#অন্তরালে_আগুন
#পর্ব:৪
#তানিশা সুলতানা
মানিকগঞ্জ বিজয় মেলার মাঠ প্রাঙ্গণে বিশাল বড় সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। শহিদ মিনারের সামনে স্টেজ সাজিয়েছে। বিভিন্ন ধরণের ফুলের গন্ধে মো মো করে জায়গাটা।। মানিকগঞ্জ জেলায় মোট ৭ টি উপজেলা রয়েছে। এবং প্রতিটা উপজেলায় একজন করে চেয়ারম্যান। সেই ৭ জন চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকবেন এই সভায় এবং মানিকগঞ্জ জেলার এমপি শাহাবুদ্দিন সোহেনও থাকবে।
সকলের উপস্থিত হওয়ার মূল উদ্দেশ্য শিক্ষা মন্ত্রী নায়েব তালুকদার এই সভার আয়োজন করেছে। সামনেই নির্বাচন। নির্বাচনের আগে নিজ জেলার এমপি চেয়ারম্যান এবং জনগণের সঙ্গে একটু আলাপ আলোচনা সেরে নিতে পারলে ভালোই হবে।
ইতোমধ্যেই বিজয় মেলার মাঠ প্রাঙ্গণ ভরে উঠেছে সাধারণ জনগণ দ্বারা। চেয়ারম্যান এবং এমপি উপস্থিত হয়েছে। তবে এখন ওবদি পৌঁছাতে পারে নি শিক্ষা মন্ত্রী নায়েব তালুকদার।
রিকশা ওয়ালা অটো ওয়ালারা বোধহয় আজকে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। শিশু পার্কের সামনে রিকশা এবং অটোগুলো দাঁড় করিয়ে রেখে তারা সভায় উপস্থিত হয়েছে। সকলের মুখে মুখে একটাই কথা “এবারের নির্বাচনে নায়েব তালুকদারকে জিতিয়ে দিতে হবে। মন্ত্রী যদি নিজ এলাকার হয় তাহলে আমাদেরই লাভ”
মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ইনকোর্স এক্সাম চলছে। গার্ড দিতে হবে সোনিয়াকে। তাছাড়া অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক ব্যাস পড়ানো হয় তিনটায়। তারাও অপেক্ষায় থাকবে।
এতোকিছু চিন্তা করে তৈরি হয়ে নেয় সোনিয়া৷
নুপুর আজকে কলেজে যায় নি। বাবা বারণ করে গিয়েছে। প্রচুর ভিড় থাকবে মানিকগঞ্জ শহরে। মারামারিও হতে পারে। তাই সোফায় শুয়ে সাইয়্যারা মুভি দেখতেছিলো সে। রিসেন্টলি হলে বেরিয়েছে মুভিটা। বেশ হাইপে উঠে গিয়েছে ইতোমধ্যেই। সকলের মুখে মুখে সাইয়্যারা মুভির প্রশংসা। কি আছে এই মুভিতে? ঠিক এটা জানতেই আড়াই ঘন্টা সময় অপচয় করে মুভি খানা দেখা।
তবে খারাপ না। সানাম তেরি কসম মুভির মতো অতোটা ভালো না হলেও মোটামুটি ভালো। আর এই মুভি এতো হাইপ এ ওঠার কারণ এতে মারামারি নেই। খুবই নিরব এবং রোমান্টিক মুভি। যা এই জেনারেশন এর মানুষ ভর্তি পছন্দ করে।
মাকে হিজাব করতে দেখে টিভি খানা বন্ধ করে নুপুর। মায়ের মুখ পানে তাকিয়ে বলে
“আম্মু কোথায় যাবে?
হিজাব করা শেষ সোনিয়ার। এবার ব্যাগে ফোন ঢোকাতে ঢোকাতে বলে
” কলেজে যেতে হবে। ইনকোর্স এক্সাম চলছে তো।
নুপুর চট করেই সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
“আমিও যাবো।
সোনিয়া ভ্রু কুচকে তাকায় নুপুরের মুখ পানে।
” কেনো?
মায়ের গম্ভীর কন্ঠস্বরে একটুখানি ভয় পায় নুপুর। কাচুমাচু হয়ো বলে
“আব্বু বললো না ভিড় হবে? তোমায় একা ছাড়া যাবে না। তাছাড়া একা একা বাড়িতে কি করবো? দাদুও তো ফুপিবাড়ি চলে গেলো।
” কলেজে বসে থাকতে হবে আমার কাছে। তিড়িং বিড়িং করা যাবে না।
“ঠিক আছে আম্মু।
নুপুর চট করে প্লাজু আর টিশার্ট পাল্টে থ্রি পিচ পড়ে নেয়। একটু আগেই গোসল সেরেছে। চুল গুলো ভেজা তাছাড়া হিজাব করার সময় নেই।
বাধ্য হয়েই হাঁটু ওবদি লম্বা চুল গুলো খোলা রেখে বেরিয়ে পড়ে মায়ের সাথে।
___
শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ি বিজয় মেলার মাঠ ভাঙ্গনের কাছাকাছি পৌঁছতে হই হুল্লোড় লেগে যায়। ভিড় বাড়তে থাকে তরতর করে। সকলেই জয়ের ধ্বনি আওরাতে থাকে। যেনো মন্ত্রীত্ব লাভ করে ফিরেছেন তিনি। গেইটের সামনে পরপর তিনটে গাড়ি থামে। প্রথম গাড়ি থেকে বের হয় মজনু তালুকদার, রাশেদুল তালুকদার এবং নিরব। তাদের ভিড় ঠেলে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু বডিগার্ড নিয়ে আসা হয়েছে।
পরবর্তী গাড়ি থেকে বের হয় নায়েব তালুকদার এবং নওয়ান রিশাদ মুসতালিন। বরাবরের মতোই ঠোঁটের ভাজে জলন্ত সিগারেট। পরনে কালো রংয়ের পানজাবি। হাতা গুটিয়ে কনুই ওবদি উঠিয়ে রেখেছে। বড় বড় চুল গুলো ঘাড় ছুঁয়েছে। ফর্সা হাতের কবজিতে ঝুলছে ঘড়ি। আর হাতের এক আঙুলে এক খানা আংটি।
নওয়ানের পেছনে নায়েব। দুই বাপ বেটা স্টেজ এর দিকে এগোতে থাকে। নওয়ান ভাই জিন্দাবাদ বলে চিৎকার করতে থাকে সকলেই। ওদিকে ফিরেও তাকায় না সে। তার দৃষ্টি দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে। মেজাজটা বদ্ধ খিটখিটে হয়ে আছে।
স্টেজে সারি সারি চেয়ার সাজানো। আগে থেকেই মজনু তালুকদার নিরব এবং রাশেদুল বসে আছে। নওয়ান স্টেজে উঠতে নিলে একটা মেয়ে ফুল এগিয়ে দেয়। মূলত এই মেয়েটিকে রাখা হয়েছে মন্ত্রীকে স্বাগতম জানাতে।
নওয়ান মেয়েটিকে উপেক্ষা করে নিজ আসনে গিয়ে বসে পড়ে।
নায়েব তালুকদার ছেলের ব্যবহারের জন্য মেয়েটাকে স্যরি বলে এবং নিজে ফুল গুলো নিয়ে নেয়। তারপর গিয়ে নওয়ান এর পাশে বসে।
স্টেজের সামনে সাধারণ জনগণদের বসার জন্যও চেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে। সামনের সারিতে ৭ জন চেয়ারম্যান বসে আছে।
এমপি মাইকে বক্তৃতা দিচ্ছে।
নওয়ান এর নজর পড়ে নাসিরের পানে। দুই ভ্রু আড়াআড়ি ভাবে কুঁচকে ফেলে সে। শালার মতবল সুবিধার ঠেকছে না।
শিক্ষা মন্ত্রী নায়েব তালুকদারের ভাষণ দেওয়ার সময় আসে।
তিনি নিজ স্থান হতে উঠে মাইক্রোফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রথমেই জনগণদের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে বলতে শুরু করে
“ভাইসব আমি আপনাদের এলাকার মানুষ। আপনাদের সন্তান আপনাদের ভাই আপনাদের অভিভাবক। শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘ দিন ছাত্র ছাত্রীদের জন্য লড়াই করেছি। তাদের সুস্থ ভবিষ্যত দেওয়ার চেষ্টা নিজেকে উৎসর্গ করেছি। এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে চাচ্ছি।
আশা রাখছি আমার এই সিদ্ধান্ত আপনাদের সহযোগিতা পাবো। আপনারা পাশে থাকবেন আমার। বেওথা হতে আন্ধারমানিক যাওয়ার রাস্তা ভাঙা ছিলো। অটো গাড়ি চলতে ভীষণ অসুবিধা হতো। সেই রাস্তা ঠিক করে দিয়েছি আমি।
ঠিক তেমন ভাবেই আমার শহরের সব অসুবিধা দূর করবো কথা দিচ্ছি।
নায়েব তালুকদারের ভাষণ শুনে সকলেই হাত তালি দেয়। নায়েব আরও বলে
” আমি চাচ্ছি আমাদের জেলার সব চেয়ারম্যান পেঁপে মার্কাকে সমর্থন করুক। অন্য কোনো মার্কার ভোট হবে না। এবারের নির্বাচনে একটা মার্কাই থাকবে। সেটা?
সকলেই এক সঙ্গে চিল্লিয়ে বলে ওঠে
“পেঁপে।
নাসির দাঁড়িয়ে পড়ে। নায়েব তালুকদারের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে
“একজন প্রধানমন্ত্রী একটা দেশের অভিভাবক।
তাকে নিষ্ঠাবান বিচক্ষণ দায়িত্বশীল এবং সৎ চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। মিস্টার নায়েব তালুকদার আপনার নামে মানিকগঞ্জ থানায় বিশটা মার্ডার কেসের মামলা এবং অহরহ চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন
আপনি কি আদৌও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য?
বড়ই স্পষ্ট কন্ঠস্বর নাসিরের। নেই কেনো ভয়, নেই কোনো জড়তা। চারিপাশের জনগণের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। সকলেই নাসিরকে সমর্থন করছে। সত্যিই তো একটা দেশের দায়িত্ব নিতে হলে তাকে অবশ্যই ভালো মানুষ হতে হবে।
নায়েব একটু হেসে নাসিরকে বলে
” কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?
বিত্তশালী বা উঁচু পদের মানুষের নামে ছোট ছোট অভিযোগ থাকবেই। ইটস নরমাল।
নাসির পূণরায় বলে
“প্রমাণ আছে আমার কাছে। জনগণ কিংবা সাংবাদিকরা চাইলে দেখাতে পারি।
চটে ওঠে নওয়ান। ফোন খানা পকেটে পুরে ঠোঁটের ভাজ হতে সিগারেট ফেলে দেয়। এবং ভরা মজলিসে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে
“ওই শালা বস। তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে দিবো।
তুই যে নির্বাচনের আগে জনগণের থেকে ভোট কিনে নিয়েছিলি তার প্রমাণ আছে আমার কাছে।
তোকে চেয়ারম্যান বানানোর পক্ষে কেউ ছিলো না। চোদ্দ গুষ্টিই গুন্ডা তোরা।
এই বল্টু প্রমাণ আন।
মুহুর্তেই বল্টু শিবালয় উপজেলার একজনকে ধরে আনে। নাসির বেশ চিনে তাকে। ভোটের সময় সাহায্য করেছিলো।
লোকটা সর্বসম্মুখে বলে ওঠে
” জ্বী নাসির খান ভোট কিনে নিয়েছিলো। এবং এলাকার মানুষের ভয় দেখিয়ে ভোটে জিতেছে।
আশ্চর্য হয় নাসির। অকপটে কি সুন্দর মিথ্যে বলে দিলো। নায়েব পূণরায় বলে
“আমার ছেলের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেটা নাকোচ করেছি বলে এভাবে সর্বসম্মূখে অপদস্ত করছেন?
ঠিক আছে প্রস্তাবে রাজি আমি। তবুও দয়া করে বদনাম রটাবেন না। বড্ড কষ্ট করে নিজের পরিচিত এবং সম্মান আর্জন করেছি।
নাসির থতমত খেয়ে যায়। তিনি কবে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো? কি বলছে এসব?
সাংবাদিকরা মুহুর্তেই নিউজ করে ফেলে।
নওয়ান ঠোঁট বাঁকায়। নাসির প্রতিবাদের স্বরে বলে
” আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবো এই বেয়াদবটার
বাকিটা শেষ করার আগেই নওয়ান স্টেজ থেকে নেমে আসে। নাসিরের সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে
“নয় ঘন্টার মধ্যে তোর মেয়েকে বিয়ে করবো। আর নিউজ ছড়াবো ১০ লাখ টাকার জন্য নিজের মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছিস নওয়ান রিশাদ মুসতালিন এর কাছে। চুপচাপ বসে পড়। ডোন্ট টক।
নাসির মাথা নিচু করে বসে পড়ে। রাগে থরথর করে কাঁপছে হাত পা।
___
সোনিয়াকে ক্লাস রুমে পৌঁছে দিয়ে কলেজের পেছন দিকটায় চলে আসে নুপুর। এখানে বিশাল বড় একটা পুকুর রয়েছে৷ দেবেন্দ্র কলেজের দুই পাশেই পুকুর।
এই পুকুরের ওই পাড়ে মহিলা হোস্টেল। তাছাড়া সান বাঁধানো ঘাটও রয়েছে।।
নুপুর সেখানে বসে পড়ে। আজকে দেবেন্দ্র কলেজ বড়ই চুপচাপ। গুটি কয়েক স্টুডেন্ট ছাড়া একটা কুকুরেরও দেখা নেই। দোকানপাট সব বন্ধ।
সকলেই যে সমাবেশ দেখতে গিয়েছে।
নুপুর ব্যাগ থেকে ফোন এবং হেডফোন বের করে। হেডফোন কানে গুঁজে ইউটিউব এ ঢুকে পড়ে। প্রথমেই নওয়ান রিশাদ মুসতালিন এর একটা ভিডিও সামনে পড়ে।
নীল রংয়ের ড্রিম লাইট জ্বালানো কক্ষে। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে গিটার বাজাচ্ছে। মুখ খানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ঢালাঢালা এক খানা টিশার্ট গায়ে। গিটারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গেয়ে উঠছে
“”তুমি দেখছো তাকে
ভাবছো যাকে
আসলে সে মানুষ নয়
সে বেঁচে আছে পৃথিবীর এক কোণে
সে মৃত মানুষের চিৎকার শুনে।
নুপুর মনোযোগ দিয়ে গান খানা শোনে। এবং বিরবির করে বলে ওঠে
” লোকটা ভালোই গান গাইতে পারে।
গুন্ডামী আর বেয়াদবি বাদ দিলে জীবনে কিছু একটা করতে পারতো।
হঠাৎ পেছন থেকে অতি পরিচিত বিরক্তিকর একখানা কন্ঠস্বর ভেসে আসে
“মিস ইঁদুর
কাম হেয়ার
নুপুর হেডফোন খুলে পেছনে তাকায়। কালো রংয়ের বাইকে বসে আছে নওয়ান। ঠোঁটের ভাজে সিগারেট। কালো পানজাবি খানা ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে।
ফর্সা গালেও বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা।
ভ্রু কুঁচকায় নুপুর। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আজকে লোকটা একা।
কেউ নেই।
আশ্চর্য
নুপুরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয় নওয়ান। সিগারেটে টান দিয়ে বলে ওঠে
” ওই শালী ডাকছি কানে ঢোকে না?
নুপুর চোখ মুখ কুঁচকে ফোন এবং হেডফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।
তারপর জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে নওয়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়৷ তখনই
চলবে……
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব (২৪+২৫)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৮
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১০
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৯
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৬
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২০
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৫(৫.১+৫.২)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৭