#অন্তরালে_আগুন
#পর্ব:১৭
#তানিশা সুলতানা
“সবটা এত সহজ? তোর কিছু এসে যায় না?
স্নেহা জবাব দেয় না সবিতার প্রশ্নের। খাটের উপরে থাকা ব্যাগ খানা কাঁধে তুলে সবিতাকে এড়িয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।
“আমার যে কি যায় আর আসে সেটা শুধু আমিই জানি। আমার হৃদয়টা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্রতিটা সেকেন্ড কাটছে। কাকে বোঝাবো আমি? কাকেই বা বলবো? কতো রাত ঘুমাই নি। বালিশ দিয়ে মুখ চেপে কান্না করতে করতেই রাত খানা কেটে যায়। আমি কিভাবে বেঁচে আছি সেটা শুধু আমি জানি।
আমার আর কাউকে কিছু বলার নেই। বলবো শুধু সৃষ্টিকর্তাকে। তিনি দুঃখ দিয়েছেন তিনিই বাঁচার রাস্তা দেখাবেন। আর যাই হোক মানুষের অভাবে মানুষ তো আর মরে না। আমিও মরবো না।
হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ির মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে যায় সে। মীরা সোফার কাভার বদলাচ্ছিলো। মেয়ের চোখের অশ্রুকণা তার কলিজা কাঁপিয়ে দেয়। কি দারুণ হাসিখুশি ভাবে চলাফেরা করছে। অথচ ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরছে।
দুঃখ লুকিয়ে নিজেকে হাসি খুশি প্রমাণ করা পৃথিবীর সবথেকে কঠিন কাজ। ভেতরটা চিৎকার করে কাঁদছে আর বাইরে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মিষ্টি হাসি।
এটা থেকে কঠিন কিছুই নেই। বিষ খেয়ে হজম করে নেয়া সম্ভব কিন্তু দুঃখ লুকিয়ে সর্বদা হাসি খুশি থাকা অসম্ভব।
আজকের গাড়ি করে কলেজে যাবে না স্নেহা। পায়ে হেঁটে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গেট থেকে বেরিয়ে বেওথা বাজার পেরুতেই একটা ছেলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায় তার। নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পেরে মাঝ রাস্তায় বসে পড়ে। নেহাল নিজেও আশ্চর্য হয়। মেয়েটা এভাবে পড়ে যাবে সে বুঝে উঠতে পারেনি। না হলে ধরতো।
স্নেহা নিজের ব্যাগটা সামলে উঠে দাঁড়ায়। হাতে পায়ে লেগে যাওয়া ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে নেহালের পানে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে
“আই এম সরি ভাইয়া। আমি একটুও খেয়াল করিনি।
কপালে ভাজ পড়ে নেহালের। আসলে দোষটা তার। সেই ফোন দেখতে দেখতে হাঁটছিলো। আর দুর্ভাগ্যবশত কারণে নিয়ে ধাক্কা লেগে যায়। ভেবেছিল মেয়েরা রাগারাগি করবে। এটা ওটা কথা শোনাবে কিন্তু এত সুন্দর ভাবে স্যরি বলাতে বেশ অবাক হয়েছে সে।
স্নেহা আবারও বলে
“সরি ভাইয়া
আসছি হ্যাঁ? ভালো থাকবেন। আর রাস্তায় ফোন কম দেখবেন। ব্যস্ত রাস্তা তো। গাড়ি সর্বদা চলতেই থাকে।।
কথা শেষ করে একখানা রিকশা ডেকে নেয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে রিকশায় উঠে পড়ে। বা পায়ের গোড়ালির দিকে বেশ খানিকটা কেটে গেছে। সেখান থেকে র*ক্ত গড়াচ্ছে। নেহালের নজরে পড়ে সেটা।
কিছু বলবে তার আগে রিক্সা মামা রিক্সা নিয়ে হাওয়া। নেহাল মুচকি হেসে বাম হাতে মাথা চুলকায়। বিবির করে বলে
“অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা। আই লাইক ইট।
___
স্পিডবোট এসে থামে দৌলতদিয়া ঘাটে। আবির ভাড়া মিটিয়ে আনুর হাত ধরে স্পিডবোট থেকে নামে। তারপর সেখান থেকে একটা সিএনজি ভাড়া করে নেয়। কি একটা গ্রামের নাম বলে আনু ঠিকঠাক শুনতে পায় না।।
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়?
আবির মুচকি হেসে একহাতে আনুকে জড়িয়ে ধরে। চুলের ভাজে চুমু খেয়ে ভীষণ আদুরে স্বরে বলে
“যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেটাই তোমার প্রাপ্য জায়গা। আই গ্রেস তুমি ভীষণ ভালো থাকবে সেখানে।
“তুমি সাথে থাকলে আমি ভালো থাকবো। ভালো থাকার জন্যই তো চলে আসলাম না?
এ পর্যায়ে আবির কিছু বলে না। সিএনজি এসে থামে একটা বাজারের সামনে। ভীষণ ছোট বাজারটা। গুটি কয়েক দোকান এবং বরসর একটা গেইট।
আবির আনুর হাত ধরে সেই গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে। সারি সারি বাধা ছোট ছোট ঘর। আনুর সমবয়সী অনেক মেয়েরা অদ্ভুত সেজে কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ গল্প করছে, পান খাচ্ছে, অযথাই হাসাহাসি করছে। কেউ কেউ নিজেদের আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় তুলতে ধরতে ব্যস্ত।
আবির কে বোধহয় সকলেই বেশ ভালো করেই চেনে। হেসে হেসে কথা বলছে আবিরের সঙ্গে।
অদ্ভুত একটা ব্যাপার হচ্ছে আনুর সেম ইয়ারের একটা মেয়ে বৃষ্টি নাম। একই সাথে তারা এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছিলো। সেই থেকে পরিচিত। তারপর একই কলেজে ভর্তি হলো। কিছুদিন ক্লাস করলো তারপর হাওয়া। মানে কলেজে আসে না। সবাই অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে কিন্তু কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই মেয়েটাও এখানে রয়েছে। আনুকে দেখে মেয়েটার হাসি মুখ খানা চুপসে যায়। কেমন অদ্ভুত নয়নে তাকিয়ে আছে। যোনো তার চোখ দুটো বলছে “তুমি এখানে কেনো আসলে আনু? বড্ড ভুল করে ফেললে”
ছোট একটা ঘর তবে বেশ সাজানো গোছানো। দামি আসবাবপত্র, সুন্দর একটা খাট, সোফা সহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী একক্ষে রয়েছে। ৪৫ কি ৫০ বছরের একজন নারী ভীষণ সুন্দর করে সেজেগুজে পান চিবুচ্ছে আরাম দায়ক বসে। আবিরকে দেখেই মহিলাটি মুচকি হাসে
বলে
“এসেছিস তাহলে?
আবির আনুর হাত ছেড়ে দিয়ে মহিলাটির পায়ের কাছে গিয়ে বসে। তার কোলে মাথা রেখে পরম শান্তিতে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। মহিলাটি যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে আবিরের চুলের ভাজে।
“মা বাবা কেমন আছে তোর?
“বাবা ভালই আছে। মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। এখান থেকে ফিরেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
“তোর বাবা এসেছিলো মাকে দেখতে?
আবির তাচ্ছিল্য হাসে
“টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। দেখতে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। টাকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আনু বুঝতে পারে না ওদের কথপোকথন। তার জানামতে আবিরের বাবা বাহিরে থাকে। আবির এবং আবিরের বোন মায়ের সঙ্গে বড় হয়েছে। তাহলে আবার বাবা দেখতে আসবে কি করে? আর এই মহিলাই বা কে? তার সাথে আবিরের কি সম্পর্ক?
প্রশ্ন গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে আনুর।।আবির হঠাৎ মহিলাটিকে ছেড়ে উঠে পড়ে।। হাত ঘড়িতে নজর বুলিয়ে বলে
“আমাকে যেতে হবে আন্টি। নওয়ান ভাই সমাবেশ ডেকেছে। সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।
” তার গোলামী আর কতো?
“যতদিন বেঁচে আছি।।
আবির আনু সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার দু গালে হাত রেখে কপালে চুমু এঁকে দেয়। তারপর বলে
“আমি ভীষণ খারাপ মানুষ আনু। নিজেকে ছাড়া আর কিছুই ভাবি না। তোমাকে কখনো ভালোবেসেছি কি না জানি না। তবে তোমার জন্য বরাবরই আমার বড্ড মায়া হয়।
মানুষ জীবনে একবার ভুল করে আর সেই ভুলটা শুধরে নিতে গোটা জীবন লেগে যায়।।
তোমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিলো আমাকে ভালোবাসা।
আমাকে ভালো না বাসলে তোমারও সুন্দর একটা জীবন হতে পারতো।
___
এমপির মৃত্যু উপলক্ষে শোক পালনের জন্য মানিকগঞ্জ বিজয় মেলা মাঠ প্রাঙ্গনে বিশাল বড় এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নায়ের তালুকদার এমপির ছবিতে মালা পরিয়ে শোক পালন করবেন।
মানিকগঞ্জ শহরের মানুষরা ক্ষেপে উঠেছে। এমপির মৃত্যুর বিচার চায়। অথচ পুলিশের ভাষ্য মতে এমপি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। তার কোনো বিচার হয় না।
বর্তমানে রানিং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠে এসেছে। অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে তিনি সৎ এবং নিষ্ঠাবান নয়। বাংলাদেশের মানুষজন এই প্রধানমন্ত্রী কে আসন থেকে নামাতে চাচ্ছে। এটাই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন নায়েক তালুকদার। তিনি তার ছেলেপেলেদের উসকে দিয়ে সাধারণ মানুষদের উৎসাহ দিচ্ছেন।
অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে নির্বাচন জানুয়ারি তো হওয়ার কথা ছিলো সেই নির্বাচন জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত হবে। মানে হাতে আর চার মাস সময় রয়েছে। এই চার মাসেই তাদের কিছু একটা করতে হবে। যাতে সমস্ত ভোট তাদের দিকে চলে আসে। প্রতিযোগিতা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর আসনটা পেয়ে যায়।
নায়েব তালুকদারের সঙ্গে নওয়ান উপস্থিত রয়েছেন মঞ্চে। থাকার কথাই।
বাপের ডান হাত যে সে। নায়েব তালুকদার বক্তব্য দিচ্ছেন আর নওয়ান পাশে দাড়িয়ে সিগারেট টানছে। আজকে একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। বরাবরের মতো লম্বা চুলগুলো এলোমেলো। বলা বাহুল্য এলোমেলো চুলেই নওয়ানকে একটু বেশি ভালো দেখায়। ফর্সা চোয়ালে লাল রংয়ের এক খানা ব্রণের দেখা মিলেছে। এটা অবশ্য নওয়ান খেয়াল করে নি। করলে নুপুরকে বলতো “এই বাল আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে তুই আমার সাথে কি করেছিস? ব্রান উঠলো কেনো?
নায়েব তালুকদারের বক্তব্যের মাঝখানে নওয়ানের ফোন বেজে ওঠে। ফোন খানা ব্রাইভেশন মুডে ছিলো বলে শব্দ হয় না কিন্তু নওয়ান বুঝতে পারে।
সে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাকায়। বল্টু নামটা জ্বলজ্বল করছে।
এই বেলা টুকুর জন্য বল্টুকে ছুটি দিয়েছে সে। হাতে হাজার খানেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন “রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেয়ে আয়।”
নওয়ানের কথা অমান্য করার সাধ্য বল্টুর নেই। তাই সে রেস্টুরেন্টে চলে গেছে।
কিন্তু হঠাৎ কি হলো যে কল করলো?
নওয়ান কল রিসিভ করে
ফোন কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে বল্টুর ফিসফিস কথা শব্দ
“ভাই ভাবি একটা পোলার সাথে রেস্টুরেন্ট আসছে।
লাচ্চি চিকেন ফ্রাই অর্ডার দিয়েছে। ছেলেটা ভাবির দিকে তাকায় তাকায় হাসতেছে।
আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করে না নওয়ান।কল কেটে ফোন পকেটে পুরে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
নায়েব পিছু ডাকে। কোথায় যাচ্ছো জিজ্ঞেসও করে
তবে জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না নওয়ান। পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বিজয় মেলার মাঠ প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে পড়ে। গেটের কাছেই কালো রঙের বাইক খানা দাঁড় করিয়ে রাখা।
হেলমেটটা বাইকের উপরে। পকেট থেকে চাবি বের করে বাইকে বসে পড়ে। হেলমেট মাথায় পড়ে এক টান দিয়ে চলে যায় মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড।
সেখানে নতুন রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে। সেটারই উদ্বোধন আজকে।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব (২৪+২৫)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৫(৫.১+৫.২)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৬
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১ (১ম অংশ+ শেষ অংশ)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২২
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৮