অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (১৪)
সোফিয়া_সাফা
নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছে ফুল। তার পুরো শরীর নিথর, স্যালাইন কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। কেবিনে শুধু অনিলা আছে। অনিও ছিল, আপাতত বাইরে গেছে।
“এখন কেমন লাগছে?”
অনিলার প্রশ্নে ফুল চোখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। তার চাহনি দেখে অনিলা ছোট্ট শ্বাস ফেলল, মেয়েটার নিষ্প্রাণ চাহনি তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। সে কি ভুলভাল কোনো প্রশ্ন করে ফেলেছে? করেনি তো! এছাড়া আর কিইবা জিজ্ঞেস করতো? এভাবে কেন তাকাল মেয়েটা?
“আমি বেচে আছি?”
ফুলের প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল অনিলা। মেয়েটার কণ্ঠ বড্ড ক্ষীণ শোনাল। কেবিন জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এলো,
“আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে; যার মানে আমি বেচে আছি।”
এমন কথার মানে অনিলা বুঝতে পারলো না। ফুল কি বেচে আছে বলে খুশি নয়?
“তুমি এভাবে বলছো কেন?”
ফুল উপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, শুভ্র রঙের সিলিংয়ের দিকে উদ্দেশ্যেহীন চেয়ে রইল।
“কষ্ট পেওনা ফুল। তুমি খুব তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।”
“আমার মরণব্যাধি হয়েছে ম্যাম, যেই ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করা নেহাতই অসম্ভব।”
অনিলার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। এসব কি বলছে ফুল?
“তুমি হয়তো আমাদের উপর রেগে আছো; ভাবছো হয়তো তোমাকে যে মে’রে ফেলতে চেয়েছে তাকে আমরা কিছুই বলিনি? কিন্তু এটা সত্যি নয় ফুল, মিস্টার চার্লসকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।”
অসুখে বিবর্ণ হয়ে গেছে ফুলের গোলগাল মুখমণ্ডল। ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে কাঠ। ফুল ম্লান হেসে বলল,
“যেখানে আমি নিজেই নিজেকে মে*রে ফেলতে চেয়েছিলাম সেখানে অন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া টা হাস্যকর।”
“কিহ! তার মানে এটাই সত্যি? তুমি নিজেই নিজের পেটে কাচের টুকরো ঢুকিয়ে ছিলে?” অনিলার কন্ঠে চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠল; সে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন ছুড়ল, “তুমি এরকম টা কেন করেছিলে?”
“আপনি একজন মেয়ে হয়ে জিজ্ঞেস করছেন কেন করেছিলাম? আমার রুমে একজন পরপুরুষকে পাঠিয়ে দিতে আপনাদের বিবেকে বাধলো না? নাকি আপনারা বিবেকহীন প্রাণী?” ফুলের কণ্ঠস্বর এবার কিছুটা তীক্ষ্ণ শোনাল। মেয়েটা শরীরের সবটুকু শক্তি খাটিয়ে বলে উঠল, “শাস্তি তো আপনাদের পাওয়া উচিৎ। লোকটাকে আপনারা পারমিশন দিয়েছিলেন বলেই তো আমার রুমে ঢোকার সাহস পেয়েছিল। বলুন, আপনারা পারমিশন দেননি?”
অনিলা নিজের তর্জনী আঙুল দিয়ে কপাল চুলকাতে লাগল, “আমরা দেইনি, রিদম তোমাকে ইউজ করার পারমিশন চেয়েছিল তেহ পারমিশন গ্রান্টেড করেছিল।”
ঘৃনায় শিরশির করে ওঠে ফুলের সর্বাঙ্গ। রাগ সংবরণ করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে গুঙিয়ে উঠল,
“সে পারমিশন দেওয়ার কে? আমার রুমে ঢোকার পূর্বে আমার পারমিশন নিতে হবে।”
“ওপস আমি তো ঢুকে গেলাম পারমিশন ছাড়াই!” হঠাৎ কারো আগমনে অনিলা ঘাড় বাকিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই শুকনো ঢোক গিলল। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদ্যান। হাতজোড়া বুকের উপর গোটানো। পরণে কালো রঙের ওভারসাইজ শার্ট আর রিপড স্কিনি প্যান্ট। উদ্যান এবার দরজা ছেড়ে বেডের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনিলা বিনাবাক্যে বসা থেকে উঠে সতর্ক পায়ে বেরিয়ে গেল।
“সুই-সা*ইড অ্যাটেম্পট করে কি প্রুফ করতে চেয়েছিস? চার্লস বলেছিল তুই নিজেই নিজেকে স্ট্যাব করেছিস। আমি বিশ্বাস করিনি। ভাবতে পারিনি তুই এতোটা বোকা। কংগ্রাচুলেশন, ইউ কেম আউট অ্যাজ আ ফুল, জাস্ট লাইক ইওর উইয়ার্ড নেম।”
(নিজের নামের মতো বোকা হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য অভিনন্দন।)
উদ্যানের চেহারাটা দেখেও ফুলের বমি পাচ্ছে। তারউপর এমন কটাক্ষপূর্ণ উক্তিতে ফুল নিজের নিয়ন্ত্রণ খুইয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে,
“ল*ম্পট হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য, আপনাকেও অভিনন্দন। নিশ্চয়ই আপনার মা-বাবা আপনার কৃতিত্বে অনেক গর্বিত হবেন।”
ফুল কথাগুলো নিঃশ্বাসের গতিতে বলল। একদম তীক্ষ্ণ-ক্ষীণ কন্ঠে, কেবিন জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। হঠাৎ নিস্তব্ধতায় ফুলের শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যায়। সে কি বেশি বেশি বলে ফেলেছে? না, সে যাই বলে ফেলুক না কেন বাড়াবাড়ি হবেনা। উদ্যানের মতো একটা জা*নোয়ারকে নির্দ্বিধায় যা ইচ্ছা তাই বলা যায়।
“কি বললি তুই?” উদ্যানের কণ্ঠস্বর নিম্ন কিন্তু ভীতিকর। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে উদ্যান হিংস্র জন্তুর ন্যায় হামলে পড়ল ফুলের উপর। একহাতে গলা চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
“আমার সম্পর্কে কতটুকু জানিস তুই? কিসের ভিত্তিতে উক্ত মন্তব্যটি করলি?”
শ্বাসকষ্ট শুরু হলো ফুলের। নাকে লাগানো নাসোগ্যাস্ট্রিক টিউব দিয়ে রক্ত উঠে আসতেই উদ্যান ফুলকে ছেড়ে দেয়। ফুল বড়বড় কয়টা শ্বাস টেনে আধো আধো গলায় বলল, “আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার কোনো আগ্রহ নেই আমার। যেটুকু জেনেছি সেটুকুর ভিত্তিতেই উক্ত কথাটা বলেছি। আর আমি জানি যে আমি ভুল বলিনি। আপনি একটা লম্পট, বোধবুদ্ধি হীন দানব। যার মধ্যে না আছে হৃৎপিণ্ড আর না আছে মেরুদণ্ড।”
উদ্যান হাত মুঠ করে পাশে থাকা টুলে লাথি মেরে দিল।
“এভাবে মুখ চালাতে থাকলে তোকে সুই-সাইড অ্যাটেম্পট করতে হবেনা। আমি নিজেই তোকে মেরে ফেলবো।”
“মেরে ফেলুন আমায়। আমি মরে যেতে চাই।”
উদ্যানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। না সে এই কথাটা মেনে নিতে পারছেনা। মেয়েটা কেন মৃত্যুকে ভয় পাবেনা? কেন বাচার জন্য আকুতি করবে না? মেয়েটার মধ্যে যদি মৃত্যুভয় না থাকে তাহলে উদ্যান কিভাবে মেয়েটাকে নির্যাতন করবে? কিন্তু মেয়েটার মধ্যের মৃত্যুভয় হঠাৎ কেটে গেল কিভাবে? কি এমন হয়েছিল যার জন্য মেয়েটা মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছেনা। এদিকে ফুলের শ্বাস আটকে আসছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে অবাধে। সে নিজেকে ঘৃনা করে। অল্পতেই কেঁদে ফেলার জন্য ঘৃনা করে। না চাইতেই ফোপাঁতে লাগল ফুল। তাকে কাদতে দেখে উদ্যান জোরালো গলায় বলল,
“হুম বেশি করে কাঁদ, আমি তোকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখতে চাই।”
ফুল অস্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিচ্ছে। হাপানি রোগির মতো; মুখাবয়ব রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ঠোঁট স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ফাঁক হয়ে গেছে। চোখ উল্টে ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলছে। উদ্যান একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
“আমি আপনাকে ঘৃনা করি। শুনছেন আপনি? আমি আপনাকে ঘৃনা করি, কিভাবে পারলেন একটা পরপুরুষকে আমার রুমে ঢোকার পারমিশন দিতে? ছি, আপনি কোন পরিবেশে বড় হয়েছেন আমি জানিনা। মনুষ্যত্ব বলেও কিছু নেই আপনার মাঝে। এতোটা বিভৎস চরিত্রের কেউ কিভাবে হতে পারে?”
উদ্যান শান্তচোখে তাকিয়ে আছে ফুলের দিকে। মেয়েটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
“এতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এতো নাটক করছিস কেন?”
“ছোটখাটো বিষয়? একটা মেয়ের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো তার ইজ্জত। আপনি আমার কাছ থেকে সেটাও কেড়ে নিতে চেয়েছেন। তাও আবার অন্য কাউকে দিয়ে।” ফুল থামল, দম ফুরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চেতনা হারাবে সে। শেষ মুহুর্তে এসে ফুল উদ্যানের চোখে চোখ রেখে আওড়াল, “মিথ্যা বলবো না, আপনার থেকে একটু রহম আশা করেছিলাম। স্ত্রী হিসেবে না হোক একজন নারী হিসেবে একটু রহম করতেই পারতেন। আমি আর আশা করবো না কিছু, নিজেকে প্রোটেক্ট করতে না পারলে শেষ করে ফেলবো তবুও শেষ নিশ্বাস অবধি কলঙ্ক মুক্ত থাকব।”
ফুলের চোখ লেগে গেছে, সেই সাথে থেমে গেছে তার অভিযোগও। রুম জুড়ে শুধু হার্ট মনিটরিং ডিভাইসের একঘেয়ে শব্দ। নাসোগ্যাস্ট্রিক টিউব বেয়ে লালচে তরল জমা হচ্ছে সাইডে ঝোলানো ব্যাগে। যার মানে ফুলের ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে। কাঁচের টুকরো টা পেটের চামড়া ভেদ করে পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও সেলাই করা সম্ভব হয়েছে, তবুও ফুলের অবস্থা শোচনীয় করেই থেমেছে উদ্যান। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দুপা পিছিয়ে যায় উদ্যান। তারপর সামনে ঘুরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে। বাইরে আসতেই দেখে সোহম আর লুহান দাঁড়িয়ে আছে। অনি আর অনিলা আশেপাশে নেই হয়তো বাড়িতে ফিরে গেছে।
“সোর্রোফুল কথা বলছে? আমি একটু দেখতে যাবো?”
সোহমের কথায় উদ্যান অদ্ভুত গলায় বলল,
“ওর ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে মেবি, ডাক্তার ডাক।”
হকচকিয়ে গেল সোহম, মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে শুনে এসেছে। এরমাঝে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ কি?
“তুই একটু চুপ থাকলেও পারতি তেহ।” লুহান বলল,
“আজকের মতো চুপচাপ আমি জীবনেও ছিলাম না। একবার সুস্থ হোক তারপর… আমি যাচ্ছি। সোহম থাক এখানে, লুহান আমার সাথে চল।”
উদ্যান কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল। সোহম ছুট লাগাল ডাক্তারকে ডাকতে, এরমাঝেই উদ্যান পেছনে ফিরে বলে উঠল,
“ফ্রম নাও, মেয়েটার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবি। ইটস আ অর্ডার। প্রয়োজন ছাড়া ধারেকাছেও ঘেষবি না।”
সোহমের ভ্রু কুচকে গেল, হঠাৎ এরকম কথার মানে কি? উদ্যান দু-দন্ড দাঁড়িয়ে ফের হাটা ধরল। সোহমও ভাবনা চিন্তা সাইডে রেখে ডাক্তার ডাকতে চলে গেল।
কেটে গেল অনেক গুলো দিন। ফুলের অনুপস্থিতিতে যেন খানজাদা নিবাস নিজের ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। ড্রইংরুমে হাতপা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে আবেশ, ছেলেটার মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে এই একমাসে। হ্যাঁ একমাস হয়ে গেছে ফুলের হাসি দেখেনা আবেশ। চুলগুলো উসকোখুসকো, মুখাবয়বে কেমন যেন খাপছাড়া ভাব। কোথায় কোথায় সে খোঁজেনি ফুলকে,
“আবেশ ভাই।”
হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠে আবেশ চোখ মেলে তাকায়। ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখে মেহেক চোখমুখ কুচকে দাঁড়িয়ে আছে, মেহেককে দেখে আবেশ চোখ সরিয়ে নিল। মেয়েটা যতবার তাকে আবেশ ভাই বলে ডাকে ততবার সে বিড়ম্বনায় পড়ে যায়, মনে হয় এই তো ফুল তাকে ডাকছে। এখনই বায়না ধরে বলবে, ‘চলো না আবেশ ভাই ফুচকা খেতে যাই। চলো না শপিং করতে যাই। চলো না ঘুরতে যাই। আমাকে এটা কিনে দেও, ওটা কিনে দেও। আজকে আমাকে একটা ছেলে প্রোপজ করেছে। লাভ লেটার দিয়েছে।’ এই তো সেদিনের ঘটনা, একটা ছেলে পাগলের মতো ফুলের পেছনে লেগেছিল। ফুল না করে দেওয়ার পরেও ছেলেটা ফুলকে বিরক্ত করেই যাচ্ছিল। পিছুই ছাড়ছিল না। কলেজ শেষে বাড়িতে এসে ফুল ব্যপারটা আবেশকে জানায়। পরেরদিনই আবেশ নিজের গ্যাং নিয়ে ছেলেটাকে শাসিয়ে আসে। ফুলকে আবেশ কতোটা আগলে রেখেছিল সেই ছোটবেলা থেকে, কখনও খারাপ নজর পড়তে দেয়নি। নিজেও সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থেকেছে। সেই ফুলকে এক আগন্তুক এসে এভাবে কেড়ে নিয়ে যাবে সে কি স্বপ্নেও ভেবেছে কখনও?
এতো যত্নে ফোটানো ফুল তার ঘরে সৌরভ না ছড়িয়ে অন্যকারো ঘরনি হয়ে যাবে কল্পনাও করেনি। দুঃস্বপ্নেও আসেনি, তবে কি সে এতোদিন অন্য বাগানের ফুলকে নিজের ফুল ভেবে ভুল করেছে? ফুল কি তার ছিল না?
“আবেশ ভাই, শুনছো?”
আবেশ বিরক্তির শ্বাস ফেলে মেহেকের দিকে তাকায়,
“কি হয়েছে? ভ্যা ভ্যা করছিস কেন?”
মেহেক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“তোমার মন মেজাজ খারাপ নাকি?”
“যা বলতে এসেছিস সরাসরি বল। আমার মনের খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন নেই। এমনিতেও এবাড়িতে আমাকে নিয়ে ভাবেনা কেউ। তাই অকারণে আদিখ্যেতা দেখানোর প্রয়োজন নেই।”
মেহেকের কপালে ভাজ পড়লো। আবেশ সবসময় এভাবে কেন কথা বলে? কই ফুলের সাথে তো কখনো এভাবে কথা বলতে দেখেনি।
“এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড না ছড়িয়ে নিজের রুমে যা। অক্সিজেন সংকট হচ্ছে।”
চোখ বড়বড় হয়ে গেল মেহেকের, সে একটু দম নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল,
“আজকে আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে। একটু চেক করে দেখবে?”
রেজাল্ট দিয়েছে শুনে আবেশ সোজা হয়ে বসল,
“এইচএসসির রেজাল্ট দিয়েছে?”
মেহেক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আবেশ বা দিকে হেলে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করল। মেহেক তো উচ্ছ্বসিত হয়ে তার পাশে এসে বসল। আবেশ একপলক মেহেকের দিকে তাকিয়ে একটু দূরে সরে বসল। তার অভিব্যক্তিতে মেহেকের মুখে জ্বলে ওঠা আলো ধপ করে নিভে গেল। একহাতে ওড়নার অংশ খামচে ধরে মেহেক মাথা নিচু করে নিল। আবেশ প্রথমেই ফুলের রেজাল্ট চেক করতে লাগল। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর ফোনের স্ক্রিনে রেজাল্ট ভেসে ওঠে, রেজাল্ট দেখে আবেশের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে; পাশে তাকাতেই মনে পড়ে ফুল নেই। আবেশকে উদাস চোখে আশেপাশে তাকাতে দেখে মেহেক ভ্রু কুচকে বলে,
“কি হয়েছে আবেশ ভাই?”
আবেশ আবারও ধাক্কা খেল। সে বুঝে উঠতে পারছেনা মেহেকের কণ্ঠের সাথে সে ফুলের কণ্ঠ গুলিয়ে ফেলছে নাকি সে ফুলের কণ্ঠ ভুলে যাচ্ছে; কোনটা হচ্ছে তার সাথে? আচ্ছা, পাগল হয়ে যাচ্ছে নাতো?
“কি হলো আবেশ ভাই? তুমি কি আমার রেজাল্ট দেখে দেবে না? না পারলে বলে দেও আমি আমার ফ্রেন্ডদের থেকে জেনে নেবো।”
আবেশ এবার চটে গেল, এমনিতেই ফুলের চিন্তায় সে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। তার উপর মেহেক তার মাথা খাচ্ছে। খাচ্ছেনা? কিন্তু তার তো মনে হচ্ছে খাচ্ছে।
“ফ্রেন্ডের থেকে জানতে পারলে আমাকে বিরক্ত করছিস কেন? যা ফ্রেন্ডের কাছ থেকে জেনে নে গিয়ে।”
একটু জোরেই চিল্লিয়ে উঠল আবেশ। রেহানা বেগম আর মাহবুবা সুলতানা রান্নাঘরে ছিলেন। আবেশের চিৎকার শুনে তারা ছুটে এলেন। মেহেক তো আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে আছে আবেশের দিকে। ইতোমধ্যেই তার চোখ জোড়া পানিতে ভরে উঠেছে। আবেশ কোনো কারণ ছাড়াই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে কেন সেটাই বুঝতে পারেনা মেহেক। ফুলের অবর্তমানে বাড়িটা যেন প্রাণ হারিয়ে না ফেলে সেই জন্যই মাহবুবা সুলতানা বোনের মেয়েকে রেখে দিয়েছেন। তাছাড়া মেহেক ঠিক করেছে রেজাল্ট ভালো হলে এখানের এক নামি-দামি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাবে।
“কি হয়েছে আবেশ? চিল্লাচ্ছিস কেন?”
মায়ের প্রশ্নে আরও ক্ষেপে গেল আবেশ,
“আমি খারাপ তাই চিল্লাচ্ছি।”
মাহবুবা সুলতানা দমে গেলেন। রেহানা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
“এভাবে কথা বলোনা আবেশ। ফুলকে ছাড়া আমাদের সবার মনের অবস্থাই খারাপ। তোমাকেও তো বুঝতে হবে আমরা উপায়হীন ছিলাম।”
“তোমরা উপায়হীন ছিলে না। তোমরা নিষ্ঠুর ছিলে। আমার ফুলকে তোমরা নিজেদের স্বার্থে রাক্ষসের হাতে তুলে দিয়েছো। কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো ফুলকে আমার সাথে থাকতে দিলে? তোমরা আমাকে খারাপ প্রমাণ করতে চাইছো কিন্তু বাস্তব তো এটাই যে খারাপ আমি নই, খারাপ তোমরা আর আমার ভাগ্য। আমি এক দূর্ভাগা যে কিনা নিজের ভালোবাসাকে রক্ষা করতে পারেনি। আচ্ছা তোমাদের একবারও এটা ভেবে অনুশোচনা হচ্ছেনা? কিভাবে পারো এতোটা নির্মম হতে? আর ফুপি, ফুল তোমার মেয়ে তো?”
রেহানা বেগমের মাথায় বজ্রপাত হলো। এহেন প্রশ্নে তার হাটু অসার হয়ে এলো। এটা কি ধরনের প্রশ্ন?
“তুমি কি বলতে চাইছো আবেশ?” রেহানা বেগম কিছুটা অস্থির হয়ে পড়লেন।
“আমি বলতে চাইছি ফুলকে দত্তক-টত্তক নিয়েছিলে নাকি?”
“আবেশ! তুই কি বলছিস জানিস?”
মায়ের ধমক গায়ে মাখল না আবেশ নির্বিকার চিত্তে সোফার উপর পা তুলে বলল।
“আমি জানিনা, তবে তোমরা তো জানো? জানো নিশ্চয়ই? একজন মা কখনও কি পারে মেয়ের মৃ*ত্যু নিশ্চিন্ত জেনেও আগুনে ফেলে দিতে?”
ড্রইংরুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। সেই নীরবতা ভেঙে আবেশ বলল,
“ফুলের বাবা তো মা*রা গেছেন তাইনা ফুপি?”
রেহানা বেগম হাপিত্যেশ করে উঠলেন। শীতের মাঝেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হলো।
“তোমাদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছিল? মানে লাভ ম্যারেজ নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ? ওয়েট, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করো নি তো?”
“আবেশ…
ঠাসসস শব্দ হলো, আকস্মিক চড়ে আবেশ হেলে পড়ল অন্যদিকে। মাহবুবা সুলতানা কঠোর চোখে তাকিয়ে বললেন,
“নিজেকে সংযত কর। তুই যেমন ভুলে গেছিস আমি তোর মম। আমিও কিন্তু ভুলে যাবো তুই আমার ছেলে।”
“ভুলে যাও। আমিও তোমাকে ভুলিয়ে দিতে চাই। আমার থেকে যেমন ভালো থাকার কারণ কেড়ে নিয়েছো; তেমনি আমিও তোমার থেকে তোমার ছেলেকে কেড়ে নেবো। অবশ্য তোমার বড়ছেলে তো আছেই। আমার মতো খারাপ ছেলে না থাকলেও তোমার যাবে আসবে না।”
আবেশ উঠে দাঁড়াল তারপর হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
পুরো ৩ সপ্তাহ হসপিটালের বন্দিত্ব জীবন কাটানোর পর সোলার এস্টেটে ফিরেছে ফুল। শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ সে। তবে মানসিক ভাবে সে বড্ড অসুস্থ, হসপিটালে কাটানো শেষের দিনগুলোতে সে বেশ কয়েকবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বলা চলে ফুলকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল হসপিটালে। ২৪ ঘন্টা নজরবন্দীতে রাখা হয়েছিল। রাতের বেলা সব কাজ শেষ করে নিজের রুমে এসে বসেছে ফুল। হসপিটাল থেকে এসেছে কয়েকদিন হবে।
ইদানীং উদ্যান তার সাথে কথা না বললেও তাকে কাজের উপর রাখে। যেমন: ঘরদুয়ার পরিষ্কার থাকলেও তাকে দিয়ে পরিষ্কার করায়। জামাকাপড় নিজে থেকে এলোমেলো করে সেগুলো আবারও তাকে গুছিয়ে রাখতে বলে। চা বানিয়ে আনলে বলে; ভালো হয়নি আবার বানিয়ে আন। কখনো কখনো তো পুরো চা টাই ফুলের মুখের উপর ছুড়ে মারে।
কিছুক্ষণ আগেও সেরকম টাই হয়েছে। চা বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ফুল কিন্তু উদ্যান চুমুক না দিয়েই পুরো চা’টা তার মুখ বরাবর ছুড়ে মেরেছে। ফুল অবশ্য কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করেনি। কান্না না করার কারণে উদ্যান দুটো ঠাটিয়ে চড় মেরে দিয়েছিল। সাথে সাথেই ফুল কেঁদে ফেলে। আর উদ্যানও সন্তুষ্ট হয়ে তাকে প্রস্থান করার অনুমতি দিয়ে দেয়। ফুল জড়োসড়ো হয়ে জানালার পাশে বসে আছে। গাছগাছালিতে ঘেরা সোলার এস্টেটে, জানালার ধারে এলেই বাতাস ছুয়ে দিয়ে যায় শরীর। শীতের মাঝেও বাতাসের স্পর্শ ভালো লাগে ফুলের। মনে হয় বাতাসের বেশে খুব প্রিয় কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হয় কেউ স্বান্তনার বাণী গেয়ে বলছে,
“এইতো আর একটু সহ্য কর। খুব শীঘ্রই পরিত্রাণ পাবি।”
রুমে কেউ নেই। আজকে আবারও পার্টি হবে হয়তো। উদ্যানের নিষেধাজ্ঞায় বাড়ির কেউই ফুলের সাথে প্রয়োজন ব্যাতিত কথা বলেনা। এতে অবশ্য ফুলের বিশেষ কিছু যায় আসেনা। ফুল হাটুতে গাল ঠেকিয়ে বসে আছে। আজকাল অন্ধকার যেন একটু বেশিই ভালো লাগে ফুলের। এই অন্ধকারের মাঝেই সে একটু স্বস্তি খুঁজে পায়। অন্ধকার রুমের জানালার ফাঁক গলে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ফুলের মলিন চেহারায় পড়তেই ফুল চোখ বুজলো। মন ভালো নেই তার, অবশ্য কখনোই থাকেনা। একসপ্তাহ আগে রেজাল্ট দিলেও ফোনের অভাবে রেজাল্ট টুকু পর্যন্ত দেখতে পারেনি ফুল। কারো কাছে ফোন চাওয়ার প্রয়োজন টুকুও বোধ করেনি। রেজাল্ট জেনে আর কি হবে। যেখানে সে এখনও অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছে সেখানে জ্ঞানের পরীক্ষার ফলাফল কি কাজে আসবে? ভাবনার মাঝেই বাতাসের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ে ফুলের চোখেমুখে। মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে যায় ফুলের অবাধ্য চুল গুলো। গাল বেয়ে নোনাজলের ধারা প্রবাহমান হয়। ধরা গলায় ফুল গেয়ে ওঠে,
ছায়া পেলে তোমার, ছুঁয়ে গেছি তোমায়
তুমি হেঁটে গেলে, ভেঙেচুরে আমি
বসে আছি দেখো, তুমি আসবে বলে
মুখের আদলে কত কী যে বলে
হারালে এখন…
আনমনা মন কেমন, মনমরা মন কেমন
একা একেলা মন।
পার্টির জন্য রেডি হচ্ছিল উদ্যান; হাতঘড়ি পড়ছিল ঠিক তখনই কোনো গানের সুর তাকে আকৃষ্ট করল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড় বাকিয়ে বেডের দিকে তাকাতেই থমকে গেল পাথর মানবটা। কনসোলের কি-প্যাড চেপে ধরে তান খেলা করছে। উদ্যান ধীরপায়ে এগিয়ে গেল বেডের দিকে। তানের থেকে কনসোল টি হাতে তুলে নিল। কনসোলের স্পিকার অপশন অন হয়ে আছে। এই অপশনের কারণেই অপরপ্রান্ত থেকে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সে অপশনটি অফ করতেই যাবে তার আগেই আবারও ভেসে আসে,
কিছু আশা বাকি, ভালোবাসা বাকি
আরো কত কী যে, ফিরে এসো কাছে
কথা জমে আছে, হাজার বৃষ্টি ভিজে
আশেপাশে চলো, তবুও না বলো
হলো কী এমন?
ভাবনা তোমারই ঘিরেছে আমায়
কেন অকারণ? আনমনা মন কেমন
মনমরা মন কেমন, একা একেলা মন।
উদ্যান অনূভুতি শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল কনসোল টার দিকে। পরমুহূর্তেই কনসোল টা আছড়ে মারল ফ্লোরে।
চলবে,,,
[পরবর্তী পর্ব পেতে রেসপন্স করুন]
Share On:
TAGS: অবাধ্য হৃৎস্পন্দন, সোফিয়া সাফা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৫(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২২
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২০
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ৩৪
-
অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ২৮