Golpo romantic golpo অবাধ্য হৃৎস্পন্দন

অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৩


অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (২৩)

সোফিয়া_সাফা

ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে এখন রাত ৮ টা। সন্ধ্যার পরপরই অফিস থেকে ফিরেছে আবেশ। এখন অবশ্য প্রাইভেট পড়াতে পাশের ফ্লোরে গেছে। রুমে ফুল একাই আছে। স্বভাবতই একা থাকলে অবসর সময়টাতে নৃত্য চর্চা করে ফুল। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বল্প আয়তনের ড্রইংরুমে বসেই; এক হিন্দি গানের তালে হেলেদুলে নাচছে ফুল। তার এই নাচ নিজের রুমে বসে লাইভ দেখছে উদ্যান। ফুলের গায়ে ওড়না নেই। রুমে কেউ না থাকায় ওড়না নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি মেয়েটা। উদ্যান সূক্ষ্ম চোখে ফুলের প্রত্যেকটা মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ফুলেদের ঘরে অনেক গুলো স্পাই ক্যামেরা লাগিয়ে এসেছে উদ্যান। যার দরুন রুমে বসেই সে ফুলের উপর নজর রাখতে পারছে।
নাচের একপর্যায়ে হাপিয়ে উঠল ফুল। বসে পড়ল ড্রইংরুমের মেঝেতে। হঠাৎ করেই পেটে ব্যথা করছে। সেই সার্জারীর পর থেকেই মাঝে মাঝে ফুলের পেটে প্রচুর ব্যথা হয়। অবশ্য সেই ব্যথা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না, আপনা-আপনি সেড়ে যায়। তার উপর বর্তমানে ফুলের মেয়েলি সমস্যা চলছে। চোখ বন্ধ করে বড়বড় শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। তাকে বসে থাকতে দেখে উদ্যানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল,
“পুরো নাচটা শেষ না করেই বিশ্রাম নিচ্ছে, স্ট্রেইজ!” বিরবির করে কথাটা বলল উদ্যান।

কলিংবেল বেজে উঠতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় ফুল। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। জুতো খুলে এক সাইডে রেখে ঘরে প্রবেশ করে আবেশ। ফুল অমলিন হেসে ব্যথা আড়াল করে বলল, “তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি খাবার বাড়ছি।”

আবেশ কিছু বলল না। চুপচাপ নিজের কক্ষে চলে গেল। আবেশের ব্যবহারে ফুলের হাসি মিলিয়ে গেল। প্রাইভেট পড়াতে যাওয়ার আগেও আবেশের মুড ঠিকঠাক ছিল তাহলে এখন কি হলো? কেন আবেশকে দুঃখী দুঃখী দেখাচ্ছে? কেন সে একবারও ফুলের দিকে তাকালো না পর্যন্ত? খুব একটা ভাবল না ফুল,
“হয়তো আজকে একটু বেশিই ক্লান্ত।” এই বলে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিল ফুল। তারপর চলে গেল কিচেনে।

মিনিট কয়েক পর আবেশ ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছে। ফুল খাবার বেড়ে দিয়ে আঁড়চোখে আবেশের দিকে তাকাল। তবে বুঝতে পারল না আবেশের মনোভাব। ছেলেটা চুপচাপ খাবার খাচ্ছে, অন্যদিনের মতো খুচরো আলাপে মেতে ওঠেনি। আর নাতো ফুল খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেছে। চেয়ার টেনে খেতে বসে পড়ল ফুল। খাওয়া দাওয়া শেষে এঁটো প্লেট গুলো ধুয়ে রাখল আবেশ। আজ নতুন নয় বরাবরই ফুলের কাজে হেল্প করে আবেশ। অফ ডেতে ফুলকে কোনো কিছুই করতে দেয়না আবেশ। রান্না বান্নাও নিজে করে নতুবা বাইরে থেকে কিনে আনে।
সব কাজ শেষ করে নিজের কক্ষে চলে যায় আবেশ। ফুল তখনও ডাইনিং রুমের চেয়ারে বসে আছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে আবেশ দেখল, ফুল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আবেশ তাকে দেখেও না দেখার ভান করে তোয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে খাটের উপর বসল,

“তোমার কি মন খারাপ আবেশ ভাই?” ফুলের প্রশ্নে আবেশ নিশ্চুপ রইল। ফুল এবার ধীরপায়ে খাটের উপর বসল। আবেশ নিস্তরঙ্গ চোখে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে চুপচাপ থাকতে দেখে, কি বলবে- না বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা ফুল। নিজেও বিমূঢ় হয়ে বসে আছে, দৃষ্টি কোলের উপর নিবদ্ধ।

“তুই সেই ডেবিলটাকে কবে থেকে স্বামী হিসেবে মানিস ফুল?” আচমকা আবেশের প্রশ্নে চকিত নয়নে তার দিকে তাকাল ফুল। আবেশকে নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। তার কণ্ঠে না ছিল নমনীয়তা আর না ছিল উষ্ণতার ছোঁয়া।

সময়টা গ্রীষ্মের শুরু। মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। সেই একঘেয়ে শব্দ ব্যাতিত পুরো ঘর নিস্তব্ধ। ফুলকে উত্তর খোঁজার জন্য সময় দিয়েছে আবেশ। অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই ফুলের। কারণ ভুল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। বেশি সময় নিল না ফুল। ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“আমার মানা; না মানাতে কিছু কি পরিবর্তন হবে আবেশ ভাই? আমি যদি তাকে স্বামী হিসেবে না মানি তাহলেই কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে? আমি মুক্তি পেয়ে যাবো সম্পর্ক নামক অসম্পর্কের বেড়াজাল থেকে? পাবো না তো। তাহলে কেন এমন ভিত্তিহীন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছো?”

ফুলের কথায় রেগে গেল আবেশ। হাতে থাকা তোয়ালেটা ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে।
“আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি আমি। আমি শুধু জানতে চাই কবে থেকে আসামীকে স্বামী মানতে শুরু করেছিস।”

আবেশের চিল্লানিতে ঘাবড়ে গেল ফুল। স্তম্ভিত নয়নে তাকাল আবেশের দিকে। রাগে ফোঁসফোঁস করছে আবেশ। চোখের কোণে জল জমলো ফুলের। এর আগে আবেশ কখনোই উচ্চস্বরে কথা বলেনি তার সাথে। ফুলের টলমলে চোখজোড়া দেখে চোখ বন্ধ করে নিল আবেশ।
“আমি উত্তর চাই ফুল।”

চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল ফুল। বুকভরে শ্বাস নিয়ে বলল, “আমি কাউকে স্বামী হিসেবে মানিনা আবেশ ভাই।”

“মিথ্যা, মিথ্যা বলছিস তুই। স্বামী না মানলে কেন মিসেস সফুরা বেগমকে বলেছিলি যে তোর স্বামী চা লাইক করে। বল কেন বলেছিলি?” আবেশের কথায় বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল ফুলের। আবেশ তো সামলাতে পারছে না নিজেকে। রাগে দুঃখে পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।

“তুমি কিভাবে জানলে এসব?” ফুল ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল।

“সাদাতকে পড়ানোর সময় সে চা বানিয়ে এনেছিল। তখনই বলল তুই নাকি বলেছিস, তোর স্বামী তোর বানানো চা ছাড়া অন্য কারো বানানো চা খায়না। জানিস, কথাটা শুনে আমার কেমন লেগেছিল? তুই খুব ভালো করেই জানিস আমি চা খাইনা। আমার ঘুম হয়না চা খেলে। সেসব জেনেও তুই কেন এসব বলেছিস?”

শুকনো ঢোক গিলল ফুল। সে নিজেও জানেনা কেন সে বলেছিল সেসব।
“আমি তো আনমনেই বলে ফেলেছিলাম আবেশ ভাই। উনার জন্যই তো চা বানানো শিখতে হয়েছিল আমাকে। তোমার মনে নেই, কিভাবে চা বানাতে ফোর্স করেছিল আমাকে?”

পাশের টেবিলের উপর বাড়ি মেরে দিল আবেশ। আর সহ্য করতে পারছেনা ফুলের হেলাফেলা। আবেশ ঘুরে বসল ফুলের দিকে। তখনও ফুলের আর তার মাঝে স্বাভাবিক দূরত্ব বজায় আছে। অবচেতন মনেই বেডশিট আঁকড়ে ধরল আবেশ। নিজেকে ধাতস্থ করে ধরা গলায় বলল,
“তুই জানিস না ফুল? জানিস না বল? আমি তোকে ভালোবাসি সেটা তুই জানিস না? তারপরও কিভাবে অন্য পুরুষকে মনে জায়গা দিচ্ছিস? আমার ভালোবাসায় কি কমতি আছে বল।”

আবেশের কথাগুলো শুনে চমকে গেল ফুল। “তুমি এসব কি বলছো? আমি কোন দুঃখে অমানুষকে নিজের মনে জায়গা দেবো? শুনে রাখো আবেশ ভাই। আমার ভালোবাসা এতো সস্তা নয় যে অপাত্রে ঢালবো। আমার মন এতো বেহায়া নয় যে যার তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়বে।”

কৃত্রিম হাসল আবেশ। থমথম করছে তার ফর্সা মুখশ্রী। অত্যন্ত তিক্ত কথাগুলো আজকে বলতেই হবে। ফুলকে বোঝাতে হবে সে আবারও ভুল পথে চলে যাচ্ছে। ফুল হয়তো নিজেও বুঝতে পারছে না, ফুলের নিজের মনই তার সাথে বেঈমানি করছে। অবশ্য আবেশ নিজেও নিশ্চিত নয় যে, ফুল আসলেই কি বুঝতে পারছেনা? নাকি বুঝতে চাইছেনা।

“তুই সত্যি কথা বলছিস না ফুল।” আবেশের হেয়ালি কথা ফুলকে যেন অথৈ সমুদ্রে ছুড়ে মারল।

“আমি তো সত্যি কথাই বলছি। একটা কারণ বলো— কেন তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করা উচিত আমার? তার মতো নিকৃষ্ট, দয়ামায়াহীন, পাথর মানবের কি অধিকার আছে আমার মনে জায়গা পাওয়ার? যেই লোকটা অন্যদের সামনে আমাকে সার্ভেন্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। যেই লোকটা কারণে অকারণে নির্যাতন করে।”

কথাটুকু বলতে বলতেই জামার হাতা গুটিয়ে নেয় ফুল। সঙ্গে সঙ্গেই ফুলের বাহুর অস্পষ্ট কালো দাগগুলো দৃশ্যমান হয়। আবেশের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় ফুল, অভিযোগের সুরে বলে, “এই যে দাগ গুলো দেখছো? এই দাগগুলো ক্ষণস্থায়ী। হয়তো আর কিছুদিন পরেই মিলিয়ে যাবে। কিন্তু তার করা প্রত্যেকটা আঘাত আমার শরীর ভেদ করে হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল। আমার হৃদয়ের সেই দাগ চিরস্থায়ী; আজন্ম থেকে যাবে। জানো, যখন আমি জানতে পেরেছিলাম আমার রুমে পরপুরুষ ঢোকার অনুমতি সে-ই দিয়েছিল, তখন আমি কতোটা ক্ষত বিক্ষত হয়েছিলাম? আমার হৃদয়ে দাগ লাগিয়ে দিয়েছে দানবটা।”

চোখ বন্ধ করে নেয় আবেশ। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াসে বড়বড় শ্বাস নেয়। প্রথম যেদিন ফুলের জবানে উদ্যানের কৃতকর্মের কথাগুলো শুনেছিল সেদিন ভেঙে পড়েছিল আবেশ। ওয়াশরুমের ফ্লোরে বসে কতক্ষণ কান্না করেছিল ইয়ত্তা নেই। উদ্যান তার ভাই হয় ব্যাপারটাই যেন সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক লেগেছিল।

“যেখানে তাকে ঘৃণা করার অজস্র কারণ আছে অথচ ভালোলাগার একটা কারণও নেই। সেখানে তুমি কিভাবে এক্সপেক্ট করো যে আমি তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি?”

ফুল ভাবল আবেশ হয়তো তার কথাগুলো বিশ্বাস করে নিয়েছি। অবশ্য ফুল নিজেও এইসব কথাই বিশ্বাস করে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবেশ বলল,
“আমি এক্সপেক্ট করিনি ফুল। বাস্তবকে এক্সপেক্ট করতে হয়না। এক্সসেপ্ট করতে হয়, যতদ্রুত তুই বাস্তবকে এক্সসেপ্ট করে নিবি ততদ্রুতই নিজেকে রক্ষা করতে পারবি। এভাবে পালিয়ে বাচা যায়না ফুল। নিজের আত্মার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে কেউ বাচতে পারেনা। নিজের অনূভুতি গুলো এক্সসেপ্ট না করে তুই তোর আত্মাকে ধোঁকা দিচ্ছিস।”

ফুলের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল যেন। বসা থেকে উঠে চিল্লিয়ে বলল, “মনগড়া কথা বলো না আবেশ ভাই। আমি সত্যিই তাকে ঘৃণা করি। এতোটাই ঘৃণা করি যে তাকে নিয়ে ভাবতেও চাইনা। তাকে নিয়ে ভাবার আগে আমি নিজের মৃ*ত্যু কামনা করি।”

আবেশ নিজেও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ফুল নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে পুরো পৃথিবীর মানুষকে জানাতে যে সে আসলেই ঘৃণা করে উদ্যানকে। ফুল উদ্যানকে ঘৃণা করে। আবেশ এবার ফুলের বাহু চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই ফুলের শরীর শিউরে উঠল। ছোটার চেষ্টায় মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল। তার অভিব্যক্তি দেখে অকপট হাসল আবেশ,
“ধরে নিলাম তুই সত্যি কথা বলছিস। বাস্তবেই ডেবিলটাকে ভালোবাসার কোনো কারণ নেই। তবে আমাকে ভালোবাসার তো অনেক কারণ আছে ফুল। তুই কি তাহলে আমাকে ভালোবাসিস?”

ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে ফুল। আবেশের স্পর্শে শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকোষ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে যেন। সহ্য করা দুষ্কর হয়ে উঠেছে,

“ছেড়ে দেও আবেশ ভাই।” ফুলের করুণ আর্তনাদে আবেশের হাত আলগা হয়ে আসলেও পুরোপুরি ছাড়ে না ফুলকে।

“তুই নিজেও খুব ভালো করেই জানিস; আমার স্পর্শ সবচেয়ে নিরাপদ তোর জন্য। তবুও কেন সহ্য করতে পারছিস না? উত্তর দে, তোর মনে কি চলছে? কেন, এই তিনমাসে তোর চোখে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাইনি? এর আগে নাহয় অবুঝ ছিলি। আমার ভালোবাসা সম্পর্কে ধারণা ছিলো না। এখন তো আছে, তারপরও কেন…

ডুকরে কেঁদে উঠল ফুল। নিজে থেকেই আবেশের হাত সরিয়ে দিয়ে কয়েকপা দূরে সরে গেল। কান্নাজরিত কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বলল,
“কারণ এসব হারাম। তোমার ভালোবাসা টা হারাম আবেশ ভাই। আমার মন হারাম জিনিস গ্রহণে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।”

ফুলের কথায় আবেশ থমকে গেল। কয়েক মুহুর্ত লাগল কথাগুলো বিশ্লেষণ করতে। কথাগুলোর অর্থ বোধগম্য হতেই আবেশ পুনরায় ফুলকে টেনে নিজের দিকে ঘোরালো। আবেশের রক্তিম চোখজোড়া দেখে ফুলের গলা শুকিয়ে এলো।
“কি বললি তুই? আমার ভালোবাসা টা হারাম?”

ফুল মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকাল। কি বলবে সে? মাঝে মাঝে সত্য কথাগুলো মিথ্যার তুলনায় বড় দুর্যোগ বয়ে আনে। সেই রকম পরিস্থিতিতেই পড়েছে সে।
“আমি সেভাবে বলতে চাইনি আবেশ ভাই।”
“কিভাবে বলতে চেয়েছিস ফুল? বল আমি শুনছি।”

আবেশের গলা এবার আটকে আসছে। বড়বড় শ্বাস নিচ্ছে, হাতপা কাঁপছে। আবেশের অস্থিরতা বুঝতে পারল ফুল। কিন্তু আবেশের অনুভূতি সম্পর্কে বেখেয়ালি ফুল বুঝে উঠতে পারল না আবেশের মন ভাঙন রোধে কি করা উচিৎ। তবুও অনেক ভাবনা চিন্তা করে ফুল বলল,
“আমি বলতে চেয়েছি যতদ্রুত সম্ভব আমি তাকে ডিভোর্স দিতে চাই। তারপর আমি তোমাকে বিয়ে করে নেবো।”

ফুলের এই একটা কথা আবেশকে শান্ত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ফুল নিজেও এই সিদ্ধান্তে অটল। এতে নিজের আত্মার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ফুলের কিছুই যায় আসেনা। বেহায়া আত্মার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতেও চায়না ফুল। অবশ্য ফুল বিশ্বাস করে তার জন্য আবেশের ভালোবাসা হালাল হয়ে গেলে সেই ভালোবাসা গ্রহণে তার মন আর বাধা দেবেনা। ফুল এও বিশ্বাস করে যাকে তুমি ভালোবাসো তার থেকে যে তোমাকে ভালোবাসে তার সাথে বেশি ভালো থাকা যায়। সেই তোমার যোগ্য এবং পরিশেষে সেই তোমাকে ডিজার্ভ করে। এতে করে পুরো একটা জীবন ভালোবাসা বিহীন অবহেলা পেয়ে কাটাতে হয়না। উদ্যানকে ডিভোর্স দিয়ে ফুল নিঃসংকোচে বিয়ে করে নেবে আবেশকে। ফুলের ভাবনার মাঝেই আবেশ বলে উঠল,
“তোর আর ডেবিলটার নিকাহনামা জোগাড় করে ফেলেছি আমি।”

আচমকা এহেন কথা শুনে হকচকিয়ে গেল ফুল। জোরপূর্বক হেসে বলল, “তাই নাকি কিভাবে পেলে?”

আবেশ এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। সেখান থেকে মানিব্যাগ টা তুলে পকেটে রাখতে রাখতে বলল,
“আকরাম চাচার ছেলে ঢাকায় গিয়েছে। আমি নাম ঠিকানা সহ প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই নিকাহনামা জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছে।”

দম আটকে এলো ফুলের। তবুও হাসোজ্জল গলায় বলল, “সে তো তাহলে অনেক বড় উপকার করল। এবার ফিরলে, তাকে নিয়ে এসো নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবো।”

ফুলের হাসি হাসি মুখ দেখে আবেশও খুশি হয়ে গেল। এই প্রথম হয়তো সে ফুলের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল আবেশ পেছনে ঘুরে বলল, “চল তোকে সী বিচ থেকে ঘুরিয়ে আনি।”

আবেশের কথা শুনে ফুলের চোখজোড়া মুক্তদানার ন্যায় চকচক করে উঠল। কিন্তু পরপরই নিস্তেজ গলায় বলল, “এখন তো রাত।”

দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়াল আবেশ। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “তাতে কি হয়েছে ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার? আমি আছি না? আমার সাথে যখন যাচ্ছিস আনন্দলোকেই যাচ্ছিস। আনন্দলোকে দিন-রাত ম্যাটার করেনা সবসময়ই আনন্দ উপভোগ করা যায়।”

ফুলের ঠোঁটের কোণে স্ফীত হাসি ফুটে উঠল। সেই সঙ্গে মনে পড়ে গেল উদ্যানের বলা কথাটা,
আমার সাথে যাচ্ছিস যখন জাহান্নামেই যাচ্ছিস।

পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে উদ্যান। এতোক্ষণ যাবৎ ফুল আবেশের রুমে কি করছে বুঝে উঠতে পারছেনা। এর আগে আবেশ থাকাকালীন ফুল কখনোই যায়নি আবেশের রুমে গেলেও এতোক্ষণ থাকেনি। আর উদ্যানও আবেশের রুমে কোনো প্রকার স্পাই ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন লাগায়নি। লাগানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে। একপর্যায়ে, দেয়ালে লাগানো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে উদ্যান বলে ওঠে,
“শুধুমাত্র নিজের সমস্যার জন্য তোমাকে ওখানে ফেলে রেখেছি মিসেস ভুল। খুব শীঘ্রই আমাদের আবারও দেখা হবে। আর মাত্র কয়েকমাস তারপর আমি তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে জড়িয়ে নেবো। গেট রেডি ফর দ্যাট।”

তন্মধ্যেই স্ক্রিনে ফুলের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে ফুল আর আবেশ রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে কোথাও যাচ্ছে। এটা দেখে উদ্যান হাতে থাকা রিমোটের বোতাম টিপে স্ক্রিন অফ করে দেয়। তারপর এগিয়ে যায় কী হোল্ডারের দিকে। সেখান থেকে বাইকের চাবি নিয়ে ঘুরে তাকায় ফ্লোরের দিকে; টয়ের সাথে খেলা করছে তান। উদ্যান সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একহাত পকেটে ঢুকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লিভিংরুমে এসে দেখে রিদমও কোথাও একটা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উদ্যানকে দেখে রিদম জিজ্ঞেস করে, “কোথাও যাচ্ছিস?”

উদ্যান মাথা নেড়ে বলে, “হুম শহরের দিকে যাচ্ছি। তুই?”

হাতে বাইকিং গ্লাভস পড়তে পড়তে রিদম বলল, “আমিও সেদিকেই যাচ্ছি। চল একসাথে যাই।”

উদ্যান সম্মতি জানিয়ে, কনসোলের বোতাম টিপে রুমাকে ডাকে। রুমা হাজির হতেই তাকে বলে,
“আমি বাইরে যাচ্ছি। আজকে ফিরবো না, তানের দিকে খেয়াল রাখিস। আমাকে না পেলে আবার মন খারাপ করে বসে থাকবে।”

“আচ্ছা মাস্টার।” রুমা হাল্কা মাথা নিচু করে উদ্যানের রুমের দিকে চলে গেল। রিদম কোণা চোখে তাকিয়ে আছে উদ্যানের দিকে, কয়েকদিন যাবৎ উদ্যানকে বড্ড অচেনা অচেনা লাগে। মনে হয়, আরে এ আবার কে? এতো তেহজিব নয়। এতো কোমল, ভদ্র, মিষ্টভাষী ছেলেটা তেহজিব হতেই পারেনা। রিদমের দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাটা ধরল উদ্যান। বিরবির করে বলল,
“আজকাল সবাই একটু বেশিই তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমার রূপ বেড়ে গেল নাকি বুঝে উঠতে পারছি না।”

উদ্যানের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রিদম। ততক্ষণে উদ্যান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। রিদম এবার দৌড় লাগালো উদ্যানের পিছু পিছু।
“আরে দাড়া একসাথে যাবো।”

বড়বড় পা ফেলে উদ্যানের পাশাপাশি হাটতে সক্ষম হলো রিদম, পার্কিং লটের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। তন্মধ্যে রিদম সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন করে বসল,
“বোকাফুলকে এখনও খুজিস তুই?”

থেমে গেল উদ্যান। ভ্রু কুচকে তাকাল রিদমের দিকে।
“বোকাফুল? এটা আবার কোন ফুল? আর এমন অদ্ভুত ফুলকে আমিই বা খুঁজতে যাবো কোন দুঃখে?”

হেসে উঠল রিদম। উদ্যানের কনফিউজড মুখখানা দেখে বেশ মজা পেয়ে গেল, “আমি কোনো ফুলকে খোঁজার কথা বলিনি। তোর পার্সোনাল মেইডকে খোঁজার কথা বলেছি।”

রিদমের কথায় উদ্যানের দৃষ্টি নিগূঢ় হলো। পুনরায় হাটা ধরে বলল, “খুঁজি, তবে খোঁজ পাইনি এখনও।”

উদ্যানের কথার প্রেক্ষিতে রিদম সরল গলায় বলল, “এখনও খুঁজে চলেছিস? তাও আবার একা একা? লুহান আর মেলোর সাহায্য নিতে পারতি।”

রিদমের কথা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেল উদ্যান, “মেয়েটার নাম বোকাফুল হলো কবে থেকে?”

উদ্যানের প্রশ্নে মুখ বাকালো রিদম, “আরে ওকে শুরু থেকেই বোকাসোকা টাইপের লেগেছে। আমি আবার মেয়েদের ফেইস দেখলেই ক্যাটাগরি অনুমান করতে পারি। তারপর, চার্লসের সাথের সেই ইনসিডেন্টের পর মেয়েটা তো নিজেকে বোকা হিসেবে প্রমাণও করে দিয়েছিল।”

উদ্যান আর কিছু বললো না। ফুল যে বোকা সেটা সেও জানে।

চলবে,,,

[পরবর্তী পর্ব পেতে রেসপন্স করুন]

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply