তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব_২৪
প্রিমাফারনাজচৌধুরী
পরদিন তাজদার শাইনাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিয়েছে। রওশনআরা নীরবে সম্মতি দিয়েছে। তাজদার মায়ের মনখারাপ বুঝতে পেরেছিল তাই কথা দিয়েছে একদিন আগে সে ফিরে আসবে। বাড়ির সবার সাথে সময় কাটাবে। এমনকি তার মামার বাড়িতে গিয়েও ঘুরে আসবে। তখন রওশনআরা খুশি হয়েছিল।
আকাশপথের সংক্ষিপ্ত যাত্রা শেষে তারা যখন ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামল, তখন বিকেলের রোদেলা আকাশটা কিছুটা মলিন হয়ে এসেছে। চট্টগ্রাম থেকে বিমানে আসায় ক্লান্তি খুব একটা হয়নি, তবে শাইনার চোখেমুখে এক ধরণের মুগ্ধতা ছিল। মেঘের ওপর দিয়ে ওড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা সে নিজের অজান্তেই বারবার তাজদারের কাছে গল্প করছিল।
তাজদার চুপচাপ তার এক্সাইটমেন্ট দেখছিল। আর মনে মনে ভাবছিল ইউকে গিয়ে যখন সেখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো সে দেখবে তখন তার উত্তেজনা কেমন হবে। যদিও এইবার সম্ভব না। তার চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল শেষ হওয়ার পর ইনশাআল্লাহ।
বিমানবন্দর থেকে তাজদারের ব্যক্তিগত গাড়ি তাদের নিয়ে রওনা দিল গুলশানের উদ্দেশ্যে। যানজট ঠেলে যখন তারা গুলশানের অভিজাত সেই বাড়িতে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
ফ্ল্যাটের লিফট থেকে বের হয়ে তাজদার যখন চাবি দিয়ে দরজা খুলল, শাইনা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিশাল ড্রয়িং রুম, কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরের শহরের আলোকসজ্জা দেখা যাচ্ছে। সাজানো-গোছানো আধুনিক ঘরটি তার কাছে একদম রূপকথার মতো মনে হলো।
তাজদার দরজা খুলে বলল,”ওয়েলকাম শাইনা মমতাজ! আপনার শাহজাহান আপনার জন্য ছোট্ট একটা রাজমহল বানিয়ে রেখেছে।”
শাইনার কোলে বাবু তখনো ঘুম। সে বাবুকে বুকের সাথে ধরে চারপাশে তাকালো। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “থ্যাংকস।”
“মোস্ট ওয়েলকাম।”
তাজদার হালকা মাথা নুইয়ে তার ধন্যবাদ গ্রহণ করে ভেতরে যেতে বললো।
শাইনা মেয়েকে বিছানায় রেখে এসে ধীরপায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। নিচে গুলশানের ব্যস্ত রাস্তা, নামি-দামি সব রেস্তোরাঁ আর মানুষের আনাগোনা। চট্টগ্রামের সেই শান্ত স্নিগ্ধতা এখানে নেই যদিও।
তাজদার পাশ থেকে বলল, “ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি ডিনারের অর্ডার দিচ্ছি। আজ বাইরে যাচ্ছি না।”
শাইনা তার দিকে ফিরলো। তারপর মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। তার এখানে ভালো লাগছে। বড় আম্মুকে তার ছেলে কথা দিয়ে এসেছে একদিন আগে ফিরে গিয়ে পরিবারের সাথে সময় কাটাবে। সেই দায়িত্ববোধই শাইনাকে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি দিচ্ছে। নইলে এখানে এসেও তার টেনশনে থাকতে হতো ওরা তাকে কি ভাবছে এই ভেবে। তার অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করার এই রোগটা কবে দূর হবে সে জানে না। এইসব ভাবতে সে হঠাৎই খেয়াল করলো তাজদার সিদ্দিকী আজও ব্লু রঙা শার্ট পরেছে। এটা আগেরটা না। অন্য ডিজাইনের। ফর্সা গায়ে ডার্ক ব্লু শার্টে এত মানিয়েছে! আর কতগুলো ব্লু রঙা শার্ট আছে? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সে করলো না। সে কেমন বউ বরের কতগুলো শার্ট আছে জানে না।
শাইনার মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই ডোরবেলের শব্দ শোনা গেল। তাজদার তখন ফোনে খাবারের অর্ডার দিচ্ছিল, শাইনা অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকাল।
তাজদার ইশারায় শাইনাকে ভেতরে যেতে বলে নিজেই দরজা খুলল। দরজার ওপাশে মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা, তার পেছনে দুজন তরুণী দাঁড়িয়ে। সবার হাতেই কোনো না কোনো গিফট বক্স বা খাবারের প্যাকেট।
"কেমন আছ বাবা? নুভা, তিতলি কেউ আসেনি?"
"না আন্টি। আপনাদের নাতনি আর তার মা এসেছে। আসুন। কেমন আছেন?"
"আছি আলহামদুলিল্লাহ।"
"এই তোমাদের কি খবর?"
মেয়েদুটো লজ্জা পেয়ে গেল। ভদ্রমহিলা বেশ আন্তরিকতার সাথে ভেতরে ঢুকলেন।
"নিচ থেকে গার্ডের কাছে শুনলাম তোমরা এসেছো। তোমার আম্মা যদিও ফোন করে বলেছিলেন তোমরা আসতে পারো। কিন্তু আমি তেমন বিশ্বাস করিনি। তো হুট করে দেশে ফিরলে যে?"
তাদের কথাবার্তার মাঝে শাইনা পর্দার আড়াল থেকে ধীরপায়ে সামনে আসতেই সবার দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হলো। তাজদার পরিচয় করিয়ে দিল,
"শাইনা মমতাজ। আর শাইনা ইনি আমাদের ওপরের তলার ফ্ল্যাটের রেশমা আন্টি। আর এরা ওনার দুই মেয়ে। প্রীতু আর তুলি।"
রেশমা বেগম মুগ্ধ চোখে শাইনার দিকে তাকালেন। শাইনা উনার সাথে অল্পতেই গল্প জমিয়ে দিল। রেশমা আন্টি নিজের হাতে বানানো অনেক বড়ো একটা পুডিং আর কিছু ফলমূল আর বাবুর জন্য ড্রেস নিয়ে এসেছেন।
পাশের ফ্ল্যাট থেকে মিস্টার তপন আর তার স্ত্রীও চলে এলেন। তারা সবাই এই অ্যাপার্টমেন্টের পুরনো বাসিন্দা। তাজদার ব্যাচেলর থাকাকালীন সেভাবে কারও সাথে মেশার সুযোগ পায়নি। কিন্তু শাইনার আগমনে সবাই একটু বাড়তি আগ্রহ নিয়ে দেখা করতে এসেছে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ছোটখাটো একটা আড্ডা জমে উঠল। শাইনা কিছুটা লাজুক হলেও সবার আন্তরিকতায় দ্রুতই সহজ হয়ে গেল।
এরই মধ্যে তাজনাকে নিয়ে আসতেই প্রীতু আর তুলি হুমড়ি খেয়ে পড়ল। "আল্লাহ! এত কিউট বাবু! একদম তাজ ভাইয়ার মতো নাক পেয়েছে তো।"
তাজদার দেখল শাইনার যে দ্বিধা আর জড়তা ছিল প্রতিবেশীদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আনাগোনায় তা মুহূর্তেই কেটে গেছে। সে মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচল। ঢাকার এই ব্যস্ত জীবনেও যে মানুষ এতটা আপন হতে পারে সেটা শাইনার জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সবার হাসাহাসি আর খোশগল্পে ফ্ল্যাটটি প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল। তাজনারও আনন্দের শেষ নেই। যদিও তার সবার সাথে সহজে মিশে যাওয়ার স্বভাব আছে। কার স্বভাব পেয়েছে এটা নিয়ে সে আর শাইনা দুজনেই সন্দিহান।
শাইনার ছোটোবেলায় এই স্বভাবটা ছিল। সবার সাথে মিশতো। সবার ঘরে যেত। মান অপমান বুঝতো না অতটা। বড়ো বড়ো হতে সে অনেকটা সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। আর তাজদার ছোটোবেলা থেকেই একগুঁয়ে ছিল। সহজেই কারো সাথে মিশতে না। হাতেগোনা কয়েকটা কাজিন আর বন্ধু ছিল তার। বন্ধুত্ব করতো মানুষ বেছেবেছে। এখন যদিও নেটওয়ার্কিং আর সোশ্যাল কমিউনিকেশনের কারণে তার অনেক পরিচিত বেড়েছে কিন্তু আগে এতটাও ছিল না। তাই তাজনা বাবার স্বভাব পেয়েছে বললে ভুল হবে।
রেশমা আন্টি তাদের ডিনারের দাওয়াত করলো। তাজদার তা বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিল। রেশমা আন্টিও জোরাজোরি করলো না। উনি ডিনারের প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি। সৌজন্যেতার খাতিরে বলা দরকার তাই বলেছে। কিন্তু আগামীকাল তাদের লাঞ্চ ওখানেই করতে হবে এমন ওয়াদা করে ফিরে গেলেন। ও হ্যাঁ এরিমধ্য আরও কয়েকটা দম্পতি দেখতে এসেছে খাবার-দাবার আর বাবু আর বউয়ের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে। শাইনা এটুকুতেই বুঝলো বাড়িওয়ালা হিসেবে বড় আব্বু হয়তো আন্তরিক মানুষ। তাই সবাই তাদের সাথে সবাই এত আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন।
~~
কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরের কাউন্টারে রাখা বড় বড় কয়েকটা ব্যাগ খুলতেই তাজদার আর শাইনা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। শাহিদা বেগম যে ভেতরে ভেতরে এত আয়োজন করে রেখেছেন সেটা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কয়েক কেজি আটা, ময়দা, দুই লিটারের তেলের বোতল, এমনকি কয়েকটা গায়ে মাখার সাবান আর শ্যাম্পুর প্যাকেটও! শাহিদা বেগম হয়তো ভেবেছেন জামাই-বউ ঢাকা গিয়ে হুট করে কোথায় এসব খুঁজবে তার চেয়ে ঘর থেকে গুছিয়ে দেওয়াই ভালো।
তাজদার একটা সাবানের প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল, ” সিরিয়াসলি! গুলশানে দোকানপাট নেই? নাকি আমরা কোনো গহীন জঙ্গলে সংসার পাততে যাচ্ছি?”
শাইনা আটার প্যাকেটটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “ভালোই হয়েছে। কাল সকালে অর্ডার করতে হবে না কিছু।”
হাসাহাসি আর কথাবার্তার মাঝেই ডেলিভারি বয় খাবার নিয়ে এল। বিফ বিরিয়ানি আর কাবাবের ম ম গন্ধে ড্রয়িং রুম ভরে উঠল। তাজদার খাবারগুলো টেবিলে সাজাতে সাজাতে বলল,
“লিসেন শাইনা মমতাজ আম্মা যেহেতু এত কষ্ট করে আটা পাঠিয়েছেন। কাল সকালে কিন্তু আমি গরম গরম হাতরুটি খাব। কোনো এক্সকিউজ চলবে না!”
শাইনা সরু চোখে তার দিকে তাকালো।
“আমি ঘরের সমস্ত কাজ জানি। আপনি কি মনে করেছেন আমি কাজবাজ জানিনা?”
তাজদার ইচ্ছে করে বলল,”তেমনই শুনেছি।”
“মানে? রান্নাবান্না একটা ব্যাসিক স্কিল। এটা আমি পারব না আপনি ভাবলেন কি করে? আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি কয়েক মাসে প্রস্তুতি নিয়ে আইইএলটিস দেয়া মেয়ে। আমার স্কোর দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না আমি এত অল্প সময়ে প্রস্তুতি নিয়েছি।”
তাজদার তার গড়গড় করে বলা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে গম্ভীর হয়ে।
মনে হচ্ছে এই প্রথম এই প্রথম তার সাথে কোনো জড়তা ছাড়া, সংকোচ ছাড়া, কোনো মেকি ভাব ছাড়াই এত সাবলীলভাবে কথা বলছে শাইনা মমতাজ। শাইনা কথা বলতে বলতে তার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
তাজদারকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে চুপসে গেল। তাজদার তার দিকে এগোতে এগোতে ঠোঁট উল্টে বলল,
“মেন্টর কে ছিল?”
“মানে?”
শাইনা অবাক হলো। পিছিয়ে যেতে যেতে তার বুক বরাবর হাত ঠেলে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,“ঘরের মানুষের কাছে পড়ে ক’জন এমন স্কোর এনেছে সেটা আগে দেখান।”
তাজদার একচুলও পিছু হটল না। বরং শাইনার হাতটা সুকৌশলে নিজের হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে তাকে চট করে টেনে নিল নিজের আয়ত্তে। শাইনার শ্বাস আটকে এলো। চোখে চোখ রেখে ঠোঁটের কোণে অল্প করে আত্মবিশ্বাসী হাসি ঝুলিয়ে তাজদার বলল,
“মেনে নিলাম স্টুডেন্ট ভালো ছিল। ব্রিলিয়ান্ট ছিল। But remember a brilliant student shines brighter under the right mentor.”
তাজদারের এই অকস্মাৎ আক্রমণে শাইনা কিছুটা হকচকিয়ে গেছে। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানিটা এক লাফে বেড়ে গেল কয়েক গুণ। সে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা না করে বরং স্থির দৃষ্টিতে তাকালো তাজদারের চোখের দিকে।
তাজদার তার মুখের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “স্কোর সবাই দেখেছে। মানলাম। কিন্তু এই স্কোরের পেছনে যার রাতজাগা পরিশ্রম আর শাসন ছিল তার কথা কে বলবে?”
শাইনা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “শাসন না শোষণ, সেটা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে।”
তাজদার হাতের বাঁধন আর একটু শক্ত করে ধরে নিজের দিকে শাইনাকে আরও এক ইঞ্চি টেনে নিল।
“শোষণই সই। তবে এই রেজাল্টের পর রিওয়ার্ডটা কিন্তু আমার পাওনা। সেটা দিতে কিপটেমি করছেন কেন মিসেস সিদ্দিকী?”
শাইনার গাল দুটো মুহূর্তেই রাঙা হয়ে উঠল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল, “আপনার পাওনা মিটিয়ে দেব। তবে আগে হাতটা ছাড়ুন। কেউ দেখে ফেলবে।”
তাজদার ভ্রু নাচিয়ে বলল, “এখানে কেউ নেই এটা ভুলে যাওয়ার ভান করে লাভ হবে না। পাওনা কিভাবে মেটাবেন সেটার প্রসেস সম্পর্কে একটা ডিসকাশন চলুক খেতে খেতে।”
“নো ওয়ে।”
তাজদার কিছু বলতে যাবে তন্মধ্যেই তাজনা কেঁদে উঠেছে। শাইনার ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
তাজদার তাকে ছেড়ে দিয়ে গুরুতর ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল মেয়ের কাছে। শাইনা দাঁড়িয়েই রইলো।
উফ! জান আরেকটু জন্য বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ হঠাৎ মানুষের রূপ পাল্টাতে সে কখনো দেখেনি। গিরগিটি সিদ্দিকী!
শাইনা বিরিয়ানি আর কাবাবগুলো টেবিলে গুছিয়ে রাখল, কিন্তু তার মন পড়ে রইল অন্য কোথাও। ড্রয়িং রুম থেকে তাজনার খিলখিল হাসির শব্দ আসছে। একটু আগে যে বাচ্চাটা কাঁদছিল, বাবার কোলে যেতেই তার কান্না উধাও। তাজদার সিদ্দিকী বাচ্চা সামলাতে বেশ পটু এটা শাইনা স্বীকার করতে বাধ্য।
খাবার টেবিলে বসার পর তাজদার একদম স্বাভাবিক। সে আয়েশ করে বিরিয়ানি মুখে দিয়ে বলল, "এই রেস্তোরাঁটার টেস্ট একদম বদলায়নি। খেয়ে দেখো।"
শাইনা চুপচাপ খেতে শুরু করল। তাজদার হঠাৎ বলল, "কাল লাঞ্চের পর আমরা একটু বেরোব। কিছু শপিং করা দরকার।"
শাইনা বলল, "আমি যাব না।"
তাজদার খাওয়া থামিয়ে শাইনার দিকে তাকাল। তারপর গম্ভীর হয়ে খেতে লাগলো চুপচাপ।
"ওকে।"
শাইনা তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুস্বরে বলল,
"আচ্ছা যাব।"
"যেতে হবে না।"
"যাব।"
"আমিই যাব না।"
শাইনা আর কথা বাড়াল না। এই লোকটার সাথে তর্কে জেতা অসম্ভব। খাওয়া শেষ করে শাইনা যখন প্লেটগুলো সরাচ্ছিল তাজদার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে গেল,
"আমি কাল এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাবো। কোথাও যাচ্ছি না।"
বলেই গটগট পায়ে হেঁটে ভেতরে চলে গেল।
শাইনা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
~~~
রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে গুলশানের বাইরের কোলাহল কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে, কিন্তু শাইনার মনের ভেতর অশান্তিটা কমছে না। তাজদার রাগ করেছে কি না সেটা সে বুঝতে পারছে না। মানুষটা হুট করে যেমন সহজ হয়, পরক্ষণেই আবার বরফের মতো জমে যায়।
শাইনা রান্নাঘর গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখল তাজদার সেখানে নেই। সে ধীরপায়ে বেডরুমে ঢুকল। দেখল তাজনা বড় বিছানার ঠিক মাঝখানে দু হাত ছড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর তাজদার বিছানার এক পাশে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কী যেন টাইপ করছে। চোখে রিডিং গ্লাস, কপালে হালকা ভাঁজ। শাইনা ঘরে ঢোকা সত্ত্বেও সে একবার তাকিয়ে দেখল না।
শাইনা আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেল। ফিরে এসে দেখল তাজদার ল্যাপটপ বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে দিয়েছে। শুধু বেডসাইড ল্যাম্পের মৃদু নীলাভ আলোয় ঘরটা মায়াবী হয়ে আছে। তাজদার পাশ ফিরে শুয়ে আছে। মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছে।
শাইনা বিছানার অন্যপাশে সাবধানে বসল যাতে তাজনার ঘুম না ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর সে তাজদারের পিঠের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ডাকল,
“শুনছেন?”
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া নেই। শাইনা আবার একটু জোরে বলল, “কথা বলবেন না?”
তাজদার এবারও নড়ল না। শাইনার খুব কান্না পেল। সে একটু এগিয়ে গিয়ে তাজদারের কাঁধে হাত রাখল।
“আমি তো যেতে চেয়েছি। আপনি কেন জেদ করছেন?”
তাজদার এবার ঝট করে ঘুরে শাইনার হাতটা ধরে শাইনাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
“আমার জেদ না কি তোমার অবহেলা? আমি চেয়েছিলাম এই কটা দিন তোমাকে আর তাজনাকে নিয়ে একটু নিজের মতো সময় কাটাতে। আর তুমি প্রথমেই বলে দিলে যাব না?”
শাইনা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রইল। কাঁপা গলায় বলল, “সরি।”
সে এই প্রথম সরি বললো কি? আর কখন বলেছে মনে নেই। তাজদার এবার তার কপালে আলতো করে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমার পাওনাটা দিয়ে দাও চটজলদি।”
শাইনা তার বুকে মুখ লুকাল শক্তভাবে। তাজদার হতাশ হয়ে তাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওকে। কাল সকালে হাতরুটি খাইয়ে মিটিয়ে দেবে।"
শাইনা মাথা নেড়ে সায় দিল। তাজদার তার কপালে একটা আলতো চুমু খেয়ে তার মাথায় নিজের মুখ ঠেকিয়ে তাজনার দিকে চেয়ে রইলো। বাইরে তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গুলশানের সেই আধুনিক ফ্ল্যাটের ভেতর এক টুকরো প্রশান্তি আর ভালোবাসা ধীরে ধীরে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে সবে।
~~~
পরদিন সকালে শাইনার ঘুম ভাঙল তাজনার কান্না আর জানালা দিয়ে আসা রোদের ঝিলিক দেখে।
গুলশান হলেও এই অ্যাপার্টমেন্টের চারপাশটা বেশ খোলামেলা। সে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল তাজদার অলরেডি কফি মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোন কথা বলছে। ব্লু নয়, এখন সে পরেছে একটা ছাই রঙের টি-শার্ট। ট্রাউজারের পকেটে এক হাত গুঁজে সে যখন ইংরেজিতে কারও সাথে প্রফেশনাল আলাপ করছিল, শাইনা আড়াল থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
তারপর ঝটপট আটা মেখে গরম গরম ফুলকো রুটি আর ডিম ভাজি তৈরি করার কাজে লেগে গেল।
সে যখন নিপুণ হাতে আটার লেচি কেটে বেলুন-পিঁড়িতে রুটি বেলছিল, তখন রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল তাজদার। কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শাইনার হাতের কাজের ওপর নিবদ্ধ।
শাইনা বুঝতে পারছিল কেউ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে, কিন্তু সে ভান করল যেন সে কিছুই দেখেনি। তাওয়া গরম হতেই রুটিটা ছেড়ে দিল সে। নিমিষেই সেটা ফুলে টইটম্বুর হয়ে উঠল।
তাজদার ভ্রু কুঁচকে খানিকটা মুগ্ধতা নিয়ে বলল, “বাহ! আমি তো ভেবেছিলাম রুটিগুলো ম্যাপের মতো হবে।"
শাইনা রুটিটা নামিয়ে রাখতে রাখতে আড়চোখে তার দিকে তাকাল। মুখে একটা বিজয়ী হাসি ফুটিয়ে বলল, “গোল রুটি বানানোও একটা আর্ট বাবুমশাই।”
তাজদার একটু এগিয়ে এসে কাউন্টারের ওপর কফির মগটা রাখল। তারপর ঠিক শাইনার পাশে দাঁড়িয়ে উনুনের উত্তাপটা অনুভব করতে করতে বলল, “আর্টটা যে ভালোই রপ্ত করেছ সেটা মানতেই হচ্ছে।"
শাইনা কড়াইয়ে ডিম ছাড়ল। তাজদার অপলক কিছুক্ষণ শাইনার রান্নার ভঙ্গি দেখল। শাইনার অবিন্যস্ত চুলগুলো বারবার মুখের ওপর এসে পড়ছিল, সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে বারবার তা সরানোর চেষ্টা করছিল। তাজদার হঠাৎ হাত বাড়িয়ে শাইনার কানের পাশ থেকে অবাধ্য চুলের গুচ্ছটা সরিয়ে দিল। শাইনা থমকে গেল। হাতের খুন্তিটা প্যানেই রয়ে গেল। সে লজ্জা লুকাতে দ্রুত ডিমটা উল্টে দিল। অপ্রস্তুত গলায় বলল, “আপনি গিয়ে টেবিলে বসুন। আমি আসছি।”
তাজদার চট করে এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়ে বলল, “গুড! মেন্টর হিসেবে আমি নিজেকে দশে দশ দিচ্ছি। আমার ভয়েই তুমি এত দ্রুত সব শিখে ফেলেছ।”
শাইনা মুখ ফুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, সব কৃতিত্ব আপনার।"
তাজদার নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়াল।
“তাজনা উঠে পড়ার আগেই আমাদের এই শান্তি বিলাস শেষ করা উচিত। উনি এক্ষুণি উঠে পড়বেন। বলবেন তোমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি?"
শাইনা একা খুব দ্রুত করতে পারছিল না তাই তাজদার এসে তাকে সাহায্য করলো। শাইনা রুটি বেলে দিল। তাজদার সেঁকে নিল। শাইনা রুটি বেলার ফাঁকে তাজদার সিদ্দিকীকে দেখতে লাগলো। চোখ-মুখে কোনো বিরক্তি নেই। বরং এত যত্ন নিয়ে রুটি সেঁকা দেখে মনে হচ্ছে তিনি বেশ উপভোগ করছেন।
~~
দুপুরের দিকে তারা ওপরের তলায় রেশমা আন্টির বাসায় গেল। সেখানে গিয়ে শাইনা অবাক! রেশমা আন্টি এলাহি কারবার সাজিয়ে রেখেছেন। পোলাও, রোস্ট, কাবাব, চিংড়ি, ইলিশ মাছ আরও কত কী! প্রীতু আর তুলি সারাক্ষণ তাজনার সাথে খুনসুটিতে মেতে রইল।
বিকেলের দিকে তাজদার শাইনাকে নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কে গেল। কেনাকাটার ধুম পড়ে গেল। শাইনা বারবার না করা সত্ত্বেও তাজদার এইসেই করে অনেককিছু কিনে ফেললো। এমনকি নিজের হাতে একটা ডার্ক গ্রিন কালারের শাড়ি পছন্দ করল শাইনার জন্য। শাইনা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। আসলেই সুন্দর!
বের হয়ে সে ঝলমলে ঢাকা শহরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হলো জীবনটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের সেই মেয়েটি এখন ঢাকার রাজমহলে। আর খুব শীঘ্রই হয়ত সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপাড়ে।
রাত দশটা। ট্রাভেল কটে তাজনা ঘুমিয়ে পড়েছে। শাইনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনছিল। এমন সময় তাজদার পেছনে এসে দাঁড়াল। হাতে দুটো কফির মগ। শাইনা তার হাত থেকে মগ নিল। চুমুক বসাতে বসাতে আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
“সময়গুলো খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে তাই না?”
“হুম।”
অন্য কোনো ভাবনায় ডুবে থেকে জবাব দিল তাজদার। অথচ শাইনা তার দিকে লম্বা একটা উত্তর আশা করেছিল।
“তারপর আর কখন ফিরবেন?”
“তাজনা স্কুলে পড়ার সময় হয়ে এলে।”
শাইনাকে একটু রাগিয়ে দিতে চায় সে। শাইনা শান্ত হয়ে থাকলে তার ভালো লাগে না। ওর রাগী চেহারাটা দেখতে বেশি সুন্দর। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো শাইনা রাগ করলো না। উল্টো তাকে বলল,
“আমি ভাবছি নিবন্ধন পরীক্ষা দেব।”
তাজদার একটু অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করলো,
“এই সিদ্ধান্ত কখন নেয়া হয়েছে?”
শাইনা তার মুখের দিকে তাকালো। বলল,
“সাইমা বলছিল ওইদিন। তার সাথে কথা বলে..
সে চাইছে তাজদার সিদ্দিকী নিজ মুখে বলুক দেশে কিছু ভাবতে হবে না। ইউকে গিয়ে তারপর কিছু ভাবা উচিত। কিন্তু সে গুড়ে বালি। বরং তাকে হতাশ করে দিয়ে তাজদার সিদ্দিকী বলল,
“ওকে, আমি নুভাকে বলবো ব্যাপারটা দেখতে। না নুভা না। তৌসিফকে বলবো। ও বুঝবে ভালো। তাজনাকে আমি নিয়ে যাব পাঁচ বছর হলে। ওখানকার এডুকেশন সিস্টেম অন্য লেভেলের। এখানে ওকে পড়ানোর ইচ্ছে নেই আমার। তাছাড়া সিকিউরিটি, আর লাইফস্টাইল সব আলাদা। তোমার ওকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
শাইনা মুখটা সামান্য পাশ ফিরিয়ে রেখেছিল। মুখটা থমথমে। গম্ভীর হয়ে আছে। তাজদার নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে হাবভাব বোঝার চেষ্টা করলে। ঠোঁটের কোণে ধেয়ে আসা হাসিটা শেষ মুহূর্তে সামলে নিল কফির মগটা তুলে নিয়ে মুখের সামনে আড়াল করে। শাইনা ভেতরে চলে যাচ্ছিল তাজদার তার মগটা দিয়ে বলল,
“এটাও রেখে এসো।”
শাইনা তার হাত থেকে মগটা নিয়ে চলে গেল। তাজদার কিছুক্ষণ পরেই তাকে ডাকলো,
“শাইনা আমার সাদা শার্টটা খুঁজে দাও।”
শাইনা তার শার্টটা খুঁজে দিল। রাতের বেলায়ও শার্ট পাল্টাতে হয়। সে শার্টটা দিয়ে চলে গেল। এটা সেই শার্ট যেটার সব বোতাম শাইনা একসময় ছিঁড়ে নিয়েছিল। আবার সব বোতাম নিজেই লাগিয়েছে।
তাজদার শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে শাইনাকে আবারও ডাকলো,
“ল্যাপটপ চার্জ হয়েছে কিনা দেখো তো।”
শাইনা গটগট পায়ে হেঁটে হেঁটে তার আদেশ চুপচাপ পালন করে যাচ্ছে। তাজদার ইচ্ছে করেই আবারও আদেশ দিল,
“বিছানার চাদরটা পাল্টে দাও।”
শাইনা তাই তাই করলো। বিছানার চাদর পাল্টে ঘাড় ফিরাতেই দেখলো বেডসোফায় তাজদার সিদ্দিকী উদাম গায়ে বসে এদিকেই চেয়ে আছে। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে শাইনার সাথে মজা করছে। মনে হচ্ছে সে বেশ গম্ভীর হয়ে কোনো জটিল কিছু চিন্তা করছে।
শাইনা বিছানার চাদরটা তার দিকে ছুঁড়ে মারলো। তাজদারের শরীর ঢেকে গেল। সে চাদরটা মুখের উপর থেকে সরিয়ে আরও গম্ভীর মুখে শাইনার দিকে চেয়ে রইলো। শাইনা বারান্দায় চলে গেল। নিজের রাগ সংবরণ করতে করতে খেয়াল হলো তাজদার সিদ্দিকী শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এসে পড়েছে। সে স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। তাজদার জানতে চাইলো,
“কোনো সমস্যা?”
শাইনা মাথা নাড়লো।
“ঘুম?”
“একটু পর।”
“ওকে।”
সে মাথা নামিয়ে ফোনে চোখ রাখলো। তা আঁড়চোখে খেয়াল করলো শাইনা। তাকে ঢাকায় এনেছে ফোনে চোখ ডুবিয়ে রাখার জন্য? কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে যখনি চলে যেতে নিল তখুনি ফোনে চোখ ডুবিয়ে রাখা অবস্থায় তার কব্জি শক্ত হাতে ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এল তাজদার সিদ্দিকী। শাইনা তার মুখের দিকে অবাক, জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকাতেই তাজদার ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে মাথা নামিয়ে তার চিবুকে চুমু খেল। শাইনা সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে না পেরে রেগেমেগে বলল,
“আই হেইট ইউ!”
“বাট আই লাভ ইউ মোর!”
“আই হেইট ইউ মোর।”
তাজদার তাকে হালকা ঠেলে দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে দাঁড় করিয়ে ধীরেধীরে বলল,
“ভাগ্যিস! আল্লাহ আমাকে মগজ দিয়েছে তোমার লাভ ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে।”
শাইনা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“কোনো লাভ টাভ কিছু নেই।”
তাজদার তাকে টেনে আরও মুখোমুখি নিয়ে এসে বলল,
“তাহলে আর দশ বছরেও দেশে ফিরবো না। এই যে এখন ছুঁয়ে আছি তোমাকে। তুমি আমাকে ছুঁয়ে আছ এটা আগামী দশ বছরে আর সম্ভব হবে না।”
বলেই তার চিবুকজুড়ে চুম্বন করতে লাগলো।
শাইনা কেঁপে কেঁপে উঠলো। ধরা গলায় বলল
“লাভ নেই বলেছি। ক্ষতি নেই তো বলিনি।”
তাজদার সিদ্দিকী তাকে দু’হাতে বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিতে নিতে মনে মনে প্রশান্তিময় হাসলো। এটাই সেই মুহূর্ত, সেই স্পর্শ, সেই স্বীকারোক্তি যেটার একটাতেও কোনো ভণিতা নেই। তার কোনো অধিকার নামক দাবি নেই, শাইনা মমতাজের কোনো আপত্তি নেই।
“তারপর?
শাইনা ছোট্ট করে প্রশ্ন করলো,”তারপর আর কী?”
“তারপর দুটো মানুষ, একটা পুতুল আর একটা ঘর।”
“কি হবে এসব দিয়ে?”
“তাজমহল।”
শাইনা তার বুকের সাথে একদম লেপ্টে গিয়ে বলল,
“তাজমহল একটা কবর।”
তাজদার তার মাথায় চুম্বন করে বলল,
“কবরই তো। আমাদের সব বিদ্বেষ, অহংকার, মনোমালিন্য, প্রতিশোধস্পৃহা, রেষারেষি, হিংসা, হিংস্রতার চিরশায়িত কবর। আর এই কবরের ওপরেই আমরা যে সংসার সাজাবো, সেটাই আমাদের তাজমহল।”
~~~~
তাসনুভা পুকুরপাড় থেকে এসেই রাগে ফোঁসফোঁস করে যাচ্ছে। ঝিমলি তার হাবভাব দেখে বলল,
“কী রে রায়বাঘিনী! কোন পোকা কামড়ে দিল? কি দেখলে? হঠাৎ এমন ফোঁসফোঁসানি কেন?”
তাসনুভার চোখেমুখে বিরক্তি উপচে পড়ছে। তারপর সে ঝিমলিকে যা বললো তাতে ঝিমলি হাঁ হয়ে গেল।
একটা নীল রঙের চেক লুঙ্গি, আর সাদা আর নীল টিশার্ট পরা লোক বাড়ির পেছনে পাকাঘাটের উপর বসে বিরহের গান শুনতে শুনতে গল্প গুজব করছে। গানগুলো শুনলেই ঝিমুনি চলে আসে। ঝিমলি অবাক হয়ে জানতে চাইল,
“কে সে?”
তাসনুভা ধপ করে বিছানায় বসে বলল,
“আর কে? আনিস ভাই।”
ঝিমলির চোয়াল ঝুলে পড়ার মতো অবস্থা।
“আনিস ভাই? তো? উনি সারাদিন স্যুটবুট পরে বসে থাকবেন? আজ অফ ডে তাই পুকুরপাড়ে বসে একটু সময় কাটাচ্ছেন বন্ধু বান্ধব নিয়ে।”
তাসনুভা পিঠের নিচে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে বসে বলল,
“উনাকে একদম সুন্দর লাগছিল না। লুঙ্গি… মানে ওইসব লুঙ্গি ফুঙ্গি কেন পরতে হবে?”
ঝিমলি টেবিলের উপর ঝুঁকে গালে হাত দিয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো সন্দিহান দৃষ্টিতে। তাসনুভা তার দিকে না তাকিয়েই একনাগাড়ে বলে গেল, এইসব লুঙ্গি পরা ছেলেপেলে সে জীবনেও বিয়ে করবে না। তার জন্য পাত্র দেখার সময় যেন খোঁজ নেয়া হয় পাত্র লুঙ্গি পরে কিনা।
চলমান..
Share On:
TAGS: তাজমহল সিজন ২, প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
তাজমহল সিজন ২ গল্পের লিংক
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২৫
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২৩
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৫+১৬
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৪
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৩
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২০
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৭+৮
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১০
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৯