বেলতুলি – [০৫]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
অক্টোবর মাসের শুরু। ভোর হলেও রাজশাহী শহরে লোকজনের চলাচল দেখা যাচ্ছে। কেউ প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে, কেউ বা অন্যান্য কাজে। ওইতো অদূরে হাই তুলে চা ওয়ালা তার টং খুলছে। টঙের বাইরে দাঁড়ানো দুজন মধ্যবয়সী লোক, তারা চা ওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছে,
–“আরে মিঁয়া, তাড়াতাড়ি করো। তোমার চা ছাড়া সকাল যে জমে না।”
এক দুটো রিকশা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যাত্রীর অভাবে তারা আলস্য সময় পার করছে। দুজন টুকটাক কথা বলছে আর ধরনীর বুকে আলো ফোঁটা দেখছে।
ভোর প্রায় ছয়টা। বাস কিছুক্ষণ আগে রাজশাহীর মূল শহরে পৌঁছেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস থেকে নাহিয়ান। তার পুরো নাম “নাহিয়ান নীরব”। ভার্সিটি কিংবা যেখানে থাকছে সবাই তাকে নাহিয়ান সম্বোধন করে। একমাত্র বাড়িতেই তার ডাকনাম নীরব। এই সুন্দর শীতল আলোয় তাকে ফুরফুরে দেখানোর কথা। কিন্তু তার চোখে-মুখে অবাধ বিরক্তি।
নাহিয়ানের পেছনে তার দুই বন্ধুও নেমেছে। একজন এখনো ঘুমে ঢুলুঢুলু। নাহিয়ান এদের দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে ধপাধপ পায়ে রাস্তার ওপার চলে যায়। নাহিয়ানের রাগ দেখে দুই বন্ধু ছুটে যায়। রুবেল, শহীদ দুজনেই ছুটে যায় নাহিয়ানের পেছন পেছন।
–“আরে নাহিয়ান দাঁড়া! এভাবে ফেলে যাচ্ছিস কেন?”
নাহিয়ান ওদের দিকে ফিরেও তাকাল না। সে সোজা সদ্য খোলা টঙের দিকে এগিয়ে যায়। খাওয়ার মতো কিছু বাশি রুটি, কলা এগুলাই পায়। চা ওয়ালা বলে ওঠে,
–“রুটি কেকগুলা কালকেরই। নতুন আইবো সাতটার পরে। এগুলাই খাবেন নি?”
নাহিয়ান একটা কলা নিতে নিতে বলল,
–“এনার্জি বিস্কুট দিন এক প্যাকেট।”
চা ওয়ালা চা বানানোর ফাঁকে তাই দিল। নাহিয়ানের দেখাদেখি বন্ধুরাও কলা নিল। রুবেল বলল,
–“তিন কাপ চা দাও তো মামা।”
কলা খেতে খেতে নাহিয়ানের প্যাকেট থেকে একটা এনার্জি বিস্কুট নিতে চাইল, কিন্তু নাহিয়ান তা সরিয়ে ফেলে। তা দেখে শহীদ বিরক্ত হয়ে বলল,
–“আরে আমি জানতাম নাকি যে হিমালয় পাহাড় দেখা যাবে শীতের সময়ে। জানলে তো এখন বগুড়া যেতাম না।”
নাহিয়ান মুখ ফিরিয়েই দাঁড়ানো। রুবেল বলল,
–“তোর এই বেশি বেশি রাগ একদম ভাল্লাগে না। মানুষ তো না জানতেই পারে তাই না?”
অবশেষে নাহিয়ান মুখ খুলল,
–“যে মানুষ জানে না তার কী দরকার ছিল বোকার মতো আমার দুটো দিন নষ্ট করার? আমার টিউশনি যে এদিক দিয়ে মিস গেল তার দায়ভার কে নিবে?”
শহীদ শুনেছে বগুড়ার এক গ্রাম থেকে নাকি মাউন্ট এভারেস্ট কিংবা হিমালয় পাহাড় দেখা যায়। ভ্রমণ পিপাসু তিন বন্ধু তাই দিক ভুলে ছুটে যায়। কিন্তু দেখা যায় সেরকম কিছুই না। ওই শীতের সময়ে হুটহাট খুব ভোরের দিকে দেখা যায়। তাও সম্ভবত বানোয়াট। বাতাসের কথা শুনে সব বন্ধু ধরা খেয়ে গেছে।
শহীদ বোকার মতো হাসল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
–“যাক, আমরা অন্তত বগুড়ার গ্রাম-ট্রাম তো ঘুরে দেখেছি। তার চেয়েও বড়ো কথা বগুড়ার দই, আহ ভাই! এখনো মুখে লেগে আছে। দুই বান্ডেল এনেছি। বাসায় দিতে পারব।”
রুবেল বলল,
–“তোরই যা লাভ, বাড়ি তোর এখানেই। অথচ আমার আর নাহিয়ানের বাড়ি বাংলাদেশের আরেক প্রান্তে।”
–“নাহিয়ানের বাড়ি তো ঢাকাতে।”
–“তো কী? দূরে না?”
নাহিয়ান এদের কথায় কান না দিয়ে তার মোবাইল চালু করল। চালু করতেই দেখল মায়ের কল। তাকে চিন্তিত দেখাল। দুইদিন সে নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল। গ্রামের দিকে একদমই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। নাহিয়ান ভেবে-চিন্তে কলা খেতে খেতে তখনই কল দিল। মায়ের খোঁজ-খবর নিল। চা খাওয়া শেষ হতেই বন্ধুদের ফেলে সে বাড়িতে চলে গেল্। আজ সাড়ে দশটায় তার ক্লাস। এখন বাসায় গিয়ে দুই ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে নিবে।
নাহিয়ান এসে পৌঁছায় এক তিন তলা পুরাতন বাড়ির সামনে। বাড়ির উঠানে এক মধ্যবয়সী লোক নরম রোদ পোহাতে পোহাতে চা খাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম কাদের। দুজনের চোখাচোখি হতেই নাহিয়ান সালাম দিল।ভদ্রলোক সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
–“কোথা থেকে ফিরলে সকাল সকাল? দুদিন ধরেও দেখি না।”
–“জি, বগুড়ার দিকে গিয়েছিলাম। আপনাদের জন্য দই এনেছি।”
ভদ্রলোক খুশি হলেন এ কথা শুনে। কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করে নাহিয়ান নিচতলার এক ঘরের তালা খুলে ঢুকে পড়ল। দুটো ছোটো ছোটো ঘর, সে একাই থাকে। নাহিয়ানের এক স্বভাব খারাপ আছে, সে আবোল তাবোল খেলেই তার পেট খারাপ হয়ে যায়। এছাড়া তার মতো পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করা মানুষ মেসের অপরিষ্কার ব্যাপারগুলোও বিশেষ পছন্দ করে না। তার জ্বালা বলা যায় সবকিছুতেই। এজন্য তার ব্যবস্থা করে থাকতে হয় ভাড়া বাসায়, যার সম্পূর্ণ খরচ মশিউর সাহেব সামলান।
ভদ্রলোক কাদের মশিউর সাহেবের পরিচিত মানুষ, বলা চলে ওনাদের গলায় গলায় ভাব। যখন শুনলেন নাহিয়ান বাসা খুঁজছেন তিনিই তাকে এখানে থাকার প্রস্তাব দিলেন। সেই থেকেই নাহিয়ান ব্যাচেলর হয়ে এখানে। অথচ কেউ ব্যাচেলরকে বাসা ভাড়া দিতে চান না। অবশ্য তার এমনিতেও কোনো খারাপ অভ্যাস নেই, মেয়ে মানুষের থেকেও দূরে দূরে থাকে। নিবিড়, নাহিয়ান.. দুই ভাইয়ের এই এক দিক থেকেই সাদৃশ্য।
গোসল সেরে আসতেই পারিবারিক ছবিটার ওপর নজর পড়ল তার, দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কবে যে ঈদের ছুটি পাবে আর ছুটে যাবে প্রিয় বেলতুলিতে। কতদিন পুরানো বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট, ফুটবল খেলা হয় না। শুনেছে ক্যারামেরও দোকান হয়েছে বাজারে।
এলাকাতে উচ্চস্বরে গান বাজানো হচ্ছে। এসব গান-বাজনার জন্য অতীষ্ঠ এলাকাবাসী। গান ছেড়েছেও কে? জাবির। তার জোরে গান শুনতে ইচ্ছে করছে, এজন্য সে সাউন্ডবক্স ভাড়া করে এনেছে। লোকের মনে মোটামুটি ভয় আছে জাবিরের প্রতি। এজন্য ঝামেলা এড়াতে তাকে কেউ কিছু বলে না। এবারও কেউ কিছু বলার সাহস করল না, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে নিজ নিজ কাজে চলে যাচ্ছে। জাবির এই ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করছে। সে মূলত মৌনোকে তার মনের অনুভূতি বোঝাতে এরকম শব্দ করে গান ছেড়ে রেখেছে। সে বোঝাতে চায় মৌনোকে ভালোবেসে সে কতটা খুশি।
এদিকে মৌনোর আগামীকাল পরীক্ষা, এজন্য সে ভরদুপুরে পড়তে বসেছিল। কিন্তু এই গান বাজনার জ্বালায় অতীষ্ঠ হয়ে কানে হাত চেপে আছে সে। এশা তো গানের তালে তালে নাচছে। জুনায়েদ বাড়ি নেই, সে স্কুল থেকে ফিরবে শেষ বিকালে। মৌনো বিরক্ত হলে পর্দার আড়াল থেকে অদূরের মাঠের দিকে তাকাল। পরপর রাগ গিয়ে ঝাড়ল এশার উপর। দুম করে এশার পিঠে এক ঘা বসিয়ে দেয় সে। এশা তো কাঁদেই না, উলটো মৌনোকে খামচি দিয়ে পালায়। রিমঝিম বাড়িতে নেই, তার চাকরি জীবন শুরু হয়ে গিয়েছে।
জাবির যখন হাতের অঙ্গি-ভঙ্গি করে দলের ছেলেদের সাথে তাল মেলাতে ব্যস্ত তখন হুট করে কোথা থেকে নিবিড় এলো। এসে কোনো কথা ছাড়াই সাউন্ডবক্সের মূল সংযোগ বন্ধ করে দিল। হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাবির যারপরনাই বিরক্ত হলো। পিছে ফিরে দেখল নিবিড় শক্ত মুখে দাঁড়ানো। জাবির কখনোই নিবিড়ের সাথে লাগে না, এবারও লাগল না। দুজনের চোখাচোখি হলো। নিবিড় শক্ত গলায় বলল,
–“এটা ভদ্রলোকের এলাকা। গান-বাজনা করার হলে দূরে কোথাও গিয়ে কর, আর যেন কোনো শব্দ না শুনি।”
বলেই নীরব হুমকি দিয়ে নিবিড় চলে গেল। জাবির কটাক্ষ করে বলল,
–“জে নেভি সাব। আপনে যা কইবেন।”
বিকালে নিবিড়দের বাড়ি মৌনোর কাজ পড়েছে। সেজন্য সে বের হয় হাতে কিছু খাবার নিয়ে। কিন্তু পথিমধ্যেই তার রত্নার সাথে দেখা হয়। রত্না বেশ সুন্দরী মেয়ে, সে সর্বদা নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পছন্দ করে, আধুনিকতা পছন্দ করে। বেলতুলিতে একমাত্র সেই চুল কিছুটা কৃত্রিম রং করিয়েছে। আর নয়তো অন্য মেয়েদের বাড়িতে কেউ শখ করে চুলে রং করতে চাইলে তাকে ঝাটা পেটা করা হয়।
রত্না মৌনোর থেকে দু’বছরের বড়ো, তাই তাকে নাম ধরেই ডাকল। মৌনো তার ডাক অদেখা করতে পারল না। বিনয়ের সাথে দাঁড়াল,
–“জি আপু?”
–“কোথায় যাচ্ছ?”
–“শেইনাদের বাড়ি।”
নিবিড়দের বাড়ির কথা শুনে রত্নার চোখ-মুখ পালটে যায়। সে মুখ-ভঙ্গি অদ্ভুত করে বলল,
–“আমি যাচ্ছিলাম কামরুলের খোঁজ করতে, কিন্ত পাচ্ছি না ওকে। তুমি যেহেতু যাচ্ছই, নিবিড়কে একটু আমার চিঠিটা পৌঁছে দিবে? দিলে খুবই উপকার হতো। বুঝতেই পারছ, বিয়ের আগে হবু শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটা কেমন দেখায়? ওনাকে কতদিন চিঠি লিখব ভাবছিলাম কিন্তু লিখতে বসার সময় হয়ে উঠছিল না।”
মৌনোর কেন যেন মনে হলো রত্না কথাগুলো বাড়িয়ে বলছে। কিন্তু মৌনোর সাথে এভাবে বাড়িয়ে, তাকে বোঝানোর তো দরকার নেই তার নিবিড়ের সাথে বিয়ে ঠিক কিংবা তাদের মাঝে গভীর সম্পর্ক। সে আগে থেকেই জানে, রত্নাকে একবার অভিনন্দনও জানিয়েছে। আগে নিবিড় ভাই বলত, এখন মৌনোর সামনে খুব রসিয়ে নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। সবই বুঝতে পারছে সে, খুব স্বাভাবিকও। কিন্তু তাকে দিয়ে চিঠি পাঠানোর মানে কী?
মৌনো না করতে পারল না। চিঠিটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল,
–“ঠিক আছে।”
–“থ্যাঙ্কস। বলবে রত্না আপু তার উত্তরের অপেক্ষায়।”
শেষ কথাটুকু বলে রত্না লজ্জা পাওয়ার ভান করল, কিন্তু মৌনোর মধ্যে কোনোরূপ ভাবান্তর দেখা গেল না। মৌনো চুপ করে মুন্সী বাড়িতে চলে যায়। দরজার মুখেই সোফিয়া খানমের সাথে দেখা। মৌনো খাবার আর চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“রত্না আপু পাঠিয়েছে নিবিড় ভাইয়ার জন্য।”
রত্নার নাম শুনে খুশি হয়ে যান সোফিয়া খানম। চিঠিটা উলটে পালটে বলল,
–“যাক, কাজের আছ। আমি দিয়ে দিব।”
সোফিয়া খানম প্রায়ই মৌনোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তবে আজ রত্নার চিঠির জন্য তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে? অবিশ্বাস্য! মৌনো মুখ ফিরিয়ে চলে আসার সময়ে কি ভেবে দাঁড়াল। পরপর পিছে ফিরে উপরে তাকাতেই দেখল বারান্দায় নিবিড় দাঁড়ানো, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকেই। চোখে চোখ পড়তেই নিবিড় গলা উঁচিয়ে বলল,
–“বাড়ি যা। গেট অবধি না পৌঁছানো অবধি আমি দাঁড়িয়েছি।”
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~~
বিঃদ্রঃ প্রথমেই.. যারা যারা পড়ছেন অবশ্যই রেসপন্স করবেন। সাড়া দিন, আপনাদের মন্তব্য দেখে প্রাণ জুড়াই।
রিচেক একটু পর দিচ্ছি।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ৭
-
বেলতুলি পর্ব ৩
-
বেলতুলি পর্ব ১৪
-
বেলতুলি পর্ব ১
-
বেলতুলি পর্ব ১০
-
বেলতুলি পর্ব ১৭
-
বেলতুলি পর্ব ২
-
বেলতুলি পর্ব ৮
-
বেলতুলি পর্ব ১৩
-
বেলতুলি পর্ব ৪