অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (২২)
সোফিয়া_সাফা
ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের সামনে থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে আবেশ। পাশের চেয়ারে বসে আছে ফুল।
“মিস্টার আবেশ, আপনি দাবী করছেন তেহজিব উদ্যান খানজাদার সাথে প্রিমরোজ আমহৃত ফুল।” থামলেন রেজিস্ট্রার সাহেব। ফুলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “মানে ওনার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আপনার দাখিল কৃত নথিপত্রে নিকাহনামা নেই। সেই সাথে ওনার আইডি কার্ডেও স্বামীর নামের জায়গায় তেহজিব উদ্যান খানজাদার নাম উল্লেখ নেই।”
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল আবেশ। তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
“নিকাহনামা হারিয়ে গেছে। তবুও সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তো ডিভোর্স সম্পন্ন করার আইন আছে, তাইনা? আমি নিজেই ওদের বিয়ের সাক্ষী ছিলাম। প্লিজ আপনি ডিভোর্স রেজিষ্ট্রেশন করুন।”
হাতে থাকা পেপার গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলেন রেজিস্ট্রার সাহেব। তারপর চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে বললেন,
“না ব্যপারটা এতো সহজ নয়। নিকাহনামা ছাড়া বৈধভাবে ডিভোর্স রেজিষ্ট্রেশন করা বলতে গেলে অসম্ভব। আপনারা এক কাজ করুন যেই কাজী সাহেব বিয়ে পড়িয়েছিলেন তার অফিসে যোগাযোগ করুন। তার কাছে অফিস কপি থাকলে সে আপনাকে সত্যায়িত নকল কপি দিতে পারবেন।”
কথাটা শুনে ধাক্কা খেল ফুল। সে কোথায় পাবে কাজীকে? সে তো চেনেও না তাকে। আবেশ কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে বলল,
“আসলে কাজী সাহেব মা*রা গেছেন।”
স্তম্ভিত চোখে আবেশের দিকে তাকাল ফুল। এটা কি বলল আবেশ? একজন অচেনা অপরিচিত মানুষকে মৃত বলে দিল? ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ভ্রুকুটি করে বললেন,
“তাহলে আপনাদের এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি কর্পোরেশনের নিকাহ রেজিষ্ট্রেশন অফিসে যোগাযোগ করুন।”
আবেশ ভারী বিরক্ত হয়ে পড়ল। মাথা টনটন করছে ব্যথায়। যে-কোনো উপায়ে ফুলের সাথে উদ্যানের ডিভোর্স করাতেই হবে। একবার ওদের ডিভোর্স হয়ে গেলে, আবেশ ফুলকে বিয়ে করে নেবে। তারপর আর উদ্যান চাইলেও কিছু করে উঠতে পারবে না। নিজেকে সামলে নিয়ে আবেশ বিক্ষুব্ধ মেজাজে বলল,
“আমরা গিয়েছিলাম সেখানে কিন্তু তারা তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে।”
আবেশ মিথ্যার উপর মিথ্যা বলে যাচ্ছে। ফুল তো হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবশ্য ফুলের এই নিরীক্ষণ দৃষ্টি উপেক্ষা করছে আবেশ। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন,
“আপনারা উপজেলা নির্বাহী অফিস বা স্থানীয় কাজী অফিসে আবেদন করে দেখতে পারেন। তাঁরা পূর্ববর্তী রেজিস্ট্রারের তথ্য এবং কপি খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।”
রাগে ফুসে উঠল আবেশ। এই রেজিস্ট্রার কেন বুঝতে পারছে না এখন এসব কোনো কিছু করাই সম্ভব নয়। তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। আবেশ চাইলেও বন্ধুদের সহয়তায় নিকাহনামা তুলতে পারবে না কারণ আবেশ এই ব্যপারে নিশ্চিত যে এই দুদিনে উদ্যান তার সব বন্ধু বান্ধবের নাড়ি নক্ষত্রের সন্ধান পেয়ে গেছে।
আবেশকে রেগে যেতে দেখে ফুল শান্ত গলায় বলল,
“চলো আবেশ ভাই। আমরা বরং এই বিষয়ে পুরোপুরি জেনেশুনে তারপর আসবো।”
ফুলের নরম কণ্ঠ শুনে চোখ বন্ধ করে নেয় আবেশ। টেবিলের উপর খানিকটা ঝুঁকে নিম্নগলায় বলে,
“নিকাহনামা ছাড়া কি কোনো ভাবেই ডিভোর্স দেওয়া যাবেনা?”
ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ভীষণ ধৈর্যসহকারে বললেন, “যাবে সেই ক্ষেত্রে বিবাহ সংঘটিত হওয়ার পর্যাপ্ত প্রমাণ লাগবে। সেসব আছে আপনাদের কাছে?”
দমে গেল আবেশ। ফুলের এবার অস্বস্তি হচ্ছে। অবচেতন মনে ওড়নার কোনা খামচে ধরল ফুল। তাদের অভিব্যক্তি দেখে কিঞ্চিৎ হাসলেন রেজিস্ট্রার সাহেব।
“বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার কোনো প্রমাণই নেই আপনাদের কাছে। প্রমাণ ছাড়া আইনের চোখে ওনাদের বিয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। আর অস্তিত্বহীন বিয়ের বিবাহবিচ্ছেদ করানো অসম্ভব।”
বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আবেশ,
“আমি প্রমাণ জোগাড় করবো। দরকার হলে নিকাহনামাও আনবো। তারপর তো আর ডিভোর্স দিতে কোনো সমস্যা হবেনা?”
আবেশের গলায় কিছুটা কর্কশতা ধরা পড়ল। তবুও ম্যারেজ রেজিস্ট্রার শান্ত ভাবেই বললেন,
“যদি নিকাহনামায় স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার দিয়ে থাকে। তাহলে শুধু নিকাহনামা হলেই চলবে।”
এতো এতো কন্ডিশন শুনে ফুলের মাথা ঘুরে গেল। সেই সাথে গলাও শুকিয়ে এলো। কিভাবে নিস্তার পাবে সে স্বামী নামক দানবের হাত থেকে? আদৌ মুক্তি মিলবে তো?
“আর যদি নিকাহনামায় স্ত্রীর হাতে তালাক দেওয়ার অধিকার না থাকে তাহলে?” উত্তেজিত কণ্ঠে আবেশ প্রশ্ন করল।
“তাহলে স্ত্রীর তরফ থেকে মানে উনি নিজের পক্ষ থেকে স্বামীর নিকট লিখিতভাবে খুলার প্রস্তাব দিতে পারবেন। স্বামী যদি রাজি থাকে তাহলে নিকাহনামা না থাকলেও সাক্ষী-প্রমাণে ডিভোর্স কার্য পরিচালনা করা সম্ভব। যদি স্বামী রাজি না থাকে; স্ত্রী কোর্টে গিয়ে বিচারিকভাবে শক্তপোক্ত কারণ দেখিয়ে খুলা মামলা করে ডিভোর্স দেওয়ার অনুমতি পেয়ে যাবে।” রেজিস্ট্রারের কথা শুনে ভড়কে গেল ফুল। মামলা কিভাবে করবে? তাহলে তো উদ্যান জেনেই যাবে তারা কোথায় আছে।
ফুল এবার নিজেও উঠে দাঁড়াল। পেছন থেকে ফিসফিস করে বলল,
“দয়া করে এখন থেকে চলো আবেশ ভাই।”
ফুলের কথায় কর্ণপাত করল না আবেশ। এই সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে কিছুতেই যাবে না সে।
“শক্তপোক্ত কারণ বলতে কি কি কারণ হতে পারে?”
প্রতিউত্তরে ম্যারেজ রেজিস্ট্রার কিছু বলার আগেই এক লোক এসে বলে,
“স্যার বাইরে আরও কয়েকজন অপেক্ষা করছে।”
চোখের ইশারায় লোকটাকে চলে যেতে বললেন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার। তারপর আবেশের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এই ধরুন স্বামী ৪ বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ। শারীরিকভাবে অক্ষম বা দু বছর ধরে ভরনপোষণ দিচ্ছে না। বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে কিংবা শারীরিক মানসিক ভাবে নির্যাতন করছে।” এটুকু শুনে ফুলের বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। ঠোঁট চেপে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
সবগুলো বিষয় ভালোভাবে মাথায় ঢুকিয়ে নিল আবেশ। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার এবার আগ্রহ দেখিয়ে বললেন,
“আপনারা চাইলে আমার সাথে নিজেদের বিষয়টা শেয়ার করতে পারেন। বিস্তারিত ভাবে সবকিছু শুনে আমি কোনো না কোনো পরামর্শ দিতে পারবো।”
আবেশ একবার বলতে চেয়েও বলল না। আগে নিকাহনামা জোগাড় করুক তারপর সামনে এগোবে।
চারপাশে রাতের নিস্তব্ধতা। দু একটা ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। পিচঢালা রাস্তায় পাশাপাশি হেটে চলেছে আবেশ আর ফুল। কিছুক্ষণ আগ অবধি আবেশকে অস্থির দেখালেও এখন বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ঠিক স্বাভাবিক নয় কেমন যেন থম মেরে আছে। আবেশ সামনে সামনে হাটছে, ফুল সামন্য পিছিয়ে পড়েছে। হঠাৎ করেই ফুলের চোখ যায় ফুটপাতের উপরে থাকা অস্থায়ী দোকানের দিকে। এক বৃদ্ধ লোক চুড়ি বিক্রি করছে। সমুখে থাকা ভ্যানের উপর রঙ বেরঙের চুড়ির সমারোহে ফুলের দৃষ্টি আটকে গেল। ফুলের শূন্যতা উপলব্ধি করতে পেরে পিছু ফিরে তাকায় আবেশ। দেখতে পায়, ফুল একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফুটপাতের দিকে। ফুলের দৃষ্টি অনুসরণ করে ব্যপারটা বুঝতে পারে আবেশ। ফুলের সামনে হাত নাড়তেই ফুল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে বলল,
“রাত হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি চলো।” বলেই হাটা ধরল ফুল। কয়েক কদম যেতেই ওড়নায় টান পড়ল। হকচকিয়ে থেমে যায় ফুল। চমকিত নয়নে তাকায় পেছনে থাকা আবেশের পানে। ওড়নার কোনা টেনে ধরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আবেশ। ফুলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি অনুমান করে সরল হেসে বলে,
“ওড়না ধরে টানাটানি করা জন্য বখাটে উপাধি দিস না প্লিজ। হাত ধরতে চাইনি বলেই ওড়না ধরলাম।”
আবেশের হাত থেকে খুব আলগোছে ওড়না ছাড়িয়ে নিল ফুল। জড়ানো গলায় বলল,
“ডাকতে পারতে…”
ফুলের কথায় মলিন হাসল আবেশ। ফুলের দিকে হাল্কা ঝুকে ক্ষীণ গলায় বলল,
“পারতাম। তবে কি করবো বল, প্রায়শই তোকে না ডেকেও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হয়। আচ্ছা তুই কি আমার না বলা কথাগুলো বুঝে নিতে পারিস না?”
অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে যায় ফুল। সেও তো চায় আবেশকে নিজের অস্বস্তির ব্যপারে জানাতে। আবেশ কি নিজে থেকেই বুঝে নিতে পারেনা? ফুলকে নুইয়ে যেতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় আবেশ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফুলের জামার হাতা টেনে ধরল আবেশ। বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে যায় ফুলের। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবেশ ফুলকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল চুড়িওয়ালার দিকে। আবেশের মনোভাব বুঝতে পারল ফুল।
“আরে আবেশ ভাই, আমি তো এমনি তাকিয়ে ছিলাম। এগুলোর প্রয়োজন নেই।”
একমুঠ কাঁচের চুড়ি হাতে নিল আবেশ। সেগুলো দিকে তাকিয়েই বলল,
“মাঝে মাঝে আমি তোকে গুলিয়ে ফেলি। মনে হয়, আরে এ তো আমার বুনোফুল নয়। কোথায় গেল আমার সেই চঞ্চলা-অবাধ্য বুনোফুল? যেই বুনোফুল কোনো বাধা নিষেধের তোয়াক্কাই করেনা। সেই বুনোফুল কি হারিয়ে গেল তবে? নাকি সেই বুনোফুলই দামীফুলে পরিনত হয়েছে?”
আবেশের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, আঁড়চোখে তাকাল ফুলের দিকে। ফুলের হরিণীর মতো চোখজোড়া দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল আবেশ।
“যাক নিশ্চিন্ত হলাম তুই-ই আমার বুনোফুল। কারণ এভাবে তাকানোর ক্ষমতা কেবল আমার বুনোফুলের আছে। পুরোপুরি ভাবে এখনও দামীফুলে পরিনত হোসনি।”
চোখ সরিয়ে নিল ফুল। আবেশের কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেছে। একদিকে আছে আবেশ যে ঘুড়িয়ে প্যাচিয়ে বললেও মনের কথা বলে দেয়। আরেকদিকে আছে উদ্যান যে কিনা এখন অবধি ভালো করে কথাও বলেনি, মনের কথা তো দূর।
“শা’লা দানব বের হ আমার মাথা থেকে।” ফুল অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করল,
“কিছু বললি আমাকে?” আবেশের প্রশ্নে হুশ ফেরে ফুলের। মাথা নেড়ে বোকা হেসে বলে,
“আরে না না। তোমাকে কিছু বলিনি। তাড়াতাড়ি চলো।”
ফুলের দিকে চুড়িগুলো বাড়িয়ে দিল আবেশ। “দেখ সাইজ ঠিক আছে কিনা। শুকিয়ে গেছিস তো, অনুমান করতে পারছি না।”
হতাশার শ্বাস ফেলল ফুল। ক্লান্তিমাখা সুরে বলল, “লাগবে না আবেশ ভাই, রাখো এগুলো।”
আবেশ এবার ভ্যানের সাথে কনুই ঠেকিয়ে ফুলের দিকে তাকাল।
“তোর আসামীর মতো অতো বড়লোক না হলেও তোকে চুড়ি কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আছে আমার।”
চোখমুখ কুচকে গেল ফুলের। খানিকটা রেগেও গেল বোধহয়,
“এসব কথা বোলো না তো আবেশ ভাই। কার সাথে নিজের তুলনা করছো? অমানুষের সাথে নিজের তুলনা কোরো না।”
বলতে বলতেই আবেশের হাত থেকে চুড়িগুলো নিয়ে নিল ফুল। তারপর হাতে পড়ে, আবেশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
“ঠিকঠাক আছে, চলো এবার।”
হাটা ধরল ফুল। পেছন থেকে আবেশ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো নিজের বুনোফুলের দিকে।
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টার মতো বেজে যায়। খাওয়া দাওয়া করে নিজের রুমে এসেছে ফুল। আবেশও চলে গেছে নিজ কক্ষে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত সে। এখন গভীর ঘুমের প্রয়োজন।
দরজা বন্ধ করে খাটের উপর বসল ফুল। কাঁধের ক্ষতটা সাড়েনি এখনও। আসার সময় ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। এমন সময় মনে পড়ল ব্যালকনি থেকে শুকনো কাপড় গুলো আনা হয়নি।
হাই তুলতে তুলতে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল ফুল। এখানে লাইট নেই, অবশ্য লাইটের প্রয়োজনও নেই। নিচেই দোকানপাট আছে। বলতে গেলে সারাদিনই মানুষের আনাগোনা থাকে। কাপড় গুলো এনে বিছানার উপর রাখল ফুল৷ দুদিনের কাপড় জমা হয়ে ছিল। অসুস্থতার জন্য ধুতে পারেনি, আজকেই ধুয়ে দিয়েছে। এখানে আসার পরেরদিন সকাল হতেই, আবেশ ফুলের জন্য ৫ সেট জামাকাপড় এনে দিয়েছে। বলতে গেলে নিজের জমানো সব টাকাই আবেশ এদিক সেদিক ভেঙে ফেলছে। বিষয়টা নিয়ে ফুলের মনঃক্ষুণ্ন হলেও কিছু করার নেই।
কাপড়গুলো ভাঁজ করার সময় ফুলের নজর আটকে গেল একটা কামিজের উপর। সেটা দেখে শুকনো ঢোক গিলল ফুল। পালিয়ে আসার সময় এটাই পরণে ছিল ফুলের। কাপা কাপা হাতে জামাটা স্পর্শ করতেই চোখ গেল ছেঁড়া অংশের দিকে। জামাটা ঠিক কিভাবে ছিড়েছে জানা নেই ফুলের। ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় ফুল। আজেবাজে চিন্তা করবে না বলেও নিজের মনকে মানাতে পারেনা,
“দানবটা যদি আমাকে খুজেই পেতো তবে কি আস্ত রেখে যেতো? আমাকে শান্তিতে থাকতে দিতো? দিতো না।” কথাগুলো ভেবে নিজের মনকে স্বান্তনা দিল ফুল।
চোখের পলকেই কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি পেয়েছে আবেশ। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সেখানেই থাকে। সারাদিন ফুল একাই থাকে বাসায়। সামনের ফ্লোরে থাকা প্রতিবেশী আন্টি প্রায়ই আসে ফুলেদের ঘরে। আজও তাই। সেই আন্টির নাম সফুরা বেগম। বিকেল হতেই ফুলের সাথে আড্ডা দিতে চলে এসেছেন। ফুলও প্রতিদিনের মতোই চা বানিয়ে আপ্যায়ন করছে,
“তুমি চা খুব ভালো বানাও ফুল।”
চায়ের প্রশংসা শুনে মৃদু হাসল ফুল। আনমনেই বলে ফেলল,
“আসলে আমার হাজব্যান্ড চা খুব লাইক করে। চা ছাড়া চলেই না। তাই আর…”
বলতে বলতেই থেমে গেল ফুল। বুঝতে পারল মারাত্মক ভুলভাল কথা বলে ফেলেছে। সফুরা বেগম নিজেও আহাম্মক বনে গেলেন,
“কিন্তু আবেশ তো চা খায়না। সাদাতকে পড়ানোর সময় আমি লক্ষ্য করেছি, চা দিলে আবেশ ছুয়েও দেখেনা।”
অস্বস্তিতে পড়ে গেল ফুল। হাত কচলাতে লাগল, ভুলেই গিয়েছিল ছেলেকে পড়ানোর সুবাদে আবেশ সম্পর্কে খুটিনাটি অনেক কিছুই জানেন সফুরা বেগম। হ্যাঁ, এখানে আসার কিছু দিন পর থেকেই রাতের বেলা সফুরা বেগমের ছেলে সাদাতকে পড়ায় আবেশ। ফুলের অভিব্যক্তি দেখে সন্দিহান চোখে তাকায় সফুরা বেগম। ফুল থেমে থেমে বলল,
“আসলে উনি শুধু আমার হাতের চা খায়। আর কারো টা খায়না।”
ফুলের কথায় হেসে ওঠে সফুরা বেগম, “তাই বলো, আমি তো ভাবলাম আবারও গুলিয়ে ফেলেছো। তুমি তো মাঝেমধ্যেই উল্টো পাল্টা বলে ফেলো।”
হাসতে কষ্ট হচ্ছে ফুলের। তবুও হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। কিভাবে বোঝাবে সে উল্টো পাল্টা বলে ফেলে না বরঞ্চ সোজা সাপ্টা সত্যি কথাগুলো বেফাঁস বলে ফেলে। মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই তো।
(সোলার এস্টেট)
বাড়ির পেছনের দিকে কাঁচে ঘেরা সানরুমে উপস্থিত আছে বাড়ির সকলে। সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। কানে এয়ারফোন গুজে কাউচে হেলান দিয়ে বসে আছে উদ্যান। বাকি সবাই আছে পাশেই।
“তুই হাসছিস তেহ?”
আকস্মিক রিদমের কথা শুনে সবাই একসাথে উদ্যানের দিকে তাকায়। ততক্ষণে উদ্যানের হাসি মিলিয়ে গেছে। লুহান আফসোসের সুরে বলে,
“উফফ রিদম, চিল্লালি কেন? আমার কানে কানে বলতে পারতি। মহামূল্যবান সিনটা মিস করলাম।”
লুহানের কথা যেন কানেই নিল না রিদম। তার দৃষ্টি এখনও উদ্যানের দিকেই নিবদ্ধ। ইদানীং উদ্যানের বিহেভিয়ারে চেইঞ্জ এসেছে। তাও আবার পজিটিভ চেউঞ্জ, নইলে অকারণেই হাসার পাবলিক উদ্যান নয়। উদ্যানের হাসি দেখা আর মরুভূমির বুকে বৃষ্টিপাত হওয়া সমান। উদ্যান তো কারো কথায় পাত্তা না দিয়ে চোখ বন্ধ করে একভাবে বসে আছে। রিদম এবার উদ্যানকে মৃদু ঝাকিয়ে বলল,
“কিরে? ভূতে ধরেছে তোকে?”
চোখ মেলল উদ্যান, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল আবারও সেই বিরল হাসির রেখা। তাজ্জব বনে গেল উপস্থিত সবাই। তারা কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে নাকি মাতাল মস্তিষ্ক হ্যালুসিনেশন করছে? সোহম তো মাথায় হাত রেখে অভিনয় করে বলল,
“আমার জন্য কেউ ডাক্তার আন। নইলে বিয়ে দিয়ে দে। ভুংভাং দেখছি।”
মেলো তো বারবার নিজের চোখ ডলে ডলে উদ্যানকে দেখছে।
“আরে কেউ ফোন বের কর। ছবি তোল।” অনির কথা শুনে লুহান নিজের ফোন বের করল যেইনা ছবি তুলতে যাবে ওমনি উদ্যান বলে উঠল,
“তোদের নাটক গুলো সানসেট দেখার চেয়েও এন্টারটেইনিং। তোরা এক কাজ কর, কাজ বাজ ছেড়ে দিয়ে যাত্রাদলে যোগ দে। ওয়েট আমিই তোদেরকে চাকরিচ্যুত করছি।”
উদ্যানের কথা বলার ধরন শুনে হা হলে গেল সবাই। চোয়াল খসে পড়ার উপক্রম। লুহান বলে ওঠে,
“তুই ঠাট্টা করছিস? সিরিয়াসলি? কেউ আমার গাল টেনে দে। আমি এসব বিশ্বাস করিনা।”
উদ্যান ঠোঁট বাকিয়ে লুহানের দিকে তাকিয়ে ত্যাড়া ভাবে বলল,
“তুই চাইলে আমি তোকে স্পেশাল লাঠি ট্রিটমেন্ট দিয়ে বিশ্বাস করাতেই পারি। করাবো?”
লাঠি ট্রিটমেন্টের কথা শুনে চুপসে গেল লুহানের মুখ। মাথা নেড়ে বলল,
“স্যরি মাস্টার।”
চলবে,,,
[পরবর্তী পর্ব পেতে রেসপন্স করুন]
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৭
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৩