অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (২৯)
সোফিয়া_সাফা
রাতের সময়, সোলার এস্টেটে ফিরে এসেছে ফুল ও অনিলা। এতোক্ষণ যাবত ডান্স থিয়েটারে বসে ডান্স শো এনজয় করেছে দুজন। অনিলা ভেবেছিল খুব একটা মজা হবেনা কিন্তু ফুলের সঙ্গ ভীষণ উপভোগ্য ছিল। খুব মজা করেছে দুজন, যার দরুন সময়ের দিকেও খেয়াল ছিলো না। অনি অবশ্য লুইসকে কল দিয়ে বেশ কয়েকবার খবরা-খবর নিয়েছে। অনিলা হাসিখুশি আছে শুনে, সে আর খোঁচায় নি।
“কোথায় ছিলে তোমরা দুজন?”
হঠাৎ প্রশ্নে অনিলা ও ফুল থেমে গেল। ড্রইংরুমে বসে থাকা মেলো প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ফুলের চেহারায় ক্লান্তির রেশ স্পষ্ট, তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে।
“আমরা ডান্স শো দেখতে গিয়েছিলাম।” ফুল জবাব দিল।
মেলো থম মেরে বসে রইলো। অতঃপর বসা থেকে উঠে ফুলের ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বুকে হাত গুটিয়ে রুক্ষ গলায় বলল,
“তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।”
একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় ফুল। বার দুয়েক চোখের পলক ফেলে বলে, “কিসের কথা বলছেন ম্যাম?”
মেলোর চোখেমুখে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। যেন ফুল তার মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে ফেলেছে।
“তুমি তেহকে মারো নি?”
ফুলের চোখ বড় হয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে গেছে অনিলাও,
“কেন মেরেছো তুমি তেহকে?” চাপাস্বরে প্রশ্ন ছুড়ল মেলো,
ফুল অত্যন্ত নীচু গলায় বলল, “সে আবেশ ভাইকে মেরেছিল, তাই আমিও তাকে মেরেছি। বোঝাতে চেয়েছি কাউকে আঘাত করলে কেমন লাগে।”
বিকট শব্দে হেসে উঠল মেলো। বিদ্রুপ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “বোঝাতে পেরেছো ওকে?”
চমকিত নয়নে মেলোর পানে তাকায় ফুল। ওর বিস্ময় পূর্ন দৃষ্টি উপেক্ষা করে ওর হাত ধরে ফেলে মেলো। একটা চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“ওর মতো পাথর মানবকে ব্যথা বোঝাতে চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক বলে তুমি মনে করো? ফেরার পথে আমি ওর শার্টে রক্তের দাগ দেখেছি। চিকিৎসা না করা হলে ক্ষত গুলো ঘায়ে পরিনত হবে। পঁচে যাবে ওর শরীর।”
বড়সড় ধাক্কা খেল ফুল। হাতের মুঠোয় থাকা চাবিটার দিকে একনজর তাকিয়ে পুনরায় মেলোর ফর্সা মুখশ্রীতে দৃষ্টি স্থাপন করলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আপনারা কেন ডাক্তার ডাকেন নি উনার জন্য? উনি নাহয় কেয়ারলেস, আপনারা তো উনার বন্ধু। চিকিৎসা করাতে পারতেন না?”
“বন্ধু?” বিড়বিড় করে শব্দটা উচ্চারণ করে মেলো। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ভারিক্কি গলায় বলে,
“সে আমাদের মাস্টার, আর মাস্টারের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার রাইট নেই আমাদের।”
পুনরায় ফুলের দিকে তাকায় মেলো। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে, অত্যন্ত নির্দয় গলায় বলে, “তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, মাস্টারকে আঘাত করার অপরাধে খু’ন করে ফেলতাম। যেহেতু সেটা করতে পারছি না সেহেতু নিজের তৈরীকৃত ক্ষতে মলম ও তোমাকেই লাগাতে হবে।”
হাতে থাকা চাবিটা চেপে ধরল ফুল। মেলোর কথাগুলো আত্মসম্মানে লেগেছে। এভাবে না বললেও মলম লাগাতে যেতে রাজী হয়ে যেতো ফুল।
“আমি যেতে পারবো না। সে মরে গেলেও আমার কিছু যায় আসেনা।” বলতে বলতেই ফুলের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। নিঃশ্বাস আটকে গেল গলায়। তবুও নিজের অস্থিরতা সাইডে রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
রাগে মেলোর মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে ফুলের গালে ঠাটিয়ে চড় মেরে দিতে।
“তুমি যার ক্ষমতার বলে আমার সাথে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছো তারই মৃত্যুতে তোমার কিছু যায় আসেনা বলছো? তার মৃত্যু তো দূর সেই প্রত্যাশা করার জন্যও তোমাকে আফসোস করাতে পারি আমি।”
নিজের ফোনটা ফুলের মুখ বরাবর ধরে মেলো, “আমার একটা ফোন কলে তোমার আবেশ ভাইয়ের ট্রিটমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের মাস্টারকে তো আমরা যেনতেন উপায়ে বাচিয়েই নেবো কিন্তু তোমার আবেশ ভাইকে কিভাবে বাচাবে তুমি? বাচাতে না পেরে আফসোস হবেনা?”
বিস্ময়ে ফুলের মুখ হা হয়ে গেলো। এই মেয়ে কি পা’গল নাকি?
“তুমি যাবে নাকি আমি…
“যাচ্ছি।” একটু জোর দিয়েই বলল ফুল। ছোট শ্বাস ফেলে সোফার দিকে চলে যায় মেলো। সেখান থেকে একটা বক্স এনে ফুলের আরেক হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাবলীল গলায় বলে,
“ডাক্তার মেডিসিন দিয়ে গেছে। এখানে আছে সব।”
বক্সটা নিয়ে উল্টো ঘুরে সিঁড়িতে পা রাখে ফুল। তন্মধ্যেই মেলো বলে ওঠে,
“১৭ই জুলাই আমাদের মাস্টারের বার্থডে।”
কথাটা শুনে ফুলের হাটার গতি কমে গেল। ঘাড় বাকিয়ে মেলোর দিকে তাকালো। এতোক্ষণ যাবত জমে থাকা সকল রাগ, বিরক্তি, ক্লান্তি সব যেন এই এক বাক্যে বিলীন হয়ে গেছে। ফোনের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে মেলো বলল,
“অনলি থার্টি–টু মিনিটস লেফট বিফোর হি টার্নস থার্টি–টু।”
ফুলের অভিব্যক্তি নমনীয় হয়ে গেল মুহুর্তেই।
“আপনারা উনাকে উইশ করবেন না?”
এক সেকেন্ডের জন্য কুটিল হাসি ফুটে ওঠে মেলোর ঠোঁটে। “বললাম না উনার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অনুমতি নেই আমাদের। তোমাকে যেহেতু ওয়াইফি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেহেতু তোমার উচিৎ আমাদের সবার হয়ে ওকে উইশ করে দেওয়া।”
নৈশব্দে ঘাড় সোজা করে হাটা ধরে ফুল। পেছন থেকে মেলো সাবধানী গলায় বলে, “ওর রুমের ডোর লক থাকতে পারে। ওই চাবিটা ইউজ করে খুলতে পারবে।”
মাথা নেড়ে দোতলায় চলে আসে ফুল। অনিলা বিদায় নিয়ে নিজের রুমের দিকে হাটা ধরে। বুকভরে শ্বাস নিয়ে ধীরপায়ে হেটে উদ্যানের রুমের সামনে দাঁড়ায় ফুল। ধাক্কা দিয়ে দেখে দরজা আসলেই লক করা। চাবি ইউজ করে দরজা খুলতে উদ্যত হতেই থেমে যায় সে। মনে পড়ে যায় উদ্যানের জন্মদিনের কথা। তার উচিৎ একটু ধীরেসুস্থে প্রস্তুত হয়ে তারপর যাওয়া। উদ্যানের রুমের পাশের দরজার দিকে তাকায় ফুল। এই দরজা ব্যবহার করেও ফুলের রুমে আসা-যাওয়া যায় আবার উদ্যানের রুমের ভেতরে থাকা দরজা ব্যবহার করেও আসা-যাওয়া যায়।
পা ঘুরিয়ে বাইরের দরজা পেরিয়ে নিজের রুমে ঢোকে ফুল। ভেতরের দৃশ্য যেন রূপকথার বই থেকে টেনে আনা। সকালে ঝুম বৃষ্টি দেখায় এতটাই ডুবে ছিল যে রুমের ভেতরটা খেয়াল করার অবকাশই পায়নি। উপরন্তু মনও ছিল এলোমেলো। হাতের চাবি ও বক্সটা খাটের ওপর রেখে বিস্ময়ে পুরো রুমটায় চোখ বোলায় ফুল। খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে গোলাপি পর্দাকে দুলিয়ে দিচ্ছে। মেঘ গুড়গুড় শব্দে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই রুমটা নিছক একটা রুম নয়; এ যেন ফুলের মনের গোপন কোণে লুকিয়ে রাখা বহুদিনের ছবি। যেমন ভেবেছে ঠিক তেমন। যেমন কল্পনা করেছে ঠিক তেমন। মনের ক্যানভাসে আকা কাল্পনিক রুমের বাস্তব চিত্র দেখে সে যেন পলক ফেলতেও ভুলে গেছে।
গোলাপি রঙের নরম শেডে সাজানো দেয়াল। কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট সাদা বুকশেলফে সারি সারি গল্পের বই। খাটের মাথার দিকটা গোলাপি ফেয়ারি-লাইটে মোড়া; মৃদু আলোয় পুরো রুমে এক ধরনের নিরাপদ উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সিলিং থেকে ঝুলে থাকা পাতলা নেটের ক্যানোপি বাতাসে হালকা দুলে রুমটাকে যেন একেবারে বার্বি-ডলের রাজ্য বানিয়ে তুলেছে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা গোলাপি হেয়ারব্রাশ, পারফিউম, সবকিছুতেই যেন শিশুসুলভ মিষ্টত্ব।
গোলাপি-সাদার টাইলসকৃত ফ্লোরে একজোড়া গোলাপি খরগোশ আকৃতির স্লিপার পড়ে আছে। আর জানালার ধারে রাখা ছোট্ট ফুলদানি থেকে মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে গোলাপি রঙের পিওনি ফুলগুলো।
“পিওনি?” আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়ে ফুল। ভাবে, দুদিন ধরে এই রুমে থাকার পরেও কিভাবে সে এগুলো খেয়াল করেনি? সকালে তো এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল? নিজের মনের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখার ফলেই কি এগুলো চোখে পড়েনি তার? ফুলগুলোয় নাক ডুবিয়ে, নিশ্বাসের সাথে মিষ্টি ঘ্রাণ টেনে নেয় ফুল।
“আমার নাম প্রিমরোজ হলেও আই লাইক পিওনি।”
বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতেই মনে পড়ে যায় ডায়েরিতে এমন কিছুই লিখেছিল ফুল। স্থির চোখে পিওনি গুলোর দিকে তাকিয়ে কেঁপে ওঠে সে।
“এই ঘর, এই সাজানোর ধরন। সবকিছুই তো আমার কল্পনার অংশ। কেউ না জেনেও কিভাবে ঠিক সেভাবেই ফুটিয়ে তুলেছে? আর এখানে এই পিওনি গাছই কেন; অন্য গাছ নয় কেন? তবে কি সে আমার ডায়েরি… একমুহূর্তের জন্য দম নিতে ভুলে গেল ফুল। ব্যপারটা মাথায় আসতেই মাথা ঘুরে গেল। দুপা পিছিয়ে লম্বা শ্বাস নিল,
“তোর ডায়েরি কেউ কিভাবে পাবে? ওয়েট, পাবে নাই বা কেন? লুকিয়ে তো রাখিস নি। তাই বলে দানবের হাতেই পড়তে হলো?”
মাথা ঝেড়ে অবান্তর চিন্তা ভাবনা দূর করার চেষ্টা করতেই ফুলের কানে ‘পেটাল’ ডাক ভেসে আসে। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক তাকায় ফুল কিন্তু উদ্যান তো দূর ওর ছায়াও চোখে পড়েনা। মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয় ফুল,
“কুল ডাউন ফুল।” বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। একহাত কোমড়ে রেখে আরেক হাত নাড়িয়ে বাতাস করতে লাগলো। আচানক রুমের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে নাকি তার অস্থিরতা উত্তাপ ছড়াচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না। উদ্যানের ভঙ্গিতে ফুল ঠোঁট নেড়ে বলল,
“হেই অ্যালেক্স, সেট এসি টু মাইনাস সিক্সটিন ডিগ্রিস।” ফুল মশকরা করেই বলেছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই রুমের তাপমাত্রা কমতে লাগল। দুহাতে নিজেকে আকঁড়ে ধরে ফুল। এই তাপমাত্রায় ৫ মিনিট থাকলে নির্ঘাত ফুল কুল ডাউন হয়ে বরফে পরিনত হবে। ফুলের ঠোঁট কাপছে, উপরের দাঁত নিচের দাঁতের সাথে বাড়ি খাচ্ছে। ও পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে ফিরে আসে। চোখমুখ কুচকে গেল ওর। শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে,
“এই অ্যালেক্স তো ভারী ডেঞ্জারাস, বললেই বরফ বানিয়ে ফেলবে?” ফুলের মনে পড়ে গেল মেলোর বলা কথাগুলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর মাত্র কয়েক মিনিটই বাকি আছে। দুদিন ধরে শাওয়ার নেয়নি ফুল, পুরো একদিন তো ঘুমে ঘুমে কেঁটেছে। আজ সকাল থেকে অনশন করে ছিল, ফলস্বরূপ ওয়াশরুমেও যেতে হয়নি, তারপর তো বাইরেই ছিল এতোক্ষণ যাবত, ভেবেছিল এখন শাওয়ার নেবে কিন্তু ঠান্ডা হাওয়া সেই ভাবনাকে উড়িয়ে নিয়েছে। তবুও ড্রেস চেইঞ্জ করা দরকার, আশেপাশে তাকিয়ে ফুল অনুমানের উপর ভিত্তি করে হাটা ধরে। এতোকিছু যেহেতু আছে, কাপড়চোপড়ও থাকবে।
ডানদিকের বিশাল ওপেন-ওয়ার্ড্রোবের সামনে এসে থামে ফুল। সেদিকে তাকিয়ে ওর চোয়াল খসে পড়ার উপক্রম। ওয়ার্ড্রোবের স্বচ্ছ কাচের ভেতর সারি সারি সাজানো:
নিখুঁত ভাঁজে রাখা থ্রি-পিস, সিল্কের নাইটওয়্যার, শাড়ি, টপস, স্কার্ট, জিন্স। নিচের ড্রয়ারগুলোয় সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো ক্ষুদ্র অ্যাকসেসরিজ। যেগুলো দেখে গাল গরম হয়ে গেল ফুলের। কাঁপা কাঁপা হাতে আন্দাজে একসেট থ্রিপিস নিয়ে সামনে ঘুরে দাঁড়ালো। হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় গুলো পড়বে। ওয়াশরুম খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হলো না।
ওয়াশরুমের দরজাটাও হালকা গোলাপি শেডের, ওপরে সোনালি ফ্রেমে খোদাই করা কারুকাজ। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ফুলের চোখ আরও বড় হয়ে যায়। এ যেন রূপকথার প্রাইভেট স্পা। দেয়াল থেকে শুরু করে মেঝে, এমনকি লাইটের রঙেও সেই সূক্ষ্ম গোলাপি প্যাস্টেল আভা। ওয়াশরুমের তিন দিকজুড়ে বড় বড় মিরর; গোল্ডেন লাইটিং করা।
বামদিকে, একটি বিশাল জ্যাকুজি, দুধ-সাদা রঙের, গোলাপি এলইডি আলোয় জ্বলজ্বল করছে। জ্যাকুজির পাশে উঁচু স্ট্যান্ডে: বাথ সল্টের জার, গোলাপি সুগন্ধি মোম, ছোট ছোট তোয়ালে রোল করে সুন্দরভাবে রাখা। কয়েকটি মিনিমালিস্ট গোল্ডেন শেলফ, যেখানে প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের বডি ওয়াশ, শ্যাম্পু রাখা।
ডানদিকে, একটি বিশাল ভ্যানিটি কাউন্টার। গোলাপি মার্বেল টপ, তার ওপর ফেয়ারি লাইটের ডেকোরেশন।
আফটার বাথ অ্যাকসেসরিজ, হেয়ার স্টাইলিং টুল। মেকআপ অর্গানাইজারে ব্রাশ, টুথপেষ্ট সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাজিয়ে রাখা। মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে ফুল। এখন সে শাওয়ার নেবেই নেবে।
প্রায় আধা ঘন্টার মতো শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে ফুল। ওর পরণে জলপাই রঙের থ্রি-পিস, চুলে শুভ্র রঙের তোয়ালে প্যাচানো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে গেল ফুল। অলরেডি সাড়ে বারোটার মতো বেজে গেছে। তাড়াহুড়ো করে চুলের তোয়ালে সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায় ফুল। নিজেকে একটু দেখে মাথায় ওড়না টেনে খাটের কাছে চলে আসে। চাবি, বক্স হাতে নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক শুরু হয়ে যায়। মস্তিষ্ক বলছে,
“যাসনা, যাসনা, মনস্টারের গুহায় যেচে পড়ে কে যায়? বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়। মেলোর কাছে গিয়ে বলে দিবি, ‘গিয়েছিলাম কিন্তু মনস্টার টা মলম লাগাতে দেয়নি।’ মেলো মিথ্যা ধরতে পারবে না কারণ মনস্টারের বিহেভিয়ার তো এমনই। প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ বারবার হাতছাড়া করিস না।”
মস্তিষ্কের কথার প্রতিরোধ করলো হৃদয়, “হ যা শুয়ে থাক, আমি আবারও তোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবো। মনস্টার নাহয় ব্যথা পায়না, তুই তো পাস তোকে শান্তি দেবো না আমি। তার শরীরের ক্ষত বাড়বে আর তোর হৃদয়ের দহন বাড়বে। সে তো ব্যথা নামক অনুভুতির উর্ধ্বে কিন্তু তার ভাগের ব্যথা তুই অনুভব করবি।”
তপ্ত শ্বাস ফেলল ফুল। মস্তিষ্কের কথামতো আঘাত করেছিল দানব টাকে এবার মনের কথা শুনে মলম লাগিয়ে দিয়ে আসবে। ব্যস মন-মস্তিষ্ক দুই খুশি হয়ে যাবে। শান্তি দেবে একটু তাকে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করে দরজার লকে চাবি ঢোকায় ফুল। দরজা খুলে ভেতরে তাকায়, এখান থেকে উদ্যানের বেড দেখা যাচ্ছেনা। ইতোমধ্যেই ফুলের অস্থিরতা বেড়ে গেছে কয়েক ধাপ। শরীর কাঁপছে থরথর করে, নিজের মনের উদ্দেশ্যে ফুল আওড়ায়, “একটু রহম কর, শান্ত থাক, এতো উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? মেরে ফেলবি আমায়?”
ভেতর থেকে উত্তর আসে, “সে কাছে এলেই তোর সব অনুভূতি গুলো এলোমেলো হয়ে যায়। মূলত এখানে আমার দোষ নেই। মানুষের অনুভূতি তার মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে, মন শুধু সেই অনুভব, অনুভূতি গুলো ব্যাখ্যা করে।”
রুষ্ট হয়ে মস্তিষ্কের উদ্দেশ্যে ফুল বলে, “বাহঃ অনুভূতি তৈরী করে দিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে বলে মেরে ফেলার ধান্দায় আছিস তাইনা? ধড়িবাজ কোথাকার।”
মস্তিষ্ক বলে, “অনুভূতি তো লিম্বিক সিস্টেমে অটোমেটিক তৈরী হয়, কিন্তু সিদ্ধান্ত তো তোর হাতে।”
আঙুল চেপে নাকের নিচের ঘাম মুছে নেয় ফুল। হাতের তালুও ঘেমে যাচ্ছে উৎকণ্ঠায়। পা টিপে টিপে খাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ফুল। সমুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ফুলের সারা শরীর শিউরে উঠল। সময় যেন থেমে গেল কিয়ৎক্ষণের জন্য। খাটের উপর বসে আছে এক সুশ্রী রমণী। পরণে সাদামাটা হলদে রঙের শাড়ি, গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা, চোখে মোটা কাজল, পেছনে শক্ত খোপা; খোপার ফাঁকে গোঁজা বেলিফুল। নারীটিকে দেখে অবাক হওয়ার মতো হলেও ফুলের মাঝে শিহরণ জাগে পাশে বসে থাকা উদ্যানকে দেখে। রমণীর কাঁধে মাথা রেখে অনড় হয়ে বসে আছে সে। তাদের দুজনের শূন্য দৃষ্টি ফুলের উপর স্থির। উদ্যানের চাহনি দেখে ফুলের গলা শুকিয়ে এলো, লাল লাল চোখে একভাবে তাকিয়ে আছে ফুলের দিকে। গায়ে শীতল কাঁপুনি বয়ে যায় ফুলের। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ফুলের উপস্থিতিতে তাদের দুজনের মধ্যে কেউ সন্তুষ্ট হয়নি। যেন ফুলের অযাচিত আগমন তাদের ব্যক্তিগত কাজে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। ফুল ঠোঁট নেড়ে শব্দ বের করার চেষ্টা করতেই, উদ্যান প্রাণহীন গলায় বলে,
“স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড।”
থমকে গেল ফুল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমি তো এসেছিলাম মেডিসিন…
বাক্য শেষ করার পূর্বেই উদ্যান সোজা হয়ে বসল। রমণীটি তখনও অদ্ভুত চোখে ফুলের দিকেই তাকিয়ে আছে।
“তোমাকে আমি পিছিয়ে যেতে বলেছি। এক পা-ও সামনে এগোবে না।”
ফুল নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এক মনে ভেবে চলেছে, কে এই নারী? কি তার পরিচয়? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো উদ্যান কেন এই নারীর কাধে মাথা রেখে বসেছিল? আর সেই দৃশ্য দেখে ফুলের দমবন্ধ হয়ে কেন আসছে? বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা কেন হচ্ছে? সবটুকু সাহস একত্রিত করে প্রশ্ন ছোড়ে ফুল,
“আমি চলে যাবো তার আগে বলুন উনি কে?”
ফুলের ভাঙা কণ্ঠে ছোড়া প্রশ্নে ভ্রু কোঁচকায় উদ্যান। মুখাবয়বে বিরক্তি ঠিকরে পড়ছে। ফুল আবারও নিজের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করল,
“উনাকে তো এর আগে কখনও দেখিনি। কে উনি?”
“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। যেতে বলেছি আমি।” উদ্যানের কণ্ঠে এবার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল।
কণ্ঠরোধ হয়ে এলো ফুলের উদ্যানের নিষেধ অগ্রাহ্য করে আরও দুপা এগিয়ে যেতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় উদ্যান, “শেষ বারের মতো বলছি সামনে এগোবে না। নিজের রুমে যাও।”
অদ্ভুত এক জেদ চাপলো ফুলের মনে। কিছুতেই এই নারীকে উদ্যানের কাছে রেখে, চলে যেতে রাজী নয় সে। বদ্ধ রুমে এই নারীর সাথে একান্তে কি এমন কাজ আছে উদ্যানের? কোনো কাজ থেকে থাকলেও ফুলের উপস্থিতিতে কেন সেই কাজ করা যাবেনা? থেকে যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার জন্য অজুহাত দেখিয়ে ফুল বলল,
“আমি এখানে একটা কাজে এসেছি। সেটা করে তার পরেই যাবো।”
রাগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল উদ্যানের। নিয়ন্ত্রণে জিভের অগ্রভাগ দিয়ে গালের অভ্যন্তরীণ গাল স্পর্শ করে; চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে, শান্ত গলায় বলে,
“তুমি এই রুমে ঢুকলে কিভাবে? দরজা তো লক করা ছিল। ওয়েট চাবি কে দিয়েছে তোমায়?”
কান্না পেয়ে গেল ফুলের। এই রমণীর সাথে দরজা লক করে উদ্যান একান্তে সময় কাটাচ্ছে। তার উপর সে কিভাবে এসেছে সেই প্রশ্ন করছে? নিজের কাজে বিন্দুমাত্র লজ্জা পাচ্ছে না? কাঁপা কাঁপা হাতে বক্সটার দিকে ইশারা করে মিছে হাসল ফুল। উদ্যান যেমন প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে তেমনি ফুলও উদ্যানের প্রশ্ন উপেক্ষা করল,
“আমার করা ক্ষতে মলম লাগাতে এসেছি।”
কথাটা শুনে চোখ মেলে শান্ত চোখে তাকায় উদ্যান।
“তুমি মলম লাগাতে এসেছো? লাইক সিরিয়াসলি! আমি মরে গেলেও আদৌ তোমার কিছু যায় আসে?”
উদ্যান যেন অজান্তেই ফুলের বুকের উপর ছুড়ি চালাচ্ছে। বুকের বা পাশ চেপে ধরে হাপাতে লাগে ফুল।
“আমার কিছু যায় আসলেই বা আপনার কি? আমাকে কষ্ট দিতে আপনি নিজেকে আঘাত করতেও পিছপা হবেন কি?”
উদ্যানের ভ্রু কুচকে গেল। “তুমি আমার ধারণার চেয়েও অধিক রহস্যময়ী। আমাকেই ধাঁধায় ফেলে দেও মাঝেমধ্যে।”
“আপনি কি আমাকে মলম লাগানোর অনুমতি দেবেন?” কথাটা ফুল নারীটির দিকে তাকিয়ে বলল।
“নোহ।” উদ্যানের সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি শুনে ফুল অবাক চোখে তাকায় তার দিকে।
“তুমি আমাকে আরও আঘাত করতে চাইলে; করতে পারো। কিন্তু মলম লাগানোর অনুমতি নেই তোমার।”
ফুলের চোখজোড়া চিকচিক করে উঠল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তাহলে ডাক্তার ডাকুন। সে এসে ট্রিটমেন্ট করে যাবে।”
উদ্যান এসে ফুলের সামনে থামল। হাত থেকে বক্সটা নিয়ে বলল, “তুমি যেতে পারো এবার।”
ফুলের নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। চোখে পানি টইটম্বুর, ওষ্ঠদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে। নিজের সবটুকু দিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
“আমি চলে গেলে আপনি উনাকে দিয়ে মলম লাগাবেন নিশ্চয়ই?”
ফুলের এহেন মন্তব্যে যারপরনাই অবাক হয়ে যায় উদ্যান। একবার খাটে বসে থাকা নারীর দিকে তাকিয়ে পরপরই ফুলের চোখের দিকে তাকায়। ঘাড় কাত করে বলে,
“নট ব্যাড, ওকে দিয়ে মলম লাগানোই যায়।”
বজ্রপাত হলো ফুলের মাথায়। ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। উদ্যানকে পাশ কাটিয়ে নারীটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল,
“এই কে আপনি? এই ঘরে কি করছেন?”
উত্তর দিলো না নারীটি। শুধু শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো ফুলের দিকে। সেই চাহনিতে খেই হারায় ফুল। চেপে ধরে নারীটির বাহু,
“ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কে জানেন? আপনার চোখ তুলে ফেলবো আমি।”
নারীটি নিরুত্তর থাকলেও হুট করেই ফুলের হাতে টান পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সপাটে চড় পড়ে ফুলের বাম গালে। চড়ের তীব্রতায় ফুলের ঠাই হয় মেঝেতে। তান বসে ছিল সেখানেই, ফুল গিয়ে পড়েছে তার গায়ের উপর। তবুও ফুলের সাইনোফোবিয়া ট্রিগারড হয়নি। মূলত আশেপাশের সবকিছুই অর্থহীন হয়ে গেছে ফুলের কাছে। উদ্যানের রাশভারী কণ্ঠস্বর পুরো রুমে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
“তুই কে সেটা ওর জানার প্রয়োজন নেই। শুধু জেনে রাখ ওর দিকে চোখ তুলে তাকালে আমি তোর চোখ তুলে ফেলবো।”
থাপ্পড়ের আঘাতে ফুলের মাথা ভনভন করছে। চোখের সামনে টা ঝাপসা হয়ে গেছে। ব্যাথা পেয়েছে তানও, তবুও উদ্যানের রাগ টের পেয়ে নীরবে ব্যাথা সয়ে গেছে। ঘেউ ঘেউ করে প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ায় ফুল। উদ্যান নিজের ঘাড় চেপে ধরে রাগ সংবরণের চেষ্টা করছে। নারীটি এবার উদ্যানের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। তার অভিব্যক্তি দেখে ফুলের মাঝে এক উন্মাদনা ভর করল। উদ্যান এই মহিলার সামনে ওর গায়ে হাত তুলে ঠিক করেনি।
“আপনি এতো তাড়াতাড়ি নিজের আসল রূপে ফিরে আসবেন, ভাবিনি।”
ফুলের তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে উদ্যানের ভেতরে থাকা জানোয়ার টা বেরিয়ে আসার দ্বারপ্রান্তে। উদ্যান তেড়ে গিয়ে ফুলের ভেজা চুলে হাত ঢুকিয়ে খামচে ধরল,
“তুমি কিন্তু আমাকে উত্যক্ত করছো।”
উদ্যানের শার্টের বুকের অংশ চেপে ধরে ফুল। উগ্র মেজাজে বলে, “আপনি আমাকে উত্যক্ত করছেন, এই মেয়েকে বের করুন নইলে আমি ধ্বংস করে ফেলবো সব।”
দাঁতে দাঁত চেপে ফুলের বাহু টেনে ধরল উদ্যান। ওকে সম্পূর্ণ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“ওকে সরি বলো।”
পাগলের মতো হেসে উঠল ফুল, “সরি বলবো? কিসের জন্য? আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্য?”
“হ্যাঁ তাই। সরি বলবে কিনা বলো।”
“না বলবো না।”
প্রচন্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে উদ্যান। ঠাস করে ফুলের একই গালে চড় বসিয়ে দেয়। এবারের থাপ্পড় টা আগের থেকেও জোরালো ছিল, ফুলের ঠোঁটের কোণ কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। নরম ফর্সা গালে উদ্যানের আঙুল দেবে যায়। ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে ফুল। মাথা ঝিমঝিম করছে, তবুও যেন উদ্যান ক্ষান্ত হলো না। ফুলকে টেনে তুলে দরজার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। উদ্যানের হাত ছোটানোর চেষ্টা করতে লাগলো ফুল। কান্না মাখা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,
“ছেড়ে দিন, আমি যাবো না। আমি সরি বলবো উনাকে… সরি, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। দরকার হলে পা ধরবো… আমাকে থাকতে দিন এখানে। আমি আপনাদের একদম বিরক্ত করবো না। চুপচাপ এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকবো। ছেড়ে দিন আমাকে।”
থামল না উদ্যান রুম থেকে ফুলকে বের করে দিয়ে দরজা লক করে দিল। বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল ফুল। চাবিটা উদ্যানের রুমেই পড়ে গেছে। দরজার সাথে ঠেস দিয়ে গগনবিদারী আর্তনাদে ফেটে পড়ে ফুল,
“আমার সর্বনাশ করবেন না। উনার থেকে দূরে থাকুন। আমি সহ্য করতে পারছি না। মরে যাবো আমি।”
পাগলের মতো নিজের চুল টানতে লাগল ফুল। চেচিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। দিশাবিশা হারিয়ে উঠে দাঁড়ায় ফুল,
“নাহ আমাকে কিছু করতেই হবে।”
হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে রুম থেকে বেরিয়ে যায় ফুল। একছুটে গিয়ে দাঁড়ায় মেলোর রুমের সামনে। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দরজায় নক করতে শুরু করে। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেয় মেলো। বাইরে ফুলকে ছটফট করতে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। ফুলের গালে চড়ের দাগ দেখে বুকে হাত গুটিয়ে বলে,
“দেখো আমি যা করেছি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য করেছি। তোমাকে আমি কিছু বললে তেহ আমাকে পানিশট করতো তাই বুদ্ধি খাটিয়ে আজকের দিনে তোমাকে ওর রুমে পাঠিয়েছি।”
কোনো কিছু শোনা কিংবা বোঝার মতো অবস্থায় নেই ফুল। কাতর গলায় বলে,
“ম্যাম আপনার কাছে কি আর কোনো চাবি আছে? আমাকে দিন প্লিজ।”
ফুলের জড়ানো কণ্ঠ শুনে চমকে যায় মেলো। তার চেয়েও হতভম্ব হয় ফুলের আবদার শুনে। থাপ্পড় খেয়ে এসেও এই মেয়ে চাবি চাইছে?
“তুমি চাবি দিয়ে কি করবে?”
গলা শুকিয়ে এসেছে ফুলের, দৃশ্যপটে উদ্যান আর রমণীটিকে ঘিরে আজেবাজে কল্পনা ভেসে উঠছে।
“মহিলা টা কে ম্যাম?”
“সারার কথা বলছো”
“উনার নাম সারা?”
“হ্যাঁ পুরো নাম আকসারা। সুবিধার্থে সারা বলে ডাকে সবাই।”
“মেয়েটা কে হয় মাস্টারের?”
ফুলের আগ্রহ দেখে খটকা লাগে মেলোর। আজব মেয়ে, মেলো ভেবেছিল থাপ্পড় খেয়ে এসে তাকে কড়া কথা শোনাতে এসেছে।
“জানিনা কে হয়।”
আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে ফুলের হৃৎপিণ্ড সংকুচিত হয়ে যায়। হাসফাস করতে করতে বলে,
“থাক সেসব কথা, চাবি দিন আমাকে।”
বেকুব বনে গেল মেলো। ঘুরেফিরে সেই চাবিই কেন চাইছে মেয়েটা? থাপ্পড় খেয়ে মন ভরেনি নাকি মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে?
“শোনো, আজ ওর জন্মদিন আর এই দিনে ওর রুমে ঢোকার পারমিশন নেই। আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো থাপ্পড় খাওয়ার জন্য।”
তড়পাতে লাগল ফুল, তার অভিব্যক্তি দেখে বিস্মিত হচ্ছে মেলো, “তোমার কি খুব বেশিই থাপ্পড় খেতে মন চাইছে? তুমি বললে তেহুর হয়ে আমিই কয়েকটা থাপ্পড় মেরে দিই?”
চোখ কটমট করে তাকায় ফুল। অশ্রু ভরা চোখে রাগ দেখে মেলো হাল্কা হেসে বলে, “বুঝেছি তেহুর থাপ্পড়েই মজা পেয়েছো। আমিও কিন্তু বেশ ভালোই থাপ্পড় মারতে পারি। টেস্ট করে দেখতে পারো।”
ফুল বুঝতে পারল এই মেলো আসলে ড্রাংক। সেই জন্যই উল্টো পাল্টা বকছে।
“আপনি আমাকে চাবি দেবেন কিনা বলুন।”
হঠাৎ করেই ফুলের গলা জড়িয়ে ধরে মেলো। বাচ্চাদের মতো বলে,
“আমার কাছে আর চাবি টাবি নেই বেইবি। সেই চাবি টাই তো লুহানকে পাম দিয়ে এনেছিলাম। ওর কাছে আরও এক্সট্রা চাবি থাকতেও পারে। কিন্তু আমি আর চাবি আনতে যেতে পারবো না। হাতির বাচ্চা টা সুযোগ পেলেই জ্বালায় আমাকে। তুমিই বলো আমার মতো নোংরা মেয়ের সাথে মানায় ওকে? কেনো যে বোঝেনা বাল।”
ফুলের কান্না থেমে গেছে। কৌতুহল ভরা চোখে তাকিয়ে আছে মেলোর দিকে। কিছু মূহুর্তের ব্যবধানেই হুশ ফেরে মেলোর। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রুক্ষ গলায় বলে,
“যাও তো এখান থেকে।”
ফুল কিছু বলার আগেই বিকট শব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
চলবে,,,
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৮
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৭
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন গল্পের লিংক