অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (২৪)
সোফিয়া_সাফা
সমুদ্রের তীর ঘেষে হেটে যাচ্ছে ফুল আর আবেশ। আজকের সমুদ্র উত্তাল বেশ; বিকট গর্জন তুলে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। ফুলের এক হাতে কুলফি মালাই, আরেক হাতে চকলেট। সে তো আইসক্রিম খাওয়ায় ব্যস্ত, আর আবেশ ব্যস্ত নিজের বুনোফুলের উচ্ছ্বাস দেখতে। হঠাৎ করেই ফুলের নজর যায় আবেশের হাতের দিকে।
“একি! তোমার আইসক্রিম তো গলে পানি হয়ে গেল। খেলে না কেন?”
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল আবেশ। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যিই আইসক্রিম গলে গেছে। চোখ মুখ কুচকে গেল ফুলের। পার্স থেকে টিস্যু বের করে আবেশের দিকে এগিয়ে দিল। বোকা হেসে ফুলের থেকে টিস্যু নিয়ে হাত মুছতে লাগল আবেশ।
“খেয়াল কোনদিকে ছিল তোমার হুম?”
চোখ সরিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগল আবেশ, “আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আইসক্রিমের কথা।”
আবেশের মিনমিনিয়ে বলা কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ফুল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“দুদিন পর ভর্তি পরীক্ষা আছে। আমি একা একা কিভাবে যাবো?”
“একা একা যাবি কেন? আমি আছি না? আমি নিয়ে যাবো। অফিসে কথা বলেই রেখেছি সেদিন ছুটি নিয়ে অফডেতে ডিউটি করে পুষিয়ে দেবো।”
আবেশের কথায় চিন্তামুক্ত হলো ফুল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রাত হওয়াতে সমুদ্রের এতোটা কাছে খুব একটা মানুষ নেই। যারা আছে তারা সবাই সীসাইড মার্কেটের আশেপাশে আছে। লোকজন কম নেই; অসংখ্য লোকজন। এই নিয়ে ফুল কয়বার এখানে এসেছে হিসেব নেই।
“চলো আবেশ ভাই বাড়িতে ফিরে যাই। কাল তো আবার ডিউটি আছে তোমার।”
ফুলের কথায় সম্মতি জানিয়ে হাটা ধরল আবেশ তখনই পেছন থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,
“একা একা মেয়ে নিয়ে ঘুরছিস? ব্যপারটা ঠিক হজম হচ্ছেনা।”
আবেশ ও ফুল দুজনেই পেছনে ঘুরে তাকায়। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ৩ জন লোক। দেখে স্থানীয় বলে মনে হচ্ছে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে অশ্লীল হাসি। তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখে আবেশের পেছনে সিটিয়ে গেল ফুল। ৩ জনের মধ্য থেকে একজন উঁকি মেরে তাকায় ফুলের দিকে,
“ভয় পাচ্ছিস কেন মেয়ে? এই ছেলেটার সাথে তো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিস আমাদের সামনে নাটক করছিস কেন?”
আবেশ এবার সতর্ক চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে ফুলকে আড়াল করে নিল,
“ও আমার বউ। যেতে দেও আমাদেরকে।” আবেশের কথার প্রতিউত্তরে লাঠিধারী যুবকটি বলে উঠল, “স্বামীকে কেউ ভাই বলে ডাকে নারে শা*লা। আমি স্পষ্ট শুনেছি মেয়েটা তোকে আবেশ ভাই বলে ডেকেছিল।”
বলেই সমস্বরে হেসে ওঠে লোকগুলো। তাদের সেই বিদঘুটে হাসি দেখে ফুলের গলা শুকিয়ে এলো। আবেশের শার্ট খামচে ধরে নিম্নগলায় বলল,
“কথার কাটাকাটি কোরো না। পালাই চলো।”
আবেশ নিজেও বুঝলো এদের সাথে কথা বাড়ানো মানে আরও বেশি করে ঝামেলায় জরিয়ে যাওয়া। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল আবেশ তারপর একদম হঠাৎ করেই ফুলের হাত ধরে দৌড় লাগাল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলো না। তার আগেই আরও দুজন লোক সামনে থেকে এসে তাদেরকে ঘিরে ফেলল। ফুলকে টেনে নিজের পেছনে লুকিয়ে ফেলল আবেশ। সাবধানী দৃষ্টিতে আশেপাশে থাকা পাঁচজন লোকের দিকে তাকিয়ে ফুলের উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বলল,
“সুযোগ পাওয়া মাত্রই দৌড়ে চলে যাবি। আমার জন্য অপেক্ষা করবি না। যেখানে মানুষের ভীড় আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াবি।”
ফুলের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, “আমি তোমাকে রেখে যাবো না।”
চোখ বন্ধ করে নিল আবেশ কঠোর গলায় বলল, “আমাকে ওরা কিছুই করবে না। ওদের নজর তোর উপর। বোঝার চেষ্টা কর, আবেগে গা ভাসালে চলবে না। আমি বলার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বশক্তি খাটিয়ে দৌড় লাগাবি। নইলে কিন্তু পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।”
উপায়হীন ফুল বুঝে উঠতে পারল না তার কি করা উচিৎ। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। হাত পা অস্বাভাবিকভাবে কাপছে। তাকে ভাবনা চিন্তা করার সময়টুকুও দিল না আবেশ। হুট করেই পেছনে ঘুরে দুহাতে দুজনের মুখ বরাবর ঘুষি মেরে দিল। ফুলের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলল, “রান ফুল রান।”
ফুলের পা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দৌড় লাগাল। খানিকটা দূর গিয়ে পেছনে ফিরে দেখল লাঠিধারী লোকটা আবেশের পায়ে বাড়ি মেরেছে। ফুলকে থেমে যেতে দেখে আবেশ আবারও বলল, “ডোন্ট স্টপ, রান অ্যাজ ফাস্ট অ্যাজ ইউ ক্যান।”
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে ফুল। তবুও সাহায্য পাওয়ার আশায়, কাউকে খুঁজে আনার লক্ষ্যে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকল।
জঙ্গলের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে উদ্যান আর রিদম। বাইকের গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে রেস করছে তারা। রিদমের থেকে বেশ এগিয়ে আছে উদ্যান। তবুও স্বভাবতই ফুল স্পিডে বাইক রাইড করছে সে। তখনই কাজে ব্যাগড়া দিয়ে গুম গুম শব্দে ফোন বেজে ওঠে। ভ্রুক্ষেপ করেনা উদ্যান। কিন্তু একনাগাড়ে বেজেই চলেছে ফোনের অবাধ্য রিংটোন। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়েই কানে থাকা ব্লুটুথের সাহায্যে কল রিসিভ করে উদ্যান। রগচটা কণ্ঠে শুধায়,
“কে?”
অপরপাশ থেকে এমন কিছু ভেসে এলো যা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না উদ্যান। ঘটনার রেশে বাইকের স্পিড কমিয়ে দিল উদ্যান। ব্যস্ত গলায় বলল,
“মেয়েটাকে যেন কেউ টাচ করতে না পারে। ওর সাহায্য কর।” উদ্যানের অনুমতি পেয়ে কল কেটে দেয় অপরপাশে থাকা লোকটা। এই ফাঁকে উদ্যানকে ওভারটেক করে চলে যায় রিদম। ঘটনার ঘূর্ণিপাকে বিরক্তির মাত্রা তরতর করে বেড়ে গেল উদ্যানের। দাঁতে দাঁত পিষে পুনরায় বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিল।
আবেশকে রেখে অনেকটা দূর চলে এসেছে ফুল। আর কিছুটা দূর গেলেই মানুষজনের উপস্থিতি। আচমকা ফুল দেখল কয়েকজন লোক সামনের দিকে থেকে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ভীতসন্ত্রস্ত ফুল হাপাতে হাপাতে হাতজোড় করে বলল,
“আমাকে যেতে দিন। ছেড়ে দিন।” লোকগুলো কিছু বলল না শুধু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তাদেরকে জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফুল কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,
“আমাকে সাহায্য করুন। আবেশ ভাইকে বাচান।”
লোকগুলো এখনও নিশ্চুপ। ফুল বুঝতে পারল এরা তার কোনো সাহায্যই করবেনা। সে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে দুপা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে আবেশের ডাক ভেসে আসে।
“দাঁড়া ফুল।”
চকিত নয়নে পেছনে ফিরে তাকায় ফুল। হাঁটুতে হাত রেখে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে আসছে আবেশ। একছুটে আবেশের কাছে চলে যায় ফুল।
“তুমি ঠিক আছো আবেশ ভাই?”
ফুলের কান্নাজরিত কণ্ঠ শুনে আবেশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সেই হাসি সুখের বা আনন্দের নয় বরং বেদনামিশ্রিত হাসি।
“তুই ঠিক আছিস ফুল? আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম ওরা দুজন মিলে আমাকে আটকে রেখে বাকি তিনজন তোর পিছুপিছু এসেছিল।” আবেশের কথা শুনে হাল্কা ঘাড় বাকিয়ে পাশে ফিরে তাকায় ফুল। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে থাকা লোকগুলোকে আর সেখানে খুঁজে পায়না। কোথায় হাওয়া হয়ে গেল লোকগুলো?
“তোমাকে ওরা মে*রেছে আবেশ ভাই?”
আবেশের হাটুতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ফুল। আবেশ ফুলের মাথায় হাত রেখে বলল,
“না দুটো বাড়ি লেগেছিল। তারপর আমিও ওদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে তোর পিছু পিছু চলে এসেছি। কিন্তু পথিমধ্যে ওদের কাউকে আর খুঁজে পেলাম না। তোর পেছন পেছন যারা এসেছিল তারা কোথায় গেল?”
ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল ফুল। তাকে ভয় পেতে দেখে আশ্বস্ত দিল আবেশ,
“মনে হয় চলে গেছে। ভয় পাসনা।”
শুকনো ঢোক গিলে উপর নিচ মাথা নাড়ল ফুল। অদ্ভুত দেখতে লোকগুলো হঠাৎ করে এসে আবার হঠাৎ করেই ভ্যানিশ হয়ে গেল কিভাবে বুঝে উঠতে পারল না।
ঘড়ির কাটায় রাত সাড়ে ১০ টা। ডাইনিং টেবিলে বসে ডিনার করছেন মাহবুবা সুলতানা, রেহানা বেগম আর মেহেক। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নীরবতা ভেঙে মেহেক বলে ওঠে,
“দুদিন পর ভর্তি পরীক্ষাটা দিয়ে আমি বাড়িতে চলে যাবো খালামনি।”
মাহবুবা সুলতানা কিছু বললেন না। যেন সে শুনতেই পান নি মেহেকের কথা। এই ব্যপার গুলোই আর মেহেকের ভালো লাগে না। মাহবুবা সুলতানা বলতে গেলে কোনো কথাই বলেন না কারো সাথে। অগত্যা রেহেনা বেগমই বললেন,
“ঠিক আছে কিন্তু কয়দিন থাকবা?”
প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল মেহেক। শান্ত গলায় বলল, “জুলাই মাস থেকে ক্লাস শুরু হবে তার কয়েকদিন আগে আসবো।”
“ভর্তি পরীক্ষার চার মাস পরে ক্লাস শুরু হবে?” রেহানা বেগমের প্রশ্নে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে মেহেক। টেবিল জুড়ে আবারও পিনপতন নীরবতা ভর করে। তন্মধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে আসে। একজন সার্ভেন্ট গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে প্রবেশ করল উদ্যান। তাকে দেখে চমকে উঠল মেহেক। মাহবুবা সুলতানা নিস্তেজ চোখে প্লেটের দিকেই তাকিয়ে আছেন। রেহানা বেগমও খুব একটা অবাক হয়েছেন বলে মনে হলো না। হাতে থাকা হেলমেট টা সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল উদ্যান। কয়েক ধাপ উপরে উঠে থেমে গেল সে। পুনরায় নেমে এসে ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। টেবিলের উপর চোখ বুলিয়ে উৎসুক গলায় বলল,
“ওয়াও! দা ফুড লুক্স রিয়েলি টেম্পটিং… স্মেলস গ্রেট টু। আই থিংক আই শুড টেস্ট ইট।”
একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ল উদ্যান। সে বসার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গেল। এতোক্ষণ যাবত বেখেয়ালি থাকা মাহবুবা সুলতানাও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন উদ্যানের দিকে। যেই ছেলেটা এই বাড়িতে থাকাকালীন নিজের রুমে একা একা বসে খাবার খেয়েছে সেই ছেলেটা নিজে থেকেই তাদের সাথে এক টেবিলে খেতে বসে পড়েছে? তাও আবার আবেশের সাথে ফুল পালিয়ে যাবার তিনমাস পর এসে? শুধু মাহবুবা সুলতানাই নয়, রেহানা বেগম আর মেহেকও বড়বড় চোখে তাকিয়ে আছে উদ্যানের দিকে। তাদের চাহনি টের পেয়ে হাল্কা হাসল উদ্যান। তার সেই হাসি দেখে শ্বাস নিতে ভুলে গেল তিনজনই। উদ্যান এবার গলা পরিষ্কার করে বলল,
“এহেম… আমি জানি, আমার রূপ বেড়ে গেছে। তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। লজ্জা লাগে আমার।”
ধাক্কার উপর ধাক্কা খেয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বসে আছে তিনজনই। প্লেটে খাবার বেড়ে তাদের রিয়েকশন উপভোগ করতে করতে খাবার খাচ্ছে উদ্যান। একপিস মাংসের টুকরো মুখে নিয়ে ভ্রু কুচকে তাকায় উদ্যান। মেহেকের উদ্দেশ্যে বলে,
“নজর লাগিয়ে দেবেন দেখছি। দৃষ্টি সংযত করুন নইলে প্রেমে পড়ে যাবেন। আমি কিন্তু বিবাহিত, প্রেম ট্রেম করতে পারবো না।”
কথাটা শুনে কেঁশে ওঠে মেহেক। তার কাশির শব্দে হুশ ফেরে মাহবুবা সুলতানা আর রেহানা বেগমের। অস্বস্তি লুকাতে দুজনেই পানি এগিয়ে দেয় মেহেকের দিকে। কার দেওয়া পানিটা নেবে সেটা ভেবেই এবার দ্বিধায় পড়ে যায় মেহেক। তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে উদ্যানের ঠোঁটের কোণের হাসির পরিধি বিস্তৃত হলো,
“আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য সবাই দেখছি নাটক শুরু করে দিয়েছে। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই এন্টারটেইন্ড হচ্ছি। তবে সত্যি বলতে আমাকে শুধু একটা জিনিসই ইমপ্রেস করতে পেরেছে আর সেটা হলো… ।” থেমে যায় উদ্যান। এদিকে পুরো কথাটা শোনার আশায় চেয়ে আছে তিনজনই। কিন্তু উদ্যান তো তাদের অবস্থা দেখে বেশ মজা পাচ্ছে, তাই সে বাকি কথাটুকু আর বলল না। হাত ধুয়ে পানি খেয়ে নিল। তারপর ঢেকুর তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল,
“খাবারের জন্য ধন্যবাদ।”
নাইট ক্লাবে ঢুকতেই রিদমের মুড ফ্রেশ হয়ে যায়। এই জন্যই তো সে এতো লাইক করে এই জায়গা টাকে। সোলার এস্টেটের সবাই যে যার মতো ব্যস্ত আছে আজকে। তাই রিদমও সেই সুযোগে চলে এসেছে ক্লাবে। কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতেই কয়েকজন পরিচিত মেয়ে এসে রিদমের সাথে ঢলাঢলি করতে শুরু করল। তাদেরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল না রিদম উল্টো সব কয়টা মেয়েকে একসাথে সামলে ড্রিংকস অর্ডার করল।
“আজকে আমার সাথে চলো বেইবি।” একটা মেয়ে রিদমের গলা জড়িয়ে ধরে বলল। রিদম রাজি হতেই যাবে তার আগেই আরেকটি মেয়ে বলে ওঠে, “নাহ রিদম বেইবি আজকে আমার সাথে যাবে।”
ব্যস লেগে যায় যুদ্ধ। তাদের যুদ্ধে অতিষ্ঠ হয়ে রিদম হাত উঠিয়ে বলে, “তোমরা এক কাজ করো ওই ফাঁকা জায়গাটাতে গিয়ে চুলোচুলি করো। যে সবচাইতে বেশি চুল ছিড়তে পারবে আজকের রাতটা রিদম তার সাথেই কাটাবে।”
রিদমের কথায় সেখানেই চুলোচুলি লেগে যায়। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় রিদমের। এই মেয়ে গুলো তার মুডের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। যে করেই হোক এদের সরাতেই হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই এদিক সেদিক তাকাল রিদম। অদূরে বসে থাকা একটা মেয়েকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ডিসাইড করে ফেলেছি আজকের রাতটা আমি ওই মেয়েটার সাথে কাটাবো। সো আজকের মতো বিদেয় হও তোমরা।”
মেয়েগুলো একে অপরের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে মুখ বাকিয়ে চলে গেল। এতোক্ষণ পর স্বস্তির শ্বাস ফেলল রিদম। ড্রিংকস হাতে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল একটু আগে সে যেই মেয়েটাকে দেখিয়ে দিয়েছে সেই মেয়েটা কাঠকাঠ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে বিষম খেল রিদম কারণ এই মেয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। এই মেয়ে হচ্ছে ইনস্পেকটর উর্বী। হুম মিসেস উর্বী সেন। তখন উর্বী উল্টো দিকে ঘুরে থাকায় চেহারা দেখতে পায়নি রিদম। উর্বীকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে অজান্তেই ভয় পেয়ে গেল রিদম। কিন্তু উর্বী কোনো কিছু বলল না। নির্বিঘ্নে হাতে থাকা ড্রিংকসে চুমুক দিতে লাগল। রিদম ভাবল উর্বী হয়তো চিনতে পারেনি তাকে। তাই সেও খুব একটা মাথা ঘামালো না।
ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা বেজে একত্রিশ মিনিট। ক্লাবের ভেতর আজকে একজন সিংগার এসেছে। তাকে ঘিরেই সবাই মেতে আছে। রিদমও আজকে কোনো মেয়ের সাথে পার্সোনাল রুমে যায়নি। এককোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছে। এর পেছনে তেমন কোনো কারণ নেই, মাঝে মাঝেই রিদম এখানে এসে শুধু মাত্র সময় কাটায়। সব সময়ই মেয়েদের সাথে রাত কাটায় না।
“এই মেয়ে তুমি আমার গালে জুতা মেরে দিয়েছো! কি ভাবো কি নিজেকে হ্যাঁ?” হঠাৎ কারো চিৎকারে রিদমের ভাবনায় বিঘ্ন ঘটে। ঘুরে তাকায় পেছনের দিকে। দেখতে পায় দুজন ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে উর্বী। একহাতে জুতো আরেকহাতে সাইড ব্যাগ। উর্বীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরো দস্তুর মাতাল অবস্থায় আছে সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দুটো একেবারে উর্বীর উপর হামলে পড়ে কথা বলছে। উর্বী না পেরে আবারও জুতো দিয়ে বাড়ি মেরে দেয় ছেলেটার গালে।
“আমি ইনস্পেকটর উর্বী। ভেবে চিন্তে কথা বলবি বা*ল।” উর্বীর আক্রমনাত্মক আচরণে ছেলেদুটো এবার উর্বীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল,
“তোর তেজ সব বের করছি চল আমাদের সাথে।”
ছেলেদুটো দু কদম এগোতেই রিদম এসে সামনে দাঁড়ায়। রিদমকে দেখে দুটো ছেলেই ভদ্র গলায় বলে,
“স্যার এই মেয়েটা চরম লেভেলের অসভ্য। আজকেই প্রথম এসেছে এখানে। এসেই আমার গালে জুতা মেরে দিয়েছে।”
বুকের উপর হাত বেধে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল রিদম। তাকে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে গাঢ় ভাজ পড়ল ছেলে দুটোর। রিদম আঙুলের ইশারায় ছেলেদুটোকে চলে যেতে বলল। ছেলেদুটো কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রিদম চোখ রাঙিয়ে তাকায়। সাথে সাথেই ছেলেদুটো ঢোক গিলে পিছিয়ে যায়। উর্বী চিনে উঠতে পারেনা রিদমকে। মাত্রাতিরিক্ত অ্যা*লকোহল সেবনে চোখে ঝাপসা দেখছে। সে মনে করে রিদমও হয়তো ওই ছেলে গুলোর সাথেই আছে। কথাটা ভেবে হাতে থাকা জুতোটা রিদমের উদ্দেশ্যে ওঠায় উর্বী। হকচকিয়ে গেলেও উর্বীর হাত ধরে ফেলে রিদম। বিক্ষিপ্ত গলায় বলে, “কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ মিসেস উর্বী সেন।”
‘উর্বী সেন’ সম্মোধনে স্তব্ধ হয়ে যায় উর্বী। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, “আমি মিসেস উর্বী সেন নই; মিস উর্বী রায়।”
বলেই ফ্লোরের উপর বসে পড়ে উর্বী। রিদম অবাক চোখে তাকায় উর্বীর দিকে। মেয়েটা উল্টো পাল্টা বলছে? কিন্তু মাতাল অবস্থায় তো কিছু কিছু মানুষ সত্যি কথাই বলে ফেলে। রিদম বেশি কিছু ভাবতে পারলো না তার আগেই শব্দ করে কেঁদে ওঠে উর্বী।
কিছুক্ষণ পর,
অভিন্ন টেবিলের পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে রিদম আর উর্বী। রিদম আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। মেয়েটাকে এতোটা অগোছালো রূপে দেখবে ভাবতেও পারেনি রিদম। কেঁদেকেটে চেহারার বেহাল দশা বানিয়ে ফেলেছে। রিদম প্রচুর ধৈর্য সহকারে উর্বীর জীবনবৃত্তান্ত শুনছে। মেয়েটা শুধু তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে সেসবই বলছে। এক কথা বারবার বলছে তবুও রিদম বিরক্ত হচ্ছেনা। উল্টো উর্বীর কথা বলার ধরনে মুগ্ধ হচ্ছে। মেয়েটার চুলগুলো এলোমেলো। চোখের নিচে কালোদাগ। ফ্যাকাশে চেহারাটাও যেন কোনো এক ভাবে আকৃষ্ট করছে রিদমকে।
“আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিল। বিনা দোষে আমার গায়ে ডিভোর্সির তকমা লাগিয়ে দিল। আমার মা-বাবা আমার সাথে কথা বলেনা। যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের মতে ডিভোর্সি মেয়েদের মুখ দেখাও অকল্যাণের। আমার জন্য নাকি আমার বোনের বিয়ে হবেনা। সেই জন্য…
কেঁদে উঠল উর্বী আর কিছু বলতে পারল না। রিদম নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। হঠাৎ করেই অনুভব করল উর্বী তার কাঁধের উপর মাথা রেখেছে। জায়গাতেই জমে গেল রিদম। আশেপাশের কোলাহল, চাকচিক্য যেন মুহুর্তেই ম্লান হয়ে থমকে গেল রিদমের দৃশ্যপটে।
ফুলের ছবির সামনে অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে উদ্যান। স্পাই ক্যামেরাতে ততোটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়না। তাই এই পর্যায়ে ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে। কিন্তু যতবারই সে ফুলের ছবির দিকে তাকায় ঠিক ততবারই তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে আটকে যায় ফুলের ঠোঁটের উপরে থাকা তিলটাতে। কোনোপ্রকারেই চোখ সরাতে পারেনা। ব্যপারটা বুঝতে পেরে ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে নিল উদ্যান। বসা থেকে উঠে ফুলের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বইগুলো অত্যন্ত পরিপাটি ভঙ্গিতে গুছিয়ে রাখা টেবিলের উপর। মনের ভাবনা গুলোকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় আনমনেই বই পুস্তক খাটতে লাগল উদ্যান। বেশ কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে চোখে পড়ল একটি ডায়েরি। থেমে গেল উদ্যান। বইয়ের আড়াল থেকে টেনে বের করল ডায়েরি টা। গোলাপি রঙা ডায়েরি টার উপর ইংরেজিতে লেখা,
“The secrets of flower.”
লেখাটি দেখে কৌতুহলী হয়ে পড়ে উদ্যান। আলতো হাতে ডায়েরি টা খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ বুলায়। সেখানে লেখা ছিল,
“Don’t touch it without flower’s permission.”
লেখাটি দেখে মুখ বাকালো উদ্যান। বিরবির করে বলল, “ড্রেসিং রুমে বসে, দেয়ালকে চোখ বন্ধ করতে বলছো? ভেরি রিডিকিউলাস। আমি কে সেটা ভুলে যেওনা ভুল। এই জন্মে আমি বিহীন তুমি কিন্তু অস্তিত্বহীন।”
চলবে,,,
[পরবর্তী পর্ব পেতে রেসপন্স করুন]
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩০
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন গল্পের লিংক
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৮
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২০
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২১