০৬
বিশাল বড় এক বাজার। বাবরিচুলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখছি। বেশ এডভেঞ্চার কাজ করছে আমার ভেতর।
খোলামেলা দোকানেস পসরা। শুটকি মাছ, বাতাসা, মুড়ি মুড়কি থেকে শুরু করে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সবকিছুই এখানে আছে। এক দোকানে গরম গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে। আমি দেখে লোভ সামলাতে না পেরে বললাম, ‘খাবেন?’
‘আপনি খাবেন?’
‘হুম।’
বাবরিচুল মুচকি হাসলো। জিলাপির দোকানের সম্মুখে বেঞ্চিতে বসলাম আমরা। দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, ‘দুই প্লেটে না এক প্লেটে?’
বাবরিচুল হতচকিত হয়ে উত্তর দিলো, ‘দুই প্লেটে দেন।’
আমি কেন যেন হাসি বন্ধ রাখতে পারলাম না। একদিন তো এক প্লেটেই খেতে হবে। আজকের এসব ভদ্রতা সেদিন কোথায় যে ভেসে যাবে..
আমাদের দুজনের হাতে দুইটা পিরিচে করে জিলাপি দেয়া হলো। গরম গরম গুড়ের জিলাপি। আমি মন ভরে জিলাপি খেলাম। খেতে খেতে বাবরিওয়ালা আমাকে বলছিলো এই জায়গার হাট অনেক বিখ্যাত। সপ্তাহে একদিন এরকম হাট বসে। সেদিন বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে বাজার সদাই কিনতে।
জিলাপি খাওয়া শেষ করে আবারও আমরা ঘুরতে লাগলাম। মেলা মেলা একটা আমেজ। এক দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফেরিওয়ালাদের মতো মেয়েলি জিনিসপত্র। আমি কিঞ্চিৎ আগ্রহ প্রকাশ করতেই বাবরিচুল বললো, ‘যা ইচ্ছে নিন।’
জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম। কিছুই পছন্দ হলো না। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা পাটিতে ছোট ছোট হাড়িপাতিল বিক্রি হচ্ছে। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে সামনে বসে কয়েকটা পাতিল ধরে ধরে দেখছিলাম। হঠাৎ আড়চোখে তাকাই বাবরিচুলের দিকে। সে বিরক্ত হচ্ছে কিনা বোঝার জন্য। অথচ তাকিয়ে দেখি তার মুখে বিরক্তির ছিটেফোঁটাও নেই। বরং অদ্ভুত এক মোহনীয় হাসি লেগে আছে মুখে!
আমি কয়েকটা হাড়িপাতিল কিনলাম। অনেকদিন পর এরকম হাড়িপাতিল দেখে আনন্দ হচ্ছে আমার। বাবরিচুল বললো, ‘আপনি দেখি ভেতর থেকে আসলেই একটা বাচ্চা।’
‘কত বছর পর এরকম হাড়িপাতিলের দোকান দেখলাম জানেন? সেই যে ছোট্টোবেলা আব্বুর সঙ্গে মেলায় গিয়ে কিনতাম! আহা শৈশব। এরপর থেকে আর কোনোদিন এগুলো চোখেই দেখিনি।’
বাবরিওয়ালা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘তাই বলে আপনার বয়সী একটা মেয়ে এই বিশাল বাজার ঘুরে ঘুরে কেনার মতো কিছুই পেলো না? মেয়েদের চুড়ি ফিতা রেখে আপনি কিনলেন বাচ্চাদের হাড়িপাতিল। হা হা।’
সে হাসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার হাসি দেখে আমার একটুও রাগ হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে।
আমার জামাকাপড়ের ব্যাগটা শুরু থেকেই ওর কাছে। এবার হাড়িপাতিলের ব্যাগটাও নিয়ে নিলো। হাঁটতে হাঁটতে একটা কুকুরকে এড়িয়ে চলে গেলাম। বাবরিওয়ালার আওয়াজ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি, সে কুকুরটার সঙ্গে বসে গল্প করছে। তারপর উঠে গিয়ে দোকান থেকে একটা বনরুটি কিনে কুকুরটাকে খেতে দিলো। এরপর আবার হাঁটা ধরলো আমার সঙ্গে।
কিছুক্ষণ পরে দেখি একটা ছোট বাচ্চা ভ্যা ভ্যা কাঁদছে। হাতের ব্যাগ দুটো আমাকে দিয়ে সে দৌড়ে গিয়ে ওই বাচ্চার সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে বাবা?’
বাচ্চাটি আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। বাবরিওয়ালা আদর করে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কার সঙ্গে এসেছো? বাবাকে খুঁজে পাচ্ছো না?’
ছেলেটা কান্নার গতি আরও বাড়ালো। চিন্তিত মুখে এদিক সেদিক তাকালো বাবরিচুল। মুহুর্তেই ছেলেটার মা এসে বললেন, ‘ওকে কাঁদতে দেন। আমি মাইর দিছি দুইটা। যেটা দেখে সেটাই কিনতে চায়।’
বাবরিচুল মহিলার সামনে ভদ্রতা সূচক হাসি দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে। আমি অন্যকিছু ভেবেছিলাম। তবে আন্টি, প্লিজ ওকে মারবেন না। এতটুকু বাচ্চার গায়ে মারার জায়গা কোথায় বলেন?’
মহিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বিরক্ত হচ্ছে সে। যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী। বাবরিচুল সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললো, ‘আন্টি, আপনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন। ওকে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝালে ও বুঝবে। দুষ্টুমি করোনা বাবু। তুমি একটা গুডবয়।’
বলেই হাঁটা ধরলো বাবরিচুল। আমি বললাম, ‘আর একটু হলে মহিলা আপনাকেই দুইটা বসিয়ে দিতো।’
‘হা হা হা। যেভাবে রেগে আছে, তাতে এটা অস্বাভাবিক কিছু না।’
‘আপনি কি সবসময়ই এমন মানবিক নাকি সঙ্গে মেয়ে আছে দেখে একটু ঢং করছেন?’
বাবরিচুল অবাক হয়ে বললো, ‘আপনাকে আমার মোটেও মেয়ে মনে হয় না। একটা বাচ্চা মনে হয়। আপনাকে দেখানোর কিছু নেই।’
আমি খানিকটা রেগে উত্তর দিলাম, ‘যাক ভালো। কিন্তু এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সেদিন আমাকে ওই কথা জিজ্ঞেস করাতে আমারও খারাপ লেগেছিলো?’
‘কোন কথা?’
‘এইযে আপনি সবসময়ই এমন অবুঝ নাকি ইচ্ছে করে এমন ভান করেন?’
বাবরিচুল ফিক করে হেসে ফেললো। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো, ‘সেই সকালবেলা বের হয়েছেন। খিদে পায়নি?’
‘হুম। পাবেনা কেন?’
‘কিছু খাবেন?’
‘খাওয়া যায়। ভালো একটা রেস্টুরেন্ট দেখে বসি।’
‘এখানে যেটা পাবেন সেটাকে বলে হোটেল। রেস্টুরেন্ট না। তবে এই ব্যাপারটা কিন্তু আমার ভালোই লাগলো। আজ মেয়ে হলে বলতেন, জিলাপি খেয়ে পেট ভরে গেছে। আপনি যে ভেতর থেকে বড় হোননি, সেটা বুঝা যায়।’
আমি ঠোঁট বাঁকা করে বললাম, ‘এসব কি ধরনের কথা? ক্ষুধা পেলেও লাগেনি কেন বলবো? মিথ্যা বলার প্রয়োজন আছে কি?’
‘ক্ষুধা পেলেও মেয়েরা চক্ষুলজ্জার কারণে কখনো মুখ ফুটে বলেনা, চলুন কিছু খাই। মেয়েরা বরং ক্ষুধা পেটে নিয়েও সেটা লুকিয়ে রাখে।’
‘ওহ আচ্ছা। এতকিছু জানেন যখন, আপনিই তাহলে মেয়ে। আর আমি শিশু। ওকে?’
‘আমাকে কোন অ্যাংগেল থেকে মেয়ে মনে হচ্ছে মিস মীরা? এই জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষটাকে আপনি মেয়ে বলতে পারলেন?’
আমি উত্তর দিলাম না। আমার মেজাজ খারাপ হয়েছে। ক্ষুধা লাগলেও নাকি লুকাতে হবে? ওই মেয়েলী স্বভাব আবার নাই বা হলো!
একটা খাবারের হোটেলে এসে বসলাম আমরা। আমি ভেবেছি কিছুই অর্ডার দিবো না। আমাকে অযথা কথা শোনানো। তার যা ইচ্ছে হয় অর্ডার করুক। আমাকে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখেও তার এতটুকু মায়া হচ্ছে না। রাস্তার কুকুরের জন্য তার মায়া, হারিয়ে যাওয়া শিশুর জন্য মায়া। অথচ আমার জন্য কোনো মায়া নাই। আমি রাগ করে বসে আছি, একবার “সরি”ও বলার প্রয়োজন মনে করছে না।
কি কি খাবার আছে, এর উত্তরে দোকানের ছেলেটা বললো, ‘মোরগ পোলাও, মুরগীর বিরানি, ভাত, গরুর গোশ, পরাটা ডালভাজি।’
বাবরিচুল আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি খাবেন?’
আমি একটা ছোট ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললাম, ‘খাবো না কিছু।’
‘কেন?’
‘মেয়ে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি।’
সে ফিক করে হেসে ফেললো। তারপর আমাকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করেই ছেলেটাকে বললো, ‘গরু দুইটা, ভাত দুইটা। সালাদ থাকলে দিবা। আর সঙ্গে দুইটা কোল্ড ড্রিংক্স।’
আমি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছি। তাকে কেউ বলেছে মীরার ভাত খেতে ইচ্ছে করছে? এত বেশী বুঝলে তো হবেনা। আমার আসলে মোরগ পোলাওয়ের ঘ্রাণেই ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে। মেয়ে মানুষ হবার চেষ্টায় মুখ ফুটে বলতে পারছি না।
বাবরিচুল বললো, ‘গরুর গোশত ছাড়া বাকি আইটেমের টেস্ট ভালো হবেনা। ভাত খেয়ে নেই। তারপর রওনা দিবো। এমনিতেই দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
আমি মুখ বন্ধ করে রেখেছি। কথা বলবো না। আজকে বাকি সময় মুখ বন্ধ রাখবো বলে ঠিক করেছি। বাবরিওয়ালা এই এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, লোকজনের কারবার নিয়ে আমাকে গল্প শোনাচ্ছে। তার কথা শুনছি চুপচাপ। রাগ করলেও কথা শুনতে তো দোষের কিছু নেই!
খাবার চলে এলো। খাবো কী না, বুঝতে পারছি না। চুপচাপ বসে আছি। বাবরিওয়ালা হাত ধুয়ে এসে খাওয়া আরম্ভ করলো। তার চুলগুলো আবার বড় হয়েছে। কপালের ওপর এসে ঝুঁকে আছে এক গোছা বাবরিচুল। সে মাথা ঝাঁকি দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে আবারও খেতে লাগলো।
এদিকে আমার যে ক্ষুধা পেয়েছে, আমি যে বসে আছি, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! আশ্চর্য। এ কেমন মানবিকতা তার?
সে কিছুক্ষণ পরে বললো, ‘খাবারটা ফেরত নিতে বলবো? খাবেন না যেহেতু।’
আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না। এর কোনো মানে হয়? না হয় না। নিছক আমাকে রাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সে বললো, ‘খাবারটা ভালোই। বিয়েবাড়ির মতো মজা না। তাও ভালো। খাওয়া যাচ্ছে। হাত ধুয়ে আসুন মিস মীরা।’
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে খাবার চিবোতে চিবোতে বললো, ‘চেহারা দেখে মনে হচ্ছে গরুর মাংস আপনার ভালো লাগছে না। এই ব্রো, এদিকে আসো। এই ভাতের প্লেটটা নিয়ে যাও।’
আমি থ হয়ে গেলাম। সত্যি সত্যি আমার সামনে থেকে ভাতের প্লেট নিয়ে যেতে বলেছে সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এরপর সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘এটা নিয়ে যাও, একটা মোরগ পোলাও দাও।’
আমি চমকে উঠলাম। এক ঝটকায় আমার রাগ খানিকটা কমে গেলো। সে কিভাবে জানলো আমার মোরগ পোলাও খেতে ইচ্ছে করছে! আশ্চর্য..
মোরগ পোলাও এসে গেলো। এবার তো চুপচাপ বসে থাকা দায়। একদিকে ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। অন্যদিকে সামনে গরম গরম পোলাওয়ের ঘ্রাণ। আমি মনেমনে বললাম, মাইনকার চিপায় পড়ছিস মীরা।
বাবরিচুল বললো, ‘আমার কথায় কষ্ট পেলে সরি। খাবারটা খেয়ে নিন। আমাদের দেরি হয়ে গেলে সবাই কল দেয়া শুরু করবে।’
আমি এবার আর কিছু ভাবলাম না। চামচ দিয়ে খেতে আরম্ভ করলাম। সত্যিই এর স্বাদ তেমন একটা ভালো হয়নি। বাবরিওয়ালা খুব আয়েশ করে ভাত খাচ্ছে। তার ভাত খাওয়া দেখে আমার ইচ্ছে করে বলি, দুইটা ভাত দেন না ভাই!
চুপচাপ বিস্বাদ পোলাওটাই খেয়ে উঠলাম। পুরোটা খেতে পারলাম না। অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা রেখে দিলাম। বাবরিচুল বললো বাকি অর্ধেক পার্সেল করে দিতে। আমি ভেবেই পেলাম না, এই অর্ধেক বিরিয়ানি সে কার জন্য নিয়ে যাবে!
খাওয়াদাওয়া শেষে বাইরে এসে সে আমাকে বললো, ‘এখানে একটা মিষ্টির দোকান আছে। খুব ভালো হয় ওদের মিষ্টি। চলুন খাই।’
আমি তাকে অনুসরণ করলাম। পথে একটা কুকুরকে দেখে সে পোলাওয়ের প্যাকেট খুলে কুকুরের সামনে রাখলো। বিড়বিড় করে বললো, ‘খা। কার এটো খাবার খাচ্ছিস জানিস? ওনার নাম মীরা। খুউউব সুন্দরী। এরকম সুন্দরী আপার খাওয়া বিরিয়ানি খেতে শরীরে একটা ভাব আসছে না? হু, আসছে। তাহলে খা। তুই সুন্দরের কি বুঝবি। তুই শুধু বুঝবি খাবার।’
কথাগুলো বলে সে উঠে আসলো। আমি মুখ টিপে হাসছি। এই সামান্য কয়েকটা কথাতেই আমার মন খারাপের মেঘটা হঠাৎ করে উড়ে অন্য আকাশে চলে গেছে।
মিষ্টির দোকানে ঢুকে আমার পছন্দের মিষ্টি কোনটা জানতে চাইলো সে। তারপর সেই মিষ্টিটা পিরিচে করে আমাকে দিতে বললো। আমি একটা বেঞ্চিতে বসে মিষ্টি খাচ্ছি। ওদিকে সে উঠে গিয়ে দোকানদারকে বললো, ‘দশ কেজি মিষ্টি দিন।’
আমি হা হয়ে গেলাম। হয়তো বিয়েবাড়ির জন্য কিনতে বলা হয়েছে তাই কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা অটোর জন্য অপেক্ষা করছি। সে নিজ থেকেই বললো, ‘আংকেলের প্রজেক্টটা পজিটিভলি এগোচ্ছে। হয়ে যাওয়ার চান্স আটানব্বই পারসেন্ট। এরচেয়ে ভালো খবর আর হয় না। তাই বাড়ির সবার জন্য মিষ্টি নিলাম।’
‘তাই বলে দশ কেজি!’
‘হ্যাঁ। এমনিতেই অনেক লোকজন, তারওপর বিয়েবাড়ি।’
একটা অটোতে উঠে পড়লাম আমরা। আমরা দুজন যাত্রী মাত্র। বাবরিওয়ালা বললো, রিজার্ভ যাবো।
সে এবার আমার মুখোমুখি বসলো। শো শো বাতাসে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিছুদূর এগোতেই ধানক্ষেতের পাশেই একটা চায়ের দোকানের সামনে অটো দাঁড় করাতে বললো সে। আমাকে বললো, নামুন।
অটো চালক’কেও ডেকে নিয়ে এসেছে। রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত। এমন সুন্দর জায়গায় বসে চা খেতেও শান্তি। এক কাপের জায়গায় দুই কাপ চেয়ে নিলাম আমি। চা খেতে খেতে অটো চালকের সঙ্গে বাবরিওয়ালা গল্প করছিলো।
চা শেষে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ‘পান খাবেন মিস মীরা?’
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকালাম। সে একটা পানের খিলি এনে দিলো আমার হাতে। সেটা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে আমি রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। হঠাৎ সে পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘সুন্দর না জায়গাটা?’
‘হুম। তারচেয়েও বড় কথা, এই মুহুর্তটা সুন্দর।’
‘তাই?’
আমি অদ্ভুত এক অনুভূতির আস্বাদনে বিমোহিত হয়ে আছি। কী সুন্দর দখিনা বাতাস। ধানক্ষেতে দোল দিয়ে যাচ্ছে। যতদূর চোখ যায় শুধুই ফসলের ক্ষেত। এমন জনমানবহীন জায়গায় চায়ের দোকান দেয়ার ভাবনা কোথা থেকে আসে মানুষের!
সে যাই হোক, আজকের এই দিনটা আমার জীবনে স্মরণীয় একটা দিন হয়ে থাকবে। খুনসুটি, হাসি, অভিমান, সবকিছুর ভীড়ে এইযে নিজের মতো কাটাতে পারা একটা দিন, এরকম দিন আমার জীবনে কক্ষনো আসেনি। বাবার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হচ্ছে না, মায়ের কথা শোনার ভয়ে নিজেকে সামলে রাখতে হচ্ছে না। আশেপাশে কেউ নেই আমাকে দেখার। কেউ নেই আমার কোনোকাজে নাক গলানোর। সম্পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ বোধহয় একেই বলে!
আমি বাবরিচুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ থ্যাঙ্কিউ। আজকের দিনটা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।’
‘ওয়েলকাম। এবার যাওয়া যাক?’
‘নিশ্চয়ই।’
দাদুবাড়িতে ফিরে আমরা দুজন দুদিক দিয়ে প্রবেশ করলাম। মা এসে নানান প্রশ্ন। কিভাবে এলাম, কখন বেরিয়েছি, বাবার মিটিং সম্পর্কে, বাসার সবকিছু ঠিক আছে কিনা! আমি ধীরেধীরে সবকিছুর উত্তর দেয়া শেষ করতেই বাবরিচুল এসে মাকে ডাকলো। মা বললেন, আসো ভেতরে।
সে একে একে সবকিছুর বিশদ বর্ণনা মাকে শোনালো। মিটিংয়ের ব্যাপারে পজিটিভ আশ্বাস শুনে মা ভীষণ খুশি। কতক্ষণ বাচ্চাদের মতো আমার হাত চেপে ধরে বসে রইলো। তারপর গেলো বাবাকে ফোন করতে। বাবা ফোন রিসিভ করলেন না। বাবরিচুল আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আনমনেই হেসে উঠলাম আমি।
কিছুক্ষণ পর বাবার কল আসে। তিনি আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘কাজটা হয়ে গেছে। আমরা ইনভেস্টমেন্ট পাচ্ছি।’ উনি চুক্তিপত্রে সই করে এসেছেন মাত্র। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যে আনন্দের বন্যা দোল দিতে লাগলো। বাবরিচুল মিষ্টির প্যাকেট গুলো এনে মায়ের সামনে রাখলেন। মা অবাক হয়ে বললেন, ‘এত মিষ্টি কেন রে বাবা?’
‘সবাইকে দিন।’
তারপর সে চলে যেতে উদ্যত হয়। মা ওকে ডেকে বললেন, ‘তুমি দাও সবাইকে। আমি আছি। কিন্তু এতগুলো প্যাকেট খুলো না। তিনটা চারটা প্যাকেট খোলো।’
বাবরিচুল ওয়ালা সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে মা। আমি দূর হতে দেখছি আর খিলখিলিয়ে হাসছি। এমন সুন্দর মুহুর্ত আমাদের জীবনে খুব কমই আসে। কত কোটি টাকার প্রজেক্ট সেটা বড় বিষয় না, বাবার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে, এলাকার মানুষগুলোর কাজের সন্ধান হবে, এটাই সবচেয়ে আনন্দের।
আজকে পাত্রপক্ষের বাসায় হলুদের আয়োজন ছিলো। আমাদের বাড়ি থেকে সকলেই গিয়েছিলো হলুদের ডালা নিয়ে। আমি সেটা মিস করেছি বলে কাজিনরা আমার সামনে এসে আফসোস করছিলো আমার জন্য। অথচ আমি যেই অপার আনন্দের মুহুর্ত পার করে এসেছি, তা কাউকেই বলতে পারলাম না! বলা সম্ভবও না।
রাতে বিয়েবাড়ির উঠানজুড়ে ঝলমলে আলো জ্বলে উঠলো। আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো উঠান। একদিকে স্টেজে মেহেদীর আয়োজন করা হচ্ছে। আজ কনের হাতে মেহেদী লাগানো হবে।
সাউন্ড বক্স ছেড়ে দিয়ে নাচানাচি করছে বাচ্চাকাচ্চারা। বাড়ির মহিলারা বসেছে আদা রসুন নিয়ে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাজা রসুনের ঘ্রাণ! এই ঘ্রাণটাই বিয়েবাড়িতে ভিন্ন এক আমেজ এনে দিয়েছে।
বাবা ফিরলেন। বাসায় ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘রাগ করেছিস মা? একা পাঠালাম বলে?’
‘আরে একদম না। কংগ্রাচুলেশনস আব্বু। তুমি পেরেছো।’
আব্বুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। তাঁর গল্প শুনতে ভীড় জমিয়েছে সবাই। আমি আব্বুর পাশেই বসে আছি। প্রজেক্ট নিয়ে ওনার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ ওনার গলা ধরে এলো। পরমুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে গেলেন।
হঠাৎ বাবা বাবরিচুল ওয়ালার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। ডাক শুনে এসে দাঁড়ালো সে। আব্বু সবার সম্মুখে ওকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার এই ছেলেটা আজকে আমার জন্য যা করেছে, এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। জার্মান ভদ্রলোক ওর কথা শুনেই মুগ্ধ। আলাদা করে কাগজে চোখই ফেলেনি। ও এত সুন্দর করে লোকটাকে সব বুঝিয়েছে, আমি কী বলবো! মিটিংয়ে যারা উপস্থিত ছিলো সবাই তোমার খুব প্রশংসা করেছে আমার কাছে।’
বাবা বাবরিচুলকে পাশে দাঁড় করিয়ে সবাইকে বললেন, ‘ও খুবই দূর্দান্তভাবে উপস্থাপন করছে সবকিছু। শুধু কি কথাবার্তা, ওর পুরো আয়োজনটাই ছিলো অবাক করার মতো। ভোরবেলা এখান থেকে গিয়ে ও পুরো অফিস ধুয়েমুছে ক্লিন করেছে, তাজা ফুল এনে টেবিলে রেখেছে। পুরো অফিসে লুক চেঞ্জ করে ফেলেছে সোনার ছেলেটা আমার। গিয়ে দেখি অফিস যেন আমার না, পুরাই বড় কোম্পানির অফিসে চলে আসছি মনে হচ্ছিলো। তারপর আবার খাবারের আয়োজন। কত হরেক রকমের নাস্তার আয়োজন করেছে। জার্মান ভদ্রলোক তো নাস্তা খেয়েই কূল পায় না। মুনযির আবার ওনাকে বুঝিয়ে বলে এই নাস্তার নাম কি, এর ইতিহাস। ভদ্রলোক এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছে সবমিলিয়ে, কী আর বলবো!’
সবাই বাবরিওয়ালার প্রশংসা করতে আরম্ভ করলো। কি অদ্ভুত, আমি এমন লাজে রাঙা হয়ে যাচ্ছি কেন! লজ্জায় কারো দিকে তাকাতে পারছি না। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে আমার বাবার আনন্দটাই দেখছি। বাবরিচুলের এই সমস্ত কৃতিত্ব যেন আমারই কৃতিত্ব। মনে হচ্ছে আমার নিজের মানুষ এতকিছু করেছে, এটা আমার জন্য গর্বের। অথচ সে এখনো আমার কিচ্ছু হয়নি!
আমি লজ্জা ঢাকতে রুমে চলে আসলাম। গানের মিউজিক কিছু সময় বন্ধ ছিলো। আবার চালু হয়েছে। জানালা দিয়ে ঝিলমিল আলো এসে পড়েছে রুমে। আমি সেই আলোয় বসে ভাবতে লাগলাম, আমার জীবনটা হুট করে এমন সুন্দর হয়ে উঠলো কেমন করে!
খানিকক্ষণ পর ছোটচাচার সঙ্গে দেখা। চাচা আমাকে বললেন, ‘তোর বাবাকে বলেছি মীরা। বলেছে তোর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলে দেখবে।’
‘কি বলেছো?’
‘যেন তোকে আমার সঙ্গে যেতে দেয়। এখানে কেউ তোকে কোনো স্বাধীনতা দেয় না।’
‘এসব বলেছো!’
‘হ্যাঁ। তুইই তো বলেছিস এসব আমাকে।’
‘কখন বললা?’
‘গতকাল রাতে।’
‘রাতে! ওহ শিট..’
‘কী হলো মীরা?’
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। দ্রুত বাবাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। বাবা নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। চাচার মুখে এসব শুনেই কি বাবা আজ আমাকে বাবরিওয়ালার সঙ্গে আসতে পাঠিয়েছে?
আমার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো। বাবাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। উনি বাজারে গিয়েছেন। এলাকার লোকদেরকে জানাতে হবে খবরটা। এত আনন্দের মাঝেও আমার অপরাধবোধ আমাকে ঘিরে রাখলো। হয়তো বাবার কাছে এটা তুচ্ছ ঘটনা। কিন্তু আমার বড্ড অনুতাপ হচ্ছে। যেই বাবা আমাকে কোনোদিন কারো সম্মুখে যেতে দেয়না, সে আমাকে বাবরিওয়ালার সঙ্গে এতদূর পথ আসার অনুমতি দিয়ে দিলো! যতই বিশ্বস্ত হোক, বাবার একরাতে এত পরিবর্তন হবার কথা না। আমি নিশ্চিত, আমার ইউরোপ চলে যাওয়ার বায়নার কারণেই বাবা আজকে এমনটা করেছেন।
মন খারাপ করে এক কোণায় বসে আছি। সেখানে এসে উপস্থিত ঝিকি আর মিকি। দুজনেই মুখের সামনে এসে আমাকে চেপে ধরলো, ‘আপু, এখন যাবা কোথায়? সারাদিন তোমাকে পাইনি। এবার বলো ছেলেটা কে?’
আমি পড়লাম মহা মুছিবতে। ছেলেটা কে সেটা আমি কি জানি! আমি তো মিথ্যে বলেছিলাম। তবে এটা তো ওদেরকে বলা যায় না।
বললাম, ‘ছেলেটার মেসেজ ডিলিট করে দিয়েছি আমি।’
‘সে কি! কেন?’
‘ফাউল কাজ এসব। ওই ছেলে মিকির যোগ্য না।’
‘সেজন্য আমাকে একবার দেখাবা না?’
মিকি আফসোস করতে লাগলো। যেন ছেলেটা যেমনই হোক, একবার দেখতে পেলে ওর ভালো লাগতো। আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘এত দুঃখ করার কিছু নাই। কাল বিয়েতে অনেক ছেলে আসবে। কেউ না কেউ ঠিকই পছন্দ করবে তোকে।’
মিকি বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ধুর। ছেলের আইডি নাম কি ছিলো?’
‘ভুলে গেছি।’
‘তুমি একটা যা তা, আপু।’
‘ঠিক আছে। তোরা খুব ভালো। এখন যা এখান থেকে।’
‘রাগ কোরো না আপু। ছেলেটা কালকে নিশ্চয়ই আসবে। হলুদে যে এসেছিলো, বিয়েতে সে আসবেই। কালকে ওকে দেখলে তুমি চিনবে না?’
আমি হাসি গোপন করে বললাম, ‘কেন চিনবো না? আমি দশ বছর আগে দেখা মানুষকেও মনে রাখতে পারি। আমার ব্রেইন অনেক শক্তিশালী।’
ঝিকি বললো, ‘কত শক্তিশালী বোঝা হয়ে গেছে আমাদের। সামান্য নামই মনে রাখতে পারো নাই। আবার দশ বছর পরে চেহারা মনে রাখবে, হেহে। চাপাবাজ।’
আমি ধরা খাওয়ার অপবাদ সইতে না পেরে বললাম, ‘তোরা বিরক্ত করিস না আমাকে। তাহলে কিন্তু কালকে আমি ছেলেটাকে চিনলেও তোদেরকে দেখাবো না। আমার সঙ্গে ভালো আচরণ কর। আমি তোদের বড় বোন।’
এরপর দুজনেই খানিকটা নরম হলো। মিকি ফিসফিস করে বললো, ‘আপু, তুমি কি শিওর ওই ছেলে আমাকে পছন্দ করেছে? ঝিকিকে করে নাই?’
‘তোকেই করেছে।’
‘ও কিভাবে আমাদের নাম জানলো? আমরা দুইবোন সেইম ড্রেস পরেছিলাম। আমাদেরকে বাড়ির মানুষই আলাদা করতে পারেনা, সেখানে ও কিভাবে পারবে?’
‘উফফ, এত কৈফিয়ত দিতে পারবো না। ওর সঙ্গে কথা হলে ওকেই জিজ্ঞেস করিস কিভাবে তোকে আলাদা করেছে। যারা মনের মানুষ তারা সব পারে। শুধু একটা, তোর হাজারটা কপির ভেতরেও তোকে আলাদা করতে পারবে যে এটাই মিকি।’
মিকিকে দেখলাম লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। ওরে লজ্জা রে! এদিকে আমি বিবাহের আলাপ ঠিক হবার পরেও এত লজ্জা পাইনি। এজন্যই বাবরিওয়ালা বলেছে আমার মাঝে মেয়েলী স্বভাব নাই!
মেয়েলী স্বভাবের দেখেছো কি? কালকে দেখাবো মেয়েলী স্বভাব কাকে বলে। শাড়ি পরে এমন সাজ দিবো, মাথা ঘুরে উলটে পড়ে যাবা তুমি। শুধু তাই না, এখন থেকে বড়দের মতো আচরণও করবো।
চলবে..
লেখা: মিশু মনি
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১০
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২