সোনাডিঙি_নৌকো (৭)
মৃধা_মৌনি
রাত গভীর। টিনের চালের উপর টুপটাপ করে নিশির ফোঁটা পড়ছে। একটা ঘুমপাড়ানি সুরের মতো শোনাচ্ছে। আবার কেমন যেন হাহাকারও মিশে আছে তাতে। ঘরটায় ম্লান একটা বাতি জ্বলছে। দীক্ষা বিছানার কিনারায় চুপচাপ বসে আছে। হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। চোখদুটো শুকনো কিন্তু ভেতরে অস্থিরতার ঝড় বয়ে চলেছে।
এই সময় দরজার সামনে ছায়া পড়ে। খালেদা বেগম ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকলেন। হাতে একটা স্টিলের থালা তার। তাতে গরম ভাত টমেটোর ভর্তা দিয়ে মাখা। চমৎকার ঘ্রাণেই বোঝা গেল তিনি নিজের হাতে যত্ন করে বানিয়েছেন।
তিনি বিছানার পাশে এসে বসে নরম গলায় বললেন,
—“এইভাবে না খেয়েদেয়ে বসে থাকলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে রে মা? দুঃখ সব কমে যাবে? বাস্তবতা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠবে?”
দীক্ষা তবু মুখ তুলল না।
খালেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
—“আমার এক মেয়ে আমি হারাইছি। আরেকটা হারাইতে চাই না। এভাবে না খেয়ে মন ম রা হয়ে থাকাটা তোর জন্য ক্ষতিকর রে মা।”
তাঁর কণ্ঠ খানিকটা কেঁপে উঠল,
—“তোকে ছাড়া আমার আর কেউ আছে? তুই না খাইলে কার মুখে আমি ভাত তুলব বল?”
দীক্ষা ঠোঁট চেপে রেখেছে, কোনো উত্তর নেই।
খালেদা আবার বললেন,
—“তোর শ্বাশুড়ি ফোন দিছিল। তুই নাকি ফোন বন্ধ করে রাখছিস? তোর চিন্তায় সেও আধ ম রা। আর…”
খালেদা উশখুশ করছেন। কথাটা দীক্ষাকে জানাবেন কি জানাবেন না- ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কিন্তু বলাটাই বোধহয় সমীচীন হবে। জানতে পারলে মনের ভার খানিকটা কি কমবে না? তাই বললেন,
—“জানাল, সে নাকি শিশিরকে আর ওই জানোয়ারটাকে তাড়াই দিছি বাসা থেকে। তৃণার নাম্বারে ফোন দিছিলাম আমি। ফোন সাথে করে নিতে পারে নাই। ঘরেই ফেলে গেছে। ওরে পাইলে আমি নিজের হাতে জুতা পিটা করব, তুই আমার এই কথাটা মিলিয়ে নিস।”
দীক্ষা এবার ধীরস্থির ভাবে চোখ তুলে তাকাল। ভাঙা গলায় বলল,
—“ওদের ব্যাপারে আমার সামনে কখনো কিছু বলবে না তো মা। যা হয় হোক, কক্ষনো আমি ওদের নাম শুনতে চাই না। আর তোমার ছোট মেয়েকে আমার কারণে তুমি কেন জুতা পিটা করবে? আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের মা মেয়ের সম্পর্ক ভাঙুক। আমি তো ওর মতো কে ড়ে নিতে শিখিনি। তারচেয়ে একটা কথা শুনে রাখো, ও যেদিন এখানে আসবে আমি চলে যাবো।”
খালেদা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,
—“তুই কোথায় যাবি! খবরদার এসব পাগলামি কথাবার্তা বলবি না। তুই এখানেই থাকবি, এই বাড়িতে। আমার একটাই মেয়ে আজ থেকে। এমন অসভ্য বেয়াদব জানোয়ার আমার মেয়ে হওয়া লাগবে না।”
দীক্ষা উত্তর দিলো না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল।
—“এসব বাদ দে এখন।”
খালেদা বেগম থালা এগিয়ে ধরে বললেন, কণ্ঠে কঠোরতা আর স্নেহ মিলেমিশে রয়েছে-
—“তোর কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু না খেয়ে বসে থাকলে কষ্ট কমবে নাকি বাড়বে?”
তিনি থালা থেকে এক লোকমা ভাত তুলে নিলেন, টমেটো ভর্তার লালচে দাগ ভোরের আভা মতো।
—“মুখ খোল, মা…হা কর। ভাতের সাথে জেদ ধরতে নাই। ভাতের উপর রাগ রাইখা তুই নিজের ক্ষতি করছিস। সেই সঙ্গে তারেও কষ্ট দিচ্ছিস যার কিনা তুই ছাড়া কেউ নাই। হা কর দীক্ষা, খেয়ে নে…”
দীক্ষা একটু ইতস্তত করলেও খালেদা বেগমের হাতের কোমল চাপ তাকে বাধ্য করে মুখ খুলতে। প্রথম মুঠোটা মুখে তুলতেই ভাতের উষ্ণতা, টমেটোর হালকা টক-মিষ্টি স্বাদ- হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে জমে থাকা ভারটা ঢিল করে দিলো।
খালেদা বেগম চুপচাপ তার মাথায় আরেক হাত বুলিয়ে দেন। টিনের টুপটাপ শব্দের সাথে মিশে যায় মায়ের মতো সেই স্পর্শ। এভাবে দু’জনে কথার ফাঁকে ফাঁকে, নীরবতা আর দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে, ক্লান্ত – অস্থির রাতটাকে একটু সহজ করে নেয়।
কুয়াশা নামছে চারদিক ঘিরে। উঠোনের এক পাশে ঝুলানো টিমটিমে হলদে বাতিটা জ্বলছে, তার আলোয় দেখা যায় শান্ত বসে আছে দাওয়ার ধারে। হাতে ধরা সিগারেটটা প্রায় আধাআধি পুড়ে গেছে। কিন্তু সে টানছে না। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ধোঁয়া উঠছে।
খালি গায়ের উপর একটা পুরনো গামছা এলোপাথাড়ি চাপানো। শীত যেন তাকে ছুঁতেও পারছে না বা সে শীতকে পাত্তাই দিচ্ছে না- এমন ভাবভঙ্গি!
তার কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। মেজাজ বিগড়ে আছে, তাও উপর দিয়ে দেখলে বোঝা যায়। মনের ভেতর খুব কড়া হিসেব নিকেশ চলছে। কিছু একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু সেটার কোঠা বরাবরই শূন্য হচ্ছে বিধায় মনটা বিষিয়ে উঠছে তার।
এমন সময় ভেতর থেকে তার ছোট বোন নন্দিনী ডাকতে ডাকতে বাইরে বেরিয়ে এলো,
—“দাদাভাই… খাইবা না? ভাত বাড়ছে।”
শান্ত গম্ভীর মুখে বলল,
—“আমার খাওয়া লাগলে আমি খাইয়া নিবোনে। তুই যা।”
—“মায়ে ডাকতাছে। তোমারে নিয়া যাইতে বলছে।”
—“তাইলে আয়, কোলে কইরা নিয়া যা, আয়, কোলে তোল।”
সঙ্গে সঙ্গে নন্দিনীর চোখে চিকচিক করে উঠল।
—“তুমি সবসময় আমার সাথে এমন কইরা কথা বলো ক্যান দাদাভাই?”
শান্তর বিরক্তির মাত্রা বাড়তেই লাগল,
—“আর তোরে একটা কিছু কইলে কাইন্দা কাইটা ভাসাস কিজন্যে? চোখ না কুয়া? পানি ভরতে ভরতে উপচাইয়া পড়ে, হুম?”
নন্দিনী জবাব দিলো না। ভেতরে দৌড়ে ঢুকে গেল। তারপর পরই দাওয়ার সিঁড়িতে ছায়া পড়ে।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেব শান্তর বাবা ইমদাদ তালুকদার। উঁচা গলা, গম্ভীর মুখ, কড়া স্বভাবের মানুষ।
—“শান্ত। দুপুরেও নাকি খাইলা নাই? আইসা শুইয়া পরলা, এখনো খাইতেছো না? বইনে ডাকতে আসছে, তার সাথে এইরকম ব্যবহার করলা। সমস্যা কী তোমার?”
শান্ত কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তৎক্ষনাৎ।
বাবার সামনে তার সব সাহস গলে পানি হয়ে যায়; সে তাঁরে বেজায় ভয় পায়।
—“এমনিতেই আব্বা। শরীরটা ভালো লাগতেছে না।”
—“এই শীতের মধ্যে এমনে সং সাইজা বইসা আছো ক্যান তাইলে? যাও ঘরে যাও। যা খাইতে ভাল্লাগে তোমার মা রে কও, বানাইয়া দিবো। আমার মেয়ের লগে মেজাজ দেখাইলে তো শরীর ভালো হইবো না তাই না?”
শান্ত কোনো কথা বলল না। মাথাটা যথেষ্ট নিচুতে নামালো। একমাত্র এই মানুষটাই পারে শান্তর সব তেজ, সব অহংবোধ, দেমাগ কে এক লহমায় চুরমার করে দিতে। দুনিয়ার সবার সামনে সে ঠোঁট কা টা বেয়াদব শান্ত হলেও বাবার সামনে তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হতেও ভুলে যায়।
ইমদাদ তালুকদার পুনরায় গম্ভীর স্বরে বললেন,
—“খামখেয়ালিপনা তোমার মায়ের সাথে দেখাইবা। আমার সাথে না। তোমার বইনের সাথেও না। নন্দিনীর বিয়া ঠিক হইছে। দুইদিন পর মাইয়াটা এই বাড়ির মেহমান হইয়া যাইবো। তারে কথায় কথায় এমন কান্দানো কি ঠিক? তুমি বলো, ঠিক?”
শান্ত দায়সারাভাবে মাথা ঝাঁকাল। যার অর্থ হ্যাঁ আবার না- দুটোই হতে পারে। তার বিরক্তি লাগছে। তবে সেটা যথাসম্ভব অপ্রকাশিত রাখার চেষ্টা করছে। যবে থেকে নন্দিনীর বিয়ে ঠিক হয়েছে তবে থেকে ইমদাদ তালুকদার মেয়ের প্রতি অতি আহ্লাদীপনা দেখাতে শুরু করেছেন। অথচ এর আগে মেয়ে ছেলে দুটোই তার কাছে দরকারী তবে অপ্রয়োজনীয় ধরনের ছিল৷
—“আল্লাহ মুখ দিছে কথা বলার জন্য। প্রশ্ন-উত্তর সবটাই মুখ দিয়ে দিতে হয়। শরীর এদিক ওদিক ঝাঁকিয়ে একটা উত্তর দেওয়া- কোনো উত্তরের মধ্যে পড়ে না।”
শান্তর মনে হলো, গায়েব হওয়ার একটা জাদু জানা থাকলে বেশ হতো। এই মুহূর্তে এই ভদ্রলোকের সামনে থেকে গায়েব হওয়া যেতো। অযথাই কত কথা টানছেন! সে পুনরায় বিড়বিড় করে আওড়ালো, ইয়া মাবুদ, আমারে রক্ষা করো পিলিজ। মনটা বেজায় অস্থির, তুমি তো জানো মাবুদ, বুঝতেছ সবকিছু। আমার বাপটারেও বোঝাও।
মাবুদ এবারে শুনলেন। হয়তো বান্দার অভিমান ভাঙাতেই কিংবা শান্তর মন সত্যিকার অর্থেই কতটা খারাপ তা বুঝতে পেরে…
ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন শান্তর দাদী।
চোখে চশমা, হাতে কাঠের লাঠি, কিন্তু মুখভরা হাসি।
তিনি বেরিয়ে এসেই ইমদাদ তালুকদারকে ধমকে বলে উঠলেন,
—“পোলারে এত জ্ঞান দিতেছোস, ওদিকে নিজে ভাত রাইখা উইঠা আসছোস। ভাতটি অভিশাপ দেয় না?”
ইমদাদ তালুকদার একবার শান্তর দিকে তাকালেন। তারপর বিনা জবাবে ভিতরে চলে গেলে দাদী শান্তর পাশে গিয়ে বসলেন।
—“কিরে?”
একটু নাক সিটকে বললেন,
—“প্রেমে পরছোস নাকি?”
শান্ত ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
—“আজাইরা কথা কইয়ো না তো দাদী। এমনেই মন মেজাজ ভালো লাগতেছে না।”
ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ করে বললেন তিনি,
—“আহারে আমার রাজপুত! প্রেমে পড়লে এমনই করে মানুষ। ছটফট করে, খাইতে পারে না, ঘুম হয় না, মন অস্থির। চোখজোড়াও কেমন লাল লাল…”
তিনি শান্তর মাথায় আলতো চাপড় দিলেন।
—“কে রে সেই লাডলি, যার লাগি তোর এ অবস্থা?”
শান্তর অবাক হয়ে খেয়াল করল, সে রাগ দেখাতে চাইছে অথচ দেখাতে পারছে না। কারণ তার রাগ হচ্ছে না। বরং দাদীর এইসব আজাইরা কথা শুনতেও আজ তার ভালো লাগছে। বড্ড ভালো লাগছে। বুকের ভেতর যে অস্থিরতাবোধ ছিল, তা সাময়িক হলেও কমতে শুরু করেছে। এমনকি গায়ে হালকা হালকা শীতের অনুভূতি ও হচ্ছে।
দাদী হঠাৎই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললেন,
—“বয়স হইছে তো! এ বয়সে পেটের ক্ষুধা থাকে না, থাকে শুধু প্রেমের ক্ষুধা। নারে ভাই?”
উঠোনের ওপার থেকে হাওয়া আসে। কাঁঠালপাতার আওয়াজ, দূরের কুকুরের ডাক আর দাদীর হাসি তামাশার মধ্যে রাতটা যেন একটু স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে।
দাদী উঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলেন,
—“চল, ভেতরে আয়। আমি নিজ হাতে ভাত মাখাইয়া দিমু। না খাইলে তো শইলে বল পাবি না। বল না পাইলে প্রেমও টিকবে না, বুঝলি? প্রেম করতে দুনিয়ার শক্তি লাগে। আয়, উইঠা আয়।”
শান্ত লজ্জায়, অস্থিরতায়, আর একটু হাসির ছোঁয়ায় মাথা নেড়ে দাদীর পিছু নেয় ভেতরের দিকে।
বিশাল বড় ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণে বসে আছে শিশির। মাথাটা বড্ড ধরে আছে তার। রাতে খাওয়া হয়নি। ফ্লোরে ঘুমিয়ে সারা শরীর ব্যথা করছে। সেই সঙ্গে ঠান্ডা ও লেগেছে বুকে। খুক খুক করে কাশি আসছে একটু পর পরই। পরনের জামা-কাপড় দুমড়ানো, মুচড়ানো। দেখে মনে হচ্ছে, এই অফিসে আসতে তাকে সাত সাগর তেরো নদী পার করতে হয়েছে।
হাবিব এগিয়ে এসে তার সামনের চেয়ারটা দখল করে বললেন,
—“শিশির ভাই, আপনার এই অবস্থা ক্যান? দুই চোখ লাল। কিছু খাইছেন নাকি?”
শিশিরের মেজাজ গরম হলেও সে ভদ্রভাবেই উত্তরে বলল,
—“না ভাই, শরীর টা ভালো লাগছে না। জ্বর আসবে মনে হয়।”
—“ও। তাইলে ছুটি নিয়া নেন। এমনিতেও আপনার তো ছুটির দরকার আছে এখন।”
বলেই মুখ টিপে হাবিব হাসতে লাগল।
শিশির ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“কেন? আমার ছুটির দরকার হবে কেন?”
হাবিব চোখে দুষ্টু ইংগিত করে বলল,
—“আপনি নাকি নতুন বিয়ে করছেন শুনলাম। বউকে নিয়ে আলাদা উঠছেন। এই সময়ে তো ছুটিই দরকার তাই না? বিয়ের এই প্রথম সময়েই তো.. যত খুশি ডট ডট ডট.. হা হা হা…”
শিশিরের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। মাথার ভেতরটা চক্কর দিলো। হাবিবের চোখেমুখে কুটিলতা ফুটে উঠছে। সে এখনো হেসেই চলেছে যেন কত মজার একটি কথা বলেছে সে!
শিশির নিজেকে সামলে বরফ শীতল কণ্ঠে বলল,
—“আপনি এসব কি বলছেন হাবিব ভাই?”
হাবিব ভাই হাসি চেপে চোখ গোলগাল করে বলে উঠল,
—“নাটক কইরেন না মিয়া। সবাই সব জানে। আপনে যে এক রাত রাস্তায় আছিলেন নয়া ভাবিরে নিয়া, তাও জানে। অফিসের যে মিলি, সেই তো সব ছড়াইছে। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না শিশির ভাই, আপনি তো ভাবির সাথে ভালোই ছিলেন, তাইলে এই দ্বিতীয় বিয়ের কারণ কি?”
হাবিব কাছে এগিয়ে এসে গলা নিচু করে ফিসফিস স্বরে ফের বলে উঠল,
—“বাচ্চাও তো পেটে আছিলো। তারপরেও তারে ছাইড়া দিলেন! নতুন ভাবিরে ভুলে প্রেগন্যান্ট করছেন নাকি? তাই কট খাইছেন হুম?”
শিশিরের ইচ্ছে করল শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে একটা থাপ্পড় কষিয়ে মা রে হাবিবের গালে। কিন্তু তার সেই ইচ্ছে পূরণের আগেই ওহি ভাই এগিয়ে এলেন চপল পায়ে, তাড়া কণ্ঠে বললেন,
—“শিশির,কাম টু মাই রুম,রাইট নাও।”
—“কি…কি হয়েছে ওহি ভাই?”
শিশির থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল।
ওহি বললেন,
—“জাস্ট কাম। ইটস আর্জেন্ট।”
ওহি ওদের চেয়ে সিনিয়রের পজিশনে রয়েছে এই অফিসে বিগত দশ বছর ধরে। তার আন্ডারে থাকা জুনিয়র কর্মীদের ব্যাপারে সবকিছু দেখাশোনা, তাদের সুযোগ সুবিধা, অসুবিধা, টার্গেট ফিক্স করা কিংবা সেল বাড়ানো- এইসব ব্যাপার গুলো দেখাই তার মূল দায়িত্ব। তার জন্য আলাদা একটা কেবিন বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে। কেবিনটি ছোট হলেও পরিপাটি এবং গোছানো। প্রয়োজনের ব্যতিত একটি কাগজও পড়ে নেই এদিক সেদিক। শব্দহীন এসির শীতল বাসাতে কেবিনটি হীম ঘরের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে থাকে সবসময়। সেই শীতলতায় ঢুকলে যে কারো প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু আজ শিশিরের প্রাণ না জুড়িয়ে আরও অস্থির হলো। কি কারণে ডেকেছেন ওহি ভাই! আর হাবিব যে মিলির কথা বলল, মিলি কীভাবে জানল তার পারিবারিক ব্যাপার? সেই কথা আবার অফিসে ছড়িয়ে দিলো কোন সাহসে? নানাবিধ চিন্তায় মাথার ভেতরটা চক্কর কা ট ছে থেকে থেকে। এত দুশ্চিন্তা নিয়ে স্থির ভাবে থাকা যায় না। শিশির ও পারছে না।
সে প্রায় অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল,
—“কি হয়েছে ওহি ভাই? ডাকলেন যে!”
ওহি টেবিলের উপর কি একটা কাগজ খুঁজতে খুঁজতে জবাবে বললেন,
—“এত অস্থির হচ্ছো কেন? বসো আগে।”
—“না ভাই, বলেন আপনি। টেনশনে হাওয়া টাইট হচ্ছে।”
—“কেন? এত টেনশন কিসের? কোনো অঘটন ঘটিয়েছো নাকি?”
শিশির শুকনো হাসল,
—“আমি আবার কি অঘটন ঘটাবো ওহি ভাই! কি যে বলেন না..”
ওহিও মৃদু হাসলেন,
—“অস্বীকার করলেই তো আর মিথ্যে হয়ে যাবে না শিশির। তোমার ভাই গতকাল অফিসে এসেছিল, তোমাকে খুঁজতে।”
কথাটা শোনামাত্র শিশিরের চোখমুখ থেকে সমস্ত রঙ উড়ে গেল এক লহমায়। ব্যাপারটা চোখ এড়ালো না ওহির। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
—“তোমাকে আমি ভালো মানুষ ভাবতাম শিশির। তোমার ওয়াইফকেও দেখেছিলাম, সুইট একটা মেয়ে। সব তো ঠিকই ছিল। কেন কমপ্লিকেশনে জড়ালে?”
শিশির কোনো উত্তর দিতে পারল না।
ওহি উত্তরের আশাও করেননি। তবে নিজের ডিফেন্ডে কি বলে শিশির, তা দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শিশিরের নীরবতা আর ঘামে ভেজা মুখ তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছে। কি যেন বলতে চেয়েও আবার ঢুকিয়ে নিলো শিশির, বলতে পারল না। তার ভাতগতিক দেখে ওহি শক্ত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
—“যাইহোক, তুমি যা করেছ সেটা তোমার ব্যক্তিগত বিষয়। আর সেগুলো আলোচনা করা জন্য আমি তোমাকে এখানে ডেকে আনিনি। তোমার ভাই গতকাল একটা লিখিত কমপ্লেইন জমা দিয়ে গেছে এডমিনে। সেখানে বিস্তারিত ভাবে তোমার কর্ম, তোমার অসৎ গুণাবলি এবং তুমি যে এই অফিসের জন্যও ক্ষতিকারক সেসব জানিয়েছেন। যার জন্য এডমিন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তোমার পজিশনে আমাদের নতুন কাউকে হায়ার করা উচিত। সো মিস্টার শিশির…”
শিশির কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলে উঠল,
—“প্লিজ ওহি ভাই…ওটা আমার পারসোনাল চয়েজ, আর এটা অফিসিয়াল! প্লিজ…”
—“আই হ্যাভ নাথিং টু ডু। তুমি নিজেই তোমার এই সিচুয়েশনের জন্য দায়ী। আর এটা তো স্বাভাবিক ভাবা তাই না যে, যে ব্যক্তি নিজের ফ্যামিলি মেম্বারকে প্রতারণা করতে পারে, সে অফিসিয়াল জায়গায় কি না করতে পারে!”
শিশির আকুতি করে জানাল,
—“আমি তিন বছর ধরে এখানে আছি। কখনো নেগেটিভ কিছু করেছি বলেন? আপনি একটু আপিল করেন না ভাই, প্লিজ, আপনার কথা অবশ্যই শুনবে এডমিন। প্লিজ ওহি ভাই, এই মুহূর্তে জব গেলে… আমার সারভাইব করা অনেক টাফ হয়ে যাবে।”
—“আই এম সরি শিশির। সো সরি। আমার এখানে কিছু বলার নেই। আর কোম্পানি তোমাকে শূন্য পকেটে বের করছে না। তোমাকে তোমার পাওনা স্যালারির সঙ্গে এক মাসের স্যালারি বাড়তি দিয়েই বের করছে। আমরা জাস্ট চাচ্ছি না, আমাদের অফিসে বিবেকবোধ হীন কেউ থাকুক আর কি। নাও এখানে সই করো।”
ওহি একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরল। আঙুল দিয়ে দেখাল কোথায় সই করতে হবে। শিশির এগিয়ে এলো এবং একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। নিচু হয়ে ওহির দু’পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ঝর ঝর করে। ওহির ঘরটা কাঁচের হওয়ায় বাইরে থেকে সবাই অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখতে লাগল।
ওহি অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে উঠলেন।
শিশির কেঁদে কেঁদে বলছে,
—“প্লিজ ওহি ভাই প্লিজ, আমি রিকোয়েস্ট করতেছি, আমাকে বের করবেন না প্লিজ। এই মুহূর্তে আমি আমার পজিশন বা সিচুয়েশন কোনোটাই বোঝাতে সক্ষম নই। আপনি অন্তত দয়া করুন, একটু বুঝুন। প্লিজ ওহি ভাই.. আই রিকোয়েস্ট প্লিজ! আমি আপনার কৃতজ্ঞ থাকব। সত্যি বলছি। প্লিজ ওহি ভাই। আপনার পায়ে পড়লাম, প্লিজ।”
ওহি কি করবে বুঝতে পারছেন না। তিনি শিশিরকে উঠিয়ে এডমিনে নিয়ে গেলেন। সেখানে কথা বললেন। শিশির ভাবল, হয়তো তারা তাকে কনসিডার করবে। জব থেকে বের করবে না৷ কিন্তু শিশিরকে বিন্দুমাত্র কনসিডার করা হলো না। বরং এক মাসের জায়গায় দুই মাসের স্যালারি দিয়ে জোরজবরদস্তি তার সই নেওয়া হলো এবং চূড়ান্ত অপমান ও করা হলো। শিশির লাল চোখমুখে অফিস থেকে বের হওয়ার সময় শুনতে পেল, মিলি উচ্চশব্দে বলছে,
—“এরকম লোকদের সাথে এটাই ঠিক আছে। একে বের না করলে আমিই বের হয়ে যেতাম। আজকে বউয়ের বোনরে বাদ দেয় নাই, কালকে হয়তো আমাদেরকেও… ছিঃ কি নোংরা….”
শিশিরের কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল।
একদম মূল গেইটের সামনে হাবিবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। শিশিরকে একটা সামান্য বায় ও বলল না। বরং কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। শিশির অবাক হয়ে ভাবল, একসময় নিজের পকেটের টাকা খরচ করে কত চা সিগারেট খাইয়েছে এই লোককে…আর আজ তার থেকে সামান্য সহানুভূতি ও পাওয়া গেল না?
ওহি ভাই শিশিরকে বিদায়ের আগে বললেন,
—“একটা কথা মনে রেখো শিশির। কাউকে বিবেকবোধ গিলিয়ে খাওয়ানো যায় না। এটাও ব্যক্তিগত ভাবে তৈরি করতে হয়। তোমার শিক্ষা, পরিবার, পরিবেশ – সব সম্পর্কে আমার সামান্য ধারণা আছে। সেই ধারণা থেকেই বলছি, যদি পারো শিখে নিও। লাইফে বিভিন্ন জায়গায় সিম্পেথি পাবে। ভালো থাকবে। মনে রেখো, যারা অন্যের উপর অবিচার করে, তাদের সঙ্গেও অবিচার হয়, হতে থাকে। সময় এবং প্রকৃতি সবকিছুই ফিরিয়ে দেয়। সবকিছু…”
টাল-মাটালের মতো বাকিটা পথ হেঁটে বাড়িতে ফিরল শিশির। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। যেন সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। আশেপাশে কি হচ্ছে বা হবে- সে নিয়ে বিন্দুমাত্র সেন্স নেই তার।
একটা সিঙ্গেল তোশক কিনে এনে তার উপরই শোয়ার ব্যবস্থা করেছিল শিশির, সেটায় হাত-পা টান টান করে শুয়ে পড়ল সে। তৃণা রান্নাঘরে ছিল। ভাতের মাড় গালতে গিয়ে এক আঙুল পুড়িয়ে ফেলেছে সে। শিশির আসা মাত্র সেও ছুটে এলো। কাঁদোকাঁদো গলায় নিজের হাতের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে দেখল, শিশির কিছুই শুনছে না। বরং দু’চোখ বেয়ে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ছে তার। তৃণা অবাক হলো। শিশিরকে জোর করে উঠিয়ে বসালো।
—“কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন? বলেন…কি হয়েছে?”
শিশির শুতে চাইলো,
—“ভালো লাগছে না। পরে বলি। এখান থেকে যাও। একলা থাকতে দাও।”
—“না দেবো না। আগে বলুন, কি হয়েছে। তারপর শোবেন। এই বলুন না।”
—“তৃণা…”
—“আবার শুচ্ছেন! আগে বলবেন তারপর শোয়াশোয়ি। কি হয়েছে বলেন.. বলেন।”
—“উফ!”
আকস্মিক চ ড় কষিয়ে বসালো শিশির।
তৃণার যে গালে দীক্ষার আঙুলের দাগ ছিল, তার অপোজিট গালে শিশিরের চ ড় পড়ল। আঙুলের দাগ না পড়লেও ভালোই লাল হয়ে উঠল। তৃণা চমকে ফিরে তাকাল। শিশির নিজেও হতভম্ব, এটা কি করল সে!
তবে সেই হতভম্ব ভাব কা টি য়ে উঠার আগে পুরোপুরি হতচকিত হয়ে গেল, তৃণার হাতে চ ড় খেয়ে…
তৃণা এতও ভদ্র মেয়ে নয়। তাকে চ ড় দেওয়া তাও বিনা কারণে! মেজাজ হারিয়ে সে নিজেও শিশিরের গালে চ ড় মে রে বসল।
(চলবে)
Share On:
TAGS: মৃধা মৌনি, সোনাডিঙি নৌকো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৪
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১০+ খন্ড অংশ
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৩
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৫
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৯
-
সোনাডিঙি নৌকো গল্পের লিংক
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৬