সোনাডিঙি_নৌকো (৬)
মৃধা_মৌনি
—“থাক আর হেসো না কেউ। বেচারার ভালো রকমের ঠান্ডা লাগছে। গা কাঁপছে। আপনি এক কাজ করুন, গোসল করে ফেলুন চট করে। গরম পানির ব্যবস্থা করছি। বকুল, চট করে একটু গরম পানির ব্যবস্থা হবে না?”
দীক্ষার কথার পৃষ্ঠে বকুল বলল,
—“হবে আপা।”
—“উনাকে দাও তো। আর আপনি গোসল করে নিন। মাছ টাছ এসব মামাই ধরবে। আপনার আর নামতে হবে না।”
শান্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দীক্ষার এই সামান্য কথাগুলো বুকের ভেতর কেমন একটা আলোড়ন তৈরি করল। হ্যাঁ না কিচ্ছু বলতে পারল না। কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দীক্ষার চলে যাওয়ার পানে।
খালেদা বেগম রান্নাঘরে পিড়ির উপর বসে আছেন। চিকন চিকন করে আলু ঝুরি করছেন। দীক্ষার চিকন আলু ভাজা খেতে বেশ ভালো লাগে। তাছাড়া ও তিনি শুটকির একটা ভর্তা করেছেন। এই অবস্থায় মাছ মাংস কোনো কিছুই খেতে ভালো লাগে না। তবে ঝাল ঝাল ভর্তা হলে কয়টা মুখে তোলা যায়৷ রাতেও খায়নি মেয়েটা। শত চিন্তার মাঝখানেও খালেদার স্নেহময়ী চিন্তারা নিশ্চিন্ত রইল না।
দীক্ষা দরজা ধরে দাঁড়াতেই তিনি তাকালেন।
হাসিমুখে বললেন,
—“উঠলি? শরীরটা ভালো লাগছেরে মা?”
দীক্ষা অবাক হলো। রাতের খালেদা আর এই খালেদার ভেতর কত তফাৎ! এর কারণ কি?
সে ভেতরে ঢুকে বলল,
—“লাগছে।”
—“নে এই পিড়িতে বস। পারবি বসতে? কষ্ট হবে না তো? পাটি বিছিয়ে দিতে বলি।”
একটা নারকেলের খোল পাশ থেকে টেনে নিয়ে তার উপর বসে পড়ল দীক্ষা। বলল,
—“কিচ্ছু লাগবে না। তুমি অস্থির হয়ো না তো।”
—“বাসী মুখে আছিস? এক কাপ চা করে দেই। বস।”
—“দু’কাপ করো তো মা। আজ দুই মা মেয়ে মিলে গল্প করব খানিকক্ষণ।”
মাটির চুলো দাউদাউ করে জ্বলছিল। খালেদা বেগম একটা লাকড়ি বের করে আনতেই আ গু নের পরিমাণ কমে গেল। তিনি মৃদু হেসে বললেন,
—“আমি কি গল্প করব তোর সাথে? বকুল আসুক, ওর সাথে কর। গরম পানি কই যেন গেল মেয়েটা।”
দীক্ষা এগিয়ে মায়ের কাছাকাছি বসল।
—“তোমার গল্প করতে হবে না মা। আমি বলব, তুমি শুনবে। তা তো পারবে নাকি? এখন চা বসাও। আগে চা হবে তারপর কথা শুরু। এক চুমুক করে চা মুখে দেবো, আর একটা করে কথা বলব। চা না হওয়া পর্যন্ত নো কথা। চা ও শেষ, গল্প ও শেষ।”
খালেদা মন খুলে হাসলেন এবার। পাগল মেয়েটা কী যে বলে। তার হাসি দেখে দীক্ষার কি যে ভালো লাগল। মন – প্রাণ সব জুড়িয়ে গেল। মনের ভেতর যত গ্লানিবোধ জমে ছিল, তাও মুছে গেল নিমিষেই।
চায়ের পানি ফুটছে। তার ভেতর বেশ খানিকটা চাপাতি ঢেলে দিলেন খালেদা। ভালো করে লিকার হলে দুইটা কাপে ঢাললেন। বোয়াম থেকে গুড়ো দুধ নিয়ে তা মিশিয়ে দুধ চা তৈরি করলেন অভ্যস্ত হাতে। রংটা দেখেই দীক্ষার লোভ লেগে গেল।
খালেদা চিনি দিতে চাইলে দীক্ষা নিষেধ করল।
—“আমারটায় দিও না মা।”
খালেদা অবাক হলেন। যেই মেয়েটা একদিন চামচ ভর্তি চিনি ছাড়া চা খেতে পারত না, সেই মেয়েটা আজ চায়ে চিনিই খায় না! মাত্র দুইটা বছর- কত কি পরিবর্তন হয়ে গেছে তার মধ্যে! ছেলে মেয়ে গুলো খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। বিয়ে হয়ে গেলে কেমন অচেনাই হয়ে যায়। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি মেয়ের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন।
—“এবার বল, কি বলবি।”
দীক্ষা এক চুমুক চা মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কতদিন পর মায়ের হাতের সেই পুরোনো স্বাদ..!
আচ্ছা সব মায়েরাই বুঝি পৃথিবীর বেস্ট কুক হয়। তাদের করা গরম পানির স্বাদ ও বোধহয় আলাদা। দীক্ষার জুড়ানো মনটা এবার আরও প্রশান্ত হলো। সে ধীর ভাবে চোখ নামিয়ে প্রায় সরল কণ্ঠেই বলল,
—“আমি আর ফিরে যাব না মা। এখানেই থাকব। তোমার বা মামার তাতে খুব অসুবিধা হবে?”
খালেদা বিস্মিত হয়ে বললেন,
—“এখানে থাকবি বুঝলাম। আর যাবি না- এটা কেমন কথা? যাবি না ক্যান, কি হইছে? শিশির বলছে কিছু?”
—“তোমার মনে হয় শিশির সামান্য কিছু বললে আমি এতবড় ডিসিশন নিতাম মা?”
—“তাহলে? কি হইছে রে মা? তুই একা একা এলি, খবর দিতেই আমার বুকটা কামড় দিয়ে ধরল জানিস। রাতেও প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগছিল। বিয়ের পর তোকে এত বলেকয়েও আমি আনতে পারিনি৷ আর এলেও শিশিরকে ছাড়া আসতি না। সেখানে এবার একদম একা…এখন এই কথা বলছিস।”
জবাব দিলো না দীক্ষা। নিশ্চুপে চায়ে আরেক বার চুমুক দিলো।
খালেদা বেগম দীক্ষার গায়ে মাথায় হাত পুছিয়ে দিতে লাগলেন এইবার,
—“স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কত রকমের কত সমস্যা হয় রে মা। সেইসব মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়াই আমাদের কর্ম। আমরা যদি হার মানি, তাহলে সংসার টা, সম্পর্কটাও যে হার মানবে। শিশিরকে আসতে বল, আমি কথা বলে যা কিছু হয়ে থাকুক, মিটমাট করি।”
দীক্ষা মায়ের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় একটা প্রশ্ন করল এবারে,
—“বাবা যদি কোনোদিন তোমাকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো নারীকে চাইতো, তবুও কি তুমি তার সংসার করতে মা? সে যদি বলত, তোমার ভেতর স্ত্রীর কিছুই পায়নি, অন্য নারীর ভেতর তাই পাচ্ছে যা সে চাচ্ছে, তারপর কি তুমি তাকে বুঝাতে, জোরাজুরি করতে সংসারটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য? তোমার গর্ভের সন্তানটার প্রতি তার যদি মায়া না থেকে এক আকাশ পরিমাণ বিস্বাদ থাকত, তখনো কি তুমি সম্পর্কটার কথা আগে ভাবতে?”
এমন প্রশ্নের কি উত্তর হয়? হয় না।
খালেদা বেগম ও তীব্র বিস্ময়ে মেয়ের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছুটি বলতে পারল না।
দীক্ষা বলল,
—“ও আমাকে চায় না মা। অন্য কাউকে চায়। আমি নাকি কোনোদিন ওর মনের মতো হয়েই উঠতে পারিনি। ওকে সম্মান করিনি, শ্রদ্ধা করিনি, আমার ভেতর ও শুধু মাত্র একজন বন্ধুই খুঁজে পেয়েছে। অথচ ওর চাহিদা ছিল একজন প্রেমিকার নয়, একজন স্ত্রীর। সেই চাহিদা অন্য কেউ পূরণ করতে পারবে মা। আমি না। এমনকি আমার পেটে যে ওর সন্তান- তাকেও ও চায় না। অথচ আমাকে কোনোদিন বুঝতেও দেয়নি। আমি নাকি ওর ঘাড়ে এই বাচ্চা একপ্রকার জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছি। এতসব কিছু শোনার পর জানার পরেও কি আমার উচিত মানিয়ে নেওয়া মা? হাল না ছাড়া? কিসের হাল ধরব আমি? কোন সংসারের বলো। ওটা তো আর আমার সংসার নেই। হয়ে গেছে অন্য কারো…অন্যের সংসারের, সম্পর্কের হাল ধরব আমি মা? তুমি বলো…”
বলতে বলতে কখন যেন দুটি চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল। দীক্ষা নিজেও টের পেল না। চোখের পানি মুছেও নিলো না। হাতে চায়ের কাপটি ধরে যেভাবে স্থির ভঙ্গিতে বলে চলছিল, সেভাবেই বলতে লাগল,
—“মানুষ কি আজব প্রাণী। ও যদি একবার আমাকে এইসব বলত, আমি কি চেষ্টা করতাম না ওর মনের মতো হতে? আমি সাজি না, আমি জীবন নিয়ে ভাবি না, আমি কেমন হয়ে গেছি- শিশিরের আমাকে পছন্দ হয় না। ওর চাকচিক্যময় দুনিয়ায় আমি বড্ড সেকেলে… অথচ ওকে পাওয়ার পর আমার মনে হয়েছিল আমি দুনিয়াটা পেয়ে গেছি। আর তো কিছু পাবার বাকি নেই। তাই আমি আর কিছু নিয়েই মাথা ঘামায়নি কোনোদিন। কিন্তু ও যদি একবার বলত, দীক্ষা তুই এভাবে থাক, এভাবে সাজ, তুই জব কর- আমি কি করতাম না মা বলো? আমার সঙ্গে কি নিখুঁত অভিনয় করল মা! অথচ আমার জন্য মুখে ভালোবাসা রেখে মনে বিষ পুষলো দিনের পর দিন… আমার বিশ্বাস ভাঙলো। আমার স্বপ্ন, আশা, এমনকি জীবনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ও ধ্বংস করে দিলো। এই যে পেটে যে আছে, তার জন্যেই এখনো বোধহর শ্বাস নিচ্ছি মা। নইলে সত্যি বলছি, তুমি তোমার দীক্ষাকে আর পেতে না গো মা, কোথাও পেতে না। শিশির তোমার মেয়ের শরীরটা ফেরত পাঠিয়েছে মা। রুহ টাকে কে ড়ে নিয়ে গেছে। আমার বুকের ভেতর চাপ হয়। দমবন্ধ হয়ে আসে। কষ্ট হয় মা। হঠাৎ হঠাৎ বুকটাকে কেউ চিঁড়ে ফালা ফালা করে- এমন অনুভূতি হয় মা। উপর দিয়ে আমি হাসি, চুপচাপ থাকি- কিন্তু ভেতর দিয়ে আমার কলিজাটা জ বা ই করা প্রাণীর মতো তড়পায় মা। এরপরেও আমি মানিয়ে নেবো তার সঙ্গে? বলো মা বলো। যার কথার আঘাত আমার রুহকে ঝাঁঝরা করল, তার সঙ্গে কি করে মানিয়ে নেবো মা? উত্তর দাও আমাকে তুমি…”
দীক্ষা কাঁদছে। পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। যে কান্না এত গুলো সময় ধরে বুকের ভেতর চেপে রেখেছিল, সেই কান্না গুলি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে এক্ষণে। মায়ের মমতার আঁচল পেয়ে…
খালেদা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। স্তব্ধ হয়ে গেছেন তিনি। নিজের চোখ দিয়েও কখন যে পানি চলে এসেছে, টের পেলেন না। বরং কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলেন,
—“তোর এতবড় সর্বনাশ কোন অজাত করল রে মা? তার নাম বল। আমি ওর মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, মেয়েকে এমন অমানুষ বানাইলো কি ভাবে…”
দীক্ষা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
—“তাইলে নিজেরে জিগাওরে মা। নিজেরে জিজ্ঞাসা করো, তোমার ছোট মেয়েটারে তুমি কী খেয়ে জন্ম দিছিলা। কীভাবে এমন অমানুষ বানাইলা? ওর হৃদয়ে কি একটু দয়া মায়াও হইলো না। বোনের সব কিছু কে ড়ে নিতে নিতে শেষমেশ তার স্বামী, সংসারটাকেই কে ড়ে নিলো? জিজ্ঞেস করো নিজেরে মা… জিজ্ঞেস করো।”
খালেদা বেগমের মনে হলো, তিনি কঠিন ভয়াবহ কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন। এই দুঃস্বপ্নের শুরু হলেও শেষ কোথায়, জানা নেই। দীক্ষা কার কথা বলছে? তৃণা? তৃণাই তো… তার ছোট মেয়ে… তার আদরের ছোট মেয়ে…
বড় মেয়ের সাজানো গোছানো সংসারটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার পেছনে তবে ছোট মেয়েই দায়ী? হে পরওয়ারদিগার, এ কোন অথৈ সাগরে ফেললেন আপনি! খালেদা বেগমের শরীর টলছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার। তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন…হারিয়ে যাচ্ছেন অতল গহ্বরে। বুকের ভেতর কাঁপতে থাকা দীক্ষার ছোট্ট শরীরটার অস্তিত্ব তিনি এই মুহূর্তে অনুভব করতে পারছেন না আর…
মা মেয়ের এই একান্ত মুহূর্তটা একান্ত রইল না তবে।
রান্নাঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকা শান্তর কর্ণকুহরে গিয়ে আঘাত হানলো দীক্ষার প্রতিটি আর্তচিৎকারের শব্দবাণী। সে হতভম্ব হয়ে গেল। সিগারেটের আ গু ন নিভে গেল কখন, সেই খেয়ালটুকুও তার রইল না।
দুপুরে এ বাড়িতে খাওয়ার কথা থাকলেও শান্ত শেষ পর্যন্ত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। সকালের ওই ঘটনাটার পর তার মনটন এমনিতেই খারাপ ছিল, সেই খারাপ লাগা বেড়ে আকাশ ছুঁলো রান্নাঘরে চলা কান্নাকাটির পর্বের পর। বারবার দীক্ষার আর্ত চিৎকার আর ক্রন্দনরত অবস্থায় করা বিলাপ গুলো কানে টেপরেকর্ডারের মতো বাজতে লাগল। এই অবস্থায় আর কোনো দিকে মন বসানো দায়। তাই সে বকুলের কাছে গিয়ে চিকন গলায় বলল,
—“এই বকুল, থাক তাইলে, আমি গেলাম।”
হাতের কাজ করছিল বকুল, তা থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে চাইলো,
—“সে কি, যাবে কেন? খেয়ে যাবে না? বাবা ও তো বলল, তোমাকে থাকতে বলতে।”
—“আজ থাক। আরেকদিন। আজ ভালো লাগছে না।”
—“শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
শান্ত অস্পষ্টে বলল,
—“হুঁ।”
বকুল ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাতেই,
—“জ্বর জ্বর লাগছে নাকি? সকালে মানা করেছিলাম না নামতে। কিন্তু তুমি শুনলে তো। চাপায় যা জোর তোমার, কে পারে…”
শান্ত আবারও বলল,
—“যাই বুঝছিস। পরে আসবানি। তোর বাপরে বলিস।”
বকুল আমতা আমতা করল,
—“তুমি শুয়ে থাকো না শান্ত ভাই। আমি মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করি। নাপা টাপা খেয়ে একটা ঘুম দিলেই…”
—“নিজের বিছনা ছাড়া আমার কোথাও ঘুম হয় না। আজাইরা চিন্তা করিস না তো। বাসায় গেলেই ঠিক হয়ে যাবেনে। থাক তুই, গেলাম।”
লম্বা লম্বা পা ফেলে শান্ত বেরিয়ে গেল।
সেই দুপুরে বকুলেরও আর খাওয়া হলো না।
বাবার বর্শীতে কখনো কিছু ধরা পড়ে না, অথচ আজ বিশাল সাইজের শোল মাছ ধরা পড়ল। সেই শোল রান্না হলো পুইশাক দিয়ে, মাখা মাখা ঝোলে, সঙ্গে বেগুন ভাজা, শুটকির ভর্তা, লাউ পাতার একটা ভর্তা। রান্নাবান্নার সময় শান্ত বেশ চঞ্চল ছিল। শোল পুইয়ের তরকারি দিয়ে এক থালা ভাত খাবে- এই ঘোষণা বারকয়েক দিলো। অথচ শেষ পর্যন্ত মানুষটি গেল খালি মুখে। এই অন্তর্দহনে বকুলও ভাতের পাতে পানি ঢেলে উঠে পড়ল।
ছোট খুপরির মতো একটা ঘর। ছয় তলা বিল্ডিং এর উপরে ছাদের ভেতর। এক সাইডে তিনটি ঘর করে আলাদা ভাবে ভাড়া দিয়েছে বাড়িওয়ালা। সেইখানের সবচেয়ে ছোট রুমটায় উঠল শিশির আর তৃণা। অফিস থেকে অল্প কিছু বেতন উঠানো গেছে। বাকিটা বেতনের নির্দিষ্ট সময়েই দেবে। সারারাত বাস স্ট্যান্ডে বসে কা টি য়ে দিয়ে তৃণার শরীর শেষ। পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থা। এক রাতের ধকলেই চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। চোখমুখ দেবে গেছে। গলার হাড় বেরিয়ে শুকনো লাগছে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না সে। গায়ে জ্বর চলে এসেছে। কিছুক্ষণ সেন্সে থাকে তো কিছুক্ষণ ঘোরের ভেতর। এই বাসাও খুঁজে ঠিক করল শিশির একাই। উঠার সময় তৃণা তিনবারে থেমে থেমে উঠল। হাঁটুর জায়গা থেকে খুলে আসবে বোধহয়।
ঘর দেখে তৃণার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
সবসময় বড় বাড়িতে থেকে আসা, গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে বড় হওয়া তার পক্ষে এই ঘর নিতান্তই জেলখানা। সে হকচকানো গলায় বলল,
—“এখানে থাকব আমরা?”
শিশির বিরক্ত হলো।
—“না থাকলে কি রঙ্গ করতে আসছি?”
—“আমার সাথে মেজাজ দেখাবেন না। কষ্ট আপনি করতেছেন, আমিও তো করতেছি নাকি? পড়াশোনা তো চাঙ্গে। আবার পড়তে পারি কি না কে জানে।”
—“এইসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দয়া করে মানিয়ে নিতে শেখো তৃণা। পছন্দ তো তুমিও আমারে করছ। আর ঘর সংসার কীভাবে সামলে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়, তা মেয়েরাই ভালো জানে। সুতরাং এসবে মন দাও এখন। মোটামুটি যা যা লাগে আমি কিনে আনবো সন্ধ্যার দিকে। আপাতত ম্যানেজ করে নাও।”
কি দিয়ে ম্যানেজ করবে- জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলেও তৃণা আর কথা বাড়াল না। যখন যা লাগত বাবাকে বললেই হতো। কেন লাগবে বা কি দরকার- এই কথা কখনো জিজ্ঞেস করতেন না তিনি। বাবার মৃ ত্যু র পর মা অনেক হিসেবের মধ্যে দিয়ে গেলেও তাকে কখনো এত কড়াকড়ি হিসেব করে চলতে হয়নি। বরং দীক্ষার জিনিসপত্র কিংবা টাকাপয়সা সবসময় নিয়ে ভালো মতোই চলতে পেরেছে সে। অথচ এখন কি কি ম্যানেজ করে চলতে হবে কে জানে! তৃণার বুক চিঁড়ে একটা ছোট শ্বাস বেরিয়ে এলো।
রান্নাঘরের অবস্থা দেখে আরও একবার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল তার। এইটুকুনি রান্নাঘরে একটা মাত্র চুলা। সেই এক চুলায় তিন পরিবারের রান্না। গোসলখানাও একটা!
কীভাবে সম্ভব?
শিশিরকে এই কথা বলামাত্র সে হাঙ্গামা লাগিয়ে দিলো।
—“করবটা কি আমি? একদিনের নোটিশে রাজমহল খুঁজে বের করব হুম? তোমার বাপ বসে আছে তো ভাড়া দেবার জন্য! যা পেয়েছি আপাতত উঠেছি। রাস্তায় থাকার চাইতে তো ভালো! একটা মাস কষ্ট করে ম্যানেজ করে নাও না। এরপর দেখেশুনে একটা ভালো বাসা নেবো তো বললাম।”
তৃণা মিনমিনে স্বরে বলল,
—“সবাই জিজ্ঞেস করছিল, আপনি আমার কি হন।”
—“কি বলেছ?”
—“কিছু বলিনি।”
—“বলোনি কেন? বলবে আমি তোমার হাজবেন্ড। নাইলে তো আরেক যন্ত্রণা। উফ.. এই সামান্য সেন্সটাও তোমার হয় না তৃণা?”
তৃণা ক্ষণকাল চুপ থেকে ভোঁতা কণ্ঠে বলল,
—“না হয় না। বিয়ে তো করেননি, জামাই বলব কোন সাহসে? আগে বিয়েটা হোক, তারপর নাহয়..”
শিশিরের ইচ্ছে করল, ঠাস করে একটা চ ড় দিয়ে বসে তৃণার গাল বরাবর। এরকম তো ছিল না মেয়েটা। কি আদুরে আর মিষ্টি ছিল! কথা বলত না যেন নেশা ধরাতো। হঠাৎ করে এমন হলো কেন!
খেতে বসে বাঁধলো আরেক বিপত্তি।
সন্ধ্যেবেলা বাজার করে এনেছিল কিছু, সামান্য রান্না, একটু ডাল আর আলুর ভর্তা রাঁধবে, কয়টা ভাত ফুটাবে। ভাত বাড়তে গিয়ে চামচেই লেগে রইল। এত গলা ভাত!
আলুর ভর্তায় তেল হয়নি, লবণ হয়নি, আস্তো আস্তো দানা রয়ে গেছে ভেতরে, পেয়াজ কেটেছে ফালা ফালা করে- ডাল ঘুটেনি, একগাদা রসুনে বাগাড় দিয়েছে। শিশির কিচ্ছু মুখে দিতে পারল না। রাগ করে ডালের বাটি উলটে ফেলে শুয়ে পড়ল। তৃণাও খেল না কিছু। শিশিরের পাশ দিয়ে গিয়ে চুপচাপ গুটিয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল কেবল। জীবনে এক গ্লাস পানি ঢেলে না খাওয়া মেয়ে হঠাৎ সংসার সামলাবে কি করে- এই সামান্য ব্যাপারটা একবারও ভাবল না শিশির!
শিশিরের প্রতি অভিমানে তৃণার বুক ভারী হয়ে এলো।
(চলবে)
Share On:
TAGS: মৃধা মৌনি, সোনাডিঙি নৌকো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৫
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৭
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৮
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৩
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১০+ খন্ড অংশ
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৪
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৯
-
সোনাডিঙি নৌকো গল্পের লিংক