Golpo romantic golpo অবাধ্য হৃৎস্পন্দন

অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১১


অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (১১)

সোফিয়া_সাফা

{পার্টি স্পেশাল—প্রথম অংশ}

ফুলের বাহুতে হাত রাখতেই উদ্যান বুঝতে পারল ফুলের শরীরে ব্যাপক জ্বর। সে ফুলের বাহু চেপে ধরে ঝাকুনি দিল,
“এই ওঠ,”

ফুলের মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলো না। উদ্যান এবার বাধ্য হয়েই ফুলকে কোলে তুলে নিল। ফুলকে সোফায় শুইয়ে রেখে ডক্টরকে কল দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডক্টর চলে এলেন। এই নিয়ে ৩য় বারের মতো ডক্টর এলেন ফুলের চিকিৎসা করতে।
“ওনার শরীরে অনেক জ্বর মাথায় পানি দেওয়া উচিৎ।”

ডক্টরের কথার পিঠে উদ্যান ভ্রুকুটি করে বলল, “তাহলে দিচ্ছেন না কেন? যেভাবে পারেন ওকে সুস্থ করে তুলুন। এভাবে অসুখের অজুহাতে কাজে ফাঁকি দেওয়া আমি একদম বরদাস্ত করবো না।”

ডক্টর অবাক গলায় আওড়ালেন, “আমি দিয়ে দেবো?”

উদ্যান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তো আমি দিয়ে দেবো না নিশ্চয়ই?”
“না মাস্টার আমি সেটা বলিনি। একজন সার্ভেন্টকে ডেকে নিলেই হয়।”

ডক্টরের কথায় যুক্তি আছে। উদ্যান একমুহূর্ত ভেবে পকেট থেকে কলিং কনসোল বের করল। একটা কি-প্যাড আকৃতির ডিভাইস যেটা সে সার্ভেন্টদের ডাকতে ইউজ করে। সেটার মাধ্যমেই সে রুমার পেজারে কল করল। দু মিনিটের মাথায় রুমা আর নাদিয়া হাজির হলো।
“ওর মাথায় পানি দিয়ে দে।”

রুমা চমকিত নয়নে একবার ফুলের দিকে তাকিয়ে আবার উদ্যানের দিকে তাকাল,
“ফুলের কি হয়েছে মাস্টার?”

রুমার প্রশ্নে উদ্যান মুখ বাকিয়ে বলল,
“ফিভার হয়েছে, ননির পুতুল যে—কথায় কথায় বেহুশ হয়ে যায়। ওকে তারাতাড়ি সুস্থ করে তোল।”

কথাটা বলেই উদ্যান নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। হাহ এসেছিল একটু শান্তি মনে চা খাবে। মেয়েটার জন্য সেটাও পারলো না। কিছুটা দূর গিয়ে উদ্যান পেছনে ফিরে নাদিয়াকে বলল,
“নাদিয়া, আমি রুমে যাচ্ছি লেমন জুস আর আইস কিউব নিয়ে আয়।”

নাদিয়া হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে কিচেনের দিকে চলে গেল। উদ্যান রুমে এসে দেখল বেডের উপর তান জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে বাম দিকের একটা রুমে চলে গেল উদ্যান। সেখান থেকে দুটো বোতল নিয়ে পুনরায় রুমে ফিরে এলো। এরমধ্যে নাদিয়া লেমন জুস আর আইস কিউব নিয়ে এসেছে। উদ্যান ইশারা করতেই নাদিয়া সতর্ক পায়ে সেগুলো টেবিলের উপরে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

সকাল ১০ টা, সোলার এস্টেটে একজনের আগমন ঘটল। হাতে লাগেজ, চোখে রোদচশমা। চেহারা জুড়ে গাম্ভীর্য লেপ্টে আছে। তাকে দেখামাত্রই রুমা আর নাদিয়া এগিয়ে গেল, তারা দুজন এতোক্ষণ যাবত ফুলের পাশেই বসে ছিল। মেয়েটা জ্বরের ভারে একদম নেতিয়ে পড়েছে, উদ্যান যেভাবে রেখে গিয়েছে সেভাবেই ড্রইংরুমের সোফাতেই শুয়ে আছে। গায়ে কম্ফোর্টার জড়ানো কপালে জলপট্টি; রেশমি কালো চুলগুলো বাধনহারা হয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে।
“রিদম স্যার আপনি এসে পড়েছেন?”

রুমার কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না রিদম নামের যুবকটি। সে তো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে চেতনাহীন ফুলের ফ্যাকাসে মুখটার দিকে। নাদিয়া এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে লাগেজ নিতে উদ্যত হল।
“এই মেয়েটা আবার কে? এই বাড়িতে কি করছে?”

রিদমের প্রশ্নে নাদিয়া সংযত চিত্তে জবাব দিল,
“ওর নাম ফুল, মাস্টার এনেছে নিজের পার্সোনাল মেইড হিসেবে।”

একহাতে রোদচশমা টা খুলে চমকিত নয়নে তাদের দুজনের দিকে তাকাল রিদম। যেন নাদিয়ার বলা কথাটা সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না,
“কি বললে? তেহ এনেছে?”
“জি স্যার।”

রিদম বিড়বিড় করে বলল,
“বাহঃ তেহুর উন্নতি হচ্ছে তাহলে। শুনে খুশি হলাম, এই ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু বলল না কেন? ধ্যাৎ এসব ছোটোখাটো বিষয় না বলাটাই স্বাভাবিক।”

রিদম এবার নাদিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি লাগেজ ক্যারি করতে পারবো। তোমরা বরং আমার জন্য নাস্তা রেডি করো।”
“আপনি নাস্তা করবেন স্যার?”

রুমার প্রশ্নে রিদমের মেজাজ খারাপ হলো,
“আজ্ঞে, আ’ম হাংরি, চটপট আমার জন্য পরোটা, ডিম ভাজি আর আলুর দম রান্না করো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

কথাটা বলে রিদম নিজের রুমে চলে গেল। দুপুরে লাঞ্চ করার সময় সবাই একত্রিত হল। ফুলের অবস্থার উন্নতি হওয়াতে নিজের রুমে রেস্ট নিচ্ছে। রুমা, নাদিয়া আরও কয়েকজন সার্ভেন্টের সাথে মিলে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছে। এরই মাঝে রিদম বলে ওঠে,
“আজকে নতুন গেস্ট আসবে। ডিল কনফার্ম হলেই গোল্ডেন ট্রায়াংগেল প্রজেক্টের ফার্স্ট স্টেপ অফিসিয়ালি সিল হয়ে যাবে।”

রিদমের কথায় উপস্থিত সকলে খুব একটা অবাক হলো না। অনি আগ বাড়িয়ে বলল,
“পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে খুব একটা টাইম লাগবে না। তবে এই প্রজেক্ট টা একটু ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”

“সবকাজে তাড়াহুড়ো করতে নেই, প্রজেক্ট অনুযায়ী প্রোপার স্ট্র্যাটেজি মেইনটেইন করতে হয়। আর এই প্রজেক্ট টা আমাদের জন্য অনেক ভ্যালুয়েবল।”
উদ্যানের হস্তক্ষেপে পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল।

বিকালের দিকে ফুল ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। শরীর মোটামুটি সুস্থ, একটু দূর্বলতা আছে তবে বিশেষ সমস্যা হচ্ছেনা। ব্যালকনি দিয়ে বাইরের সবুজাভ অরন্যের দিকে তাকিয়ে আছে ফুল। চোখের চাহনি নির্লিপ্ত, চুলগুলো অপরিপাটি, তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভেতর থেকে সে ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে। আবেশ কেন এখনও তাকে উদ্ধার করতে আসছে না? আর কতদিন সে এসব সহ্য করবে? চোখের কার্ণিশ বেয়ে টুপটাপ দু ফোঁটা জল অহর্নিশ গড়িয়ে পড়ল। বুকের ভেতর প্রচন্ড চাপ অনুভব করছে ফুল। কবে নাগাদ এই নরক থেকে মুক্তি মিলবে? এই একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত সে।
“রিদম স্যার তোমার তলব করেছেন। চলো আমাদের সাথে।”

নাদিয়ার কথায় পিছু ফিরে চাইলো ফুল,
“রিদম স্যার কে?”

ফুলের প্রশ্নে নাদিয়ার চোখ বড়বড় হয়ে গেল, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ফুলের দিকে,
“তুমি রিদম স্যারকে চেনো না? আরে মাস্টারের পর তিনিই আমাদের বড় স্যার।”
“তাকে কি আমার চেনার কথা? এর আগে কি আমাদের দেখা হয়েছে?”

নাদিয়া ভেবে দেখল ফুলের কথায় যুক্তি আছে।
“তা ঠিক, তবে তিনি তোমাকে দেখেছেন।”

ফুল অবাক গলায় বলল, “কিভাবে?”

“সকালে তুমি যখন লিভিং রুমে শুয়ে ছিলে তখন তোমাকে দেখেছিল সে।”

ফুল ধাঁধায় পড়ে গেল। এই বাড়িতে হচ্ছে টা কি সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছেনা তার উপর আবার নতুন কারো আগমন; ফুল কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আচ্ছা এই বাড়িতে যারা আছেন তাদের সাথে তেহজিব খানাজাদার সম্পর্ক কি?”

প্রশ্ন টা শুনে নাদিয়ার মুখটা চুপসে গেল, তার এহেন প্রতিক্রিয়ায় ফুলের মনে খটকা লাগল, কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে নাদিয়া বলল,
“ওনাদের মাঝে ঠিক কি সম্পর্ক তা জানিনা। তবে আমার মনে হয় ওনারা খুব ভালো বন্ধু।”
“তুমি সঠিক জানো না কেন? তুমি তো অনেকদিন ধরেই তাদের বাড়িতে কাজ করছো তাইনা?”

নাদিয়া এবার সম্পূর্ণভাবে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল,
“রিদম স্যার ডেকেছেন। সেখানে যাওয়া উচিৎ।”

নাদিয়া অপেক্ষা করলো না দরজার দিকে হাটা ধরল। ফুলও তার পিছু পিছু বের হলো। রিদম নিজের রুমে বসে কিছু ফাইল চেক করছিল। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। গায়ে অফ হোয়াইট রঙের টি-শার্ট আর ট্রাউজার। চোখমুখের গাম্ভীর্য দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। তার পাশের চেয়ারে বসে আছে অনি, তার হাতেও একটা মোটাসোটা ফাইল।
“স্যার আসবো?”

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে প্রশ্ন টা করল নাদিয়া। তার পেছনে আরও ৮-১০ জন মেয়ে ফর্মাল স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটা মেয়েই দেখতে শুনতে দারুণ, ফুল তো গোলগোল চোখে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। এতগুলো মেয়ে কোথা থেকে এলো? এদের মধ্যে কয়েকজনকে সে এর আগেও দেখেছে। তারা প্রতিদিন বাড়িঘর পরিষ্কার করতে আসে। রান্নার কাজে সাহায্যের জন্যও প্রায়ই আসে।
“ভেতরে এসো।”

রিদমের অনুমতি পেয়ে ধীরপায়ে সবগুলো মেয়ে রুমে প্রবেশ করল।
“তেহুর পার্সোনাল মেইড সামনে এসো।”

রিদমের সম্মোধনে ফুলের শরীর হিম হয়ে গেল। তাকে কেন ডাকছে? সে দাঁড়িয়ে ছিল একেবারে পেছনের সারিতে। বাকি সব মেইড সরে গিয়ে তাকে হাইলাইট করে দিল। একজন তার কাঁধ চেপে ধরে সামনের দিকে ঠেকে দিল। ফুল জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৎক্ষনাৎ রিদম উঠে এসে তার সামনে দাঁড়াল। লম্বায় রিদম ৬ফুট হবে হয়তো। তার সামনে ৫ফুট ৪ইঞ্চির ফুলকে পিচ্চি ঠেকছে। এই বাড়িতে উদ্যানের পর রিদম-ই এতোটা লম্বা। বাকি সবাই ও এক একটা খাম্বা।
“তোমার পরিচয় দেও।”

রিদমের প্রশ্নে ফুল এবার চোখ তুলে রিদমের দিকে তাকাল। রিদমের চুলগুলো একটু কোকড়া টাইপের; একটু বড় হলেও উদ্যানের মতো কপাল ঢাকা নয়। গায়ের রঙ ফর্সা বলা চলে। ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি, ফুলের সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্রই সেই হাসি যেন আরও প্রসস্ত হলো।
“আর ইউ মিউট?”

ফুলের চোখের কোণে পানি জমল। সে উত্তর দিতে আগ্রহী নয়। তবুও ব্যাপারটা ঘেটে ফেলতে চাইছে না,
“আমার নাম ফুল।”
“বয়স?”
“১৯”

ফুল একটু বাড়িয়ে বলল তার ১৯ বছর এখনও হয়নি। আরও ১ মাস পর হবে।
“এডুকেটেড, অর আনএডুকেটেড?”

তার অযাচিত প্রশ্নে অনি বিরক্ত হলো,
“এতো জিজ্ঞাসাবাদ করছিস কেন? ব্যপার কি?”

রিদম হাত গুটিয়ে দাঁড়াল, একবার ফুলকে পা হতে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নিল,
“তেহুর পার্সোনাল মেইড বলে কথা; বিশদভাবে জানতে হবেনা?”
“জেনে কি করবি?”
“বোঝার চেষ্টা করবো, তেহ নিজের পার্সোনাল মেইডকে ঠিক কি কাজে ইউজ করছে।”

ঘৃনায় ফুলের শরীর রিরি করে উঠল। এই বাড়ির লোকগুলোর চিন্তা ভাবনা, কথা বলার ধরন এতো বিশ্রী কেন?
“তো বোকাফুল কি পড়াশোনা করেনি?”

‘বোকাফুল?’ ফুল এবার নড়েচড়ে দাড়াল। এরা যে তাকে আর কি কি নামে ডাকবে কে জানে।
“আমি এবার এইচএসসি এক্সাম দিয়েছি।”
“রেজাল্ট?”
“দেয়নি এখনও।”

অনি এবার উঠে এসে রিদমের হাত ধরে তাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। অনির সাথে গেলেও রিদমের চাহনি ফুলের উপরেই স্থির।
“তুইও সোহমের মতো শুরু করে দিসনা।”

কথাটা শুনে রিদম অবাক চোখে অনির দিকে তাকায়,
“মানে?”
“আমি সংক্ষেপে বলছি শোন; ফুল হচ্ছে তেহুর কাজিন। ওর ফুপাতো বোন, কিন্তু মেয়েটাকে তেহ সহ্য করতে পারেনা। এক কথায় মেয়েটা হচ্ছে তেহুর জাতশত্রু। এতো শত্রুতা কিভাবে এক্সপ্লেইন করবো জানিনা। সেই শত্রুতার জের ধরেই মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এসেছে তেহ।”

রিদম মন দিয়ে অনির কথা শুনে বলল,
“বাহঃ ভালো তো। তার মানে মেয়েটা আনরেস্ট্রিকটেড; অনিলার মতো রেস্ট্রিকটেড নয়। অ্যাম আই রাইট?”

অনিলার কথা উঠতেই অনির মুখাবয়ব শক্ত হয়ে যায়,
“অনিলা আমার ওয়াইফ; ভালোভাবে কথা বল।”
“কুল, রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি বলতে চাইছি মেয়েটা তেহুর শত্রু মানে মেয়েটাকে কাজে খাটালে তেহ রিএক্ট করবে না।”
“কি করতে চাইছিস তুই?”

রিদম আঁড়চোখে ফুলের দিকে তাকাল। ফুল তো ভয়, সংকোচের ঠেলায় ওড়নার একপ্রান্ত খামচে ধরে রেখেছে।
“মেয়েটাকে ঠিকঠাক ইউজ করবো।”

কথাটা বলেই রিদম পুনরায় ফুলের সামনে এসে দাঁড়াল,
“মাথার কাপড় সরাও।”

ফুল তাজ্জব বনে গেল। রিদম এবার বিরক্ত হলো,
“কানে কম শোনো? কাপড় সরাও দেখি।”

রিদম চোখ দিয়ে ইশারা করতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মেইড ফুলের মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে দিল। ফুলের গলা শুকিয়ে এলো। চোখজোড়া ছলছল করে উঠল।
“এখানে এমন মাথায় কাপড় টাপড় দিয়ে থাকবে না। মেইডদের এভাবে থাকা মানায় না। তোমাদের কাজ মালিকের মাইন্ড ফ্রেশ রাখা। এভাবে জবুথবু হয়ে থাকলে মালিকের বিরক্ত লাগবে।”

ফুল নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“নাচতে জানো?”

আকস্মিক প্রশ্নে ফুল সাথে সাথেই নাবোধক মাথা নাড়ল। তার অভিব্যক্তি দেখে রিদম খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“নাচতে না জানলে ম্যাসাজ করা শিখে নেও। আজকে কয়েকজন গেস্ট আসবে। যারা নাচতে জানে তারা নেচে তাদের মনোরঞ্জন করবে। আর যারা জানে না; তারা গেস্টদের হাত পা ম্যাসাজ করে তাদের খুশি করবে।”

ফুলের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। এসব কি বলছে? কিসের গেস্ট? কারা আসবে? আর কেনোই বা আসবে? তন্মধ্যেই মেলো এসে হাজির হলো।
“মেলো ওদেরকে ভালোভাবে রেডি কর। আজকের পার্টিতে ওরা বিশেষ একটা রোল প্লে করবে।”

রিদমের কথা শুনে মেলো একবার উপস্থিত মেয়েদের দিকে তাকাল। তাদের মধ্যে ফুলকে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
“ফুল এখানে কি করছে?”
“ও আজকের পার্টির প্রিমিয়াম ফেস হবে।”
“নো রিদম! ইউ নো না ও তেহুর রিলেটিভ।”
“আই নো, ও তেহুর শত্রু। আর শত্রুর সাথে কিরকম বিহেভ করতে হয় সেটা এক্সপ্লেইন করতে হবেনা নিশ্চয়ই? ও যদি আলাদা কেউ হতো তাহলে তেহ আমাদের কাছে সেটা ক্লিয়ার করে দিতো। অবশ্য তেহুর থেকে এসব আশা করাটাও বাড়াবাড়ি। অনি বলল, ও নাকি নিজেই মেয়েটাকে শত্রু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাহলে সমস্যা টা কোথায়? এনিওয়ে আজকের জন্য ও একদম পার্ফেক্ট।”

ফুল ঠোঁট চেপে মেলোর দিকে তাকাল। মেলো একটা শ্বাস ফেলে রাজি হয়ে গেল। এমনিতেও তেহুর শত্রু হওয়াটা মস্ত বড় অভিশাপ। ফুল যত তাড়াতাড়ি এসবের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবে তত ভালো।
এক এক করে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ফুলও টালমাটাল পায়ে হেটে চলেছে। হাটার গতির সাথে তাল মিলিয়ে তার এলোমেলো চুলে ঢেউ খেলছে। এরইমাঝে তার গলায় থাকা পেজারে সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। ফুল বুঝতে পারল তার ডাক পড়েছে। আজকেই এই পেজার যুক্ত নেকলেস পড়ানো হয়েছে তাকে। তাকে শুধু উদ্যানই কল করতে পারবে। কারণ তাকে উদ্যান নিজের পার্সোনাল মেইড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ফুল রাস্তা পরিবর্তন করে উদ্যানের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা খোলাই ছিল, নক করা মাত্রই ভেতর থেকে গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে,
“কাম ইন।”

দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল ফুল,
“তানের দেখভাল করতে বলেছিলাম। তা না করে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে আছিস। তানের দুপুরের মেডিসিন গুলো মিস হয়ে গেছে সেই খবর আছে?”

সামনের ডেস্কের উপর বসে থেকে উদ্যান ল্যাপটপে কিছু করছে। অন্যসময় হলে ফুল হয়তো চোখ বাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতো উদ্যান কি করছে কিন্তু আজ সে-সব দেখার আগ্রহ নেই। সে ধীরপায়ে টেবিলের উপর থেকে মেডিসিন সংগ্রহ করে উদ্যানের সামনে এসে দাঁড়ায়, তার উপস্থিতি টের পেয়ে উদ্যান স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাল,
“হোয়াট…

হাতে থাকা মেডিসিন গুলো উদ্যানের দিকে এগিয়ে দিল ফুল। এদিকে উদ্যান তো ফুলের দিকে তাকিয়ে থমকে গেছে। বরাবরের তুলনায় ফুলের চেহারা ফোলা ফোলা লাগছে। গাল জোড়া আর নাকের অগ্রভাগ লাল হয়ে আছে। ওড়না টা সাধারণ ভাবে বুকের উপর জড়ানো। তার চাহনি দেখে ফুল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। এর আগে উদ্যান যতবার তার দিকে তাকিয়েছে ততবার হয় রাগী চোখে নয় বিরক্তি ভরা চোখে তাকিয়েছে। কিন্তু এবারের তাকানোটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা ফুল।
“এতো বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে কেন তোকে?”

উদ্যানের ঠান্ডা গলার প্রশ্নে ফুল হতবাক হয়ে গেল। তাকে বাজে দেখাচ্ছে? প্রতিউত্তরে কিছু বলল না ফুল। হাতে থাকা মেডিসিন টা একভাবে উদ্যানের সামনে ধরে রাখল। উদ্যান ফুলের থেকে চোখ সরিয়ে তার হাতের দিকে তাকায়,
“এটা আমাকে দিচ্ছিস কেন? গিয়ে তানকে খাইয়ে দে।”

ফুলের সারা শরীর কেঁপে উঠল। সে গিয়ে তানকে খাওয়াবে? নিজের হাতে? লাইক সিরিয়াসলি? হঠাৎ করেই ফুল নিজের ওড়নায় টান অনুভব করল। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল তান তার ওড়নার কোনা কামড়ে ধরে টানাটানি করছে। দৃশ্যটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না ফুল। ভয়ে সে তৎক্ষনাৎ ছিটকে পড়ল ফ্লোরে। ঘটনার আকস্মিকতায় তানও উল্টে গিয়ে পড়ল তার পায়ের উপর। উদ্যান কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফুল গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলো,
“ও মাআআআ…

তার চিৎকারে হয়তো তানও ভয় পেয়ে গেল। কুকুরটা বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। উদ্যান কয়েক মুহুর্ত চুপচাপ থেকে বড় বড় পা ফেলে তানকে নিজের দিকে টেনে নিল,
“হোয়াট দ্য হেল আর ইউ ডুয়িং?”

ফুল হাসফাস করতে করতে পিছিয়ে যেতে লাগল। শরীর অস্বাভাবিক রকমে কাঁপছে। উদ্যানের হাত থেকে ছুটে গিয়ে তান আবারও ফুলের দিকে তেড়ে গেল। তানকে নিজের দিকে আসতে দেখে দুহাত দ্বারা নিজের মুখ ঢেকে নিল ফুল। তান তো ফুলের শিয়রে গিয়ে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে। ফুলকে অদ্ভুত রিএক্ট করতে দেখে উদ্যান হয়তো প্রথমবারের মতো ভড়কে গেল। সে এবার শক্ত হাতে তানকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তান স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু ফুল তো একদম দেয়ালের উপর হেলে পড়েছে। নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানচ্ছে। উদ্যান একপ্রকার বাধ্য হয়েই রুমাকে কল করল, সঙ্গে সঙ্গেই রুমা এসে হাজির হয়। ফুলের অবস্থা খারাপ দেখে সে ফুলকে পানি খাওয়ায়।
“তোর সাইনোফোবিয়া আছে?”

উদ্যানের প্রশ্নে ফুল উপরনিচ মাথা নাড়ায়। স্বীকার করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
“ড্যাম ইট! আগে বলিস নি কেন? সাইনোফোবিয়া নিয়ে তুই তানের দেখাশোনা করবি? তুই তো দেখছি প্রাণীদের কেও রেহাই দেস না। আমার কল্পনার চেয়েও অধিক সর্বনাশা তুই। কেউ এতোটা বিধ্বংসী কিভাবে হতে পারে?”

উদ্যানের কথাগুলো যেন সুচের ন্যায় ফুলের গায়ে বিঁধে গেল। সে আর শুনতে পারল না। ক্ষীণ স্বরে উচ্চারণ করল,
“দয়া করে চুপ করুন।”

উদ্যান আরও ক্ষিপ্ততা সহিত বলে উঠল,
“চুপ করবো? তানের কতো বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো তোর ধারণা আছে? তানের হার্টে সমস্যা আছে। কিছুদিন আগেই ওর হার্টে মেজর সার্জারী করা হয়েছে।”

ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ফুল। সে কি ইচ্ছা করে কিছু করেছে? সে নিজেই তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল,
“আমি ইচ্ছা করে করিনি। তানকে হার্ট করার উদ্দেশ্য ছিলোনা আমার।”

উদ্যানের চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। কাঠখোট্টা গলায় বলে উঠল,
“ভেনমের উপস্থিতিই যেখানে মৃত্যু ঘটাতে যথেষ্ট সেখানে ভেনম বলছে সে ইচ্ছাকৃত করেনি? ভেনমের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, পরিণাম সবসময় মৃত্যুই হয়। ভুলটা আমার ছিল যে আমি তোর মতো ভেমনকে তানের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছি। ভুলে গিয়েছিলাম, তুই শুধু ধ্বংস করতে জানিস; রক্ষা করা তোর ধর্ম নয়। তবে আমিও তোকে ধ্বংস করেই থামবো। আমার বুকের অরণ্যে যে আগুন জ্বলছে, সেই আগুন তোকে ছাই না করা পর্যন্ত নিভবে না।”

ফুলের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। পুরো শরীর অসাড় হয়ে এলো।
“তানের ধারেকাছেও আর আসবি না তুই। যা এখান থেকে।”

হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ফুল উঠে দাঁড়াল। একমূহুর্ত অপেক্ষা না করে ব্যস্তপায়ে রুম ত্যাগ করল। তার সাথে সাথে রুমাও চলে গেল।

রাতের নিকষ কালো আঁধার সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলেছে। ফুল নিজের লক্ষ্যে অটল ছিল যে সে কিছুতেই গেস্টের সামনে নাচবে না; আর নাতো কারো হাত পা ম্যাসেজ করে দেবে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলতে বাধ্য করেছে। যখন সে শুনেছে রিদমের কথার অবাধ্য হলে রিদম রেগে গিয়ে অনেক খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে। সে ইতোমধ্যেই রিদমের ক্যারেক্টর সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে। তাছাড়াও এই বাড়িতে তাকে বাচানোর মতো কেউ নেই। উদ্যান যেখানে সোহমের সামনে সেই নিকৃষ্ট কথাটা বলেছিল সেখানে তার থেকে ইতিবাচক কিছু আশা করাটাও বোকামি হবে। ফুলকে নিজের সেভিয়ার হয়ে উঠতে হবে।
ফুল এসব ভাবছে আর রেডি হচ্ছে। তাদের সবাইকে কালো ও লাল রঙের সংমিশ্রণে পার্টি ড্রেস দেওয়া হয়েছে। সাথে একটা মাস্কও আছে। যদিও ড্রেসটা অতোটা খোলামেলা নয় তবে ওড়না নেই। ফুল বাড়তি ওড়না নিতে চাইলে মেলো মানা করে দেয়। এই মেলোকে বড্ড অপরিচিত লাগছে ফুলের কাছে। সেদিন যেমন সোহম রোবটের মতো বিহেভ করেছিল। আজ মেলোও সেম বিহেভ করছে। ফুল কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করল চুলগুলোকে সে ওড়নার মতো ইউজ করবে।
“তুমি তো ড্যান্সার। ম্যাসাজ করার ডিসিশন নেওনি নিশ্চয়ই?”

মেলোর প্রশ্নে ফুল মাথা নেড়ে বলল, “শুধু তো নাচতেই হবে তাইনা?”

মেলো উত্তর দিলো না। শুধু কিছুক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল,

নিস্তব্ধ রাত, সোলার এস্টেটের রুফটপ টেরেসের উপরে যেন অন্য জগত। সোনালি-নীল আলোকসজ্জায় সাজানো রুফটপ। চকচকে গ্লাস, টেবিল আর ক্রিস্টালের ডেকরেশন। মাঝ বরাবর গ্লাসের শ্যাম্পেন টাওয়ার আলো প্রতিফলিত করে চারপাশকে আরও ঝলমলে করে তুলেছে। ছাদের একপাশে বসানো স্পেশাল ভিআইপি টেবিলে বসে আছে উদ্যান। তার চারপাশে বৃত্তাকারে বসে আছে রিদম, অনি, লুহান, সোহম আর মেলো।
ঘড়ির কাঁটায় ১২টা, অপর পক্ষের প্রতিনিধি সোনালি কলমে সই করল ডিলের কাগজে। মুহূর্তেই পুরো ছাদ করতালির শব্দে মুখরিত হলো। অনি গ্লাস উঁচিয়ে বলল,
“লেটস চিয়ার্স”

সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলজুড়ে গ্লাসের ঠোকাঠুকির শব্দ, শ্যাম্পেনের ফেনা আর উল্লাসে ছেয়ে গেল। তন্মধ্যেই আলো নিভে গিয়ে মৃদু লাল আলো ছড়িয়ে পড়ল। টেরেসের একপাশের ভারী কালো পর্দা সরে গিয়ে মঞ্চ উন্মোচিত হল। সাউন্ড বক্সে বেজে উঠল একটা গম্ভীর, রহস্যময় লাতিন বিট। একে একে মঞ্চে উঠল মাস্কড পারফর্মারস। লাল-কালোর সিল্কি পোশাকে তাদের প্রতিটি ভঙ্গি যেন আগুনের মতো ঝলসে দিচ্ছে চারপাশ। মাঝখানে একজন পারফর্মার অন্য সবার চেয়ে সামান্য ভিন্ন, যদিও মাস্ক দিয়ে আবৃত চেহারা চেনার উপায় নেই। তবুও উদ্যানের চোখজোড়া আটকে গেল মেয়েটির উপর। মেয়েটির খোলা চুলগুলোই যেন তাকে সবার থেকে আলাদা করে দিচ্ছে।
উদ্যানের শীতল, অনুভূতিহীন চোখ ধীরে ধীরে গেঁথে গেল সেই পারফর্মারের শরীরে। মেয়েটির হাতের অঙ্গভঙ্গি, পায়ের ছন্দ সবকিছুই গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করছে মনস্টার-টা। টেকিলা ভর্তি গ্লাসটা ঠোঁটে চেপে ধরলেও এক ফোঁটা গিলতে পারল না। ঠোঁটের কোণে জমে রইল শূন্যতা। তার চোখে বিস্ময় নেই, নেই উল্লাসও বরং এক অদ্ভুত শীতলতা।
নাচের মাঝেই একবার উদ্যানের সাথে চোখাচোখি হয়েছে ফুলের। উদ্যানের শীতল তীক্ষ্ণ চাহনি তার শরীরে কাপন ধরালেও সে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। চোখ সরিয়ে নাচে মনোনিবেশ করেছে। পরিস্থিতি যেমনই হোকনা কেন নাচ হচ্ছে তারা প্যাশন। নাচ নিয়ে কম্প্রোমাইজ করবে না সে। নাচ প্রায় শেষের দিকে এমন সময়েই উদ্যান হাতে থাকা গ্লাসটা ঠক শব্দে টেবিলের উপর রেখে পাশে ফিরে গর্জে উঠল,
“হু দ্য হেল ডেয়ার্ড দিস? হু ব্রট হার হিয়ার উইদআউট মাই পারমিশন?”

চলবে,,,

(বিরাট পর্ব দিয়েছি, পরবর্তী পর্ব পেতে লাইক কমেন্ট করুন)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply