Golpo romantic golpo অবাধ্য হৃৎস্পন্দন

অবাধ্য হৃৎস্পন্দন পর্ব ১০


অবাধ্য_হৃৎস্পন্দন (১০)

সোফিয়া_সাফা

ফুলের বন্ধ নেত্রপল্লব কিছুটা নড়ে উঠতেই পাশে বসে থাকা রুমা ব্যস্ত ভঙ্গিতে নাদিয়াকে ডাক দেয়,
“নাদিয়া দেখ ওর হয়তো জ্ঞান ফিরছে।”

কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেল ফুল। পিটপিট করে চোখ মেলে আশেপাশে তাকাতেই মাথায় চাপ অনুভব করল,
“তুমি ঠিক আছো তো?”

রুমার প্রশ্নে ফুল কিছুক্ষণ স্থির হয়ে শুয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে মৃদু গলায় বলল,
“আমি ঠিক আছি। একটু উঠে বসতে হেল্প করো।”

ফুলের আওয়াজ খুব ক্ষীণ শোনালো। তবুও তার কথামতো রুমা তাকে উঠে বসতে সাহায্য করল। মাথা চেপে ধরে ফুল শোয়া থেকে উঠে বসল। রুমের কোণে লাগোয়া একটা জানালা থেকে সূর্যের আলো লুটিয়ে পড়েছে মেঝের সবুজ টাইলসের উপর। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকাতেই ফুলের মুখ আরও কুচকে গেল। ঘড়ির কাটা পরিষ্কার জানান দিচ্ছে এখন দুপুর ২ টা বাজে। সে এতোক্ষণ যাবত অচেতন ছিল ভাবতেই বিষন্নতা বেড়ে যাচ্ছে। ফুল আশেপাশে তাকিয়ে দেখল; রুমা আর নাদিয়া ছাড়া পুরো রুমে কেউ নেই। নাদিয়া চিন্তিত কন্ঠে শুধাল,
“কেমন লাগছে শরীর এখন?”

বিছানা হতে নামার জন্য উদ্যত হলো ফুল, মৃদু গলায় আওড়াল,
“একটু দূর্বল লাগছে। শাওয়ার নিলে ফ্রেশ লাগবে।”

প্রায় ২০ মিনিট পর শাওয়ার নিয়ে বের হলো ফুল। বের হয়ে দেখল রুমা তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। বিনাবাক্যে খাবার খেয়ে নিল ফুল। আপাতত নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে, ভেঙে পড়লে চলবে না। আবেশ যেখানে বলেছে তাকে খুঁজে বের করবে সেখানে ফুলের উচিৎ আবেশের জন্য অপেক্ষা করা। খাওয়া দাওয়া শেষে ফুল রুমা আর নাদিয়ার সাথে লিভিং রুমে এসে দেখল আরও কয়েকজন সার্ভেন্ট এসেছে, যারা পুরো বাড়ি পরিষ্কার করছে। বাড়িটা মাত্রাতিরিক্ত চকচক করার পেছনের কারণটা এবার বোধগম্য হলো ফুলের। এর মাঝেই ফুল জানতে পেরেছে রাতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল তারপর ডাক্তার এসে তার চেক-আপ করে কয়েকটা ইনজেকশন দিয়েছিল। সেগুলোর প্রভাবেই সে এতোক্ষণ যাবত অচেতন ছিল। তবে এখন শরীরের ব্যাথাটা আর অনুভব করছে না সে। হয়তো হাই পাওয়ারের ব্যাথানাশক প্রয়োগ করেছিল ডাক্তার।
“বাড়ির সবাই কোথায়?”

ফুলের প্রশ্নে নাদিয়া উত্তর দিল,
“সোহম আর লুহান স্যার সকাল অবধি তোমার পাশেই বসে ছিল। তারপর ঘুমাতে চলে গেছে। বাকিরা নিজেদের কক্ষে সময় কাটাচ্ছে।”
“লাঞ্চ করবে না?”
“সবাই দেড় টা নাগাদ একসাথে বসে লাঞ্চ করে গেছে। এটাই প্রতিদিনের রুটিন। এই বাড়িতে ব্রেকফাস্ট করা হয়না। রাত এগারোটা নাগাদ ডিনার আর ঠিক দেড়টা নাগাদ লাঞ্চ করে সবাই।”

ফুল কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল,
“ব্রেকফাস্ট করেনা কেন?”

এবার রুমা বলল, “কারণ তারা ব্রেকফাস্ট করার সময় টাতে ঘুমায়। ঘুম ভাঙার পর একসাথে লাঞ্চ করে নেয়। রাতে তো লক্ষ্যই করলে তারা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। প্রায় ভোরের দিকে ঘুমাতে যায়। আর যেদিন পার্টি থাকে সেদিন তো পুরো রাতটাই নির্ঘুম কাটায়।”

‘পার্টি’ শব্দটা শুনে ফুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল,
“কিসের পার্টি?”

নাদিয়া একটা শ্বাস ফেলে বলল, “তুমি তো কালকেই এসেছো তাই বুঝতে পারছো না। কয়েক দিন এখানে থাকলে নিজে থেকেই সব বুঝে যাবে। তুমি আসার আগের রাতেও পার্টি হয়েছিল। আবার হয়তো সামনের সপ্তাহে হবে। রিদম স্যার তো এখনও আসে নি, আগামী পার্টির আগেই এসে পড়বে। তার অনুপস্থিতিতে পার্টি খুব একটা জমে না। উফফ সে যেন আগামী পার্টিতে উপস্থিত থাকে।”

নাদিয়ার কথাগুলো সব ফুলের মাথার উপর দিয়ে গেল।
“একটু ডিটেইলসে বলবে?”

নাদিয়া হয়তো বলতে চাইল কিছু কিন্তু রুমার চোখের ইশারা তাকে থামিয়ে দিল। নাদিয়ার মনে পড়ে গেল লাঞ্চ করার সময় উদ্যান সবার উদ্দেশ্যে বলে দিয়েছে ফুলের সাথে প্রয়োজন ব্যাতিত কথা না বলতে। ফুলকে কোনো বিষয় না জানাতে। যদি ফুল অপ্রয়োজনীয় বা বাড়তি কিছু জেনে যায় তাহলে তার পরিনাম তাদের দুজনকে ভোগ করতে হবে। কথাটা মনে পড়তেই নাদিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলল। তার ভীতসন্ত্রস্ত মুখটা দেখে ফুলের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল।
সোহম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। কানের কাছে ফোন, মুখাবয়ব গুরুগম্ভীর; হয়তো কোনো ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়ে কথা বলছিল। এমন সময়েই তার চোখ আটকে গেল লিভিংরুমে বসে থাকা ফুলের উপর। খোলা চুলে ফুলকে কোনো অপ্সরা থেকে কম লাগছেনা। ফুলের উপস্থিতি যেন এক চিলতে রোদের নিচে থাকা কাঁচের স্বচ্ছ টুকরোর মতো। হাটু অবধি ছড়িয়ে থাকা ভেজা চুলগুলো সোফার সীমানা পেরিয়ে ফ্লোরে লুটোপুটি খাচ্ছে। সোহম আপনা-আপনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ফোনের অপর পাশ থেকে কেউ একনাগাড়ে ডেকেই যাচ্ছে,
“সোহম, শুনছিস?”

নিজের উপর সোহমের তীক্ষ্ণ চাহনি টের পেয়ে যায় ফুল। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে তাকায় সোহমের দিকে৷ সোহমের এরূপ চাহনি দেখে ফুল ত্রস্ত হাতে মাথায় কাপড় টেনে নিল। তাকে অপ্রস্তুত হয়ে পড়তে দেখে সোহমের মাঝে ভাবাবেগ ঘটল, মুখে হাসি টেনে পুনরায় ফোনালাপে মনযোগী হলো। যদিও তার দৃষ্টি পুরোপুরি ভাবে ফুলের দিকেই স্থির। সোহম মনে মনেই ভাবল, কি দরকার ছিল উদ্যানের শত্রু রূপে এই বাড়িতে পদার্পণ করার? এবার উদ্যানকে কিভাবে বোঝাবে ফুলকে তার প্রয়োজন? এই প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি সে দূর্বলতা অনুভব করছে। সুন্দরী মেয়ে কি কম দেখেছে? তাহলে ভিন্ন কি আছে ফুলের মাঝে? আছে, ভিন্ন কিছুই আছে বটে। এই যে ফুলের মধ্যেকার এই দ্বিধা এই প্রটেক্টিভ ভাইব, অপ্রস্তুত হয়ে পড়া। সবকিছুই যে ভিন্ন, এসব সে এর আগে কখনও কোনো মেয়ের মাঝে লক্ষ্য করেনি।
এদিকে সোহমের চাহনি দেখে ফুল ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। কই আবেশ তো কখনও এভাবে তাকায়নি তার দিকে। আবেশ কেন আজ পর্যন্ত কেউ তার দিকে এভাবে তাকায়নি। তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় এই সোহমের খারাপ ধান্দা আছে। তবে সেটাই বা কিভাবে সম্ভব? সোহম তো তখন তাকে উদ্যানের হাত থেকে বাচানোর চেষ্টাও করেছিল। নিজে গিয়ে গার্ডেনে ফুলকে লুকিয়ে রেখে এসেছিল। যদিওবা আবার নিজেই ফুলকে উদ্যানের হাতে তুলে দিয়েছিল। ফুল ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা, তবে সোহমের মতিগতি ভালো ঠেকছেনা। তাকে নিয়ে মনে মনে ঠিক কি চিন্তা করছে, কে জানে। ফুল এবার ওড়না টেনেটুনে নিজের শরীর যতটা সম্ভব আবৃত করে ফেলল। তারপর ওড়নার ফাঁক দিয়ে আবারও সোহমের দিকে তাকাল। তার এহেন কাজে সোহম ঠোঁট কামড়ে হেসে ওঠে।
“নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে উল্টো পাল্টা ভাবছে। কিভাবে বোঝাই আমার আপাতত খারাপ কোনো মতলব নেই। তবে ঠিক কয়দিন নিজেকে সামলে রাখতে পারবো জানি না। সবকিছুই তেহুর উপর নির্ভর করছে।”

তার ভাবনার মাঝেই কারও গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো।
“সিঁড়ি আটকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হয় নিচে নাম নয় উপরে যা।”

সোহম পাশ ফিরে তাকাতেই উদ্যান ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। উদ্যানকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এতোক্ষণ যাবত ওয়ার্ক আউট করেছে। পরণের ধূসর রঙা স্লিভলেস জিম ভেস্ট আর ট্র্যাকপ্যান্ট-টা ঘামে জবজবে। কাঁধে ঝুলছে সাদা রঙের একটা তোয়ালে, মাঝে মাঝে সেটা দিয়ে কপাল আর ঘাড় মুছে নিচ্ছে। কবজিতে কালো রঙের স্পোর্টস ওয়াচ, যেটা দিয়ে সে সময় আর হার্টবিট ট্র্যাক করছিল। হাতদুটো ভারোত্তোলনের কারণে ফোলা ফোলা লাগছে। লিভিং রুমে এসেই উদ্যান ধপ করে সোফায় গা এলিয়ে দিল। তাকে এভাবে দেখার জন্য ফুল মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফুল এতোক্ষণ যাবত সোফায় বসে ছিল। খানাজাদা নিবাসে বড় হওয়া ফুল সোফায় ভুল করে বসে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। রুমা আর নাদিয়া পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। উদ্যান বসার সাথে সাথেই রুমা ফুলের কাঁধে হাত রেখে তাকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করল। ব্যপারটা বুঝতে পেরে ফুল তড়িৎ গতিতে উঠে সোফার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। আঁড়চোখে একবার উদ্যানের দিকে তাকিয়ে মনে মনেই আওড়াল,
“এই জন্যই এতো শক্তি শরীরে; শালা মনস্টার, আমার মতো চুনোপুঁটিকে মারা ছাড়া আর কোনো কাজ করিস বলে তো মনে হয়না। এতো ব্যায়াম করার কি দরকার?”

তন্মধ্যেই উদ্যান ভারী গলায় আদেশ করল,
“আইসড টি নিয়ে আয়।”

রুমা মাথা নেড়ে যেতে নিতেই উদ্যান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল,
“এই মেয়ে আমি তোকে অর্ডার করেছি।”

ফুলের ভ্রু কুচকে গেল। উদ্যান তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলেনি; আর নাতো তার নাম… ওয়েট উদ্যান তার নাম ধরে আদৌ ডেকেছে কখনও? ফুলের ভাবনার মাঝেই উদ্যান তার দিকে তাকিয়ে চিল্লিয়ে উঠল,
“ইউ ব্লাডি মিস্টেক, প্যারালাইজড হয়ে গেছিস? কথা কানে যাচ্ছেনা? নিজে থেকে যাবি? নাকি তুলে কিচেনের দিকে ছুড়ে মা*রবো?”

উদ্যানের ধমকে ফুল কেঁপে উঠল। তৎক্ষনাৎ একপ্রকার দৌড় লাগাল কিচেনের দিকে। কল কেটে দিয়ে সোহম এসে বসল উদ্যানের পাশে,
“কষ্ট করে নিচে নামতে গেলি কেন? কল করলেই পারতি।”
“নিচে না নামলে তোর হাবভাব অবজার্ভ করতাম কিভাবে? এতো চিপ প্রডাক্টের প্রতি তুই ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়বি ভাবতে পারিনি।”

সোহমের মুখটা চুপসে গেল, “এভাবে বলছিস কেন? মেয়েটা দেখতে শুনতে খারাপ নয়। ক্যারেক্টর ও ঠিকঠাক আছে আই থিংক।”

উদ্যান এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল, “ইউ থিংক হোয়াট? ফোনে কি কথা বলেছিল শুনেছিস?”
“তেমন কি বলেছে? বলেছে এখানে ও কষ্টে আছে তাই ওকে নিয়ে যেতে। আপাত দৃষ্টিতে ভুল কিছু বলেনি। তুই যেভাবে টর্চার করছিস মেয়েটার কাছে তো এটা জাহান্নাম বলেই মনে হচ্ছে।”
“ফোনের ওপাশে কে ছিল সেই সম্পর্কে ধারণা আছে?”

সোহম এবার নড়েচড়ে বসল, “কে ছিল?”

উদ্যান হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগল,
“ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল। ফোনের মধ্যেই কিস করেছে ছেলেটা। তাহলে ভেবে দেখ এক বাড়িতে থেকে আর না জানি কি কি করেছে। ওর মতো একটা ক্যারেক্টরলেস মেয়ের প্রতি উইক হয়ে পড়িস না। আই ওয়ার্ন ইউ, মেয়েটা এখন অবধি তোর চাহনিতে বিরক্ত বোধ করে সেই জন্যই তোকে কিছু বললাম না। যেই মুহুর্তে মেয়েটা তোকে পাত্তা দিতে শুরু করবে সেই মুহুর্তে ওর সাথে কথা বলাও তোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। মাইন্ড ইট!”

উদ্যানের কথাগুলো বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সোহম। ফুলকে সঠিক রাস্তায় পাওয়া এই জন্মে সম্ভব হবেনা। কারণ উদ্যান থাকতে ফুলকে কখনোই সুখে থাকতে দেবে না। সোহম কিছু একটা ভেবে বলল,
“তুই থ্যাঙ্কফুলকে আমায় দিয়ে দে, আমি ওকে কষ্ট দেবো। একটুও শান্তি দেবো না। তুই ওকে নিজের মেইড হিসেবে ইউজ করিস, আমি জাস্ট ওকে বিয়ে করতে চাই।”

সোহমের কথা শুনে উদ্যানের ভ্রু কুচকে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,
“তুই নাইট স্পেন্ড করতে চাইছিস ওর সাথে?”

সোহম ভড়কে গেল, এভাবে কে বলে? হ্যাঁ সে নাইট স্পেন্ড করতে চায়। কিন্তু বউয়ের সাথে, অন্য কারো সাথে না। এরইমাঝে ফুল চা বানিয়ে এনে উদ্যানের সামনে ধরল, উদ্যান চায়ের কাপটা হাতে নিতেই ফুল চলে যেতে উদ্যত হয়। তখনই উদ্যান অন্য হাতে ফুলের হাত চেপে ধরল। তারপর কোনোপ্রকার ভাবনা চিন্তা ছাড়াই গলা ছেড়ে বলল,
“ইউ ডোন্ট নিড টু ম্যারি হার… টু হ্যাভ দা নাইট।”

উদ্যানের কথাটা শুনে ফুলের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। এদিকে সোহম নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। উদ্যান খুব ভালো করেই জানে সোহম বিয়ে ছাড়া কারো সাথেই কিছু করবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারপরেও এসব বলার মানে কি? তাও আবার ফুলের সামনে? ঘৃনায় ফুলের শরীর শিউরে উঠল,
“কি বললেন?”
“মুর্খ তুই? কি বললাম বুঝতে পারিস নি?”

প্রচন্ড ক্রোধে ফুলের নাকের পাটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। চোখজোড়া পানিতে ভরে উঠল। ওষ্ঠদ্বয় অনবরত কাঁপতে লাগল। উদ্যানের থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উদ্যান গর্জে উঠল,
“তোর আচরণে আমি বিরক্ত হচ্ছি। রাগিয়ে দিস না আমায়।”

সোহম এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল, “তেহ ওকে ছেড়ে দে। আমি ইন্টারেস্টেড নই।”

সাথে সাথেই উদ্যান ফুলকে ছেড়ে দিল। ছাড়া পেতেই ফুল স্থান ত্যাগ করল। আর সোহম বিরসমুখে বলল,
“এভাবে মেয়েটার চোখে আমায় খারাপ করে দিলি?”

হাতে থাকা কাপে একটা চুমুক দিয়ে উদ্যান বলল,
“তুই ওর চোখে ভালো হতে চেয়েছিস?”
“তেহ তুই বুঝতে পারছিস না।”
“তুই রাত কাটাতে চাইলে বিয়ে না করে কাটাতে পারিস কারণ এতে মেয়েটা কষ্ট পাবে। যদিও আমার সন্দেহ আছে মেয়েটা আদৌ এসবে কষ্ট পাবে কিনা। বয়ফ্রেন্ডের কিস খেয়ে তো বেশ স্যাটিসফাইড হয়েছিল। তবে মেয়েটা কষ্ট পেলেই আমি সন্তুষ্ট। স্বাভাবিক ভাবে বিয়ে করে রাত কাটালে মেয়েটা একদমই কষ্ট পাবেনা কারণ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এসব হওয়াটা স্বাভাবিক। তার উপর মেয়েটা ক্যারেক্টরলেস।”

উদ্যানের কথায় সোহম হাল ছেড়ে দিল। আপাতত ফুলের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা ছাড়া উপায় নেই।
“এইটুকুন একটা মেয়ের সাথে তোর কিসের এতো শত্রুতা তেহ, বুঝতে পারছিনা।”
“বুঝতে পেরে কি করবি? তোদের বুঝিয়ে আমার লাভ টা কি হবে? তার চেয়ে ভালো হবে তুই এই শত্রুতার মধ্যে আসিস না।”
“আমি এসেও তোর বিশেষ কিছু করতে পারবো না। পরিশেষে তুই-ই জিতে যাবি। তাই বৃথা চেষ্টাও করবো না। তবে হোপফুল কোনদিন জানি আমাকে কন্ট্রোললেস করে দেয়। সেদিন হয়তো আমি নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে গিয়ে বিয়ে ছাড়াই…
“সেদিন তুই রিদমের কাছে হেরে যাবি। প্রমাণ করে দিবি পুরুষ জাতি আসলেই জঘন্য।”

সোহম শ্বাস ফেলে উদ্যানের দিকে তাকাল। উদ্যান কতো সহজে কথাটা বলে ফেলল।
“কেন তুই আছিস না? তুই-ই তো জলজ্যান্ত প্রমাণ যে সব পুরুষ এক নয়।”
“আমি তো মনস্টার, মনস্টারের মধ্যে এসব ইমোশন কাজ করবে না সেটাই স্বাভাবিক। তাই আমাকে দিয়ে সব পুরুষকে জাজ করা সঠিক হবেনা।”
“তার মানে ফুলকে বিয়ে করতে দিবি না?”
“না।”

ব্যস, সোহম আশা ছেড়েই দিল। দেখা যাক কতদিন নিজেকে সামলে রাখতে পারে।

কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। ফুল এই বাড়িতে আসার আজকে এগারো তম দিন। আবেশের অপেক্ষাতেই ফুল দিনাতিপাত করছে। এরমাঝে উদ্যান তাকে দিয়ে কাজ করালেও আঘাত করেনি। গতরাত থেকে মনস্টার টা বাড়িতেও নেই। মনস্টার টার অনুপস্থিতিতে বাড়িতে আলাদাই একটা শান্তি বিরাজ করছে। বিকেলের দিকে ফুল নিজের কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখছিল। হঠাৎ করেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ ভেসে এলো। আওয়াজটা শুনেই ভয়ে তটস্থ হয়ে যায় ফুল। তার অভিব্যক্তি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তার সাইনোফোবিয়া আছে। তন্মধ্যেই আওয়াজটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। ভয়ে ফুলের বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে,
“ফুল, মাস্টার তোমাকে ডাকছেন।”

রুমার ডাকে ফুল ঘাড় বাকিয়ে দরজার দিকে তাকাল। হাতে থাকা কাপড়টা সাইডে রেখে ধীরপায়ে রুম থেকে বের হলো। সে রুমা আর নাদিয়ার সাথে একরুমেই থাকে। লিভিং রুমের অন্যপাশে সার্ভেন্ট রুম; এখানে আরও কয়েকটা রুম আছে তারপরেও তারা তিনজন একরুমেই থাকে। রুম বড় হওয়াতে সমস্যাও হয়না। লিভিং রুমে আসতেই ফুল হতবাক হয়ে গেল। উদ্যান সোফাতে বসে আছে, তার কোলের মাঝে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছে মাঝারি আকারের ডোবারম্যান প্রজাতির কুকুর। কালো বর্ণের কুকুরটাকে দেখামাত্রই ফুলের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল, এই মনস্টার টা কি তার সাইনোফোবিয়ার কথা জেনে গিয়েছে? জেনে গিয়েই কি তাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কুকুর নিয়ে হাজির হলো? ফুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উদ্যান বলল,
“ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়, তানের মেডিসিন গুলো বুঝে নে। আজ থেকে ওর দেখাশোনা তোকেই করতে হবে, এটাই তোর মূল কাজ।”

ফুলের চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। আজ থেকে এই কুকুরের দেখাশোনা তাকে করতে হবে? ভয়ে ফুলের প্রাণপাখি ডানা ঝাপটাতে শুরু করল, তার অবস্থা দেখে নাদিয়া ফিসফিসিয়ে বলল,
“যাচ্ছো না কেন? মাস্টার কিন্তু রেগে যাবেন। তান হচ্ছে তার প্রাণ, একমাসের চিকিৎসা শেষে তান বাড়িতে ফিরেছে।”

ফুলের চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমল।
“এই তানের ব্যপারে তো আগে কিছুই বললে না আমাকে।”
“তোমার সাথে বাড়তি কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের কাজ বুঝে নেও গিয়ে।”

ফুল জানে তার সাইনোফোবিয়ার কথা জানতে পারলে উদ্যান আরও বেশি চড়াও হবে। তাই এই ব্যপারে বুঝতে দেওয়া যাবেনা। ফুল একটা শুষ্ক ঢোক গিলে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে উদ্যানের সামনে এসে দাঁড়াল। উদ্যানের পাশে আরও দুজন সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে আছে, তাদের উদ্দেশ্যে উদ্যান বলল,
“ওকে সবগুলো মেডিসিন বুঝিয়ে দেও।”

উদ্যানের কথামতো একজন সার্ভেন্ট ফুলের সামনে মেডিসিন গুলো রাখল। ফুল তো ভয়ার্ত চোখে তানের দিকে তাকিয়ে আছে, সার্ভেন্ট তাকে কি বলছে—না বলছে সেই দিকে সে মোটেও মনোযোগ দিকে পারছেনা। উদ্যানের কোলে থাকা তানকে দেখে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছেনা। হয়তো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই ফিরে এসেছে। উদ্যান তো একমনে তানের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, উদ্যানকে নরম হতে এই প্রথম দেখল ফুল। বর্তমানে উদ্যানকে তানের বাবা বলে মনে হচ্ছে, বাবার মতোই বিহেভ করছে। ভাবনা টা মাথায় আসতেই ফুল হাসফাস করে উঠল। আহ কিসব ভেবে ফেলল,
“মনোযোগ দিয়ে শুনে নে, তানের ব্যপারে কোনোপ্রকার কম্প্রোমাইজ করবো না আমি।”

উদ্যানের কথায় ফুল মনে মনে আওড়ায়,
“হুহ, এমন ভাবে বলছে যেন বাকি সব ব্যপারে কম্প্রোমাইজ করে খুব।”

ফুল এবার ওষুধ গুলো খাওয়ানোর নিয়ম ভালো ভাবে বুঝে নিল। তারপর উদ্যান তানকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ফুল আর বাকি দুজন সার্ভেন্টও তার পিছুপিছু গেল।

ঘড়ির কাটায় রাত এখন ১২ টা। কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির সবাই একসাথে ডিনার করে নিয়েছে। ফুলের শরীর টা ভালো লাগছেনা, বিকেলের পর থেকে তানের আশেপাশে থাকতে হয়েছে তাকে। যদিও তানের সব খেয়াল উদ্যানই রেখেছে, তানের সংস্পর্শে যেতে হয়নি ফুলকে। তবুও সাইনোফোবিয়ার প্রভাবে ফুলের জ্বর চলে এসেছে। তানকে দেখে যা বুঝল, তান আসলেই উদ্যানের প্রাণ। একটা কুকুরের প্রতি উদ্যানের এতোটা সহানুভূতি দেখে ফুল বিস্মিত হয়েছে। কুকুরের প্রতি যত্নশীল একটা লোক কিভাবে ফুলের মতো মেয়ের উপর টর্চার করতে পারে ভেবেই কুল পাচ্ছেনা ফুল। মাঝরাতে ফুলের শরীরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়। শরীর ঝাকিয়ে জ্বর আসে। ফুল বিছানার একপাশে শুয়েছে। রুমা মাঝে আর নাদিয়া অন্যপাশে শুয়েছে। ফুল গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে, প্রচন্ড খারাপ লাগছে, মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। সারাটা রাত ছটফট করে কাটায় ফুল। ভোরের দিকে আর শুয়ে থাকতে পারলো না, গলা শুকিয়ে আসছে, একটু পানি প্রয়োজন। ফুল একবার ভাবল রুমাকে ডাক দেবে তারপর আবার ভাবল থাক, এমনিতেও সারাদিন কাজ করতে করতে একটু বিশ্রাম নেওয়ারও ফুরসৎ পায়না। এখন ঘুম ভাঙাটা ঠিক হবেনা।
ফুল ধীরে সুস্থে উঠে দাড়াল, লিভিং রুম পেরিয়ে ডাইনিং হলে উঁকি দিতেই সে অবাক হয়ে গেল। উদ্যান টেবিলে বসে চা খাচ্ছে আর ফোন চাপছে। কিন্তু উদ্যান তো রাতে বাড়িতে থাকেনা। কখনও কখনও সন্ধ্যার পর পরই চলে যায় আবার কখনও কখনও ডিনার শেষে বেরিয়ে যায়। তাহলে আজকে এই সময় ডাইনিং হলে কি করছে? জ্বরের ঘোরে ফুল অসাবধানতা বশত পাশে থাকা টবের সাথে ধাক্কা খেল। নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ আওয়াজে উদ্যানের শ্রবণ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেল। স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি তাকাল ফুলের দিকে, ফুল ভাবল উদ্যান হয়তো রেগে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। উদ্যান তাকে পুরোপুরি ভাবে অগ্রাহ্য করে নিজের কাজে মনোযোগী হয়। ফুল উল্টো দিকে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো, উদ্যানের উপস্থিতিতে পানি খেতে যাওয়া আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা সমান। তার উপর উদ্যান যদি জানতে পারে ফুলের শরীর খারাপ তাহলে তো আর কথাই নেই। এসব ভেবেই ফুল দু কদম এগিয়ে গেল কিন্তু হঠাৎ করেই তার মাথা ঘুরে যায়।
আচমকা ধাম করে আওয়াজ হওয়াতে উদ্যান হাতে থাকা চায়ের কাপটা সাইডে রেখে দরজার দিকে তাকাল। ফুলের নিথর দেহটা সেখানেই পড়ে আছে। এহেন দৃশ্য দেখে উদ্যানের ভ্রু কুচকে গেল। ধীরপায়ে ফুলের সামনে এসে দাঁড়ায় উদ্যান। লিভিং রুমে দু একটা ড্রিম লাইট জ্বলছে সেই আলোয় ফুলকে আবছা দেখা যাচ্ছে। উদ্যান এসে ফুলের শিয়রে বসল,
“কি রে তুই এখানেই ঘুমিয়ে পড়লি কেন?”

ফুলের থেকে উত্তর না পেয়ে উদ্যান বিরক্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করল,
“হুদাই বেহুশ হয়ে গেলি?”

চলবে,,,

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply