অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (১৬)
সোফিয়া_সাফা
জঙ্গলের শেষপ্রান্তে অবস্থিত ঝিলের ধারে বসে আছে উদ্যান। চারপাশের পরিবেশ একদম নিস্তব্ধ; গা ছমছমে। ফুলের ঠোঁটের খুব কাছাকাছি গিয়েও থেমে যায় উদ্যান। কানে ভেসে আসে ফুলের বলা সেই কথাটা,
“নিজেকে প্রোটেক্ট করতে না পারলে শেষ করে ফেলবো; তবুও শেষ নিশ্বাস অবধি কলঙ্ক মুক্ত থাকব।”
উক্ত কথাটাই যেন পাথর মানবটিকে থামিয়ে দিয়েছে। ভাবতে বাধ্য করেছে। তন্মধ্যেই উদ্যানের চুলের ডগা থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে ফুলের ঠোঁটের উপর, সঙ্গে সঙ্গেই ফুল পানি উগড়ে দিল। উদ্যানের মুখ ফুলের ঠোঁটের সন্নিকটে থাকায়, পুরো পানিটাই ছিটকে পড়ল উদ্যানের মুখের উপর। ঘটনার আকস্মিক ঘূর্ণিতে উদ্যান দূরে সরে গেল। বিদ্বেষের গলায় বলল,
“ইউ ব্লাডি মিস্টেক! হোয়াট দ্য হেল ডিড ইউ ডু।”
কাশতে কাশতে ফুল ঝাপসা চোখে আশেপাশে তাকাল। ঠান্ডায় যেন শরীর অবশ হয়ে গেছে। তবুও নিজের শরীরটাকে টেনে তুলে উঠে বসল ফুল। মাথা চেপে ধরে নিম্নগলায় বলল,
“কি করেছি আমি?”
উদ্যান নিজের মুখ মুছতে মুছতে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“তুই আমার মুখের উপর থু দিয়েছিস! এতোবড় সাহস তোর। নিজেকে কি ভাবিস? চুনোপুঁটির প্রাণ নিয়ে আমার সাথে লাগতে আসিস। ইচ্ছা তো করছে তুলে আবারও পানিতে ছুড়ে মারতে।”
চোখ মুখ কুচকে উদ্যানের কথার মানে বোঝার চেষ্টা করে ফুল, কিন্তু বুঝতে পারেনা। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় উদ্যান। নিজের জামাকাপড় ঝেড়ে গম্ভীর গলায় বলে,
“জীবনে বাইকে ওঠা হয়নি?”
যদিও উদ্যান ফুলের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেনি তবুও ফুল বুঝতে পারে মনস্টার টা তার উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন ছুড়েছে,
“ওঠা হয়েছে, তবে এভাবে বসার অভ্যাস নেই।” উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ফুল, কিন্তু পারছেনা। পা দুটো যেন অসার হয়ে গেছে।
উদ্যান এবার ভ্রু কুচকে ফুলের দিকে তাকাল, শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলল, “তো কিভাবে বসার অভ্যাস আছে?”
ফুল উত্তর দিলোনা। সে হাতে গোনা কয়েকবার আবেশের সাথে বাইকে উঠেছিল। অবশ্য তার বাইকে ওঠা নিয়ে আবেশের ছিল তীব্র অনীহা। যদি পড়েটড়ে যায়, যে কয়বার ফুল বাইকে উঠেছে সেই কয়বার আবেশ অনেক স্লো বাইক রাইড করেছে আর বারবার বলেছে, ‘ভালো করে ধরে বস, পড়ে যাসনা।’ বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াতেই ফুল নিজের বাহুতে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল। পানিতে পড়ার পূর্বে রেলিঙের সঙ্গে ধাক্কাটা বেশ জোরেশোরেই লেগেছিল। হাতের আঙুল দ্বারা কাধ স্পর্শ করতেই পুরো শরীর নড়ে উঠল। জায়গাটা থেতলে গেছে, সম্ভবত র*ক্তও বের হচ্ছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছেনা।
হঠাৎ করেই উদ্যান তেড়ে গেল ফুলের দিকে। শক্ত হাতে চেপে ধরল ফুলের বাহু। ব্যথার ফুলের প্রাণ ওষ্ঠাগত,
“এই মেয়ে তুই আমার কথার জবাব দিস না কেন? একটা কথা বারবার রিপিট করতে হয় কেন?”
“উহ ছাড়ুন লাগছে আমার।” ককিয়ে উঠল ফুল, সে ব্যথা পাচ্ছে শুনে উদ্যান আরও খুব করে চেপে ধরল জায়গাটা,
“কথা রিপিট করতে; এর থেকেও বেশি যন্ত্রণা হয় আমার। লাস্ট বারের মতো ওয়ার্ন করছি, এক কথা একবার বলব, সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স করবি।”
ব্যথায় দুপা পিছিয়ে গেল ফুল। চোখ থেকে টুপটাপ পানি গড়িয়ে পড়ছে। এতোটা যন্ত্রণা হচ্ছে যে মুখ দিয়েও শব্দ বেরোচ্ছে না শুধু শরীরটা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। উদ্যান সেভাবেই ফুলকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। তাকে বাইকের পেছনের সিটে বসিয়ে উদ্যান বাইকের সামনের সিটে বসল। ফুল একহাতে ক্ষতস্থান চেপে দাঁতে দাঁত পিষে বসে আছে। প্রচন্ড শীত করছে, কেন এতো শীত করছে? ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে কিছু একটা ভেবে উদ্যান পেছনে ঘুরে তাকায়, তার নির্জীব চোখের চাহনি ফুলকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। একে তো শীতকাল, তার উপর জামাকাপড় ভেজা। ঠান্ডায় দাঁত লেগে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে উদ্যান থাবা বসায় ফুলের বুকের উপর। ঘটনার আকস্মিকতায় ফুল পেছনের দিকে সরে যেতে চাইল। তার আগেই ফুলের ওড়নাটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করল উদ্যান,
“স্থির থাক।”
হাত দিয়ে বুকের উপরিভাগ ঢাকার চেষ্টা করে ফুল তেজি গলায় বলল, “এটা কি ধরনের অসভ্যতা? ওড়না দিন বলছি।”
তার এহেন তেজি কণ্ঠ ভালো লাগল না উদ্যানের,
“লো ইওর ভয়েস। আদার ওয়াইস, এটা দিয়েই গলা প্যাচিয়ে ধরবো। মেরে ফেলবো না, তবে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরিয়ে আনবো। যাবি ঘুরতে?”
শুকনো ঢোক গিলল ফুল। কণ্ঠ খাদে ফেলে বলল,
“দয়া করে ওড়না টা দিয়ে দিন।”
উদ্যান কিছু বলল না। সামনের দিকে ফিরে সোজা হয়ে বসল। ফুল তো বড়বড় চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কয়েক মুহুর্ত পেরিয়ে যেতেই উদ্যান ওড়না টার দুপ্রান্ত দুহাতের মুঠোয় নিয়ে পেছনের দিকে ছুড়ে মারে। ফুল ব্যপারটা বুঝে ওঠার আগেই উদ্যান ওড়না টা ফুলের কোমড়ে প্যাচিয়ে তাকে নিজের পিঠের সাথে মিশিয়ে নিল অতঃপর ওড়নাটা নিজের কোমড়ে বেধে শান্ত গলায় বলল,
“আপদ বেধে নিলাম।”
উদ্যানের উষ্ণ পিঠের সংস্পর্শে আসতেই ফুলের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। তাদের দুজনের শরীরই তো ভেজা তবুও এতো উষ্ণ কেন দানবটা? সে উষ্ণতা হারিয়েছে বলেই কি দানবটাকে এতোটা উষ্ণ লাগছে? ফুল যেন বাক্যহারা হয়ে পড়ল। কেন এমন লাগছে? মনে হচ্ছে কোনো কিছু প্রবল বেগে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুটে বেড়াচ্ছে। শিরা উপশিরা গুলো টনটন করছে যেন। ভাবমায় মগ্ন ফুল বুঝতেই পারলো না উদ্যান কখন বাইক স্টার্ট দিয়েছে। পুরো ৩ মিনিট নির্বিঘ্নেই কাটে এরপর থেকেই অস্বস্তির শুরু হয়। উদ্যান রাস্তায় ফোকাস করতে পারছে না, ফুল যেন ক্রমশঃ তার পিঠে ঢলে পড়ছে। বিপত্তি বাধে তখন যখন ফুলের হাত উদ্যানের কোমড় জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা যেন উদ্যানের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে, আষ্টেপৃষ্টে উদ্যানের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।
“এই হাত সরা।” উদ্যান দৃঢ় গলায় বলল,
ফুলের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না, সে আরও শক্ত হাতে উদ্যানের সিল্কের শার্ট খামচে ধরল। উদ্যান এবার না পেরে বাইকের ব্রেক কষলো। ওড়নার বাধন খুলতেই ফুল ঢলে পড়ল বাম দিকে। হকচকিয়ে গেল উদ্যান, একহাতে কোনোমতে ফুলকে পড়া থেকে বাচাল। মেয়েটার শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছে। জ্বর এসেছে বোধহয়। উদ্যান কপালে হাত দিয়ে চেক করার প্রয়োজন বোধ করল না। এমনিতেও ফুলের শরীরের তাপমাত্রা সে টের পেয়েছে। উদ্যান এবার সম্পূর্ণ ফুলের দিকে ঘুরে গেল। একহাতে মেয়েটাকে সামলে ভ্রু কুচকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল, সে তো মনে মনে ঠিক করেছিল; মেয়েটাকে উল্টো ঘুরিয়ে বসাবে। যাতে তাকে বিরক্ত করার জন্য জড়িয়ে টরিয়ে ধরতে না পারে।
কিন্তু এই মেয়েটা তো নিজের হুশেই নেই। একে ঘুরিয়ে বসানো তো দূর পেছনে বসানো টাও মারাত্মক রিস্কি। উদ্যান পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখল রাত ১২ টা ছুইছুই। আর কিছুটা রাস্তাই বাকি আছে, উদ্যান ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ফুলের মুখের উপর ধরল। মেয়েটার চেহারা রক্তশূণ্য হয়ে ভূতের ন্যায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ভেজা চুলগুলো খোপা করা ছিল যদিও এখন ঢিলে হয়ে প্রায় খুলে যাওয়ার উপক্রম। উদ্যান জানেনা সে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল যখন বুঝতে পারল, সে অকারণেই তাকিয়ে আছে তখন সে চোখ সরিয়ে নিল। এরইমাঝে চোখ পড়ল ফুলের কাধে। জামার অংশটা র*ক্তে ভেজা। উদ্যান প্রচন্ড বিরক্ত হলো,
“উঁহু এ মেয়ে নয়, আস্ত এক আপদ। আপদ নিয়ে ঘুরছি; ভাবতেও অবাক লাগছে।”
কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে ফুলকে সামনে এনে বসায় উদ্যান। পূর্বের ন্যায় ওড়না দিয়ে নিজের সাথে বেঁধে নেয়। তারপর বাইক স্টার্ট দেয়, এবার যেন ফুল অসীম সুখ খুঁজে পায়। উদ্যানের শরীর থেকে নির্গত প্রখর পুরুষালি ঘ্রাণে ফুলের নারী অবচেতন মন জেগে ওঠে। এই ঘ্রাণ যে খুব আপন বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ঘ্রাণের উপর একান্তই তার অধিকার। একি হচ্ছে ফুলের সাথে? কেন হচ্ছে? কেন এতো সুখানুভব হচ্ছে? কেন এই তীব্র গন্ধটা তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ সজাগ করে তুলছে? কেনো অন্তঃকরণে তীব্র অস্থিরতা জাগছে। একি উন্মাদনা ভর করছে?
এ যে সুখ নয়, এ যে অসুখ! তবে কি ফুলকে অসুখে পেয়েছে? ফুলের অবচেতন হাত পুনরায় উদ্যানের কোমড় ঘিরে ফেলল। উদ্যান এবার চরম বিরক্ত হলো। জন্মের শিক্ষা হয়েছে, আর কখনও এই মেয়েকে নিজের বাইকে ওঠানোর পাপ করবেনা।
“একটু আগে আমাকে অসভ্য বলে, এখন নিজে এসব কি করছিস? আমি সভ্য অসভ্যের ব্যাখ্যা জানিনা। তবে আমার মনে হচ্ছে তুই চরম অসভ্যতা করছিস আমার সাথে। সভ্যতার সীমা কতটুকু জানা নেই তবে তুই অসভ্যের সীমানা পেরিয়ে গেছিস; নিশ্চিত। এখানেই থেমে যা।”
থামল না ফুল। উদ্যানের কথাগুলো যেন তার কর্ণগুহরে পৌঁছালোই না। একভাবে লেপ্টে রইলো উদ্যানের প্রশস্ত বুকের মাঝে। মুখ গুজে নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিতে লাগল সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রখর গন্ধটাকে। উদ্যানের কি হলো জানা নেই সে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিল। উদ্দেশ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছানো। এদিকে গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুল গুঙিয়ে উঠল, চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মারাত্মক অসুখে ধরেছে তাকে। একি হয়ে গেল? অন্যদিকে ফুলের অবাধ্য চুলগুলোও যেন আজকে উদ্যানকে জ্বালানোর সুযোগ হাতছাড়া করছেনা। ভেজা চুল বাধনহারা হয়ে উদ্যানের মুখমন্ডলে আছড়ে পড়ছে। উদ্যানের অনুভুতি হীন দেহও যেন আজকের এই অঘটন এড়িয়ে যেতে পারছে না। কিছু মুহুর্ত পেরোতেই উদ্যানের মুখাবয়ব রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। প্রথমবারের মতো তার কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। ফুলের ডলাডলি তে উদ্যানের শার্টের দুটো বোতাম খুলে গেছে। ফুল এবার শার্টের ফাঁক দিয়ে উন্মুক্ত বক্ষপটে নাক ঘষতে লাগল।
নিজের বক্ষপিঠে ফুলের নরম অধরের ছোয়া পেয়ে উদ্যান দ্বিতীয় দফায় সেই শব্দতরঙ্গ শুনতে পায়। যেই শব্দতরঙ্গ সে ফুলের কানে কিস করার দিন শুনতে পেয়েছিল। চোখ বড়বড় হয়ে গেল দানব টার, রাগ আর অস্থিরতা মিলেমিশে মাথায় বিশাল চাপ তৈরি করেছে। সহ্য করতে না পেরে বাইকের স্পিড স্লো করে ফেলল। চিৎকার করে বলল,
“স্টপ অল দিজ।”
বাইক থামিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল উদ্যান। ফুল এখনও জ্ঞানশুন্য। তাকে দেখে নেশাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। জ্বর আর বিষ ব্যথা তাকে কাবু করে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলেছে। তবে উদ্যানের পক্ষেও আর সহ্য করা সম্ভব না। কিছু তো আছে যা তাকেও ঠিক থাকতে দিচ্ছেনা। সেই শব্দতরঙ্গ বড্ড অদ্ভুত, সে বোঝাতে পারবে না। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? হুম হচ্ছে, সেদিনও হয়েছিল; ফুল রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেদিন তার মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। এই জনশূন্য রাস্তায় তার শ্বাসকষ্ট হলে কি করবে সে? নেবুলাইজার তো দূর, সাথে করে তো ইনহেলারও আনেনি। উদ্যান ক্ষুব্ধ হয়ে ফুলকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বাইক থেকে নামায়। রাগে দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়েছে উদ্যান, ফুলকে কাধে তুলে রাস্তা ছেড়ে পাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল সে। এদিকের জঙ্গল ততটা ঘন না হলেও গাছপালা দিয়ে আবৃত। শহর থেকে বেশি দূরে নয়। আর ৫ মিনিটের রাস্তা পেরোলেই শহর। উদ্যান এটা করতে চায়নি। তবে সেও উপায়হীন, ইতোমধ্যেই তার শ্বাস আটকে আসছে। যখন তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।
উদ্যান একটা বড়সড় গাছের নিচে এনে ফুলকে বসিয়ে দিল। মেয়েটা শীতে রীতিমতো কাপছে। গুনগুনিয়ে কান্না করছে আর অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করছে। চাঁদের ক্ষীণ আলো গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে সামান্যই আলোকিত করে রেখেছে চারপাশ। উদ্যান হাটু গেড়ে ফুলের সামনে বসল, ওড়না টা দিয়ে ফুলকে গাছের সাথে বেধে ফেলল। তারপর মৃদু গলায় বলল,
“কখন জানো ফোনটা পকেট থেকে পড়ে গেছে। আর এসব তোর জন্যই হয়েছে, আমার তো মনে হয় তুই-ই হাতাহাতি করে ফোনটা ফেলে দিয়েছিস। বড্ড জ্বালিয়েছিস। শাস্তি হিসেবে এখানেই পড়ে থাক, আমি ওদের কাউকে পাঠিয়ে দেবো তোকে নেওয়ার জন্য। এখানে বেঁধে রেখে যাচ্ছি, যাতে পালিয়ে যেতে না পারিস।”
ফুল ক্ষীণ চোখে তাকিয়ে থেকে বা দিকে হেলে পড়ল। উদ্যানের কথাগুলো বোধগম্য হলো না তার। উদ্যান দ্রুত উঠে দাঁড়াল তারপর আবারও কিছু একটা মনে করে বসে পড়ল। ফুলের চুলগুলো সতর্কতার সাথে সামনে এনে বুকের উপর ছড়িয়ে রাখল। তার পর আর একমুহূর্ত নয়; উদ্যান একপ্রকার দৌড়ে রাস্তায় এসে পড়ল। রাস্তার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে হাটুতে ভর দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। হাপিয়ে গেছে সে, এতোটা দূর্বল কেন লাগছে নিজেকে? রাস্তার পাশে থাকা গাছগাছালির দিকে তাকাল উদ্যান। বহু কষ্টে সেদিকে এগিয়ে গেল। চিহ্ন রাখা প্রয়োজন নইলে ফুলকে খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হবে। সে বেশ কিছু গাছের ডালপালা ভেঙে নিচে বিছিয়ে রাখল। কতগুলো রাস্তার মাঝেও রাখল। তারপর হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘাম মুছে বাইকে উঠে বসল,
খানজাদা নিবাসের পরিবেশ প্রতিদিনকার মতোই শান্ত। বাড়ির সদস্যরা প্রত্যেকে নিজনিজ কক্ষে ঘুমে তলিয়ে আছে। ব্যতিক্রম বলতে শুধু আবেশই আছে যে এখনও ঘুমায়নি। ছেলেটা একা একাই ফুলের জন্মদিন উৎযাপন করছে। হ্যাঁ আজ ফুলের জন্মদিন! যেখানে ফুল থাকাকালীন ঘটা করে তার জন্মদিন পালন করা হতো। সেখানে তার অনুপস্থিতিতে যেন সবাই ভুলেই গেছে আজ এই বাড়ির একমাত্র ফুলের জন্মদিন। সেই ফুল যেই ফুলের হাসিই ছিল এই বাড়ির প্রাণ এই বাড়ির রঙ। কিভাবে ভুলে গেল সবাই? সবার কথা বাদ ফুলের মা কিভাবে ভুলে গেল?
সমস্ত ভাবনা সাইডে রেখে আবেশ মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটল। সামনেই ফুলের ছবি রাখা, আবেশ একটুকরো কেক নিয়ে ছবির সামনে ধরল,
“ফুল, শুভ জন্মদিন।”
আবেশের চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে এলো। কেকের টুকরোটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
“এসব খেলে মোটা হয়ে যাবি। তখন তোকে ভালো দেখাবে না ফুল।”
নীরবতা নেমে এলো রুম জুড়ে। আবেশ উচ্চস্বরে হেসে উঠল, “কিছু বললি না? তোকে কেক খেতে দিলাম না, তবুও কিছু বললি না? এই তুই চুপ কেনো আছিস? তোর চুপচুপ থাকাটা সাজে না। কথা বল না, বলবি না? ভাব দেখেচ্ছিস খুব! কথা বলিস না। রাগও দেখাস না, বায়না ও করিস না। এতো বড় কবে হয়ে গেলি?”
মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল আবেশ, “আমি তোর জন্য গিফট এনেছি। এবার আর ভুলে যাইনি। মনে আছে আমার,”
আবেশ একটা গিফট বক্স বের করে ফুলের সামনে রাখল। “এই নে তোর গিফট, এবার অন্তত কথা বল। একবার আমার দিকে তাকিয়ে হাস। বেশি না একবার। আমি আর পারছিনা জান; তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। নম্বরটাও ট্র্যাক করে সঠিক লোকেশন পাইনি। প্রত্যেকবার উল্টো পাল্টা লোকেশন দেখায়। আমি কি করবো বল? শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে আছিস বলেছিস কিন্তু কোন দিক থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে আছিস সেটা কিভাবে বুঝবো? তবুও আমি খুঁজছি তোকে ফুল। আমি তো জানি আমার ফুল আমার অপেক্ষায় আছে।”
“আবেশ ভাই?” হঠাৎ কারো ডাকে আবেশ চকিত নয়নে পেছনে ঘুরে তাকায়। তবে বরাবরের ন্যায় এবারও সে হতাশ হয়। এটা ফুলের কণ্ঠস্বর নয়, ফুল আসেনি; ফুল তাকে ডাকেনি। এটা তো মেহেক,
“আবেশ ভাই তুমি কাঁদছো?” মেহেকের প্রশ্নে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত চোখের পানি মুছে নেয় আবেশ। ধরা গলায় বলে, “তুই এতো রাতে কি করছিস?”
“আমি তো এডমিশন টেস্টের জন্য স্টাডি করছিলাম। তোমার চিৎকার শুনে দেখতে এলাম।” মেহেক কিছুটা এগিয়ে এলো আবেশের দিকে। “তুমি ফুলের জন্য কাঁদছো আবেশ ভাই?”
অন্যসময় হলে আবেশ মেজাজ দেখিয়ে মেহককে কড়া গলায় দুখান কথা শুনিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করতো না। তবে আজকের পরিস্থিতি অন্যরকম। আজ ফুলের জন্মদিন,
“হুম, আজ ওর জন্মদিন তো তাই আরকি।”
একটু আশকারা পেয়ে মেহেক খাটের উপর বসে পড়ল। স্বভাবতই পায়ের উপর পা তুলে দুহাত বেডের উপর রেখে পেছনের দিকে কিছুটে হেলে গেল, “তাই নাকি? তার মানে ফুল আমার চেয়ে বেশ কয়েক মাসের ছোট।”
“হুম।” আবেশ চুপ হয়ে গেল। মেহেক একটু সাহস জুগিয়ে বলে উঠল, “তুমি ফুলকে খুব ভালো বাসো তাইনা আবেশ ভাই?”
আবেশ ম্লান হাসল। মেহেকের দিকে তাকাতেই মেহেক পায়ের উপর থেকে পা নামিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো সোজা হয়ে বসল।
“ভালোবাসি বলে আর কি হবে? সে তো আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে। ভালোবাসি বললেই কি সে আসবে আমার কাছে? জানিস তো মেহেক, এই পর্যায়ে এসে উপলব্ধি করতে পারলাম; রূপবান, গুনবান হওয়ার চাইতে ভাগ্যবান হওয়াটা কতোটা জরুরী। আমি ভীষণ দূর্ভাগা রে মেহেক।”
আবেশের কথাটা শুনে মেহেকের কিছুটা মন খারাপ হলো, “এভাবে বলোনা আবেশ ভাই। ফুলের তো বিয়ে হয়ে গেছে। যেভাবে হোক হয়েছে তো। যদিও আমরা জানিনা সেদিন ঠিক কি হয়েছিল। তবে এটা তো সত্যি, সে সম্পর্কে এখন তোমার ভাবী হয়। উদ্যান ভাই যেমনই হোক, ফুল তার স্ত্রী। তাই ফুলের জন্য ভালোবাসা পুষে রাখলে দিনশেষে তোমাকেই যন্ত্রণা….
“গেট আউট।” হঠাৎ ধমকে কেঁপে উঠল মেহেক। রাগে ফোঁসফোঁস করছে আবেশ। আচ্ছা মেহেক কি সুযোগ পেয়ে একটু বেশিই বলে ফেলল?
“তোর সত্য বাণী শুনতে চাইনি আমি মেহেক। এসব লজিক নিজের পড়াশোনায় খাটাবি। আমার উপর নয়।”
“আবেশ ভা….
“চুপপপ! আর কিছু শুনতে চাইনা, বের হ।”
মেহেক মাথা নিচু করে নিল। ঠোঁট ভেঙে কান্না পেলেও কান্না গুলোকে গিলে দ্রুতপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে আসতেই দেখল রেহানা বেগম দরজার পাশে থাকা অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেক কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেহানা বেগম উল্টো ঘুরে চলে যায়। মেহেকও নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই আচমকা একটা কিছু উড়ে এসে তার মাথার উপর পড়ে। মাথার সাথে লেগে জিনিসটা অন্যপাশে গিয়ে পড়েছে। মেহেক আবেশের রুমের দিকে তাকাতেই দেখল ছেলেটা সব জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করছে, তার মাথার মধ্যে শুধু একটা শব্দই ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেটা হলো ‘ভাবী’ কি খারাপ শোনাচ্ছে শব্দটা। আবেশ ইতোমধ্যেই শব্দটাকে ঘৃনা করে ফেলেছে।
আবেশ রক্তচোখে মেহেকের দিকে তাকাতেই মেহেক একটা শুকনো ঢোক গিলে ছুট লাগায়। পথিমধ্যে আবারও সেই জিনিসটার সাথে হোঁচট খায় মেহেক। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দেখে সেটা একটা গিফট বক্স। মেহেক ঝুকে গিয়ে সেটা হাতে তুলে নেয়। গিফট বক্সটা ফেরত দিতে ফের আবেশের রুমের দিকে আসার পূর্বেই আবেশ ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিল। মেহেক আর কি করবে? গিফট বক্সটা সাথে নিয়েই নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
১০ মিনিটের মধ্যে উদ্যান এসে পৌঁছায় নিজের গন্তব্য। শরীর ভালো নেই তার। ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা, রাত এখন ১২ টা ৪৭ মিনিট, ১৭ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং টার দিকে তাকিয়ে হাসফাস করে ওঠে উদ্যান। বাইক টা সেখানে ফেলে রেখেই ক্লান্ত শরীর টাকে টেনে নিয়ে যায় ভেতরে। লিফটে উঠে ১৭ নম্বর বাটনে ক্লিক করতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। লিফটে আপাতত সে একাই। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে উদ্যানের, শত চেষ্টা করেও সে আর স্থির থাকতে পারেনা। লিফট টা উপরের দিকে যেতে শুরু করার সাথে সাথেই উদ্যান জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে।
চলবে,,,
[পরবর্তী পর্ব পেতে রেসপন্স করুন]
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৬
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৩
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৮
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১৫
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৯
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩০
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৮