#অন্তরালে_আগুন
#পর্ব:২৪
#তানিশা সুলতানা
কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নুপুর। এ বাড়িতে এসেছে ৫/৬ দিন হলো। ভালো সুখকর কোনো স্মৃতি নেই তবুও যেনো কোনো এক অদ্ভুত মায়া ডোরে জড়িয়ে পড়েছে সে। চলে যাওয়ার কথা খানা শুনতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে। সে তো থাকতে আসিনি এখানে, সংসার করতে আসে নি,এসেছিলো এই বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যর দোষ গুলো ধরতে। পাকাপোক্ত প্রমাণ সংগ্রহ করতে। যাতে সবাইকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিতে পারে।।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে এ বাড়ির কয়েকটা সদস্যর প্রতি এক আকাশ সমান মায়া জন্মে গেছে নুপুরের। এ ৫-৬ দিনে এই বাড়িটাকে এতটাই আপন করে নিয়েছে যে এখন চলে যেতে ইচ্ছে করছে না।
নওয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। নুপুরের বড্ড ইচ্ছে করে মানুষটার ঘন কালো চুলের ভাজে একটুখানি হাত বুলিয়ে দিতে। লোমশযুক্ত ফর্সা বুক খানা একটু ছুঁয়ে দিতে।
স্নেহা ঠিকই বলেছিলো। বিয়ের বন্ধন বড়ই অদ্ভুত। মুহূর্তের মধ্যেই দুটো মানুষের হৃদয় মিলিত করে দেয়। যার প্রতি কোন অনুভূতি ছিল না তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
নুপুর নওয়ানের মাথার পাশে বসে। কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে ছুয়ে দেয় পাষাণ পুরুষের কপাল।
আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে চুলের ভাজে। বিড়বিড় করে বলে
“আমাদের পরিচয়টা অন্যভাবে হলেও পারতো। এমন নিষ্ঠুর আর রহস্যময় চরিত্র না হলেও পারতেন। আমার জন্য আপনি সঠিক পুরুষ হয়ে আসতেন।
নওয়ান জেগে থাকলে নুপুরের কথার বিপরীতে অবশ্যই শক্তপোক্ত কোন জবাব দিতো। সেই জবাবে নুপুরের রাগ হতো। নাক ফুলিয়ে আঙুর তুলে কথাই বলতো। অথচ মানুষটা ঘুমিয়ে আছে বলে কোনো কথাই বাড়লো না।
নুপুর বলতে পারল না
“আমি যেতে চাই না। এসেছি আপনাদের ইচ্ছায় যাবো আমার ইচ্ছায়।
বলতে পারল না
“আপনাদের এই নিষ্ঠুর বাড়িটার মায়ায় পড়ে গেছি আমি। চলে যাওয়ার কথা শুনতেই বুকের ভেতরটা কাঁদছে। আমি যাবো না।
___
নায়েব তালুকদার খুবই চালাক এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। অবশ্যই তাকে নারীবাজ বলা যায়। কলেজ লাইফ থেকে এই বুড়ো বয়স অবধি কতো মেয়ের সাথে ইন্টিমেন্ট হয়েছে হয়তো নিজেও জানে না। আবিরের মা আশা আক্তার। নায়েব তালুকদারের দ্বিতীয় স্ত্রী। হ্যাঁ তাকে বিয়ে করেছিলেন নায়েব। কিন্তু কোনদিনও সংসার করেনি। ভালোও বাসে নি কখনো। শরীরের প্রয়োজনে যতটুকু দরদ দেখাতে হয় ঠিক ততটুকুই দরদ দেখিয়েছে৷ এর বেশি নয়। আশার মনে পড়ে না নায়েব তালুকদার কোনদিনও তার সঙ্গে বসে খাবার খেয়েছে কিনা। কোনদিনও তাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে কিনা? কোনদিনও একটু মাথায় হাত বুলিয়ে বলেনি “আমি আছি তো”
মরীচিকার সঙ্গে সংসার করে গেছেন বিশ বছর। সমাজের চোখে না পেয়েছে পরিচয় আর না পেয়েছে সম্মান। মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড এর মমতাজ চক্ষু হাসপাতালের পেছনের দিকের একটা বিল্ডিং এর তিনতলায় ভাড়া থাকেন উনি।
আজ ছয় মাস পর পর ২ ঘন্টা ৩ ঘন্টা জন্য নায়েব যায় ওনার ছোট্ট বাসায়৷
মাঝে মধ্যে আশার ইচ্ছে করে নায়েব কে বলতে
“আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে চলো”
কিন্তু বলতে পারেনা। কোন মুখে বলবে? আশা নিজেই আমিনার সংসারে ঢুকেছে।
সালটা ছিল ১৯৯৭। ডিসেম্বর ৩০ তারিখ। আর মাত্র একদিন বাদেই নতুন বছর শুরু হবে। তালুকদার বাড়ির একমাত্র রাজপুত্রের জন্মদিন। গোটা মানিকগঞ্জ শহরের মানুষকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিলো। সব থেকে বেশি উল্লাসিত ছিলেন নায়েব তালুকদার। গোটা শহর জানতেন সে তার ছেলেকে ঠিক কতটা ভালোবাসে।
আশার এসব সহ্য হতো না। বহু আগে থেকেই নায়েবের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিলো। এটা অবশ্যই তার ইচ্ছেতেই। এর বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা পেতো সে। আশা ভেবে নেয় নায়েব তোবাচ্চা খুব পছন্দ করে। নওয়ান কে যেমন ভালোবাসে সেও যদি মা হয় তাহলে তার ছেলেকেও এতোটা ভালোবাসবে। তখন না হয় সন্তানকে দিয়েই নায়েবের মন থেকে আর পরিবারকে মুছে দেবে।
এতসব চিন্তা করে কনসিভ করে।
নওয়ানে জন্মদিনের দিন কেক কাটার কিছু মুহূর্ত আগে আশা নায়েবকে কল দিয়ে তার বাসায় নেয়৷ এবং জানায় তার প্রেগনেন্সির কথা। কিছু ভিডিও ধারণ করে রাখে নিজের ফোনে। নায়েবকে হুমকি দেয়
“যদি তাকে বিয়ে না করে তাহলে এই ভিডিও দেখিয়ে দেবে তার বউকে”
ভয় পেয়ে যায় নায়েব। এসব দেখলে আমিনা নিশ্চয়ই তার সঙ্গে থাকবে না। নওয়ানকে নিয়ে চলে যাবে। এছাড়া এ বছরই তার বাবা এমপি পদে ভোটে দাঁড়ালো। কিছু মাস বাদে নির্বাচন। এমন মুহূর্তে সব সামনে চলে আসলে তারা কিছুতেই নির্বাচনে যেতে পারবেনা।
সবকিছু চিন্তা করে আশাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নায়েব।
সে রাতে সে আর বাড়ি ফিরতে পারে না। আমিনা এবং নওয়ান নায়েবের ফেরার অপেক্ষা করতে থাকে। বাবার সঙ্গে কেক কাটবে বলে কত আনন্দ ছিল বাচ্চাটার।
শেষ মুহূর্তে কেক না কেটেই ঘুমিয়ে পড়ে।
পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে আশার চোখে পানি জমে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।
হ্যাঁ কিছু মুহূর্ত আগে নায়েব কল করেছিলো। স্পষ্ট ভাষায় বলেছে
“তুমি এবং তোমার ছেলে মানিকগঞ্জ ছেড়ে অন্য কোন শহরে চলে যাও। আমার আব্বা ইদানিং আমাকে নিয়ে রিচার্জ করছে। বাই এনি চান্স তোমাদের কথা জানতে পারলে সে দুঃখ পাবে।
আব্বা বলতে নওয়ানকে বোঝানো হয়েছে।
আশার আফসোস হয়। দুইটা প্রাণকে সে দুনিয়াতে এনেছে।
কিন্তু তার কখনো বাবার আদর পায় নি৷ বাবা তাদের দিকে কখনো ফিরে তাকায় নি। কি এক হতভাগা মা সে। অতি সুখের আশা করে নিজের এবং নিজের বাচ্চাদের জীবনটাই বরবাদ করে দিলো। ধিক্কার জানানো উচিত এমন মাকে!
___
এক নতুন নওয়ান তালুকদার কে আবিষ্কার করছে নুপুর। এই মানুষটাকে সে চেনে না। এতোটা পরিপাটি এবং অ্যাটিটিউট নিয়ে নওয়ান তালুকদার কখনো চলাফেরা করেনি। সে তো সাধারন ছিলো। অতি সাধারণ। যে বেপরোয়া হলেও তার মধ্যে কোনো অহংকার ছিলো না।
এই যে এই মুহূর্তে তালুকদার বাড়ির গ্যারেজ থেকে সবচেয়ে দামি গাড়িটা বের করা হয়েছে। শোনা গেলো গতকালই গাড়িটি কিনেছে নওয়ান। নতুন ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যে সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট এবং মাথায় সাদা টুপি পরে একদম পরিপাটি হয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বল্টু ছাড়াও দশ বারো জন লোক কালো পোশাক পড়ে হাতে বন্দুক নিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে। বোঝা গেলে ওনারা নওয়ান তালুকদারের বডিগার্ড।
নওয়ান ঘুম থেকে উঠেই কেউ একজনকে কল করে। গম্ভীর স্বরে তাকে বলে
“আমার জন্য বডিগার্ড অ্যারেঞ্জ করো। এন্ড দশ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ির সামনে পাঠাও।
তালুকদার বাড়িতে পার্মানেন্ট কাজের লোক রয়েছে চারজন। তাদের মধ্যে রেবেকা নামক মহিলাটি নওয়ানের হুকুমের জন্য অপেক্ষায় থাকে। মানে তাকে তালুকদার বাড়ির বড় রাজপুত্রের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। দশ বছর যাবত রয়েছে তিনি।।
এই মুহূর্তে রেবেকা নুপুরের লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত। নওয়ান কফির মগে চুমুক দিতে দিতে তৈরি হচ্ছে। রেবেকা দুই একটা প্রশ্ন করছে নওয়ানকে। সে হুম হ্যাঁ তে জবাব দিচ্ছে। যেমন
“আম্মারে আর আনবা না বাপ?
নওয়ান জবাব দিলো
“হুমম
” কি হুম? আনবা না?
“তুমি কি চাও খালা?
” আনিও না আব্বা। তোমার দাদি ভালা মানুষ না। আইজকা তো আম্মারে মা/ই/রা/ই ফালাইতো।
“ঠিক আছে আনবো না। তুমি জলদি করো।
নওয়ান এর এক খানা ফটো নুপুরের লাগেজে ঢুকিয়ে দেয় রেবেকা।
নুপুর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গার্ডদের দেখছে।
মনে মনে বেশ বিরক্ত সে। নওয়ানের পরিবর্তন ভালো লাগছে না তার। একটুও ভালো লাগছে না।
“হেই চাঁদ
আমাদের বের হতে হবে
নুপুর পেছন ঘুরে তাকায়। দেখতে পায় কালো শার্ট, কালো জিন্স, কালো শু, বড় বড় চুলগুলো জেল দিয়ে সেটআপ করা। শর্টের হাতা ভাঁজ করে কনুই অব্দি গোটানো। ফর্সা হাতের কব্জিতে কালো রঙের ব্র্যান্ডের ঘুড়ি ঝুলছে।
কেমন রাজপুত্র রাজপুত্র দেখাচ্ছে তাকে। নুপুর দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারেনা। কেমন মায়া মায়া নয়নে তাকিয়ে থাকে নওয়ান এর মুখপানে। সেদিকে অবশ্য নজর নেই রাজপুত্রের। সে সিগারেটে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত।
সিগারেটে টান দিয়ে নুপুরের মুখপানে তাকায় নওয়ান। তাকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে।
“হোয়াটস রং উইথ ইউ চাঁদ? তোমাকে ড্রপ করে আমি ঢাকা যাবো। সো
” আমি যাবো না। এখানেই থাকতে চাই।
“চাইলে কি সব হয় চাঁদ?
আমিও তো তোমার সাথে ইন্টিমেন্ট হতে চাই। পারছি কি?
বিরক্ত হওয়ার কথা ছিলো নুপুরের। কিন্তু সে বিরক্ত হলো না। বরং মনোযোগ দিয়ে শুনলো ঠিক কতোবার তাকে চাঁদ বললো নওয়ান?
বেয়াদব পুরুষটার মুখে চাঁদ ডাকটা শুনতে এতো বেশি ভালো লাগছে কেনো?
” আব্বা আব্বা মেহমান চলে এসেছে। তুমি আসবে না?
বলতে বলতে আমিনা বেগম কক্ষে ঢুকে পড়ে।
নুপুর মাথা নিচু করে ফেলে। হয়তো কান্না লুকানোর বৃথা চেষ্টা।
নওয়ান জবাব দেয়
“চলো যাচ্ছি।
বলেই সে বড় বড় পা ফেলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।আমিনা বেগম নুপুরের মুখ পানে এক পলক তাকিয়ে চলে যায় নওয়ানের পেছনে।
___
স্নেহা পালিয়ে গিয়েছে। গোটা বাড়িতে কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেহমানরা এসে বসে আছে অনেকক্ষণ হলো। তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ। এখন মজনু এবং রাশেদুলের সঙ্গে গল্প করছেন। ইতোমধ্যেই কয়েকবার বলে ফেলেছে “মেয়েকে আনুন”
কিন্তু স্নেহাকে আনতে পারছে না।
শেষ মুহূর্তে নওয়ান এসে বলে
“স্যরি
আসলে আমার কাজিন রিলেশনশিপ এ আছে। আমরা এটা জানতাম না। সে পালিয়ে গিয়েছে।
ওনারা কিছু না বলেই চলে যায়। মীরা ভীষণ ভয় ছিলো। এই বুঝি নওয়ান রিয়েক্ট করে উঠবে। অসভ্য ভাষায় গালাগালি করে স্নেহাকে বকবে।
কিন্তু সেসব কিছুই হলো না।
রেবেকা নুপুরের লাগেজ নিয়ে আসে। পেছনে নুপুর।
নওয়ান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে
“আমি চাঁদকে এই বাড়িতে এনেছিলাম। প্রয়োজন শেষ এখন আমাকে দিয়ে আসছি। i think কারো কিছু বলার নেই।
সত্যিই কেউ বলার মত কিছু খুঁজে পায় না। নওয়ান বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তার পেছনে পেছনে রেবেকা নুপুরের লাগেজ নিয়ে যায়। নুপুর মজনু তালুকদারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখে চোখ রেখে বলে
“আপনার নাতি ভয় পেয়েছে। সে বুঝে গেছে আপনাদের পতন খুবই নিকটে। তাই আমায় দিয়ে আসছে। তবে আমি একটা কথা বলে যাচ্ছি
এই বাড়িতে আমি আবার আসবো। সেদিন আপনারা আমাকে দেখে ভয়ে আতঙ্কে উঠবেন৷ বাঁচার জন্য আমার হাতে পায়ে ধরবেন। চ্যালেঞ্জ করে বললাম।
তারপর নুপুর বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। মীরার খুব খারাপ লাগে। অল্পদিনে মেয়েটা মনে জায়গা করে নিয়েছিলো। আরও কিছুদিন থাকতে পারতো।
___
পরপর তিনটে গাড়ি এসে থামে নুপুরদের ছোট্ট বাড়িটার সামনে। নেহাল এবং নাসির অভির সঙ্গে চায়ের আড্ডা জমিয়েছে। হাসি তামাশায় মেতে উঠেছে তিনজন। সোনিয়া কিচেনে রান্না করছে। এমন মুহূর্তে প্রাইভেট কারের দীর্ঘ আওয়াজে সবাই একটু চমকায়। কেননা প্রাইভেটকার নিয়ে তাদের বাড়িতে আসার মত কেউ নেই। খুবই কৌতুহল বসত নেহাল এগিয়ে যায়।
দরজা খুলতে দেখতে পায় কালো রঙের একখানা মার্সিডিজ এবং সাধারণের দুটো নরমাল প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে তাদের উঠোনে।
নওয়ান গভীর মনোযোগে ফোন দেখছে। নুপুর নওয়ানের মুখ পানে তাকিয়ে আছে। বলতে চাচ্ছে অনেক কথা কিন্তু বলতে পারছে না। অকারণেই আঁখি পল্লব ভিজে উঠছে।
“নওয়ান আপনি কি আমায় মুক্তি দিলেন?
নওয়ান ফোন থেকে নজর সরিয়ে নুপুরের মুখ পানে তাকায়।
বাঁকা হেসে ঠোঁটের ভাজে থাকা সিগারেট হাতে নেয়।
” হয়ত
“ওকেহহহ
আর আনু?
“সে কখনো ফিরবে না।
” কারণ
“খুঁজে নাও।।
নেহাল গাড়ির কাচে টোকা দেয়। নওয়ান দরজা খুলে নেমে পড়ে। নুপুরও নামে। নেহাল এক হাতে জড়িয়ে নেয় নূপুরকে।
“ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন মিস্টার নওয়ান তালুকদার।
নেহাল এর শক্ত কন্ঠস্বর। নওয়ান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
” ডিভোর্স দিতেই হবে?
“অবশ্যই
” আচ্ছা
ব্যাসস নওয়ান তালুকদার আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়ায় না। গাড়িতে উঠে বসে। আর ড্রাইভারও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘোরানো শুরু করে। নুপুর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কতো সহজে আচ্ছা বলে গেলো মানুষটা। বিয়ে করা বা ডিভোর্স দেওয়া এতোটা সহজ? তার মন চাইলো সে জোর করে বিয়ে করে নিলো। আবার এখন তার মন চাইলো ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
নুপুর তো তার হাতের পুতুল।
“সব ঠিক আছে তো নুপুর? উনি তোকে এত সহজে দিয়ে গেলো?
নুপুর একটু হাসার চেষ্টা করে।
“আমার তো প্রয়োজন শেষ ভাইয়া। তাই দিয়ে গেলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুপুর।
” চলো ভেতরে যাই।
নুপুরের লাগেজ নেহাল টেনে ভেতরে নেয়।
চলবে
#অন্তরালে_আগুন
#পর্ব:২৫
#তানিশা সুলতানা
কতদিন পরে বাড়িতে ফিরলো নুপুর। গিয়েছিলো একরাশ ঘৃণা নিয়ে আর ফিরে আসলো আফসোস নিয়ে। নেহাল একে একে অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
যেমন,
কপাল কাটলো কি করে? নওয়ান কি অত্যাচার করতো? ওই বাড়ির মানুষজন কেমন? কি এমন হলো যার জন্য নওয়ান তাকে ফেরত দিয়ে গেলো? নির্বাচন নিয়ে তালুকদারদের প্রিপারেশন কেমন?
নুপুর একটা প্রশ্নেরও জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকে। কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের কক্ষে চলে যায়। অভি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নুপুরের দিকে। হিজাব পড়ে থাকার ফলে শুধু মুখ টুকুই দেখা যাচ্ছে। তাতেই যেনো অভির কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো। মনে মনে বলে ওঠে
“চাঁদের মতো সুন্দর তুমি”
নাসির নেহাল এর পানে তাকিয়ে বলে
“কি হলো এটা? নুপুর চলে আসলো কেনো?
নেহাল অভির পাশে বসতে বসতে বলে
“বুঝলাম না ঠিক।
নওয়ান তালুকদার নিজে ওকে এখানে দিয়ে গেছে। আর ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেও বলেছে।
অভি যেনো মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি পেয়ে গেলো। মনে মনে কয়েকবার আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।
সোনিয়া বেগম কিচেন থেকে বেরিয়ে নুপুরের কক্ষে যায়। এই মুহূর্তে মেয়ের সঙ্গে কথা বল অতীব জরুরী।
___
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৬৪ জন এমপিকে নিয়ে জরুরী বৈঠকের আয়োজন করেছেন নায়েব তালুকদার। নির্বাচনের আর মাত্র কিছুদিন বাকি। এখনই সকলের সাথে আলাপ না সারলেই নয়। মন্ত্রী সভায় উপস্থিত হয়েছে সকলেই। গোল টেবিলের দুইপাশের চেয়ার গুলো দখল করে বসেছে। সকলের সামনে নওয়ান। নায়েব তালুকদার যার যার কাজ বুঝিয়ে দেয়। কিভাবে কি করতে হবে? কিভাবে সাধারণ জনগণদের হাতের মুঠোয় আনতে আরও অনেক কিছু। এখানে মূল আকর্ষণ নওয়ান তালুকদার। সে খুবই রিলাক্স মুডে সিগারেটে টান দিচ্ছে। সামনে এতগুলো গণ্যমান্য ব্যক্তি বসে আছে তাতে তার কিছু এসে যায় না। ছেলের কর্মকাণ্ডে নায়েব তালুকদার মোটেও লজ্জা পায় না। ছেলের এই অ্যাটিটিউটই তার ভালো লাগে। বৈঠক প্রায় শেষের পথে। সকলেই আশায় আছে নওয়ানের মুখ থেকে কিছু শোনার। তার কি মতামত বা পরিকল্পনা?
কিন্তু এই ছেলে সিগারেট খেতেই ব্যস্ত। কথা বলবে কি?
রংপুর জেলার থেকে নায়েব তালুকদারের দলের হয়ে যে এমপি পদে দাঁড়াচ্ছেন। তার নাম ইমতিয়াজ আহমেদ।
সে বলে ওঠে
“মিস্টার নওয়ান রিশাদ মুসতালিন। আপনার কি বক্তব্য?
নওয়ান সিগারেটে শকষ টান দিয়ে সেটা ছুঁড়ে মারে দূরে। তারপর নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে জবাব দেয়
” কিছু ছেলেদের টার্গেট করুন। তাদের পেছনে টাকা ঢালুন। সুস্থ নির্বাচন হবে না। ভোট কেটে জয়ী হতে হবে আমাদের।
নওয়ানের এহেম কথায় সকলেই অবাক হয়। কি বলছে এই ছেলে?
আরেকজন বলে ওঠে
“কিন্তু এটা তো অন্যায়
নওয়ান দাঁড়িয়ে পড়ে।
” রাজনীতি করবেন আর অন্যায় করবেন না? ব্যাপারটা এমন হলো না যে
আমি নেশা করবো কিন্তু হারাম খাবো না।
আরেহহ শালা মদই তো হারাম।
আর কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। বল্টু নওয়ানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সে আরেকটা সিগারেট এগিয়ে দেয় নওয়ানের দিকে। দিয়াশলাই দিয়ে আগুনও জ্বালিয়ে দেয়। নওয়ান সিগারেটে টান দিয়ে বলে
“যারা অন্যায় করতে চান না তারা দল ছেড়ে দিন। আমি নতুন লোক নিয়ে নিবো। নওয়ান মানে অন্যায়
অন্যায় মানে নওয়ান।
যে শালা ন্যায়ের জ্ঞান দিতে আসবে তাকে কে/টে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। মাইন্ড ইট
নিজের কথা শেষ করে বড় বড় পা ফেলে মন্ত্রী সভা থেকে বেরিয়ে যায় নওয়ান তালুকদার। ঘাম ঝরে গিয়েছে সকলের। নায়েব সকলকে ঠান্ডা করার উদ্দেশ্যে বলে
“আমার ছেলে একটু বেপরোয়া। সে বরাবরই স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি আছি তো। কোন টেনশন নেই।
___
নির্বাচনের আমেজ গোটা মানিকগঞ্জ শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। পোস্টার রেলি মাইক্রোফোন দিয়ে প্রচারণা সবকিছু মিলিয়ে বিশৃংখল পরিবেশ। অন্তত নুপুরে সেটাই মনে হয়। গোটা বছর এমপি কিংবা বড় বড় মানুষদের দেখা যায় না। এলাকার মানুষদের সুবিধা ও অসুবিধা কোন কিছুতেই তাদের পাত্তা নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ঘনঘন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মুখ দেখা যায়।
এই যেমন এবার ভোটে দাঁড়ানো আইয়ুব হোসেন আইয়ুব হোসেন সফল বিজনেসম্যান। গোটা মানিকগঞ্জ শহর জুড়ে তার বেশ নাম ডাক। ধনীদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। মানুষজন তাকে শুধু ছবিতেই দেখে এসেছে। কিন্তু নির্বাচন আসার পর থেকে সেজন্য সাধারণ মানুষ হয়ে গিয়েছে। রোদ বৃষ্টি কোন কিছু তোয়াক্কা না করেই সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলছে। সেদিন তো একটা রিক্সাওয়ালাকে জড়িয়ে ধরলো।
নুপুরের বেশ হাসি পেয়েছিলো। আজকে যাদের জড়িয়ে ধরছে ভোটটা হয়ে গেলে জীবনেও তাদের খোঁজ নেবে না।
তালুকদার বাড়ি থেকে নুপুর চলে এসেছে একমাস হয়ে গেলো৷ এক মাস নওয়ানের কোনো খোঁজ নেই।
আর না আনুর খোঁজ পেয়েছে।
শাফিন পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে আনুকে। নুপুর হাল ছেড়ে দিয়েছে। আর হয়তো পাওয়া যাবে না তার বন্ধুকে। আনুর গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু শাফিন বিশ্বাস করে আনুকে খুঁজে পাওয়া যাবে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক শাফিন তাকে ঠিক খুঁজে বের করবে।
মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে আজকে একটা প্রোগ্রাম রয়েছে। বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং চলমান শিক্ষা মন্ত্রী নায়েব তালুকদার এবং তার একমাত্র রাজপুত্র নওয়ান তালুকদার তাদের সঙ্গে আয়ুব হোসেন উপস্থিত হবেন দেবেন্দ্র কলেজের মাঠ প্রাঙ্গনে। বরাবর এরকম সভা মানিকগঞ্জ বিজয় মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এবার দেবেন্দ্র কলেজের মাঠটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। গত চার পাঁচ দিন যাবত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে কলেজ টাকে। আজকে সকাল থেকেই মানুষের ভিড় যেনো লেগে রয়েছে। এই যে আর মাত্র কিছুক্ষণ পরেই এখানে উপস্থিত হবেন তারা। ইতোমধ্যে মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে চলে এসেছে। এই খবরটা যেনো মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। চারিদিক থেকে মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে কলেজের মাঠে। নুপুরকেও আজকে কলেজে আসতে হয়েছে। বিশাল বড় দায়িত্ব তার ঘাড়ে। নুপুর মিথি রামিশা এবং সায়মা। সকলেই শাড়ি পড়ে এসেছে। কলেজের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতে মন্ত্রী এবং তার ছেলেকে।
বেজায় বিরক্ত নুপুর। শুধু প্রিন্সিপালের কথা ফেলতে পারলো না বলে গোলাপি রংয়ের শাড়িতে নিজেকে সং সাজিয়েছে। এই মুহূর্তে হাতে একগুচ্ছ গোলাপের বুকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কলেজের গেটের সামনে। মিনিট পাঁচে পরেই পরপর দশ বারোটা গাড়ি এসে থামে কলেজের সামনে। কলেজের সামনে থাকা ছোট্ট রাস্তাটা মন্ত্রীদের গাড়ি দিয়েই ভরে যায়। অনেকগুলো পুলিশ কিছু সংখ্যক দেহরক্ষী এসেছে তাদের সঙ্গে। সকলের হাতে বন্দুক। যেনো মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর ছেলে দিকে কেউ তাকালে তাদের গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেবে।
গাড়ির দরজা খুলে আগে পুলিশ এবং বডিগার্ডরা বের হয়। তারপর নায়েব তালুকদারের ব্র্যান্ডের দামি গাড়িখানার দরজা খুলেন একজন পুলিশ। প্রথমে বেরিয়ে আসে নায়েব। বয়স ৫০ ছুঁয়েছে। কিছু সংখ্যক চুলে পাক ধরেছে। তবুও বেশ সুদর্শন দেখতে সে। সাদা রঙের পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে।
নায়েবের পেছনে নওয়ানও গাড়ি থেকে নামে। গভীর মনোযোগে ফোন দেখতে ব্যস্ত সে। নায়েব ছেলে ডান হাতটা মুঠো করে ধরে সামনে এগোতে থাকে। যেনো তার ছেলে একটা ছোট বাচ্চা।
বল্টুকেও দেখা যায় নেতা সাহেবের পেছনে। নুপুর মন্ত্রীর ছেলের মুখপানে তাকিয়ে আছে। বহুদিন পর দেখলো বলেই বোধ হয় তাকে দেখতে খুব ভালো লাগছে। এ্যাশ কালারের ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট তাকে একটু অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। বেলায় চোখ দুটো ঢেকে রাখা কালো রঙের সানগ্লাস টা যেনো তার জন্যই বানানো হয়েছে। এতটাই পারফেক্ট মানিয়েছে।
নুপুর শুকনো ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে নেয়।
মন্ত্রী এবং তার ছেলে কলেজের গেটে সামনে এসে। প্রথমেই নুপুরকে ফুল দিতে হবে। পেছন থেকে মোনালিসা ম্যাম নুপুরের কানে কানে বলে
“ফুল গুলো এগিয়ে দাও। আর ওয়েলকাম বলো।
নুপুর একটু হাসার চেষ্টা করে ফুলগুলো এগিয়ে দেয় নওয়ানের দিকে। দুজনের চোখে চোখ পড়ে যায়। কালো সানগ্লাসের আড়াল থেকে নওয়ান একটু দেখে নুপুরকে। তারপর হঠাৎ ঠাসস করে নুপুরের গালে এক খানা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় নওয়ান।
সকলেই স্তব্ধ হয়ে যায়। বাকি মেয়ে গুলো দু পা পিছিয়ে যায়। নুপুর গালে হাত দিয়ে নওয়ানের মুখ পানে তাকিয়ে থাকে কিছু মুহুর্ত।
নায়েব তালুকদার নওয়ানের হাতখানা চেপে ধরে বলে
“কি হচ্ছে?
এটা পাবলিক প্লেস।
থোরাই কেয়ার করলো বাপের কথায়।
সে নুপুরের দিকে আঙুল তাক করে বলে
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে এখান থেকে চলে যাবা।
বল্টু ওকে এখান থেকে বের কর।
অশ্রুসিক্ত নয়নে নওয়ানকে এক পলক দেখে এক দৌড়ে চলে যায়। কলেজের ভিতরে ঢুকে ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে যায়।
নুপুরের চলে যাওয়া দেখে নওয়ান।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৬
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৬+২৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২০
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১ (১ম অংশ+ শেষ অংশ)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৯
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৭