝতে পারল, উদ্যান হয়তো অনেক আগেই ওর খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলো। তবে কেন উদ্যান সময় নষ্ট করলো?
চলবে,,,
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১০
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৭
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৭
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১