অন্তরালে_আগুন
পর্ব:৩৩
তানিশা_সুলতানা
নুপুর বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো লালচে রং ধারণ করেছে। অন্ধকার একটা কুটিরে বন্দী করা হয়েছে তাকে। আশেপাশে আরও অনেকগুলো মেয়ে রয়েছে। সকলের চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। তবে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আনু নুপুরের হাত জড়িয়ে পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। যেন বহুদিন হলো সে ঘুমায় না। আজকে ভরসাযোগ্য একটা কাঁধ পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া করছে না।
এতক্ষণে নুপুর বুঝে গেছে এসব কিছু নায়েব তালুকদারের কারসাজি। এবং এখান থেকে মুক্তি পাওয়া এক্কেবারে অসম্ভব।
তবুও মনের মধ্যে কোথাও একটা আশা রয়েছে কেউ একজন আসবে। আর সেই কেউটা নওয়ান তালুকদার। সে আসবে নুপুর কে মুক্ত করবে এবং এখান থেকে নিয়ে চলে যাবে।
ধ্বংস করবে পাপের রাজ্য শাস্তি দেবে তার বাবাকে এবং নিজেও শুধরে যাবে। বন্দি থাকা মেয়েগুলো নতুন জীবন ফিরে পাবে। আনু আগের মত হয়ে যাবে।
এই স্বপ্ন নুপুরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটায়।
হঠাৎ করে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ কানে আসে। এখন কি মাঝ রাত? নাকি দিন? মাঝেমধ্যে একটু আকটু মানুষের কোলাহলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এই জায়গাটা কেমন? এতগুলো মেয়ে এখানে বন্দি আছে কেউ কি বুঝতে পারছে না?
কেউ কি জানার আগ্রহ প্রকাশ করছে না কি আছে এই জায়গায়?
“নুপুর চিনেছ আমায়? আমি বৃষ্টি।
অন্ধকারে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পায় নুপুর। মুখখানা দেখলে হয়তো চিনতেও পারতো। তবে মাথা খাটিয়ে বের করে
“আমার সাথে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল সেই বৃষ্টি?
বৃষ্টি তাড়াহুড়ো করে জবাব দেয়
“হ্যাঁ। আমি সেই বৃষ্টি।
পুনরায় নুপুরের চোখ দুটো ভিজে উঠে।
এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনের ঘটনা। পরীক্ষার শুরুর দিন সাধারণত সব বাচ্চারা বাবা-মায়ের সঙ্গে পরীক্ষার কেন্দ্রে আসে। বৃষ্টিও তাই এসেছিল। ছোট বাচ্চাদের মত বাবার হাত ধরে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
ওর বাবা বারবার বলছিল
“একদম ভয় পাবে না। আমি বাইরেই থাকবো। পরীক্ষা শেষে আবার তোমায় নিয়ে যাব।
নুপুরের বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল বিষয়টা। এসএসসি পরীক্ষার্থী কোন মেয়ে এতটাও ছোট নয় যে বাবা ছাড়া দু মিনিটও থাকতে পারবে না। কিন্তু এই মেয়েটা একটু বেশি বাচ্চামি করছে।
পরে জানতে পারলো জীবনে প্রথমবার বাড়ি থেকে এতটা দূরে এসেছে পরীক্ষা দিতে।
এমনকি আজ অব্দি একা স্কুলেও যায়নি সে। বাবা মা বা পরিবারের কেউ তাকে দিয়ে আসে এবং নিয়ে আসে।
সেই ননির পুতুলটা এই প্রতিতালয়ে। বাবাকে ছেড়ে কতটা দূরে চলে এসেছে। কতগুলো বছর হবে এখানে আছে কে জানে?
আহারে
জীবনে এত অদ্ভুত কেন?
আর মানুষ এত স্বার্থপর কি করে হতে পারে? কি করে পারে একটা মানুষ হয়ে আরেকটা মানুষের ক্ষতি করতে?
নুপুরের ভাবনার মাঝেই বৃষ্টি বলে ওঠে
“ওর বাবাকে দেখেছিলে? রাস্তাঘাটে তার সঙ্গে দেখা হয়? এখনো কি টাকা বাঁচানোর জন্য পায়ে হেটে বাসায় ফিরে?
হ্যাঁ নুপুর দেখেছিল বৃষ্টির বাবাকে। এইতো মাস দিন এক আগে কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখতে পায় মধ্য বয়সী লোকটা রাস্তার পাশে বসে আছে। চোখ দুটো তার টলমল করছে।
নুপুরে এগিয়ে যায় তার কাছে। কৌতুহল বসত তার পাশে বসে প্রশ্ন করে
“কাঁদছেন কেন আঙ্কেল? বৃষ্টি কেমন আছে?
প্রশ্নটা করা বুঝি উচিত হয়নি নুপুরের। লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
কলেজ ড্রেস পরে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকা মেয়েদের পানে দৃষ্টি তার। হয়তো তাদের দেখতেই রাস্তার পাশে বসে ছিল।
“আমার পাখিটার ইচ্ছে ছিল দেবেন্দ্র কলেজে পড়বে। আমি তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যাবো।
নতুন ব্যাগ কিনবে। দুটো কলেজ ড্রেস বানিয়ে দিতে হবে। একটাতে নাকি হবেই না।
কোথায় হারিয়ে গেল আমার মেয়ে।
কিভাবে থাকে আমাকে ছেড়ে?
নুপুর ঠিক বুঝতে পারে না ওনার কথা। তবুও প্রশ্ন করে না। লোকটা আবার বলে
“আমাকে বলেছিল বাবা 5 মিনিটে আসছি।
আর আসলো না একে একে পাঁচটা মাস হয়ে গেল আমার পাখি ফিরল না।
আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন উনি। কিন্তু কান্নার ফলে বলতে পারছিলেন না। জৈষ্ঠ্য মাসের প্রচন্ড গরম এবং সূর্যের তাপে মুহূর্তে অস্থির হয়ে উঠছিলো। নুপুর অতি দ্রুত সদর হাসপাতালে ভর্তি করায়। তারপর আর দেখা হয়নি। কিন্তু নুপুর দেখা করতে চেয়েছিল। ব্যস্ততা নিজের জীবনের এত সমস্যা সব মিলিয়ে সময় হয়ে ওঠেনি।
নুপুরে থেকে জবাব না পেয়ে বৃষ্টি বোধহয় একটু কষ্টই পেলো। চুপ হয়ে গেলে বাকিদের মত।
গোটা শহরে কারফিউজারি করা হয়েছে। গাড়ি চলাচল থেকে শুরু করে মানুষ জনদেরও বেরোনো বারণ। চারিদিকে পুলিশের গাড়ি শব্দ। চারিদিকে পুলিশ আর্মিরা বন্দুক হাতে দৌড়াদৌড়ি করছে। নুপুরের ফটো দেখিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে “মেয়েটিকে কেউ দেখেছে কি না”
কিন্তু কেউ জবাব দিতে পারছে না। যারা দেখেছে তারাও চুপ করে আছে।
গোটা মানিকগঞ্জ শহরটাকে তন্য তন্য করে ফেলা হয়েছে বিগত দুই ঘন্টায়। কোথাও এতটুকু প্রমাণ পরে নেই কোথায় থাকতে পারে নুপুর।
হঠাৎ করে নওয়ানের মাথায় আসে আনুর কথা। তবে কি আনু কাছে চলে গেল?
মুহূর্তে খবর নিয়ে জানতে পারে পতিতালয়ে কোন মেয়ে নেই। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কোথাও একটা।
অস্থির হয়ে ওঠে নাওয়ান। বল্টু পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখে। ভরসার স্বরে বলে
“ভাই অস্থির হবেন না।
আমরা ঠিক খুঁজে পেয়ে যাবো ভাবিকে।
বল্টুর কথায় নওয়ান জবাব দেয় না। তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে
“তোমায় একবার খুঁজে পেলে আর কখনো হারাতে দেবো না।
অভির ধারণা মতে নায়েব তালুকদার মেয়েগুলোকে বিদেশে পাচার করে দেবে। সেই অনুযায়ী তাদের এখন এয়ারপোর্ট থাকার কথা।
মুহূর্তে এয়ারপোর্টে কল দিয়ে সবগুলো ফ্লাইট ক্যান্সেল করে দেওয়ার কথা বলা হয়। এবং নুপুরের পিকচার পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাকে পাওয়া গেলে যেন আটকে রাখা হয়।
কিছু মুহূর্তের মধ্যেই দুটো হেলিকপ্টার চলে আসে দৌলতদিয়া। একটাতে অভি এবং আহিল এবং দ্বিতীয় টাতে নেহাল এবং পুলিশরা উঠে পড়ে। ঘন্টাখানেক এর মধ্যে সকল উপস্থিত হয়েছে এয়ারপোর্টে। অভিকে কেমন পাগল পাগল দেখাচ্ছে। সে গোটা এয়ারপোর্ট দৌড়াদৌড়ি করছে। একে ওকে ধরে জিজ্ঞেস করছে “নুপুরকে দেখেছে কি না”
তারা অস্বীকার করতে তাদের মারধর করছে। চিল্লিয়ে বলছে “কেনো দেখো নি? চার ঘন্টা হয়ে গেলো আমার নুপুর মিসিং তোমরা কেনো তাকে দেখছো না?
কেনো?
নেহাল এবং সিফাত অভিকে থামায়।
টেনে নিয়ে আসে এয়ারপোর্টের বাইরে।
থর থর করে কাঁপছে তার হাত পা। ঘেমে নেয়ে একাকার। বুকের ধুপবুকানি বেড়েই চলেছে। যদি নুপুরকে খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে অভি বাঁচবে না। কিছুতেই না কোনো মতেই না।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৮
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৬
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩০
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৬+২৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১০
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৪