#অন্তরালে_আগুন
#পর্ব:২০
#তানিশা সুলতানা
নওয়ানের দুটো দুর্বলতা রয়েছে। দুর্বলতা বা অভ্যাস। এক সিগারেট আর দুই হচ্ছে বাইক। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বাইক আছে তার কালেকশনে। যখন যেটা পছন্দ তখন সেটা ব্যবহার করে। এই যেমন আজকে বাবার সাথে গাড়ি করে এসেছিলো কিন্তু হঠাৎ করে তার মনে হচ্ছে বাইক লাগবে। এখনই, এই মুহূর্তে। নিরবকে কল করে বাইক নিয়ে আসতেও বলে ফেলেছে। এখন শুধু অপেক্ষা।
আইয়ুব হোসেন। নায়েক তালুকদারের ভীষণ কাছের এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তি। এবার এমপি পদে তাকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছেন নায়েব। সেই নতুন এমপির সঙ্গে দেখা করতে যাবে নওয়ান।
তাছাড়া হাতের র*ক্ত এখনো শুকায়নি। ঘা এখনো তাজা। নওয়ান তালুকদারকে আঘাত করার সাহস যারা করেছে তাতে তো সহজে ছেড়ে দেবে না।
এই মুহূর্তে মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে অবস্থিত বিশাল বড় পৌর সুপার মার্কেটের প্রথমে যে oppo ফোনের শোরুম রয়েছে সেখানে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে নওয়ান। হাতে ফোন ঠোঁটের ভাজে সিগারেট। ফোনের স্কিনে আইয়ুব হোসেন এর ফটো এবং ডিটেইলস রয়েছে।
নওয়ানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ছেলেপেলে। মেইন রোড দিয়ে যত মানুষ যাচ্ছে আসছে সকলে নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নওয়ান কে দেখছে। কেউ কেউ লুকিয়ে ভিডিও করছে। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে ভিশন একটিভ একটা প্ল্যাটফর্ম। এখানে যত ভিউ তত ইনকাম। কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েটর নামক ভিউ ব্যবসায়ী সর্বক্ষণ অপেক্ষায় থাকে নতুন নতুন নিউজ জানানোর। শিক্ষামন্ত্রীর ছেলে বা ভবিষ্যৎ সরকারের ছেলে ফোনের শোরুমে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
এটা কি কম বড় চমক? অনেক ভিউ হবে।
বল্টু বেজায় বিরক্ত। একেতে কুত্তামরা গরম তার উপর সূর্যমামা প্রচন্ড রেগে অসহ্যতাপ দিচ্ছেন। এই শোরুমে এসি নেই। মাথার উপর ভনভন করে দুটো সিলিং ফ্যান ঘুরছে। তাতে শব্দ হচ্ছে বেশি বাতাস লাগছে কম। নওয়ানের ফর্সা মুখশ্রীতে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। সাদা পাঞ্জাবি খানা ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছে। পিছন থেকে মানুষজন কমলে বোধহয় বাতাসটা ভালো লাগতো।
বল্টু ইতোমধ্যে কয়েকবার বলে ফেলেছে
“আপনারা একটু সরে দাঁড়ান। ভাইয়ের গরম লাগছে।
কেউ শুনললোই না তার কথা। আর নওয়ানও কাউকে কিছু বলছে না। ঠাটিয়ে ধমক লাগিয়ে দিতে পারে তো। চিন্তিত বল্টু তো শান্ত হতে পারছে না।
হাতে বিশাল ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। ঘামগুলো কাটা জায়গায় ঢুকে গেলে ব্যাথা করবে না? করবেই তো।
ভাই যে এখানে কেনো বসে আছে সেটাই তো বুঝতে পারছে না বল্টু।
হঠাৎ একটা ছেলে বলে ওঠে
” ভাই আমাদের মানিকগঞ্জে পেঁপে মার্কা জিতে যাবে। ১০০% শিওর আমরা।
কিন্তু বিপক্ষ দলও কিন্তু উঠেপড়ে লেগেছে।
নওয়ান হাসে একটু। সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে বলে
“রাস্তায় কাঁটা পড়লে কি করি আমরা?
আরেকটা ছেলে বলে
” আপনি যেমনটা বলবেন।
নওয়ান দাঁড়িয়ে পড়ে।
“প্রয়োজনে গোটা বাংলাদেশ ধ্বংস করে দিবি তবুও জয়টা আমাদের চাই।
নওয়ান রিশাদ মুসতালিন হারতে শেখে নি।
সে হারবে না।
তামিম ওদের যত টাকা লাগে দিয়ে দিস।
বলেই বড় বড় পা ফেলে শোরুম থেকে বেরিয়ে যায় নওয়ান। পেছন পেছন বল্টুও যায়। যেতে যেতে মনে মনে বলে
” ওহহ তাইলে ভাই এই জন্যই এতোক্ষণ বসে ছিলো এখানে?
কালো রঙের Suzuki বাইক নিয়ে এসেছি নীরব। নওয়ানের হাতে চাবি দিয়ে নীরব বলে
“ভাই তোমার হাতে ব্যথা
আমি যাবো?
” নো নিড
কথা শেষ করে একটানে চলে যায় নওয়ান। বল্টুকেও সাথে নেয় না। তবে বল্টু এবং বাকি ছেলেরা অটো ডেকে নওয়ানের পিছন পিছন যায়।
শিশু পার্কের সামনে নায়েব তালুকদার এবং সোনিয়া বেগমকে কথা বলতে দেখা যায়।
নেহালও রয়েছে সেখানে। মা ছেলেকে বড্ড চিন্তিত দেখাচ্ছে। নওয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ে। কি কথা বলছে তারা?
হাতে সময় কম বলে দাঁড়ায় না। বাইক চালাতে চালাতেই পকেট থেকে ফোন বের করে। কারো নাম্বারে একটা ছোট্ট টেক্সট দেয়। তারপর পুনরায় মনোযোগী হয় ড্রাইভিং এ।
____
আনুর ফোন খানা পাওয়া গিয়েছে। যদিও ফোনটা ভালো নেই তবু শক্ত একটা প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে আশা করে শাফিন। কিন্তু নুপুর আশা করতে পারছে না। তার বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠছে। হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় ক্ষণে ক্ষণে চোখ দুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে। শাফিনের পুলিশ ফোর্স চলে গিয়েছে। সেও চলে যেতে চাচ্ছে কিন্তু নুপুরের জন্য যেতে পারছে না। মেয়েটা পদ্মা নদীর পানিতে হাত ভিজিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছে। হয়তো তার মনটা বুঝতে পারছে এই সমুদ্র পার হলে আনুর খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
এাি মাত্র একটা লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে। শতশত মানুষ নদী পাড় হওয়ার জন্য লঞ্চ উঠেছে। বিশাল লঞ্চ খানা প্রচন্ড শব্দ করে একটু একটু এগোচ্ছে। নুপুরের মন বলছে “নুপুর তুইও ওদের সাথে চলে যাহ। খুঁজে পাবি আনুকে”
হঠাৎ করে নুপুরের সামনে এসে দাঁড়ায় আবির।
তার হাত পা এবং কপালে ব্যান্ডেজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আবিরের পেছনে নওয়ান। ওদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে নুপুর। কপালে ভাজ ফেলে দেখে। আনু আবিরের সঙ্গে যায় নি?
নতুন ভয় বাসা বাঁধে মনে।
রাজনীতি বীদ এবং বিজনেসম্যান নওয়ান তালুকদার ঠিক জানতো তার পার্সোনাল ইঁদুর আনুকে খুঁজে না পেয়ে আবির কে সন্দেহ করছে। সন্দেহ প্রথমে নওয়ানেরও হয়েছিলো। ভেবেছিলো আবিরই বোধহয় মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু যখন জানতে পারলো আবির নিজেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তখন নিজের সন্দেহটাকে দমিয়ে ফেললো।
নুপুর নওয়ানের মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে একটা মানুষটাই পারে আনুকে ফিরিয়ে আনতে।
সবকিছু ভুলে এই মানুষটার প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে
“নওয়ান আমার বন্ধুকে এনে দিন। কোথা থেকে আনবেন, কি করে আনবেন, আমি জানিনা
আমার শুধু আনুকে চাই।
কিন্তু নুপুর সেটা করতে পারেনা।
সে নওয়ানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবিরের পানে তাকায়। পর পর পদ্মা নদীর গভীর পানির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে
“আমি জানিনা আনু কোথায় আছে। তবে তাকে আমি খুঁজে পাবো। আর খুঁজে পাওয়ার পর যদি জানতে পারি সবকিছুর পেছনে আপনি ছিলেন।
বিশ্বাস করুন আবির ভাই আপনার কলিজা খানা ছিঁড়ে এই নদীতে ফিরে দেবো।
সেখানে আর দাঁড়ায় না নুপুর। বড় বড় পা ফেলে মেইন রোডে উঠে আসে। শাফিন এবং তার পুলিশ বাহিনী ইতোমধ্যেই চলে গিয়েছে। বাকি আছে নওয়ান। সে তার বাইকে বসে দু হাতে দুটো হেলমেট ধরে নুপুরের মুখপানে তাকিয়ে আছে। হয়তো মুখে বলতে সাহস পাচ্ছে না “আমার বাইকে এসো”
নুপুরেরও আজকে ঝগড়া করার মুড নেই। তাইতো চুপচাপ নওয়ানের হাত থেকে একটা হেলমেট নিয়ে নেয়। কিন্তু সেটা মাথায় বাঁধতে পারে না। চেষ্টাও করে না। ধরে শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নওয়ান নিজের মাথায় হেলমেট বেঁধে নুপুরের হাত থেকে তার হেলমেটটা নিয়ে নেয়। এবং সেটা খুব যত্নসহকারে ওর মাথায় পরিয়ে দেয়।
আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে নওয়ানের ঠোঁটের ফাঁকে কোনো সিগারেট নেই আজকে।
নুপুর বাইকে উঠতে গিয়েও ওঠে না।
উল্টো পথে হাঁটা ধরে।
“কোথায় যাচ্ছো?
জবাব দেয় না নুপুর। কাছের একটা দোকানে গিয়ে দোকানদারকে বলেন
“এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট দিন।
দোকানদার দিয়ে দেয়। ও টাকা মিটিয়ে আবার নওয়ানের কাছে ফিরে আসে। ওর কাঁধে হাত রেখে বাইকের পেছনে বসে।
নরম স্বরে বলে
“চলুন।
নওয়ান কি একটু হাসলো? সিগারেটের পোড়া ওষ্ঠ দুটো একটুখানি প্রশস্ত হলো যেনো। মুহূর্তে ফুল স্পিডে বাইক চালানো শুরু করে। নুপুর হয়ত ভালো করে দেখলে খেয়াল করতো নওয়ানের কপালের পাশে দীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন। ফর্সা হাত দুটোর বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। হয়তো শরীরের আরো বিভিন্ন জায়গায় চোট পেয়েছে।
এই যে নুপুর দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছে পাষাণ পুরুষটির কোমর। মাথা রেখেছে পিঠে। মানুষটা যে ব্যথা পাচ্ছে। ক্ষত জায়গায় টান পড়ছে।
বুঝতে পারলে হয়ত আলতো করে ধরতো বা ছেড়ে দিতো।
নওয়ান এক হাতে বাইক চালাচ্ছে অপর হাতে নুপুরের হাতখানা ধরে আছে। যেনো নুপুর একটা ছোট বাচ্চা সে যখন তখন পড়ে যেতে পারে তাই তার এই সেফটি।
পাটুরিয়া থেকে বেওথা আসতে মোটামুটি ২০ মিনিটের মত সময় লাগে। বাড়ির সামনে আসতেই বাইক থামায়।
নুপুর নেমে পড়ে হেলমেট খুলে সিগারেট প্যাকেট এগিয়ে দেয় নওয়ানের দিকে।
মায়া ভরা স্বরে বলে
“আমি জানি আপনি আমায় সহ্য করতে পারেন না। আমারও আপনাকে অসহ্য লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনাকে আমার ভীষণ দরকার। একমাত্র আপনি পারেন আনুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে৷ বন্ধু হিসেবে এটুকু উপকার করবেন তো?
নওয়ান নুপুরের থেকে সিগারেট প্যাকেট নিয়ে নেয়। সেটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলে
“ব্যাস এটুকুই? এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে আস্ত একটা মানুষ চাচ্ছো?
“বলুন আপনার আর কি চাই? সব দিতে রাজি আমি।
নওয়ান একটু অন্যরকম স্বরে বলে ওঠে
“তোমাকে চাই।
ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে বাইক স্টার্ট করে চলে যায়। এক মুহূর্ত আর দাঁড়ায় না। নুপুর ভ্রু কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
“উনাকে যেতে দিলে কেনো নুপুর? অসুস্থ উনি। আঘাত পেয়েছে। ট্রিটমেন্ট দরকার ছিলো।
বড্ড চিন্তিত শোনালো স্নেহার কন্ঠস্বর। আঁখি পল্লবে অশ্রু জমেছে কি? ডাগর ডাগর নজর ফিরিয়ে নওয়ানের চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।
নুপুর বলে
“আপু উনি সুস্থ। কিছু হয় নি। তুমি হাইপার হচ্ছো কেনো?
স্নেহা সঙ্গে সঙ্গে অস্থির স্বরে বলে
“তুমি খেয়াল করোনি? উনার কপালে যে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। তাছাড়া পাঞ্জাবির হাতায় র*ক্ত লেগেছে। হাই আল্লাহ এখন এভাবেই থাকবে সারাদিন। ইসস কতোটা কষ্ট হবে ওনার। আমি এখন কি করবো?
এই নুপুর কল করো ওকে।
তুমি কল করলে ও ধরবে।
নুপুর অবাক নয়নে স্নেহাকে দেখতে থাকে। কেনো জানি রাগ হয় নুপুরের।
নিজের আজান্তেই বলে ওঠে
” সে আর তোমার নেই আপু।
ইমোশন কন্ট্রোল করো। এতো মায়া কিসের? আরেহহ ওই মানুষটা তোমাকে দুই পয়সারও মূল্য দেয় না। তুমি মরে গেলেও তার কিছু এসে যায় না।
আর তার সামান্য আঘাতে তুমি মরে যাচ্ছো।
স্নেহা মাথা নিচু করে ফেলে।
“বেঁচে থাকতে এই মায়া কমবে না।।
দোয়া করিও যেনো অতি দ্রুত মৃত্যু আমায় আলিঙ্গন করে নেয়।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১২
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৮
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৫
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৫(৫.১+৫.২)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৬+২৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৬
-
অন্তরালে আগুন গল্পের লিংক
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২