অন্তরালে_আগুন
পর্ব:৩৫
তানিশা সুলতানা
নুপুর কে নিয়ে হেলিকপ্টারে উঠে পড়ে নেহাল। তার পেছনে রয়েছে অভি। বড্ড তাড়াহুড়ায় জায়গাটা ছেড়ে তারা আসমানে উড়াল দেয়। বাঁকা নয়নে নওয়ানের পানে তাকাতেও ভোলে না। যেনো বোঝালো “তোর চাঁদ আর তোর নেই। সে বদলে যাচ্ছে। নতুন জীবন শুরু হবে তার আমার সাথে”
অতি দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা উচিত নুপুরের। ভীষণ বাজে ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। জামাকাপড় নোংরা। স্যাঁত স্যাঁতে মাটির উপর একনাগারে বসে ছিল ১৯ ঘন্টারও বেশি সময়। পোকা মাকড়ে কামড়েছে বেশ কিছু জায়গায়। কপাল ফেটে র/ক্ত গড়িয়ে গোটা মুখশ্রী রক্তিম হয়ে গেছে। অভুক্ত দেহ খানায় এক বিন্দু পরিমাণ শক্তি নেই। তবুও যেন কিছু একটা বলতে চাইছে সে। কিছু একটা বুঝিয়ে চলেছে অনবরত।
আনুকে নিয়ে সিফাত আরও আগেই চলে গিয়েছে। কারণ তার অবস্থা খুব খারাপ। মুখের এক পাশটা ভীষণ বাজে ভাবে থেতলে গিয়েছে।
আশ্চর্যজনক বিষয় আনু এবং নুপুর ছাড়া এই কুটিরে আর একটাও মেয়ে নেই। কারো আর্তনাদ শোনা হচ্ছে না।
নওয়ান দাড়িয়ে আছে। ক্লান্ত নয়নে তাকিয়ে দেখতে থাকে প্রেয়সীর চলে যাওয়া। আধ বোজা নয়ন মেলে তাকিয়ে ছিলো সে নওয়ানের চোখের দিকে। যতটা সময় দুজন কাছাকাছি ছিল ততটা সময়ই নুপুর তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলছিলো।
ওই চোখের চাহনিতে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে “কোনো একটা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এখানে। এবং সেটা তাকেই খুঁজে বের করতে হবে”
নুপুর যেনো স্পষ্ট তার কানে কানে বলছে
“মিস্টার বেয়াদব আপনি এখান থেকে আসবেন না। বাকিদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনি নিজেই খুঁজে দেখুন গোটা জায়গাটা। আপনার চাঁদকে যে কষ্ট দিয়েছে তাকে ছাড়বেন না। কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিবেন।
এখানে কতো মানুষ ছিলো। কেউ বুঝলো না। বুঝলো শুধু নওয়ান। সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে ভাবে কিছু একটা।
তখনই
এসিপি আশিক বড্ড আফসোসের স্বরে বলে
“ম্যামের জন্য আপনি এত কষ্ট করলেন, পাগলের মত ছুটে আসলেন
অথচ ম্যাম আপনাকে এভাবে ইগনোর করে চলে গেল?
নওয়ান ঠোঁট বাঁকায়। দুই ভ্রু আড়াআড়ি ভাবে কুঁচকে তাকায় এসিপির মুখ পানে।
জলন্ত সিগারেট ঠোঁটের ভাজে পুরতে পুরতে বলে
“আমার চাঁদকে স্পর্শ করার সাহস যে দেখিয়েছে তার কলিজাটা আমার চাই।
আপনারা এখন আসতে পারেন।
আমার এখানে একটু কাজ আছে
আশিক তাড়াহুড়ো করে বলে
“আপনাকে রেখে আমরা যেতে পারবো না।
নওয়ান চোখ দুটো ছোট ছোট করে দৃষ্টি এখনো এসিপির মুখ পানে। ব্যাসস আর কিছু বলার সাহস হয় না ওনাদের। চুপচাপ চলে যায়। থেকে যায় শুধু বল্টু।
তাকে কেউ মেরে ফেললেও নওয়ানকে একা ফেলে যাবে না।
জুলাই মাসের ১৭ তারিখ। নায়েব তালুকদার শপথ গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটা দখল করবেন আজ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ইউটিউব ফেসবুক instagram সব জায়গায় এই একটা নিউজ ঘুরাঘুরি করছে। সাংবাদিকরা অন্য সব নিউজের পেছনে ছুটাছুটি না করে অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছে দশটা বাজার।
কেননা ঠিক দশটায় অনুষ্ঠিত হবে শপথ গ্রহণ কার্যক্রম। গোটা বাংলাদেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা, জনগণদের অভিভাবক হওয়া, তাদের দায়িত্ব নেওয়ার শপথ নিবেন।
নায়েব তালুকদার আজকে ভীষণ খুশি। এতো দিনের অপেক্ষার সমাপ্তির দিন আজ। সাদা পানজাবি পাজামায় নিজেকে সাজিয়েছে ভিন্ন রূপে। বয়সটা যেনো আজকে একটু কমই লাগছে। সাদা চুল গুলো খুবই যত্ন সহকারে আড়াল করে ফেলেছে। ফর্সা হাতের কব্জিতে ঝুলছে রোলাক্স ঘড়ি। রাজা রাজা একটা ভাব চলে এসেছে ইতিমধ্যেই। এখন শুধু শপথ গ্রহণ করে গোটা বাংলাদেশের রাজা বলে ঘোষিত হওয়ার অপেক্ষা।
গতকাল রাত থেকে অনবরত কল করে চলেছে নওয়ানকে। ছেলে ছাড়া তিনি এক পা এগোতে পারে না। আজকের শপথ গ্রহণ করবে কি করে?
বড্ড চিন্তিত হয়ে মাঝরাতে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ চলে আসে। তবে এখানে এসেও তার হতাশা কাটে না। কেনোনা তার ছেলে বাড়িতে ফেরে নি।
তবে কি নুপুর নামক ঐ মেয়েটিকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরবে?
খুঁজে বের করবেই তাকে?
চিন্তায় কপালে তিনটে বাজ পড়ে নায়েব তালুকদারের। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে গম্ভীর মুখে কিছু একটা চিন্তা করেই যাচ্ছে।
মেয়েটা ভীষণ চালাক এবং বুদ্ধিমতি। ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড় ও বলা চলে।
এইতো যেদিন নওয়ান মেয়েটিকে তার বাড়িতে দিয়ে আসলো সেদিন সকালের ঘটনা।
বিনা অনুমতিতে নায়েব তালুকদারের কক্ষে ঢুকে পড়ে মেয়েটি। কল লিস্ট ঘেটে বের করে মৃত এমপির মেয়ের ফোন নাম্বার। এবং ফোনের গ্যালারি ফোল্ড থেকে পেয়ে যায় অপ্রতিকর কিছু পিকচার।
মূলত যে পিকচার গুলো দেখিয়ে নায়েব তালুকদার ব্ল্যাকমেল করতো ইরাবতীকে। এবং যে রাতে ইরাবতী এবং তার বাবা মৃত্যুবরণ করেছে সেদিন বিকেলে নায়েব তালুকদার ইরার নাম্বারে মেসেজ দিয়েছিলো “আমি আসছি। যা কথা হওয়ার সামনাসামনি হবে”
এইসব প্রমাণ গুলো নুপুর সংগ্রহ করেছে। আর কয়দিন এই বাড়িতে থাকলে কি না কি করে ফেলতো। তাই তো অতি দ্রুত তাকে এই বাড়ি থেকে সরানো হলো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের “শেষ হয়েও হলো না শেষ” কথাটির মতো কিছুই শেষ হলো না।
“আপনি বেরুবেন না?
আমিনার কণ্ঠস্বর এ চোখ খুলে নায়েব তালুকদার। ছোট্ট আয়াশ ফ্লোরে বসে প্লেন দিয়ে খেলছে। আসমানে উড়ানোর চেষ্টা করছে। এই প্লেনটা নওয়ান কিনে এনে দিয়েছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে কেউ একটা বারও আয়াশের পরিচয় জানতে আগ্রহী দেখাচ্ছে না। যেনো সকলেই জানে। আজকের মতো একটা ভালো দিনেও মন ভালো নেই নায়েব তালুকদারের। চারিদিক থেকে হতাশা ঘিরে ধরছে তাকে। আমিনা জবাব না পেয়ে চলে গিয়েছে।
লাঠির খটখট আওয়াজ তুলে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে মজনু তালুকদার। তার চোখে মুখেও বিরক্তির ছাপ।
“নায়েব আমাদের এবার বেরোনো উচিত।
নায়েব তালুকদার পকেট থেকে ফোন বের করে কল করে নওয়ানের নাম্বারে। ছেলেকে ছাড়া সে কিছুতেই যাবে না। প্রয়োজনে আজকে শপথ গ্রহণের ডেট পিছিয়ে দিবে।।
হাসপাতালে ভর্তি আনু। তার মুখের এক সাইড একদম থেতলে গিয়েছে। প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হওয়ার ফলে বাঁচার চান্স খুবই সামান্য। আর বেঁচে থাকলেও কোনদিনও স্বাভাবিক হতে পারবে না। সাধারণ মানুষদের মতো হাঁটাচলা করতে পারবে না, এমনকি চেহারাও আর ঠিক করা সম্ভব নয়, কথা বলতে পারবে না কোনদিন। এতসব কন্ডিশনের পরে পাঁচ লাখ টাকা লাগবে অপারেশনের জন্য।
হাসপাতালের করিডোরে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে সিফাত। সিফাতের মা সিমলা বেগম বড়ই বিরক্ত স্বরে ছেলেকে বারংবার ধমকে যাচ্ছে। বাসায় ফিরতে বলছে। তবে সেসব কানে তুলছে না ছেলেটা। গভীর মনোযোগে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে টাকার খোঁজ করে যাচ্ছে।
ডাক্তার তো বলল
তাকাতে পারবে আনু, দেখতে পারবে তাকে। ব্যাস আর কি চাই?
নাইবা কথা বলতে পারলো শুধু সিফাতের কথা শুনতে পারলেই হলো। সুন্দর চেহারা দিয়ে কি করবে ও? সুন্দর এই চোখ দুটো থাকলেই হলো।
সিমলা বেগম এবার প্রচন্ড রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে
” পতিতালয়ের বেইশ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এতো গুলো টাকা নষ্ট করবি কেনো? পাগল হয়ে গিয়েছিস
সিফাত। তাও যদি ভালো হতো। সে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে থাকবে।
সিফাত মায়ের মুখপানে তাকায়। একটু হাসার চেষ্টা করে বলে
“ও যদি পৃথিবীর সব থেকে খারাপ মেয়েটিও হয়ে থাকে তবুও আমার ওকে লাগবে।
ও শুধু নিশ্বাস নিক। আমায় ফিল করুক। আর কিছু চাইনা আমার।
ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে আমি মরে যাব মা।
তুমি আর আমাকে বাঁচাতে পারবে না।
সিমলা বেগম আর কিছু বলার সাহস পায় না। চুপচাপ বসে পড়ে করিডোরে রাখা ব্রেঞ্চে। এই পর্যন্ত 6-7 লাখ টাকা জমিয়েছে সিফাত। আজকের শুক্রবার। ব্যাংক বন্ধ। টাকা তুলতে পারবে না। কিন্তু তার এক্ষুনি টাকা লাগবে।
অনেক কিছু চিন্তা করে ছুটে যায় অভির কাছে।
পাশের কেবিনে নুপুর রয়েছে। তার শারীরিক অবস্থা এখন একটু ভালো। মাথার আঘাতটা গভীর ছিলো তাই আপাতত সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।
কিন্তু কেবিনে ঢুকে দেখে বেডে নুপুর নেই। অভি নেহাল নাসির সোনিয়া বেগম সকলেই চিন্তিত ভঙ্গিমায় এদিকে ওদিক খুঁজে চলেছে নুপুরকে।
চলবে
Share On:
TAGS: অন্তরালে আগুন, তানিশা সুলতানা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৬+২৭
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৫(৫.১+৫.২)
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ২৯
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩৪
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১২
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১৯
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ১১
-
অন্তরালে আগুন পর্ব ৩৩