সোনাডিঙি_নৌকো (১২)
মৃধা_মৌনি
দীক্ষা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই বকুল দ্রুত পায়ে তার পিছু নেয়। বারান্দা পেরিয়ে দীক্ষা উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকাতেই বকুল তার পাশে এসে দাঁড়াল। রাতের নিশি তখনও চারপাশে থমকে আছে, শুধু দূর থেকে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক তাদের নীরবতাকে মাঝে মাঝে ভেঙে দিচ্ছে।
দীক্ষার চোখে জল নেই কিন্তু আছে গভীর এক শূন্যতা। বকুল তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। সেই স্পর্শে কোনো সান্ত্বনা মিশে নেই। তবে আছে কেবল নিঃশর্ত সমর্থন।
বকুল মৃদু কণ্ঠে কথা শুরু করল।
—“ভালোবাসা- একটা নদীর মতো। নদী যখন স্বাভাবিক গতিতে বয়ে চলে, তখন দু’পাশে ফসল ফলে, জীবন বাঁচে। কিন্তু যখন সেই নদী গতিপথ হারায়, দিক পাল্টে অন্য পথে যেতে শুরু করে- সেটা আর নদী থাকে না, কেবলই জঞ্জাল আর ভাঙনের কারণ হয়। তখন সেই ভাঙন মেনে নিয়েই সরে আসা উচিত।”
দীক্ষা নিঃশ্বাস ফেলে ওর দিকে তাকাল।
—“কিন্তু আমি যে ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে পারি নারে বকুল। তুই তো জানিস, শিশির আমার কাছে শুধু স্বামী ছিল না… ও ছিল আমার পৃথিবী।”
মৃদু স্বরে বকুল হেসে উঠল সঙ্গে সঙ্গে,
—“পৃথিবী? আপা পৃথিবী কখনও কারো উপর নির্ভর করে টিকে থাকে না। পৃথিবী নিজের কক্ষপথে ঘোরে বলেই কোটি কোটি বছর ধরে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। যে ভালোবাসা তোমাকে শক্তি জোগানোর বদলে দুর্বল করে দেয়, যে সম্পর্কে তোমার মানসিক শান্তি আর আত্মসম্মানটুকু অবশিষ্ট থাকে না, সেটাকে আর যা-ই হোক, ‘পৃথিবী’ বলা যায় না। সেটা একটা ভারী শিকল আপা। আর শিকল থেকে মুক্তি পাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”
বকুল আরও কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। গোল থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে আকাশে। থৈ থৈ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে পথঘাট, এই রাতকে ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে কত কবিতা, লেখনী, জীবন বদলে দেওয়া শব্দ মালা…
সেই চাঁদের দিকে একটা আঙুল তুলে ধরল বকুল। চাপা স্বরে স্নেহ মাখিয়ে বলল,
—“দেখো, চাঁদকে একবার দেখো আপা। সে আলো পায় সূর্যের কাছ থেকে, কিন্তু সে কক্ষপথে সূর্যের কাছে নত হয়ে থাকে না। নিজের দূরত্ব বজায় রাখে বলেই তার নিজস্ব সৌন্দর্য বজায় থাকে, আর সে নিজের আলোয় রাঙানো হয়। তুমিও ওই চাঁদের মতো- দীপ্তি তোমার ভেতরেও আছে। অন্যের কাছ থেকে আলো ধার করে ভালোবাসার ভিক্ষা চেয়ে কেন নিজেকে ম্লান করবে?”
দীক্ষা স্থির দৃষ্টিতে বকুলের দিকে তাকাল। তার ভেতরে জমা হওয়া দ্বিধা যেন হঠাৎ এই স্পষ্ট কথার স্রোতে ভেসে যেতে চাইল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল,
—“কিন্তু সবাই বলে, স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা উচিত নয়… একটা সন্তান আসছে…ওর মুখের দিকে চেয়ে…”
বকুল দীক্ষার হাত ধরে ফেলল শক্ত করে। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল,
—“স্বামী! স্বামী তো একটা সম্পর্কের নাম, একটা দায়িত্বের বাঁধন। কিন্তু সেই বাঁধন যখন ভালোবাসার বদলে প্রতারণা আর নীরবতা নিয়ে আসে, তখন সেই সম্পর্কের চেয়ে আত্মমর্যাদা অনেক বেশি দামি। দেখ, মানুষ বলে সোনার দাম কখনও কমে না, ঠিক তেমনি তোমার আত্মসম্মানবোধের দামও কখনো কমতে দেওয়া উচিত নয়। মানসিক শান্তি যদি না পাও, তবে সেখান থেকে সরে আসাই মঙ্গল। কারণ, শান্তি ছাড়া আর কোনো ঐশ্বর্য নেই, আপা, বিশ্বাস করো।”
বকুল থামল। দীক্ষার চোখ এবারে ভিজতে শুরু করল। চাঁদের নরম আলোয় তাকাতেই আধো ছায়া আধো আঁধারিতে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সমস্ত যন্ত্রণা একটি প্রশ্নে নিয়ে এলো,
—“আমার জায়গায় তুই থাকলে কি করতিস? পারতি এভাবে সব ছেড়ে চলে আসতে?”
—“আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম… আমি হয়তো শিশিরকে ভালোবেসে ভুল করতাম, কিন্তু একবার প্রতারিত হওয়ার পর আর ফিরে তাকাতাম না। আমার কাছে আমার শান্তি আর আমার আত্মসম্মান- এই দুটোই সবার আগে। যে মানুষটা আমাকে আর আমাদের সন্তানকে দিনের পর দিন উপেক্ষা করে থাকতে পারে, সেই দুর্বল মানুষটার জন্য আমি আমার মূল্যবান জীবন আর এক মুহূর্তও নষ্ট করতাম না। আমি পারতাম আপা কারণ নত হয়ে ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে একা থাকা অনেক সম্মানের।”
বকুলের কথাগুলো দীক্ষার হৃদয়ে বরফের মতো শীতল এবং তীক্ষ্ণ আঘাত হানলো। আঘাতটা কষ্টের হলেও, সেটির ফল হিসেবে রয়েছে মুক্তি এবং স্পষ্টতা। দীক্ষা বুঝতে পারল বকুলের কথায় কোনো ভুল নেই। এইবার তার ভেতরে সেই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আরও দৃঢ় হলো।
—“তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তুমি স্বাধীন হবে। এটাই তোমার সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ আপা। আমি তোমার সাথে আছি। কোনো ভয় করো না।”
কোনো জবাব দিলো না দীক্ষা। গাল বেয়ে নরম ধারায় উষ্ণ চোখের জল গড়িয়ে চিবুক ছুঁয়েছে। বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সে চেয়ে রয়েছে ওই অটল হয়ে থাকা চাঁদটির দিকে। কি সুন্দর, কি মোহনীয়, একটি থালার ন্যায়- দুধ সাদা গায়ে কালো রঙের দাগ যেন তারই অহংকারের প্রতীকি!
হঠাৎ করেই আবার বলে উঠল বকুল, সে চেপে এসে দীক্ষার পায়ে গায়ের সঙ্গে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়েছে।
চাপা স্বরে ফিসফিস করে বলছে,
—“তুমি কার জন্যে কার সঙ্গে যুদ্ধে নামবে আপা?”
দীক্ষা আচানক চমকে উঠল। এই প্রশ্নটা সে নিজেও নিজেকে করেছে। উত্তর ও পেয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিচ্ছুটি বলতে না পেরে দৃষ্টি সরিয়ে বকুলের শান্ত মুখপানে চাইলো।
দ্বিধাগ্রস্ত গলায় শুধালো,
—“বুঝিনি।”
বকুল এবার সরাসরি দীক্ষার দিকে ফিরল। অকুতোভয় সত্যের দীপ্তি নিয়ে বলল,
—“বলছি, যাকে পেতে চাও, সেই তো তোমার শত্রু হয়ে বসে আছে। তুমি যাকে ভালোবাসার দুর্গ ভেবে আক্রমণ করতে চাও, সে স্বেচ্ছায় সেই দুর্গ ছেড়ে বহু আগেই অন্য কোথাও চলে গেছে। তুমি ভাঙা দেয়াল নিয়ে যুদ্ধ করছ, অথচ ভেতরে এখন কেবলই শূন্যতা।”
বকুল দীক্ষার দুই হাত শক্ত করে ধরে তার দিকে টানল।
—“আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম আপা, আমি শুধু এই একটিই প্রশ্ন করতাম। আর কোনো অজুহাত নয়, আর কোনো অভিমান নয়।”
দীক্ষা রুদ্ধশ্বাসে তাকাল।
—“আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম, সে কি চায়? যদি সে আমাকে চাইতো, তবে আমি গোটা দুনিয়া একত্র করে তাকে রেখেই দিতাম। আমার এই সন্তানটার জন্য, আমাদের ভালোবাসার জন্য। কিন্তু যদি সে আমাকে না চাইতো, তবে তামাম দুনিয়া এক হয়ে গেলেও তাকে আমি আর আমার কাছে রাখতাম না। কারণ আপা, জোর করে কাউকে বেঁধে রাখার নাম ভালোবাসা নয়।”
বকুলের কণ্ঠস্বর এবার নরম হয়। কিন্তু তার ভেতরের দৃঢ়তা ঠিকরে পড়ছে সে সময়েও।
—“ভয় পাচ্ছ তো? কি করে থাকবে তাকে ছাড়া? এই ভয়টা তোমার মনের গহীনে শিকড় গেড়ে বসে আছে, তাই না? একবার থেকেই দেখো না, আপা। আমি সত্যি বলছি, কারো অভাবে গায়ে জ্বরও ওঠে না।”
বকুল একটু থামল,
—“বিশ্বাস করো, এই যে তুমি নিঃস্ব ভাবছো নিজেকে, এই নিঃস্বতাটা কেবলই একটা মানসিক ধারণা। তুমি তো একা নও। তোমার ভেতরে এখন একটা নতুন জীবন আছে, আর আমরা আছি তোমার পাশে। কাউকে ছাড়া বাঁচা যায় না এই কথাটা কেবল একটা মিথ্যা অভ্যাসের দাসত্ব আপা। তুমি একবার সেই দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসো। দেখো, জীবন কত সুন্দর, কত স্বাধীন!”
দীক্ষা অবাক হয়ে মুগ্ধ চোখে তাকাল। তার ঠোঁটে সেই মলিন হাসিটুকুও নেই। আছে শুধু অপার বিস্ময়। এই তো সেদিনের বকুল, কত বড় হয়ে গেছে! জীবন সম্পর্কে কত জ্ঞান তার! তার ছোট বোনটির কথায় যে গভীর সত্য লুকিয়ে আছে, যা সে তার এত বছরের জীবনেও বুঝতে পারেনি, আজ পরিষ্কার জলের মতো তার সামনে ভেসে উঠল।
দীক্ষার ভেতরের সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। চোখের কোণে সামান্য জল চিকচিক করে উঠল, কিন্তু তা দুঃখের নয়, বরং এক নতুন উপলব্ধির। সে তার গর্ভাবস্থার ভার নিয়েই বকুলের দিকে ঝুঁকে এলো, তার কাঁধে মাথা রেখে কেবল বলল,
—“বকুল রে…”
বকুল তাকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরল। সে জানে, এই মুহূর্তে দীক্ষার আর কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই। তার সিদ্ধান্ত এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
প্রায় এক মাস পর, দীক্ষা আজ আবার তার সেই চেনা শহরে পা রেখেছে, যে শহর একসময় তার কাছে ভালোবাসার উষ্ণ আশ্রয় ছিল। কিন্তু আজ তা কেবল এক পোড়া ভিটের শূন্যতা। সায়েমা বেগমের বাড়িতে ঢোকার সময় তার বুকটা ভারী হয়ে উঠল। পুরোনো দিনের কোলাহল নেই, সব যেন এক থমথমে নীরবতার আস্তরণে ঢাকা।
শর্মিলা আর সায়েমা বেগম তাকে দেখে এগিয়ে এলেন। দীক্ষা তাদের স্নেহময় দৃষ্টিতে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পা দুটো যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এগিয়ে গেল সেদিকে- যেদিকে তাদের সেই বেডরুম, যেখানে তাদের ভালোবাসার গল্প শুরু হয়েছিল এবং অসমাপ্ত থেকে গেছে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক রাশ বাসি বাতাস তার মুখে এসে লাগল। ঘরে কোনো আলো নেই। পর্দা সরানো হয়নি, তাই বাইরের মৃদু আলোয় ঘরটির ভেতর আবছা আলো ছায়ার কারুকার্য দেখা যায়। মাসখানেক ধরে তালাবন্ধ ছিল এই ঘরটি, কিন্তু দীক্ষার মনে হলো যেন শত বছর ধরে এই ঘরের ভেতরে স্মৃতির ধুলো জমে আছে।
দীক্ষার বুকটা একদম ভারী হয়ে উঠল। নিঃশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি আসবাব, প্রতিটি কোণ যেন তাকে নীরবে প্রশ্ন করছে, “কেন এলে? কেন এভাবে সব ফেলে চলে গেলে?”
ধীরে ধীরে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল সে। চোখ বুঁজতেই পুরোনো সব দৃশ্য চোখের পর্দায় ভেসে উঠল- ঠিক যেন একটা পুরোনো সাদাকালো সিনেমা।
দীক্ষার চোখ ঠেকে গেল কোণের ড্রেসিং টেবিলটায়- যেন বহুদিনের নীরবতা জমে থাকা এক পুরোনো স্মৃতিস্তম্ভ। কাঁচের ওপর পুরু ধুলোর স্তর, লিপস্টিক-চিরুনি এলোমেলো, আর চারদিকে একধরনের নীরব বিষণ্ণতা। দীক্ষা টেবিলটার দিকে এক অদ্ভুত টান অনুভব করল। এই আয়নার সামনে দাঁড়ালেই তো হতো। চুল বাঁধতে যেতেই শিশির পেছন থেকে এসে তাকে জাপটে ধরত, ঘাড়ের কাছে মুখ লুকিয়ে বলত, “আমার বউটাকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন?”
সেই উষ্ণ শ্বাস, সেই আদরের চাপ, সেই উন্মনা ফিসফাস- সব যেন আজও কাঁচের ভেতরে আটকা পড়ে আছে। অথচ আয়নার ঠান্ডা পৃষ্ঠে আজ আর কোনো নিঃশ্বাসের কুয়াশা জমে না। দীক্ষা হাত বাড়িয়ে কাঁচ ছুঁতেই মনে হলো, সে যেন অতীতের গাঢ় উষ্ণতা খুঁজছে, যা বহু আগেই মুছে গেছে, শুধু ধুলো রয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে সে এগোতে লাগল বেলকনির দিকে। পর্দা সরাতেই কনকনে শীতের বাতাস তার গালে আঘাত করল। বেলকনির দুইটা চেয়ার এখনও পাশাপাশি পড়ে আছে। যেন তাদের দুইজনের নাম লেখা আছে তাতে। কত রাতের আড্ডা, দু’কাপ ধোঁয়া-ওঠা চা, নরম আলোয় ছোট ছোট স্বপ্ন- সব মিলেছিল এখানে। শিশির প্রায়ই আকাশের দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলত, “দেখো দীক্ষা, ওই তারাগুলো আমাদের মতো- কেউ কারো খুব কাছে নয়, খুব দূরেও নয়; কিন্তু আলো দিতে ভুলে না কখনো।”
সেই কথা শুনে দীক্ষার বুকের ভেতর কত স্বপ্ন ফুঁটে উঠত। আজ সেই একই আকাশ, একই চেয়ারে বসানো নিস্তব্ধতা, কিন্তু কোথাও নেই সেই আলো। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভু নিভু হয়ে দুলছে, যেন ভেঙে পড়তে চাইছে ওরাও। দীক্ষার চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু জল নামল না। তার বুকের ভেতরে জমে থাকা শোক বুঝি বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজে পেল না।
শেষে তার চোখ গিয়ে থামল বিছানার ওপর। সেই বিছানাটা যেটা ঘরের সবচেয়ে কাষ্ঠকঠিন সত্য। সাদা চাদর ভাঁজ করা, অথচ তার গায়ের ওপর অদৃশ্য দাগ- উষ্ণতার স্মৃতি, ভাঙনের প্রতিধ্বনি। এই বিছানার ওপর কত রাত তারা দুজন শরীরের উষ্ণতায় এক হয়ে গিয়েছিল। শিশিরের চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়া, দীক্ষার ঘুম ভেঙে গেলে তাকে জড়িয়ে ধরা, মধ্যরাতে ফিসফিস করে স্বপ্ন বলা- কি ছিল না তখন? আজ সেই সব স্মৃতি জমাট বরফ হয়ে পড়ে আছে কাঠের কাঠামোর ভেতরে। বালিশের গায়ে মুখ গুঁজতেই দীক্ষার মনে হলো, ঘরটা এক নিমেষেই তাকে ভেতর থেকে চেপে ধরছে, শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে।
সে আর থাকতে পারল না। ভারী পায়ের শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অন্তর জানে- এই ঘর আর তার নয়। এই ঘর শুধু স্মৃতির শবদেহ বহন করে। এখানে ভালোবাসা ছিল ইলিউশনের মতো- দেখতে মায়াবী হলেও ভেতরে পচে থাকা প্রতারণার গন্ধ। এই চারদেয়ালে তার ভবিষ্যৎ নেই। যা আছে, তা শুধু অতীতের ছাই, যন্ত্রণার ভার, আর মুক্তির পথে ঠেলে দেওয়ার নিঃশব্দ প্রার্থনা।
এই ঘর থেকে বেরিয়ে আসাটাই তার জন্যে প্রথম বিজয়। প্রথম মুক্তি!
দীক্ষা যখন তার স্মৃতি আর বেদনার প্রকোষ্ঠে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে ব্যস্ত, তখন রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দায় সায়েমা বেগম আর খালেদা বেগম শীতল পরিবেশে বসেছে। একটি ছোট টেবিলের ওপর রাখা দুটি চায়ের কাপ থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে। শীতের দুপুরের সেই সামান্য উষ্ণতা তাদের ভেতরের উদ্বেগ কমাতে পারছে না মোটেই।
দু’জনের চোখেই চিন্তা আর ভারাক্রান্তের ছাপ। সায়েমা বেগম চায়ের কাপটা দু’হাতে ধরে উষ্ণতা নিচ্ছেন, তার দুর্বল কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল কথা বলতে গিয়ে,
—“বেয়াইন আপনার মেয়ে বলে বলছি না, আমার ছোট বউমা এমনিতে এত লক্ষ্মী মেয়ে! এই ঘরটাকে ও ফুলের মতো সাজিয়ে রেখেছিল। আজ ও এসেছে… আমার একদিকে খুব ভালো লাগছে, আবার খুব চিন্তা হচ্ছে। সত্যি করে বলেন তো বেয়াইন, দীক্ষা কি একবারে এসেছে নাকি আবার ফিরে যাবে?”
সায়েমা বেগমের কণ্ঠে হতাশা আর একরাশ মিনতি মেশানো। তিনি দীক্ষাকে কেবল পুত্রবধূ নয়, মেয়ের চোখেই দেখেন- এ কথা খালেদারও জানা।
খালেদা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার চোখেও গভীর ক্লান্তি। নিজের পেটের এক সন্তানের কারণে আজ তিনি অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। আরেক সন্তানের জীবন বিপন্নের মুখে। কি যে বলবেন, আর কি যে করবেন- বুঝ খেয়ালে আসে না।
—“আমি জানি না, ও কী সিদ্ধান্ত নেবে। ও শুধু বলেছে, শিশিরের সঙ্গে আগে মুখোমুখি কথা বলবে, তারপরই একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। ওর নীরবতা দেখে আমার ভয় হচ্ছে। ওর ভেতরের কষ্টটা আমি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।”
তিনি চায়ের কাপে নিঃশব্দে চুমুক দিলেন।
—“ওকে আমি কোনো চাপ দিইনি। এই সময়ে ওর মানসিক শান্তি সবার আগে প্রয়োজন। আমার বড় ভাই ওকে বুঝিয়েছে- সন্তানের জন্য ফিরে আসা উচিত। কিন্তু দীক্ষা আমাদের কারো কথায় সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না।”
সায়েমা বেগম হঠাৎ করেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। চায়ের কাপটি সাবধানে নামিয়ে রাখতেই তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
—“আমার এত সাধের সংসারটা! আমার শিশির কেন এমন করল? কেন এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল? আমার এই সুন্দর সংসারে কার নজর লেগে এমন এলোমেলো হয়ে গেল, এই ভেবে ভেবে আমি রাতে এক মুহূর্তও ঘুমাতে পারি না, বেয়াইন! ও কেন বুঝল না, দীক্ষার মতো মেয়ে… ওর মতো বউ পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার!”
সায়েমা বেগমের কান্নার শব্দে খালেদা বেগম স্থির হয়ে রইলেন। তিনি কোনো সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলেন না। তার পেটের সন্তানের জন্যেই তো আজ এই পরিস্থিতি! তার সান্ত্বনা দেওয়াটা এখন কেবলই প্রহসন মনে হবে। তিনি কী বলবেন? যে মুখোশধারী সাপ এই সংসারের ভিত্তি ভেঙে দিয়েছে, তাকে তো তিনি অস্বীকারও করতে পারেন না।
খালেদা বেগম শুধু তার হাতে হাত রেখে মৃদুস্বরে বললেন,
—“কাঁদবেন না বেয়াইন। সব ঠিক হয়ে যাবে। খোদা যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।”
কিন্তু তার নিজের কণ্ঠস্বরই যেন কাঁপছে এ কথা বলতে গিয়ে। তিনি নিজেও জানেন, এই পরিস্থিতিতে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’- কথাটি বলা কেবলই এক অলীক সান্ত্বনা।
দীক্ষা তার বিষাদের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ড্রয়িংরুমে এলো। সেখানে আগে থেকেই বসে আছে শিশিরের বড় ভাই রুমেল এবং তার স্ত্রী শর্মিলা। দু’জনের মুখেই গভীর উদ্বেগের ছাপ। দীক্ষাকে দেখেই শর্মিলা উঠে এসে তাকে হাত ধরে বসালো।
—“আসো, বসো। তোমাকে দেখে যে কত শান্তি লাগছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।”
দীক্ষা শান্তভাবে বসল।
রুমেল হতাশ গলায় বললেন,
—“দীক্ষা, তুমি জানো বোন, আমি কখনো শিশিরের পক্ষ নিইনি। ওর এই কাজটা শুধু ভুল নয়, চরম অন্যায়। কিন্তু তুমি তো সব বোঝো। এই বাড়িতে তুমিই সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে আমি মনে করি। তোমার মনও ভীষণ নরম। ভাঙা জিনিস তো জোড়া লাগানো যায় দীক্ষা, শুধু চেষ্টা করতে হয়।”
দীক্ষা চুপ করে আছে দেখে রুমেল আবারও বলতে লাগল,
—“দেখো, শিশির ওর ভুলের জন্য চরম শাস্তি পাচ্ছে। চাকরি তো নেই, ঘর থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে। আর মা! মা তো পুরো ভেঙে পড়েছেন। তিনি খাওয়া-ঘুম সব ছেড়ে দিয়েছেন। মায়ের জন্য হলেও তুমি একবার ভাবো, দীক্ষা। তোমার সন্তানটা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে… এই সংসারটা ভেঙে গেলে তার দায়ভার কি তোমার ওপর পড়বে না?”
—“আমার উপর পড়বে? কেন পড়বে? আমি কি যেচেপড়ে এই সংসার ভাঙতে চাইছি নাকি?”
—“আমি সেটা বোঝাইনি। কীইবা যে বলব। সিচুয়েশনটা এত খারাপ আর এত ঘেটে গেছে…সত্যি বলতে তোমাকে বোনের নজরে মেনে নিতে পেরেছি। আর কাউকে পারব কি না জানি না।”
—“পারবেন। আমাকে যখন পারছেন অন্য কাউকেও পারবেন।”
রুমেল নিশ্চুপে শর্মিলার মুখের দিকে তাকালেন।
শর্মিলা বলে উঠল এবারে,
—“ও যা বলছে, সেটা আমাদের সবার মনের কথা। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু মা সত্যি মানসিক ভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রাতে ঠিকমতো ঘুমান না, ঠিকমতো খান না। সারাক্ষণ শুধু তোমার আর তোমার অনাগত সন্তানের কথা বলেন। শিশিরের কথা বলেন। তোমাদের দু’জনকে নিয়ে খুব দুঃখ করেন। শিশিরের এই অন্যায়ের জন্য মা ওকে বাড়ি ঢুকতে দেননি। উনি তোমাকেই বেছে নিয়েছেন। এমন শাশুড়ি ক’জন পায়, বলো? তুমি যদি চলে যাও, তবে মা খুব একা হয়ে যাবেন।”
শর্মিলা থেমে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে দৃঢ় কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বলল পরের কথাগুলি,
—“তবে এটাও সত্যি যে, জীবনটা তোমার, সিদ্ধান্তটা তোমারই হবে। আমরা তো শুধু তোমাকে ভালোবাসা দিয়েই বেঁধে রাখতে পারি, জোর করতে পারি না। তোমার মনে যে কষ্ট আছে, তা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু যদি তোমার এক বিন্দুও মনে হয়, এই সংসারে ফিরে এলে তুমি শান্তি পাবে, তোমার সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে, তবে এসো। আর যদি মনে হয়, সরে যাওয়াই তোমার জন্য মুক্তি, তবে সেটাই করো। তোমার জন্য শুভ কামনা সবসময় থাকবে।”
রুমেল এবং শর্মিলার কথাগুলো দীক্ষা মন দিয়ে শুনল। সে জানে, এই পরিবারটা তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার ভেতরের আত্মসম্মানবোধ আর রমিলা মামীর দেওয়া স্বাধীনতার মন্ত্র তাকে পিছু হটতে দিচ্ছে না।
দীক্ষা মাথা তুলে রুমেল এবং শর্মিলাকে দেখল। বলল,
—“আপনারা সবাই আমার প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এটা আমার সাত কপালের ভাগ্য। কিন্তু আমার এইখানে (নিজের বুকের উপর ইশারা করে) শান্তি নেই। আমি শিশিরের সাথে কথা বলি। তারপরই আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাব।”
রুমেল এবং শর্মিলা আর কথা বাড়াল না। অতঃপর তিনজনই গম্ভীর হয়ে রইল বেশ অনেকটা সময়।
সন্ধের পরের সেই স্নিগ্ধ আলো আজ অস্বাভাবিক রকম ভারী। ঘরের দাওয়ায় আলো-অন্ধকারের পালাবদলে আর্তনাদের ভাঁজ লুকিয়ে আছে। চারদিক স্তব্ধ। এমন নিস্তব্ধতা যেখানে বাতাসও নিঃশব্দে হেঁটে বেড়ায়, যেন জানে আজ একটি সম্পর্কের শেষ পর্ব মঞ্চস্থ হবে।
শিশির দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত ধরে। হাতে মুঠো পাকিয়ে আবার আলগা করছে, বুকের ভেতরটা চঞ্চল অশান্তিতে দুলে উঠছে। এ ঘর, এ চৌকাঠ যেখানে কোনো একসময় তার নাম উচ্চারণ হতো, আজ সেখানেই দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো শ্বাস নিচ্ছে সে।
সায়েমা বেগম ফোন করেছিলেন।
তাঁর কণ্ঠের অদৃশ্য ওজনেই শিশির চলে এসেছে।
কিন্তু আসার আগে তৃণাকে বোঝাতে গিয়ে তার যা অবস্থা হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথমে রাগ, তারপর কেঁদেকেটে একশা। বারবার বলছে, আপনি গেলেই আর ফিরবেন না, আমি জানি, ও কি এমনি এমনি এসেছে নাকি, আমার বোনকে আমি চিনি না, তোমায় আঁটকে ফেলবে আমি জানি।
অনেক চেয়েও বোঝাতে পারেনি তৃণাকে। তবু শিশির এসেছে। ওকে তো আসতেই হতো। কিছু অধ্যায় আছে, যেগুলো বন্ধ করতে গেলে হাত কাটে; তবু বন্ধ করতেই হয়।
দরজা খুলতেই পুরনো স্মৃতি ও অপরাধবোধের ঘ্রাণ শিশিরকে স্তব্ধ করে দিল। একটু এগিয়েই তার দৃষ্টি থমকে গেল। সোফার ওপরে শান্তভাবে বসে আছে দীক্ষা – কিন্তু সেই শান্ততার ভেতরে এক ক্রান্তিকালীন ঝড় লুকিয়ে আছে যেন।
দীক্ষার পেট আরও উঁচু। মুখে ক্লান্তির তীব্র রেখা।
চোখের নিচে কালো ছাপ- রাত্রিব্যাপী জেগে থাকা, অশান্ত দিন-রাত্রির প্রমাণ যেন। তার অযত্নে ছড়িয়ে থাকা চুল, ঢিলেঢালা পোশাক- সবকিছুই সাক্ষী দিচ্ছে একটি নীরব লড়াইয়ের।
দীক্ষার চোখ দুটো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিশিরের দিকে। সেই চোখ- এক অদ্ভুত গভীরতা, বিষণ্ণতা, প্রত্যাখ্যান, অথচ কোথায় যেন একটা অমোঘ টান…
যা শিশিরকে হঠাৎ করেই অস্থির করে তুলল।
এই মুহূর্তে দীক্ষার মনে হচ্ছে, কারো হাত তার হৃদয়ের গভীরে ঢুকে ছু রি ঘষে দিচ্ছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, যে মানুষটা তাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়েছে, যে মানুষ প্রতারণার কাদায় তাকে ডুবিয়ে রেখেছে, যে মানুষ তার গর্ভের নিস্পাপ প্রাণকেও ভয়ংকরভাবে উপেক্ষা করেছিল- আজ সেই মানুষটিকে দেখেই কেন তার বুকের ভেতর আবার আ গু ন জ্বলে উঠছে?
নারী মন— নির্দয় এবং দুর্বল একই সাথে। অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ভরা।
শিশির এক পা এগোতেই হাত থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগটা নিচে পড়ে গেল। হাত কাঁপছে। চোখের ভাষা বলছে, দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর আর পরিচিত মানুষটাকে সে একই সাথে দেখছে।
দু’জনের চোখে চোখ পড়তেই ঘরজুড়ে অদৃশ্য ঝড় বয়ে গেল। তাদের মাঝে কেউ কথা বলল না-
কিন্তু দুই হৃদয়ের ভাঙা আওয়াজে ঘরটা যেন কেঁপে উঠল। নাকি কেঁদে উঠল?
(চলবে)
Share On:
TAGS: মৃধা মৌনি, সোনাডিঙি নৌকো
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৫
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৭
-
সোনাডিঙি নৌকো গল্পের লিংক
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ২
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১০+ খন্ড অংশ
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৪
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৬
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ৮
-
সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১১