Golpo romantic golpo অন্তরালে আগুন

অন্তরালে আগুন পর্ব ১৫


#অন্তরালে_আগুন

#পর্ব:১৫

#তানিশা সুলতানা

চারিদিক থেকে ফজরের আজানের সুর ভেসে আসছে। মিষ্টি ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে গোটা এলাকা। প্রতিটা মসজিদে একসঙ্গে আযান দেয়া হচ্ছে। আনুর ঘুম ছুটে গেছে অনেক আগেই। মূলত সে আজকে ঘুমোতেই পারিনি। শুধু আজকে নয় আনুর চোখের ঘুম সেদিনই চলে গেছে যেদিন থেকে আবির তাকে ছেড়ে গিয়েছে। প্রতিটা রাত অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতেই কেটে যায়। ঘুমোনোর সুযোগই পায় না।

তবে আজকে ঘুম না আসার আরেকটা কারণ রয়েছে। এইতো ভোরের আলো ফুটতেই আবিরের সঙ্গে চলে যাবে সে। কোথায় যাবে জানা নেই। শুধু জানে আবির তাকে নিয়ে অনেকটা দূরে চলে যাবে। ছোট্ট একটা সংসার হবে তাদের।

সত্যিই কি সংসার হবে? যে একবার ছেড়ে গেছে সে কি সারাজীবন থাকবে?

হয়ত থাকবে, বা থাকবে না।

আনুর একটা মন বলছে

“ওই বেঈমানটার সঙ্গে যাস না তুই। তোর নিষ্পাপ বাচ্চাটার খুনি সে। ক্ষমা করিস না তাকে। কঠিন হ আনু।

আরেকটা মন বলছে “বাবা-মায়ের অসম্মানিত মুখ দেখে কতকাল বাঁচবি? তোর জন্য তোর বাবা বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। ছোট বোন তো স্কুলে যেতে পারছে না। মাকে পাড়ার মানুষরা যা নয় তাই বলে অপমান করছে। এসবের একটাই সমাধান। তুই চলে আনু। সবাই ভালো থাকবে। সবটা ঠিক হয়ে যাবে।

আযানের শব্দ শুনতেই বিছানা ছেড়ে নামে আনু।বালিশের নিচে পড়ে থাকা ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। আনু জানে আবির কল করছে।

এইতো পাঁচটা বাজলেই তাদের চলে যাওয়ার কথা।

আনু গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে যায় বাবা মায়ের কক্ষে। আম্মু নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আব্বু বিছানায় ঘুমচ্ছে। আনু মায়ের সামনে দাঁড়ায় মাথা নিচু করে বলে

“মা একবার জড়িয়ে ধরবে আমায়?

রাজিয়া বেগম জবাব দেয় না। আনুকে ইগনোর করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে। আনু কিছু মুহূর্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।

নিজের কানে থাকা ছোট দুল পায়ের নুপুর হাতে থাকা বেসলেট সবটা খুলে রেখে দেয় বিছানার উপর।

তারপর ওড়না খানা মাথায় চাপিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

দেবেন্দ্র কলেজের পেছনে মহিলা হোস্টেল। সেই মহিলা হোস্টেল এর পেছনে কয়েক কদম হাঁটলে দুই তালা একটা বাড়ি দেখা যায়। মূলত সেই বাড়ি দ্বিতীয় তলায় অনুরা থাকে। বাড়ির বাইরে বের হতে আবিরকে দেখা যায়। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের আবছা আলোতে শ্যাম বর্ণের পুরুষটিকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে। বরাবরই এই লোকটার দিকে তাকালে আনুর অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে যায়। দিন দুনিয়া ভুলে তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কি দারুন মায়া মানুষটার চোখে মুখে।

আনুর বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে।

সে আবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে

“দ্বিতীয়বার আমায় ঠকিও না আবির। আমি তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি। আবার ঠকালে আর বাঁচতে পারবো না।

আবির মৃদু হেসে আনুর গালে নিজের হাত রাখে। বড্ড আশ্বাসের সুরে বলে

“আমি আছি তো তোমার সাথে। সারা জীবন থাকবো।

এবার জলদি উঠো। অনেকটা দূরে যেতে হবে আমাদের। যাতে কেউ কখনো খুঁজে না পায়।

আনু আবিরের কাঁধে হাত রেখে বাইকে বসে। পেছন ফিরে নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে ওঠে

“আমায় ক্ষমা করে দিও আব্বু আম্মু। এই জীবনে তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। ভুলে যেও আমায়। মনকে বুঝিও একটা জানোয়ার জন্ম দিয়েছিলে। যে তোমাদের ভালো থাকার কারণ হতে পারলো না।

___

সবিতার ডাকা ডাকিতে ঘুম ছোটে নুপুরের। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখতে পায় ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে। এবং অনুভব করে কারো শক্ত বাধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। লোমশ যুক্ত ধবধবে সাদা বুকে তার মাথা খানা। অদ্ভুত এক পুরুষালী সুঘ্রান নাকে লাগছে। কপাল কুঁচকে ফেলে নুপুর। কয়েকবার চোখের পলক ঝাপটে বড় বড় নয়নে তাকায়। ঘাড় উঁচু করে মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করে।

মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে যায়। বেয়াদব নওয়ানের বুকে সে পরে পরে ঘুমোচ্ছে? ছি

নুপুর নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে থাকে। সবিতার গলার স্বর বাড়তে থাকে। অনবরত দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলছে

“নবাবজাদির ঘুম কি ছুটবে না? মহারানীর খাবার কি কক্ষে পৌঁছে দিতে হবে?

নওয়ানের ঘুম হালকা হয়ে যায়। আড়াআড়ি ভাবে ভ্রু কুচকে ধমকের স্বরে বলে

” গুইসাপের মতো লাফালাফি করছিস কেনো? দেখছিস না ঘুমচ্ছি। বাল

নুপুর দাঁতে দাঁত চেপে বলে

“লজ্জা লাগে না আপনার?

” না লাগে না।

লজ্জা বিক্রি করে কটকটি খেয়েছি।

তখুনি আবারও সবিতার গলা ভেসে আসতেই নওয়ান উচ্চস্বরে বলে ওঠে

“বুড়ি আর একবার ডাকলে ছাঁদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো।

বাল গুলা। ঘুমাতেও দিবে না।

সবিতা ভয় পেয়ে তারাহুরো করে চলে যায়। ভেবেছিলো আজকেও নুপুরকে দিয়ে রান্না করাবে।

একটু জ্বালাবে। তা আর হলো না।

নুপুর নুপুর বলে

“ছাড়ুন আমায়।

নওয়ান আরো একটু শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরে। চুলের ভাজে ঠোট ডুবিয়ে নরম স্বরে বলে

“থাকো না একটু। এভাবেই ভালো লাগছে। পাপী বুকটা কেমন পূর্ণতা পূর্ণতা অনুভব করছে।

নুপুর তাচ্ছিল্য হেসে বলে

“কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে পাপের মাঝে ডুবে আছি।

” খুব পাপী আমি?

“খুব নয়। মারাক্তক। এই পৃথিবীর সব থেকপ শ্রেষ্ঠ পাপি আপনি। প্রতিটা রক্তের কণায় পাপ জমে আছে।

” পাপ কমানোর উপায় কি?

“মৃ/ত্যু। যেদিন আমার হাতে আপনার প্রাণ খানা দেহ থেকে বেরিয়ে যাবে। সেইদিনই শান্তি পাবো আমি।

” ঠিক আছে।

কথা দিলাম

আমার মৃ*ত্যু তোমার হাতেই হবে।

বলেই নুপুরকে ছেড়ে দেয় নওয়ান। নুপুরে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ে। বিছানার তলা থেকে ওড়না খানা কুড়িয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়। এবং বলে

“আই উইশ সেই দিনটা তাড়াতাড়ি চলে আসতো।

আপনার সঙ্গে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনার মুখ পানে তাকালে ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে।

নুপুর ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। প্রচন্ড জোরে শব্দ করে দরজা লাগায়। নওয়ান মাথার ওপরে থাকা গোলাপি রঙের দেওয়াল খানা মনোযোগ দিয়ে দেখে কিছু মুহুর্ত। তারপর বালিশের নিচ থেকে সিগারেট এর প্যাকেট বের করে এক খানা সিগারেট ঠোঁটের ভাজে গুঁজে নেয়। লাইটারের সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে মনের সুখে টান দেয়। নিকোটিন এর ধোঁয়ায় ভরে যায় নওয়ানের গাল।

” এতোটাই বাজে আমি?

প্রশ্ন খানা মনে জাগতেই ধোঁয়া শূন্যে উড়িয়ে বিরবির করে গেয়ে ওঠে

“তুমি না ডাকলে আসবো না।

কাছে না এসে ভালোবাসবো না।

দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?

না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়।

দূরের আকাশ নীল থেকে লাল

গল্পটা পুরোনো

ডুবে ডুবে ভালোবাসি

তুমি না বাসলেও আমি বাসি।

___

নায়েব তালুকদার চিন্তিত ভঙ্গিমায় বসে আছে ড্রয়িং রুমের সোফায়। একটু আগেই আমিনার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে তার। ঝগড়া বলতে

নায়েব এর ফোনে একটা মেসেজ এসেছে “আই মিস ইউ”

আমিনা সেটা দেখে ফেলেছে এবং নায়েবকে প্রশ্ন করেছে

“কে এই মেয়েটা?

আপনার কাউকে ভালো লাগলে বা কাউকে ভালোবাসলে নির্দিধায় আমায় বলতে পারেন। আপনি ভালো থাকলেই হলো।।

রেগে যাওয়ার মতো কোনো কথা বলে নি আমিনা। তবুও নায়েব এর রাগ হয়। হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাস খানা ছুঁড়ে মারে তার দিকে। ডান গালে গিয়ে লাগে। ব্যাথা পেয়েছে আমিনা৷ তবুও শব্দ করে না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়।

ভাবনার মাঝেই নায়েব এর ফোন বেজে ওঠে। স্কিনে আবির নামটা ভেসে ওঠে। নায়েব সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে। ফিসফিস করে বলে

” কি খবর?

“বাবা আনুকে নিয়ে এসেছি। তুমি কোথায়?

” কোথায় আছো?

“এই তো পাটুরিয়া।

” লঞ্চে উঠে পড়ো। নদী পার হয়ে কল করবে আমায়।

“ঠিক আছে।

” বি কেয়ার ফুল আবির। নওয়ান যেনো কিছু বুঝতে না পারে।।

“ঠিক আছে।

কল কাটে নায়েব। কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মাথায় হাজারটা চিন্তা। নওয়ানকে ব্যস্ত রাখতে হবে। নুপুর নামের মেয়েটির থেকেও দূরে করতে হবে।

” আপনার চা।

নায়েব ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় আমিনার পানে। কিন্তু কিছু বলে না।

নওয়ান বেরুনোর জন্য তৈরি হয়ে সিগারেট টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়। মা এবং বাবাকে এক সঙ্গে দেখে খুশি হলো কি না বোঝা গেলো না। তবে গম্ভীর মুখ খানা একটু স্বাভাবিক হয়।

বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে। বাবার পাশে বসে চায়ের কাপ খানা হাতে তুলে নেয়। সিগারেট হাতের আঙুলের ভাজে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে

“মাম্মাম ইয়াম্মি।

আমিনা হাসে।

” চা কি আর ইয়াম্মি হয়?

নওয়ান দ্বিতীয় বার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে

“আমার আম্মুর বানানো চা ইয়াম্মি হয়। বাবা বলো?

নায়েব নওয়ান এর মাথায় হাত বুলিয়ে মাথা নারায়। মানে হ্যাঁ আমিনার বানানো চা ইয়াম্মি হয়। আমিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নওয়ান মনোযোগ দিয়ে চা পান করতে থাকে।

” আব্বা নির্বাচন এগিয়ে আসছে। তোমার খেয়াল আছে তো?

নওয়ান মায়ের মুখ পানে তাকায়।।

“রিলাক্স বাবা।।

নওয়ান বলেছে প্রধানমন্ত্রী তুমি হবে। তো হবেই।।

পেছন থেকে নুপুর বলে ওঠে

” নুপুর শিকদার চ্যালেন্জ করে বলছে। প্রধানমন্ত্রী নায়েব তালুকদার হবে না।

নায়েব পেছন ঘুরে তাকায়। সাদা কলেজ ড্রেস পড়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুপুর। চোখে মুখে কি দারুণ আত্মবিশ্বাস।

যেনো সে ১০০% শিওর এই চ্যালেন্জ এ তার জিত নিশ্চিত।

নওয়ান নাক মুখ কুঁচকে ফেলে। যেনো এখুনি কিছু একটা করে ফেলবে।

আমিনা প্রসঙ্গ পাল্টে বলে

“নুপুর ব্রেকফাস্ট করে যাও।

নুপুর একটু হেসে আমিনার দিকে এগোয়। আঘাত প্রাপ্ত গালটায় আলতো করে হাত রাখে

” আপনার হাজব্যান্ড আঘাত করেছে?

বাহহ বাপ ছেলে তাহলে একই। মেয়ে মানুষদের দুর্বল মনে করে শুধু আঘাত করতেই জানে।

নওয়ান আমিনার গালের দিকে তাকায়। আসলেই লাল হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ শক্ত আঘাত পেয়েছে।

“আম্মু কিভাবে ব্যাথা পেলে?

আমিনা এক পলক নায়েব এর দিকে তাকায়। নুপুর বলে

” আপনার বাবা আঘাত করেছে।

নওয়ান যেনো ক্ষেপে গেলো।।

“আমার বাবা সব করতে পারে। বাট আমার মাকে ব্যাথা দিতে পারে না। হি ইজ এ বেস্ট হাজব্যান্ড ইন দ্যা ওয়াল্ড।

আমিনাও একটু হাসার চেষ্টা করে বলে

” বাতরুমে পড়ে গিয়েছিলাম। উনি আমায় কখনো আঘাত করতে পারেই না।

নুপুর বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে যেতে নেয়। নওয়ান বলে ওঠে

“আমার আম্মু বললো না খেয়ে যেতে?

নুপুর না দাঁড়িয়েই বলে

” আমি খাবো না৷

নওয়ান বড় বড় পা ফেলে নুপুরের দিকে এগোয়। বাহু ধরে তাকে থামায় এবং শক্ত গলায় বলে

“তুই খাবি মানে খাবি। না খেলে তোকে আমি খেয়ে ফেলবো।

চলবে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply