নির্লজ্জ_ভালোবাসা
লেখিকাসুমিচোধুরী
পর্ব ৫৭ (❌কপি করা নিষিদ্ধ❌)
সকালবেলা আরশি আর মিনহা চৌধুরী ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর শান্ত চৌধুরীও নিচে নেমে এসে নিজের নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। তার কিছু পরেই শিহাবকে দেখা গেল, সে নিজের শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে গম্ভীর মুখে এসে ডাইনিং টেবিলে বসল। আরশি বরাবরের মতো আজও সবাইকে খাবার সার্ভ করতে শুরু করল। শিহাব খাওয়া শুরু করতেই মিনহা চৌধুরী আরশির উদ্দেশ্যে বললেন।
“মা, শিহাবকে হাঁসের মাংস দাও। ও হাঁসের মাংস বেশ পছন্দ করে।”
শাশুড়ির কথা শুনে আরশি বাটিটা হাতে নিয়ে শিহাবের পাতে মাংস তুলে দিতে গেল। ঠিক তখনই অসাবধানতাবশত কিছুটা তরকারি ছলকে শিহাবের হাতের ওপর পড়ে গেল এবং তার শার্টের হাতা নষ্ট হয়ে গেল। শিহাবের এমনিতেই অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছিল, তার ওপর আরশির এই কাণ্ড দেখে সে মেজাজ হারিয়ে ফেলল। আরশি লজ্জিত মুখে সরি বলার জন্য মাত্র মুখ খুলেছে, তার আগেই শিহাব আরশির গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। রাগে ফেটে পড়ে সে চেঁচিয়ে বলল।
“মন কোথায় থাকে তোমার? দেখে কাজ করতে পারো না?”
ডাইনিং টেবিলের শান্ত পরিবেশ মুহূর্তেই থমকে গেল। মিনহা চৌধুরী আর শান্ত চৌধুরী পাথর হয়ে বসে রইলেন। আরশি থাপ্পড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ধরা গলায় সে বলল।
“আসলে আইম সরি, ভুল করে হয়ে গেছে।”
শিহাব আরও হিংস্র ভঙ্গিতে গর্জে উঠে বলল।
“তুমি জানো আমার এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে তুমি আরও ঝামেলা পাকিয়ে দিলে। আচ্ছা, তুমি কি আমার জীবনে শুধু ব্যাঘাত ঘটাতেই এসেছ? একটা না একটা ঝামেলা তুমি করেই ছাড়ো। কখনো বিরক্ত করো, কখনো কাজে বাধা দাও। এসবের মানে কী? শোনো আরশি, আমার আর এসব ভালো লাগছে না। আমাকে একটু শান্তি দাও, আমি শান্তি চাই। জীবনটা আমার বড্ড অসহ্য লাগছে এখন।”
বলেই শিহাব রাগে টেবিলের নিচে একটা লাথি মারল। খাওয়া ফেলে রেখে সে গটগট করে রুমে গিয়ে শার্ট চেঞ্জ করল এবং কোর্ট হাতে নিয়ে না খেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছন থেকে মিনহা চৌধুরী অনেক ডাকলেন, কিন্তু সে একবার ফিরেও তাকাল না। মিনহা চৌধুরী ব্যথিত মনে আরশির কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
“মা, তুমি কষ্ট পেও না। ছেলেটা আমার রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ও আসলে বুঝতে পারছে না কী করছে।”
আরশির চোখের কোণ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। সে তাড়াতাড়ি ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলল।
“না মা, আমি কিছু মনে করিনি। আমি বুঝতে পারছি তার মনের অবস্থা।”
শান্ত চৌধুরীও আরশির পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্নেহের পরশে তার মাথায় হাত রেখে শান্ত স্বরে বললেন।
“কষ্ট পেও না মা। সময় হলেই আমার ছেলেটা সব বুঝবে। একটু ধৈর্য ধরো মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আরশি মাথা নেড়ে কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে রুমে চলে এল। দরজার আড়ালে আসতেই তার দীর্ঘদিনের চেপে রাখা ধৈর্যের বাঁধটা মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সে ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বুকের ভেতরটা তীব্র কোনো যন্ত্রণায় যেন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। বারবার তার মনে হতে লাগল, ভুলটা কি সে সত্যিই ইচ্ছা করে করেছে যার জন্য সবার সামনে তাকে এভাবে লাঞ্ছিত হতে হলো?
মিনহা চৌধুরী আরশির মনের সেই হাহাকারটুকু বুঝতে পারলেন। তিনি ধীর পায়ে রুমে ঢুকে দেখলেন আরশি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে অসহায়ভাবে কাঁদছে। তিনি বুকভরা মমতা নিয়ে আরশির সামনে বসলেন এবং নিজের কম্পিত দুই হাতে তার চোখের তপ্ত জল মুছে দিয়ে অত্যন্ত নরম সুরে বললেন।
“বললাম না মা কষ্ট পেও না। আমার ছেলেটার রাগ উঠলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তুমি তার ওই কটু কথায় কিছু মনে নিও না মা।”
আরশি এবার ডুকরে কেঁদে উঠে মিনহা চৌধুরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার কান্নার তোড়ে কথাগুলো যেন আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। সে বলতে লাগল।
“ও মা, আপনার ছেলে কেন আমায় ভালোবাসে না? আমি কি মেয়ে হিসেবে সত্যিই এতই অপয়া আর খারাপ? আমাকে কি একবিন্দু ভালোবাসা যায় না মা? একটু ভালোবাসলে কি আপনার ছেলের রাজত্ব কমে যাবে নাকি কোনো ক্ষতি হবে? আমি তো দুনিয়ার অন্য কোনো ঐশ্বর্য চাই না মা, শুধু তার একটুখানি ভালোবাসার কাঙাল আমি। তাহলে সে আমাকে প্রতি পদে পদে এভাবে কেন আঘাত দেয়? ভালোবাসার কি কোনো দাম নেই এই পৃথিবীতে? ভালোবাসাটা কি সত্যিই এতটাই যন্ত্রণার আর কষ্টকর হয়?”
মিনহা চৌধুরী নির্বাক হয়ে গেলেন। আরশির এই বুকফাটানো আহাজারির কোনো সান্ত্বনা তার কাছে ছিল না। তিনি শুধু নিঃশব্দে পাথর হয়ে আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আরশির প্রতিটি ফোঁটা চোখের জল যেন সেই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে এক অবহেলিত ভালোবাসার করুণ উপাখ্যান লিখে দিচ্ছিল।
দুপুরের রোদটা ফিকে হয়ে এসেছে। আরশি ব্যালকনির কোণে চুপচাপ বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সকাল থেকে পেটে একটা দানাও পড়েনি। মিনহা চৌধুরী অনেকবার সাধাসাধি করেছেন, জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তার বুকের ভেতরের হাহাকারটা যেন সব খিদে কেড়ে নিয়েছে।
আকাশের মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে আরশি নিজের অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে উঠল। তার করুণ সুর ব্যালকনির বাতাসে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দিল।
~নাগর আমার নিঠুর বড় মন ও বুঝে না~
~আমার ভাঙা খাঁচা পড়ে আছে সে তো আসে না~
~পুড়া মনে ভালোবাসা বাসা বাঁধে না~
~পুড়া মনে ভালোবাসা বাসা বাঁধে না~
গানটা গাইতে গাইতে আরশির কণ্ঠ বুজে এল। শেষ হতেই আবারো কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ কাঁধের ওপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আরশি চমকে উঠে পেছনে তাকাল। দেখল মিনহা চৌধুরী আর্দ্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি পরম মমতায় আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
“যাও তো মা, ঝটপট রেডি হয়ে নাও।”
আরশি অবাক হয়ে চোখের জল মুছে বলল।
“কেন মা? কোথাও যাবেন নাকি?”
মিনহা চৌধুরী মুখে একটা ম্লান হাসি ফুটিয়ে বললেন।
“হুম। তোমার শ্বশুর হঠাৎ বললেন বাড়িতে আর ভালো লাগছে না। চলো না তুমি আর আরশি মা মিলে আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”
আরশি কিছু একটা বলতে চাইল, হয়তো মানা করত। কিন্তু তার আগেই মিনহা চৌধুরী কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন।
“খবরদার! আর একটা কথাও বলবা না। আমাদের সাথে যাবে মানে যাবে, ব্যাস। যাও এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো তৈরি হও।”
শেষমেশ আরশি আর না করতে পারল না। মিনহা চৌধুরী তাকে রেডি হতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আসলে এই পুরো বিষয়টাই ছিল মিনহা চৌধুরী আর শান্ত চৌধুরীর সাজানো পরিকল্পনা। সকালের সেই তিক্ত ঘটনার পর আরশির বিধ্বস্ত চেহারা দেখে তাদের মন কাঁদছিল। তারা চাইলেন মেয়েটাকে একটু বাইরের জগৎ থেকে ঘুরিয়ে আনতে যাতে তার মনটা কিছুটা হলেও হালকা হয়। এই পাথুরে সংসারে এমন হিরের মতো শ্বশুর-শাশুড়ি পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
খান বাড়ি,,,
তুরা নিচ থেকে হালকা মেজাজে নিজের রুমে ঢুকেই দেখল রৌদ্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি হচ্ছে। আজ তার নীল শার্টের সাথে গাঢ় রঙের টাইটা বেশ মানিয়েছে, কিন্তু টাইয়ের গিঁটটা একদম অগোছালো হয়ে ঝুলে আছে। তুরা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য উপভোগ করল, তারপর ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল।
“এই যে মিস্টার লম্বু, আয়নায় নিজেকে অত না দেখে টাইটার দিকে একটু তাকান। টাই তো না, মনে হচ্ছে গলায় দড়ি ঝুলিয়ে রেখেছেন!”
তুরার কথা শুনে রৌদ্র আয়না থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি তার দিকে ফিরল। এক পা দু পা এগিয়ে এসে তুরার একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলল।
“তো ম্যাডাম, আপনার মতো একজন গুণবতী স্ত্রী থাকতে এই মিস্টার লম্বুকে কি নিজের হাতে টাই বাঁধতে হবে? আপনার উচিত না আপনার হাসবেন্ডের টাইটা ঠিক করে দেওয়া?”
তুরা এবার একটু এগিয়ে এল। চট করে টাইয়ের দুই মাথা ধরে সজোরে একটা টান দিয়ে ফাঁসের মতো করে বলল।
“হুম, আমার তো মনে হয় আপনাকে এইভাবে টাই দিয়ে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলা বেশি উচিত।”
রৌদ্রের চোখেমুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, বরং সে ঝুকে এসে হাসতে হাসতে বলল।
“ওকে ম্যাডাম, আপনার সেই শখটাই বা বাকি থাকে কেন? মেরেই ফেলুন না এখনই!”
তুরা প্রথমে মজা করেই ফাঁসটা একটু বেশি জোরে টেনে ধরল। রৌদ্রের দম যেন আটকে আসছিল, সে যন্ত্রণায় একটু উপরের দিকে মুখ তুলে ফেলল। রৌদ্রের সেই অবস্থা দেখে তুরার বুকটা মুহূর্তেই কেঁপে উঠল। সে তড়িঘড়ি করে টাই ছেড়ে দিয়ে ব্যাকুল হয়ে বলল।
“সরি! সরি রৌদ্র! আমি আসলে মজা করছিলাম। খুব বেশি কি লেগেছে? আমি ইচ্ছা করে করিনি।”
রৌদ্র এবার তুরার থুতনিটা আলতো করে উঁচিয়ে ধরে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসিটা দিল। তার চোখের গভীরতা যেন তুরাকে গিলে খেতে চাইছে। সে মায়াবী স্বরে বলল।
“সরি বলছিস কেন পাগলী? তুই মারতে চাইলে আমি যে হাসিমুখে চোখ বন্ধ করে মরতে রাজি। তোর হাতে মৃত্যু হলেও তো সেটা আমার জন্য সার্থকতা।”
তুরার বুকের ভেতরটা রৌদ্রের এমন উত্তরে তোলপাড় করে উঠল। সে আর কথা না বাড়িয়ে ধীরস্থিরভাবে রৌদ্রের খুব কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। অতি পরম যত্নে টাইয়ের গিঁটটা নিখুঁতভাবে বাঁধতে বাঁধতে মাথা নিচু করেই আদুরে গলায় বিড়বিড় করে বলল।
“ভালোবাসা।”
রৌদ্র তুরার সেই নিচু স্বরে বলা শব্দটা শুনতে পেল। সে তুরার কানের কাছে মুখ নিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল।
“তোর ভাবনার চেয়েও অনেক বেশি।”
টাই বাঁধা শেষ হতেই রৌদ্র তুরার মাথাটা দুই হাতে আগলে ধরল। তারপর তার কপালে গভীর ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দিল। তুরার চোখের পাতায় তখনো আবেশ লেগে আছে। রৌদ্র এক টুকরো মুচকি হাসি দিয়ে কোর্ট টা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর তুরা সেই আবেশ মাখা কপালটা ছুঁয়ে সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তিথি রুমে ঢুকেই দেখল আয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব যত্ন করে চুলে জেল দিচ্ছে। পরনে কুচকুচে কালো রঙের শার্ট, যার হাতা দুটো কনুই পর্যন্ত গুটানো। কবজিতে দামী ঘড়িটা তার হাতের গঠনকে আরও বলিষ্ঠ করে তুলেছে। আয়ানকে এই লুকে এতটাই আকর্ষণীয় লাগছে যে তিথি না চাইতেও কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
আয়ান হঠাৎ আয়নায় খেয়াল করল তিথি মুগ্ধ চোখে তাকে দেখছে। মুহূর্তেই তার মুখে একটা বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল। সে শার্টের কলারটা একটু টেনে, বেশ একটা ভাব নিয়ে বলল।
“আজকাল মনে হয় বউয়ের আদরে বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছি। তাই তো বউ আমাকে আড়ালে দাঁড়িয়ে এভাবে চুরি করে করে দেখে।”
আয়ানের এই আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস দেখে তিথির খুব মজাই লাগল। সে সাথে সাথে নিজের মুগ্ধতা ঝেড়ে ফেলে একটা মুচকি হাসি দিল। তারপর মুখটা একটু ভেংচি কেটে আয়ানের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
“আয়ান ভাইয়া, সত্যি বলছি তোমাকে না আজকে হেব্বি সুন্দর লাগছে। একদম খাপে খাপ! কিন্তু জানো তোমাকে ঠিক কার মতো লাগছে? ওই যে আমাদের প্রিয় ‘হিরো আলম’, তাকে চেনো? একদম পুরাই তার মতো আগুন! আমার তো মনে হচ্ছে তুমি হিরো আলমের একদম কার্বন কপি। তোমরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়ালে দুনিয়ার সব মানুষ বলবে তোমরা একদম যমজ ভাই।”
তিথির মুখে নিজের সাথে হিরো আলমের তুলনা শুনে আয়ানের হাতের চিরুনিটা যেন হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তার সারা সকালের গাম্ভীর্য আর স্টাইল এক নিমিষেই ধুলোয় মিশে গেল। সে কপাল কুঁচকে বিষম খাওয়ার মতো করে বলল।
“কী বললি তুই? আমি হিরো আলমের মতো দেখতে’ তার মানে আমাকে তোর হিরো আলমের মতো দেখতে মনে হয়?।”
তিথি এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল।
“হ্যাঁ গো! বিশ্বাস করো, আমি তো ভাবছি তোমার এই হিরো আলমের মতো লুকটা দেখে যাতে মানুষ নজর না দেয়, তাই তোমার কপালে একটা নজর ফোঁটা দিয়ে দেব কি না। তাহলে একদম ষোলকলা পূর্ণ হবে।”
আয়ান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হাতের চিরুনিটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরল যেন ওটা এখনই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। সে তপ্ত দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
“পেত্নির বাচ্চা! তুই আমার মতো একটা ছেলেকে হিরো আলমের সাথে তুলনা করলি? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। তোর ওই লম্বা চুলগুলো আজ আমি কেঁচি দিয়ে এমনভাবে কেটে দেব যে আয়নায় নিজেকে দেখলে মনে হবে কোনো ন্যাড়া ডাইনি দাঁড়িয়ে আছে। তখন বুঝবি কার যমজ ভাই আমি।”
আয়ান এক পা এগোতেই তিথি বাতাসের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আয়ানও দমবার পাত্র নয়, সেও পিছু নিল। শুরু হলো বাড়িতে এক চোর-পুলিশ খেলা। দৌড়াতে দৌড়াতে তিথি সোজা ছাদে উঠে পড়ল, পেছনে বাঘের মতো আয়ান। ছাদের রেলিং ঘেঁষে তিথি যখন মরিয়া হয়ে বাঁচার পথ খুঁজছে, ঠিক তখনই আয়ান এক ঝটকায় তার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নিল। তিথি ভয়ে আর ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে আর্তনাদ করে উঠল।
“আ-আ-আয়ান ভাই, বিশ্বাস করো আমি জাস্ট মজা করছিলাম। তোমাকে দেখে আমার ভীষণ হিংসা হচ্ছিল, তাই ওই কথা বলেছি। তুমি তো দুনিয়ার সবথেকে হ্যান্ডসাম হিরো, প্লিজ আর রাগ করো না, এবারের মতো ছেড়ে দাও।”
আয়ান তিথির ঘাম ভেজা, লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বাঁকা করে হাসল। সে একবার তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল অফিসের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। হাতে সময় কম, তাই মোক্ষম দাওয়াইটা এখনই দিতে হবে। আয়ান এক নিমিষেই তিথিকে নিজের বুকের সাথে পিষে ফেলল। তার এক হাত তিথির ঘাড়ের কাছে শক্ত হয়ে বসল। তিথির কাঁধ থেকে জামার কাপড়টা অবহেলায় একটু নিচে নামিয়ে দিয়ে সেই দুধে-আলতা নগ্ন কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়াল আয়ান। তিথি আবেশে আর অজানিত আশঙ্কায় শিউরে উঠল। কিন্তু পরের মুহূর্তেই আয়ান সেখানে বুনো হিংস্রতায় দাঁত বসিয়ে গভীর এক কামড় দিল।
“আহহহহ! আয়ান!” তিথি যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল।
আয়ান তিথির কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে খুব নিচু আর গম্ভীর স্বরে ফিসফিস করে বলল।
“তুই যত বেশি ভুল করবি, আমার কাছ থেকে তত বেশি রোমান্স বোনাস পাবি। তুই কি ভেবেছিস সেই আগের মতো ভুল করলে তোকে চড়-থাপ্পড় মারব? একদম না মিসেস আয়ান। এখন থেকে তোর প্রতিটি অন্যায়ের শাস্তি হবে আমার এই পাগলাটে ভালোবাসায়। আবার রাতে দেখা হবে এই পাগলামি আদ’র নিয়ে গেট রেডি ফর দ্যাট মিসেস তিথি খান।”
বলেই আয়ান তিথিকে আলতো একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তারপর নিজের শার্টের কলারটা ঠিক করে, চুলে হাত বুলিয়ে একদম সিনেমার হিরোর মতো গটগট করে ছাদ থেকে নেমে গেল। তিথি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে কাঁধের কাপড়টা ঠিক করল। সে আয়ানের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রাগে আর অপমানে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল।
“অসভ্য! আস্ত জানোয়ার একটা। কোনো দিন মনে হয় মাংস খাই নাই এখন আমারটা খেয়ে খেয়ে দুযোগ ভরতেছে।”
বিকেল গড়িয়ে আকাশটা কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে, যেন কোনো অশুভ সংকেত দিচ্ছে। আরশি, শান্ত চৌধুরী আর মিনহা চৌধুরী আজ সারা শহর ঘুরেছেন। আরশির মলিন মুখে অনেক দিন পর হাসি ফুটেছে, সকালের সেই থাপ্পড়ের অপমান আর বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কষ্টগুলো যেন বিকেলের হাওয়ায় কিছুটা হালকা হয়ে গিয়েছে। তারা তিনজন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে যখন হাসাহাসি করছিল, তখন আরশির চোখ পড়ল রাস্তার ওপারে একটা আইসক্রিম ভ্যানের ওপর। সে উজ্জ্বল চোখে শান্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল।
“বাবা, আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি ওইপার থেকে আইসক্রিম নিয়ে আসছি। আজ বড্ড গরম লাগছে, আইসক্রিম খেলে মনটা আরও শান্ত হবে।”
শান্ত চৌধুরী পরম মমতায় বললেন।
“আচ্ছা মা যাও, তবে খুব সাবধানে রাস্তা পার হইয়ো।”
আরশি খুশিতে আটখানা হয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে তিনটে আইসক্রিম কিনল। হাত ভর্তি আইসক্রিম নিয়ে সে যখন তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে রাস্তার মাঝখানে পা দিল, ঠিক তখনই যমদূতের মতো এক কালান্তক প্রাইভেট কার তীব্র গতিতে এসে তাকে পিষে দিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে আরশির শরীরটা শূন্যে কয়েক হাত ওপরে উঠে অনেকটা দূরে আছড়ে পড়ল। ধাক্কাটা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে তার পেট ফেটে গলগল করে তাজা রক্ত পিচঢালা রাস্তায় নদীর মতো বয়ে যেতে লাগল। আইসক্রিমগুলো ছিটকে পড়ে ধুলোয় মিশে গেল। শান্ত চৌধুরী আর মিনহা চৌধুরী কলিজা ফাটানো এক আর্তনাদ করে উঠলেন।
“আরশিইইইইই! মা আমার!”
মুহূর্তে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। উৎসুক মানুষের ভিড় জমল সেই নিথর দেহটার চারপাশে। আরশি বুঝতে পারছে তার প্রতিটি নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, শরীরটা অবশ হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে অন্ধকার নেমে আসছে। সে তার শরীরের অবশিষ্ট শেষ বিন্দু শক্তি দিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, যা কেবল তার ভাঙা হৃদয়ের আর্তনাদ হয়েই ঝরছিল।
“মামা বাবা তোমাদের সাথে শেষবার একটা দেখা হলো না গো। বড় ভাইকেও দেখতে পারলাম না। মা, বাবা তোমাদের এই মেয়েটা হয়তো সত্যিই বড্ড অপয়া ছিল, তাই তো যাওয়ার বেলাতেও আপন মানুষগুলোর মুখ দেখার সৌভাগ্য হলো না। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে উফফ, বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে! আল্লাহ, আমি কি এতটাই পাপী ছিলাম যে শেষবেলায় একটু শান্তিও পেলাম না?শিহাব ও শিহাব আমার আর্তনাত শুনতে পাচ্ছেন,আমার না বড্ড ইচ্ছে ছিল আপনার হাত ধরে এই জীবনটা পার করে দেব,খুব বেশি ইচ্ছে ছিল আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর, ইচ্ছে ছিল দুজনে মিলে ছোট্ট একটা ঘর সাজানোর। কত স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম এই ছোট্ট মনে আপনার পাশে ঘুমাব, আপনার জন্য সকালের নাস্তা সাজাব, আপনার এক চিলতে হাসির জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করব। কিন্তু আপনি আমায় বুঝতে দিলেন না। এই জীবনে আপনার সাথে একটু শান্তিতে বাঁচার অনেক ইচ্ছে ছিল শিহাব, সেই ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেল? আপনি আজ আমায় মেরেছিলেন, কিন্তু আমি তো রাগ করিনি। আমি তো শুধু আপনার একটুখানি ভালোবাসা চেয়েছিলাম। একটু ভালোবাসলে কি খুব ক্ষতি হতো আপনার?তিন কবুলের সেই বন্ধনটা কি এতটাই ঠুনকো ছিল যে এক মুহূর্তের জন্য আমায় মায়া করলেন না? শিহাব আমি আজ সব আফসোস আর আপনার ওপর এক বুক ভালোবাসা নিয়ে চলে যাচ্ছি। আপনি আপনার শান্তি খুঁজে নিয়েন। আমাকে ছাড়া যদি আপনি শান্তিতে থাকেন, তবে তাতেই আমি শান্তি। তবে ওপারে দাঁড়িয়ে আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করব,ওপারে যেন আল্লাহ আপনাকে আমাকেই দেন। আমি আপনাকে বড্ড ভালোবাসি শিহাব বড্ড ভালোবাসি। আই লাভ ইউ সো মাচ।”
আরশির কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল। শেষবারের মতো এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তার নিস্পন্দ দেহটা রাস্তার মাঝখানে এলিয়ে পড়ল। তার খোলা চোখের কোণ দিয়ে শেষ এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল। আইসক্রিমগুলো রোদে গলে যাচ্ছে, আর সেই রক্তের পুকুরে পড়ে রইল এক অবহেলিত স্ত্রীর না বলা হাজারো অভিমান আর ভালোবাসার গল্প।
রানিং…!
Share On:
TAGS: নির্লজ্জ ভালোবাসা, সুমি চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৮
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৯
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৫
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা সূচনা পর্ব
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৪
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১৯
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৪