তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব_২০
প্রিমাফারনাজচৌধুরী
প্রায় একদিন পরেই শাইনা নিচে পা রেখেছে। প্রথমবার দাঁড়াতেই তার মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবীটা যেন নড়ে উঠেছে। মা না থাকলে তার কি হতো সে জানে না।
মায়ের উপর তার কম অভিমান ছিল না। যখন তাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন মায়ের সান্ত্বনাও তার কাছে বিরক্তিকর লেগেছিল। মনে হয়েছিল সবাই তাকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। এই বয়সে মা হওয়ার কোনো প্রস্তুতি তার ছিল না। এত তাড়াতাড়ি সে মা হতে চায় নি।
কিন্তু এখন বাচ্চাকে দেখে তার সেইসব রাগ, ক্ষোভ কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছে। মা ছাড়া মা হওয়া কষ্টকর এই কথাটা আগে সে শতবার শুনেছে কিন্তু বিশ্বাস করেনি। আজ টের পাচ্ছে মাকে কেন দরকার।
স্যুপ খাওয়ার পাশাপাশি সে পাতলা সবজি দিয়ে অল্প পরিমাণ ভাত খেয়েছে। খেতে ইচ্ছে করছিল না। সবাই সাহস যুগিয়েছে। খেলে কিচ্ছু হবে না।
তাছাড়া খাওয়াদাওয়া না করলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সাহস করে খেয়ে নিয়েছে। প্রথমবার মা হয়েছে তাকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। বারবারই মনে হচ্ছে এমনটা করলে বেবির জন্য ভালো হবে না। অমনটা করলে বেবির জন্য খারাপ হবে। উদ্ভট উদ্ভট সব চিন্তাভাবনা তার মাথায় আসছে।
শাহিদা বেগমের কোলে বাবু ঘুমাচ্ছে। শাইনা কয়েক কদম হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই এখন বেডে বসে পড়েছে। যেই একটু জিরোলো অমনি বাবুর ঘুম ভেঙে গেল। শাইনা নিজ থেকেই ব্রেস্টফিডিং করাতে পারছে না। মায়ের সাহায্য নিতে হচ্ছে।
একের পর এক আত্মীয় স্বজন আসছে দেখার জন্য। তাজদারের মামার বাড়ি, ঝিমলির বাবার বাড়ি, শাইনা মামার বাড়ি থেকে কবুতরের মাংস সহ হরেক রকমের মাছ মাংস দিয়ে ভাত তরকারি এসেছে।
শাইনা শুধুৃমাত্র লাউ, পেঁপের তরকারি আর কবুতরের মাংস খেয়েছে। বাকিসব বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। দুই বাড়িতে এখন রান্না বান্না তেমন করতেই হচ্ছে না। আত্মীয়দের আনা খাবার-দাবারে ভরে গেছে।
যদিও আনিস এইসবে বিরক্ত হচ্ছিল। মা বাচ্চা বাড়ি ফিরলে সবাই বাড়িতেই দেখতে আসতো। আন্তরিকতা দেখাতে গিয়ে হাসপাতালে ভীড় করছে সবাই। তাদেরও কষ্ট হচ্ছে। রোগীরও। তাজদারও সেই কথাটায় বলছিল তাকে।
কিন্তু তারা এখন কিছু বললেই লোকে দুটো কথা বেশি বুঝবে তাই চুপ রইলো।
শাইনাকে চতুর্থ দিন বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। শাহিদা বেগম তাজদারকে বলে উনাদের বাড়িতে নিয়ে গেছেন মেয়েকে। একটু শক্তপোক্ত হোক তারপর ওই বাড়িতে যাবে। শাইনাও তাদের বাড়িতেই থাকবে ঠিক করেছে চল্লিশ দিন অব্দি। কারণ মাকে ছাড়া সে এই মুহূর্তে কিছু করতেই পারছে না। কিন্তু এতদিন থাকবে বাপের বাড়িতে কথাটা ওই বাড়ির কেউ মানতে পারলো না। রওশনআরা তাজদারকে ফোন করে বললেন,
“যত্নআত্তির আমরা কি করতে পারতাম না? আশরাফের মা’র সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। শাইনাকে বলো যেন চলে আসে। আমরা বাবুর চুল ফেলবো। নামকরণ করবো এখানে। আত্নীয়স্বজন আসছে ওদের দেখতে। ওই বাড়িতে পাঠাতে হচ্ছে। এগুলো কেমন কথা।”
তাজদার চুপ করে রইলো। শাইনা মমতাজ এখন বাচ্চার মা হয়েছে। তার পাওয়ার আগের চাইতে বেড়েছে। এখন তার কথাই শেষ কথা। তাই সে মাকে বলল,
“শাইনার যেখানে ভালো লাগছে সেখানে থাকুক। এক্সট্রা প্যারা নিয়ে লাভ নেই। ও ওদের বাড়িতে কমফোর্ট ফিল করছে। সো ওখানেই থাকাটাই বেটার। তোমার উপর কোনো ঝামেলা আসবে না। তিতলি তেমন কিছু বোঝে না। নুভা শো-রুমে চলে যাবে। তুমি, মেঝ, দাদু ওর কি সেবা পশু করবে? ওর মায়ের কাছে থাকতে চাইছে, থাকুক।”
রওশনআরা এতে ক্ষিপ্ত হলেন। বললেন,
“নামকরণ ওই বাড়িতে হবে?”
“হোক সমস্যা কি?”
“নাম কে ঠিক করেছে?”
“শাইনা করবে। আনিসরা সবাই আছে। আমাকে জানাবে বলেছে নাম কোনটা সিলেক্ট করলো। আমি তোমাদের জানাবো। তোমাদের কিছু থাকলেও বলতে পারো।”
“ওরা যখন সব করছে তখন আমাদের কি করার? আকীকার জন্য ছাগল ঠিক করেছে তোমার আব্বু। জানিয়েছে?”
তাজদার বলল,
“হ্যাঁ আব্বুর সাথে আমি কথা বলেছি। আমি তৌসিফ আর আনিসকে বলে রেখেছি। ওরা জবাই করে মাংস বিলি করে দেবে।”
“আচ্ছা বেশ।”
ছেলের সাথে কথাবার্তা বলার পর তিনি ছেলের বউকে ফোন করলেন। নাতনির কি অবস্থা জানতে চাইলেন। শাইনা বলল,”এখন ঘুমোচ্ছে।”
“দিনের বেলায় ঘুমানোর অভ্যাস করছো কেন?”
“রাতে ঘুমায় না।”
পাশ থেকে দাদীমা বললেন,”রাতে বাপের সাথে কথা বলবে তাই ঘুমায় না। ওর দাদী ওকে দেখতে আসছে না কেন?”
রওশনআরা চুপচাপ শুনলেন। বললেন,”দাদীকে কি দরকার ওর? জোয়ান নানা নানী পেয়েছে।”
শাইনা উনার অভিমান বুঝতে পারলো। বলল,”বড়ো আম্মু আমি কিছুদিন পর..
“চল্লিশ দিন পর এসো। তাজ সব বলেছে আমাকে।”
শাইনা আর কিছু বললো না। তবে বিকেলে শো-রুম থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে তাসনুভা সোজা ভাইঝিকে দেখতে চলে গেল তিতলি আর ঝিমলিকে নিয়ে। সবাই খুশি হলো তাদের দেখে। সাবরিনা চা বানাতে চলে গেল। চা খাওয়াদাওয়া হতেই তাসনুভা শাইনাকে বলে বাবুকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছিল। শাহিদা বেগম হায়হায় করে উঠলেন,
“আম্মু সন্ধ্যায় বাচ্চাদের বাড়ি থেকে বের করলে খারাপ বাতাসে ধরে। এখন ওকে নিয়ে বাইরে যেওনা।”
তাসনুভা বলল,
“এইসব আজগুবি কথা চাচীমা। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আম্মু আব্বু দাদুরা সবাই দেখতে চেয়েছে।”
শাহিদা বেগম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তখুনি শাইনা ইশারা করলো কিছু না বলার জন্য। ওদের বাড়ির মেয়ে তাই অধিকার দেখাচ্ছে। কিছু বললে বাড়িতে গিয়ে কি না কি বলে বসে।
তিতলি সারাদিন উশখুশ করেছে বাবুকে একটু কোলে করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। লজ্জায় বলেনি। তাসনুভা এত লজ্জা পায় না। সে বাবুকে ছোট্ট কম্বলে মুড়িয়ে সোজা তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে আনিস আর শাওনের মুখোমুখি হয়ে গেল।
শাওন বলল,”এই মহিলা সারাদিন ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে আমার মাথা খেয়েছে। এখন দেখছি ঠান্ডা হয়ে গেছে।”
তাসনুভা কপাল কুঁচকে বলল,”ও কিভাবে মহিলা হলো শাওন ভাই?”
শাওন থতমত খেল। আনিস ভেতরে চলে গিয়েছে ততক্ষণে।
তাসনুভা বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রওশনআরা নাতনিকে কোলে নিলেন। তারপর সোফায় বসে থাকা তাজউদ্দীন সিদ্দিকীও। জন্মের পরপর কেউ কেউ বলছিল সে মায়ের মতো, কেউ কেউ বলছিল বাপের মতো, নানার মতো, মামার মতো,। এখন মনে হচ্ছে পুরোটাই বাবার মতো।
তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে এখন। তিতলি বলল,”আপু আর মেঝ ভাইয়ার মতো ফোলা ফোলা ওর নাকটা। মনে হচ্ছে কারো সাথে রেগে আছে।”
তাসনুভা তার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। রওশনআরা কোলে নিতে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল,”দাদুমণি তুমি আব্বুর মতো হবে? নাকি আম্মুর মতো?”
বাবু হাত পা নেড়ে কান্নার সুর তুলছিল তখুনি তাসনুভা কোলে নিয়ে ফেললো। তারপর তিতলিকে বলল,”আমাদের কয়েকটা ছবি তোলো।”
তিতলি ছবি তোলার পর বলল,”আমাকে একটু কোলে দাও।”
“না তুমি ফেলে দেবে।”
তিতলি বলল,”বিয়ে হলে আমিও শাইনার মতো বাচ্চার মা হতাম।”
বলার পরপরই সে জিভে কামড় দিল। তারপর লজ্জা পেয়ে তাসনুভা জিহবা দেখিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
তাসনুভার ফোনে তাজদার তখন ফোন করেছে। সে ফোন রিসিভ করেই বাবুকে দেখালো। তাজদার সাথে সাথে হেসে উঠলো,”উনি এখানে কি করছেন?”
“আমি নিয়ে এসেছি।”
“বড়ো বড়ো চোখ করে কাকে দেখছে?”
“উপরে তাকিয়ে আছে।”
রায়হানও এল কিছুক্ষণ পর। এসে তাসনুভার কোল থেকে বাবুকে কোলে নিল। তাজদারকে বলল,”তোর মেয়ে তো হুবহু তোর মতো হয়েছে। মেজাজ তোর মতো পেলে তো..
সাথে সাথে মা বাবা আর ঝিমলির চোখে চোখ পড়তেই রায়হানের শেষের কথাটুকু অস্পষ্ট রয়ে গেল।
তাজদারও এমন ভাব করলো পাশ থেকে নোটবুক আর পেন নিতে নিতে যেন সে কিছুই সে শুনতে পায়নি। বলল,”ওর মায়ের মতো হতে পারে। জ্বালায় না কাউকে।”
রায়হান বলল,”হ্যাঁ শুনলাম। ওর মায়ের মতোই শান্ত।”
তাজদার বিড়বিড় করলো,”মা আর শান্ত!”
তাসনুভা বলল,”ভাইয়া সোনামণির নাম কি হবে? আমি কিন্তু অনেক নাম চুজ করেছি।”
তৌসিফ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছে। তোমাকেও জয়েন দিয়েছে। সেখানে সবাই মিলে ঠিক করে ফেলো। আমিও কিছু লিখে দিয়েছি। দেখো সবগুলো মিলিয়ে।
তাসনুভা বলল,”তানজিবা, তাযকিয়া, তাহিয়্যাহ, তাসমেরী এসব কেমন?”
“সবগুলোই সুন্দর। তোমরা সবাই মিলে ডিসাইড করো। আমি পরে দেখবো সব।”
তন্মধ্যে তিতলি এসে বলল,”বাবুনির নাম তুতুল নয়তো পুতুল।”
তাসনুভা বলল,”তোমার মাথা।”
তিতলি তার কথাকে গ্রাহ্য না করে বলল,”তিতির নয়ত তিতলির সাথে মিলিয়ে পিতলি, কিতলি, মিতলি, জিতলি, সিথলি।”
তাসনুভা গর্জে উঠতেই তিতলি মায়ের পেছনে গিয়ে লুকোলো। তাজদার তার কথা শুনে বলল,
“ফোনটা ওকে দাও।”
তাসনুভা কপাল কুঁচকে বলল,”তিতলি নাও।”
তিতলি লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। মায়ের পেছনে লুকিয়ে রইলো। তৌসিফ এসে সোফায় গা এলিয়ে বসতে বসতে বলল,”নাটক করছিস কেন? কথা বলতো চাইছে, বল। এমনিতে তো সারাদিন পাকনামি করিস।”
তিতলি আদর আদর কণ্ঠে বলল,”ইনননা।”
সে বাড়ির ছোটো মেয়ে বলে ভীষণ আহ্লাদী। মেঝ ভাইয়ার সাথে সে কি কথা বলবে। তার খুব লজ্জা করছে।
তৌসিফ তার কথা শুনে রেগে গিয়ে বলল,” ধরে একটা লাথি দিলে সব সোহাগ পালাবে। বুড়ি দামড়ি হয়ে ঢঙ দেখাস।”
তিতলি মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো।
“অ্যাই বেটা চুপ চুপ চুপ!”
~~
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নামের বন্যা নেমেছে। তৌসিফ নাম দিয়েছে সব তিতলির দেয়া নামগুলো। শাইনা আর শাওন দিয়েছে শ দিয়ে।
আনিস যতগুলো নাম দিয়েছে সবগুলোই আ, শ দিয়ে। তাসনুভা শুরুতেই রেস্ট্রিকশন দিয়ে রেখেছে ‘আ’ দিয়ে কোনো নাম লিস্টে হবে না। সেকথা দেখে আনিস কিছুক্ষণ পর গ্রুপ থেকে লিভ নিল।
তাজদার আবারও তাকে এড করল। বলল,
“লিভ নিলি কেন?”
“আমার কি কাজ এখানে? তোরা ঠিক কর। নামধাম ঠিক করার ব্যাপারে আমি কাঁচা।”
তাসনুভা রিপ্লাই করলো,”আনিস ভাই আপনার নামগুলো সুন্দর ছিল। আপনার মেয়ের নাম আনিসা কিংবা আমিশা রাখতে পারবেন। যাইহোক ভাইয়া ফাইনাল নামটা চুজ করে দাও।”
শাওন বলল,”তাজ ভাইয়ের নাম থেকে তা নিলাম। শাইনা নাম না নিলাম। দুটো মিলিয়ে দিলাম তাইনা। শাইনার বাচ্চা তাইনা।”
শাইনা, তিতলি, তৌসিফ হা হা রিয়েক্টে ভরিয়ে দিল। সাথে তাজদারও হা হা স্টিকার সেন্ড করলো। আনিস বলল,”তোর ফাইজলামি রাখ।”
“তোমার সিরিয়াসনেস তোমার কাছে রাখো। যেখানে সেখানে ধমকাধমকি।”
আনিস বিরক্ত হয়ে বলল,”কেউ ওকে গ্রুপ থেকে ব্যান কর।”
তাসনুভা বলল,”উফ, মাছের বাজার বসিয়ে ফেলেছে সবাই।”
তাজদার থামার জন্য একটা স্টিকার দিল। সবাই আর কিছু বললো না।
শেষমেশ তাজদার নাম চুজ করলো সবার সমর্থনে।
“তাজনাহা সিদ্দিকী শেহরিন।”
শাওন বলল,”ওকে সমস্যা নেই। আমি সেহেরি ডাকবো।”
সবাই একসাথে হা হা রিয়েক্ট দিলেও তাসনুভা দিল অ্যাংরি রিয়েক্ট। তৌসিফ বলল,
“মিস মাথা গরম আপনি মাথায় পানি দিয়ে আসুন।”
সবাই আবারও হা হা দিল আনিস, শাইনা আর তাজদার ছাড়া।
তাজনাহা নামটা অবশ্য তাজদারের সিলেক্ট করা নাম। এটা সে সিলেক্ট করেছিল তাসনুভার বিজনেস পেজের জন্য। এই নামেই তাসনুভা তার বিজনেস পেজ চালায়।
চট্টগ্রামের নিউমার্কেটে ‘Tajnaha – তাজনাহা ’ নামে তার একটি শো-রুমও আছে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম দুটোতেই একই নামে পেজ চলছে। সব মিলিয়ে তাজনাহা এখন তাসনুভার পুরো ব্যবসার অফিশিয়াল ব্র্যান্ড নেম। মেয়ে বাচ্চা হলে তার নাম এটা রাখবে তারা সেটা আগে কখনোই কল্পনাও করেনি।
সাতদিনের মাথায় বাবুর চুল ফেলে দেয়া হয়েছে। আকীকার জন্য ছাগল জবাই করা হয়েছে। কাঁচা মাংস বিলি করে দিয়েছে। বাবুর নামকরণ হয়েছে। যদিও বাড়িতে সবাই তাকে সোনামণি, বাবুনি, আদরিনী, সোহাগিনী বলেই ডাকে।
তাসনুভা নিজের ভাইঝির জন্য অনেক কিছু কিনেছে। একটা বড়ো ঢালা শাইনার জন্য পাঠিয়েছিল ওই বাড়িতে। সেখানে বাবুর জিনিস থেকে শুরু করে নিউ মমের জন্য যাবতীয় সব স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট আর কাপড়চোপড় ছিল। এমনকি কিছু ওয়ার্ক আউটের বইও দিয়েছে যেগুলো ফলো তার ব্যাকপেইন একদম ভ্যানিশ হয়ে যাবে। আর মেন্টালি স্ট্রং থাকার জন্য অনেক টিপস ট্রিকসও আছে সেখানে।
মেঝ ভাইয়া টাকা পাঠালে তিতলি প্রতিমাসে মায়ের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নেয়। বড়ো ভাইয়া দেয় এক হাজার। ছোটো ভাইয়া এক হাজার। আপু দেয় এক হাজার। আব্বুও দেয় পাঁচশ ছয়শো, মাঝেমধ্যে তিতলিও আরও বেশি নিয়ে নেয়। তার অনেক টাকা জমেছে। তার টাকা থেকে সে শাইনা আর বাবুর বড়ো একটা টেডিবিয়ার কিনে উপহার দিয়েছে। শাইনা বলল,
"আমি এতকিছু তো চাইনি তোমাদের কাছ থেকে।"
তিতলি বলল,"তোমাকে কে দিচ্ছে? সবাই বাবুর আম্মুকে দিচ্ছে। হুহ! আপু কি কি দিয়েছে?"
"অনেককিছু। মনে হচ্ছে অনেক টাকা খরচ করেছে। আমার লজ্জা লেগেছে নেয়ার সময়। এসব না দিয়ে আমার সাথে ভালো করে কথা বললেই আমি খুশি হয়ে যেতাম। যাইহোক যা পাব না তা আশা করে লাভ নেই।"
তিতলির মন খারাপ সাথে লজ্জাও পেল সে নিজের বোনের জন্য। শাইনা নিশ্চয়ই আপুর ব্যবহার নিয়ে মনে মনে খুব রুষ্ট। চাপা স্বভাবের বলে বোঝা যায় না। কিন্তু ওই পাগলটাকে কি করে বোঝাবে সে?
তাজদার ফোন করলে বাবু মাঝেমধ্যে জেগে থাকে নয়তো ঘুম থেকে। শাইনা ইচ্ছে করেই তার হাত দেখায়, পা দেখায়, মাথা দেখায়। তাজদার রাগিয়ে দেয়ার জন্য এমনটা করে। চেহারা দেখায় না সহজে। তাজদার হাল ছেড়ে দিলে তারপর মুখটা দেখায়। ঘুম থাকলে ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে থাকে সে। জেগে থাকলে তার দিকে তাকানোর জন্য ডাকাডাকি করে। কিন্তু শেষে হতাশ হয়ে বলে,
“ও সাড়া দিতে শিখবে কখন?”
শাইনা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জবাব দেয়,
“তাজদার সিদ্দিকীর প্রডাকশন না? জন্মের পরেরদিনই তো কথা বলা উচিত। কথা বলছে না কেন? আপনি যেভাবে কোয়ালিটির কথা বলেছেন শুনে মনে হয়েছিল জন্মের পরের সপ্তাহ থেকে হাঁটবে।”
তাজদার চুপচাপ বসে রইল। আগের চেয়ে তার স্বাস্থ্য আরও ভালো দেখাচ্ছে। প্রাণবন্ততা ফুটে উঠেছে। চেহারাতেও সেই পরিবর্তন স্পষ্ট, দেখতে আরও সবল ও সতেজ লাগছে। শাইনা খোঁচালো এই বলে,
“মা হয়েছি আমি। বাচ্চার বাপ বাপ ভাইব এসে গেছে আপনার মধ্যে। সমস্যা কি?”
তাজদার কাঁধ কুঁচকে বলল,”আমার বয়স কমছে না বাড়ছে?”
শাইনার ইঙ্গিত সে বুঝতে পারেনি। শাইনা তাকে বোঝাতে গেল না। বলল,
“বুড়ো বয়সে দেখা হবে তাহলে?”
“তুমি যেমনটা চেয়েছ।”
“আমার কচি মন বুড়োলোক পছন্দ করবে না।”
“তোমার কোনো মনই আমাকে কখনো পছন্দ করবে না।”
“আপনি নিজেই কখনোই মন থেকে চাননি আমি আপনাকে পছন্দ করি।”
“আমি তাজদার সিদ্দিকী কতটুকু পাল্টাতে পারব যে নিশ্চিত হবো তুমি আমাকে পছন্দ করবে?”
বলেই ঘাড়টা দুইপাশে ঝাড়া দিয়ে বাঁকালো। সেই পুরোনো বদভ্যাস। থুতু ছোঁড়ার অভ্যাস কমেছে নাকি লুকোয়?
“আপনি পাল্টাননি আমি জানি। ভং ধরেন বউয়ের সামনে। পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষ বউয়ের সামনে ভালো বর সাজার ভান করে। আপনিও তাই।”
তাজদার নীরবে শুনলো। সহজ স্বীকারোক্তি দিল,
“কিছু ব্যাপার স্যাপার থাকে যেগুলো চাইলেও পাল্টানো যায় না। একজন চেইন স্মোকার সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে বললে তুমি বিশ্বাস করবে সহজে?”
“না।”
“আমার ক্ষেত্রেও তাই। আমরা মানুষেরা সবাই আসলে একেকজন অভিনেতা।”
“আপনি এখনো গরিব, ভিক্ষুকদের অপছন্দ করেন আগের মতো? এখন আবার জিজ্ঞেস করবেন না কখন অপছন্দ করেছি। উত্তরটা নিশ্চয়ই ভালোভাবে দেব না আমি। পুরোনো হিসেবের খাতা খুলতে চাই না।”
তাজদার সিদ্দিকী হাসলো নিঃশব্দে। অকপটে স্বীকার করলো,
“তারা অপছন্দের কাজ করলে অপছন্দ করবো না কেন? কোন মানুষ স্বেচ্ছায় ভিক্ষা দেয়? মানসম্মানের ভয়ে, অভিশাপ বদদোয়ার ভয়ে, ভিক্ষা দেয় রাস্তাঘাটের ভিক্ষুকদের। মন থেকে কেউ ভিক্ষা দেয় না। দেয় তোমার মতো গুটিকয়েককন। দূর্ভাগ্যবশত আমি সেই দলে নেই।”
শাইনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ভারী গলায় বলল,”আপনি বিন্দুমাত্র পাল্টাননি।”
তাজদার সিদ্দিকীর ডান ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীরমুখে তাকালো। শাইনার দিকে চেয়েই প্রশ্ন করলো,
“নিজেকে পাল্টানো সহজ?”
শাইনা একটু চুপ থেকে বলল,
“কঠিন কিছু না।”
তাজদার বড়োসড়ো শ্বাস ফেললো। নড়েচড়ে বসে বলল,
“সবকিছু পাল্টে ফেলা অতটা সহজ হলে আমি সবার আগে নিজের পছন্দটাই পাল্টে ফেলতাম। তোমাকে আমার পছন্দ থেকে বাদ দিতে পারলে এত জবরদস্তির কি দরকার ছিল?”
শাইনা কথাটায় চমকালো। তাজদার বলল,
“তখন তোমাকে জোর করে পেতে চাইতাম না। পারব না বলেই তোমাকে জেদ ধরে নিজের করে ফেলেছি। এটাও মাথায় ছিল যতগুলো দিন তোমার সাথে কাটাবো ততগুলো দিন তোমার ঘৃণা সইতে হবে।”
শাইনা ঠোঁট গোল করে বলল,
“ওহহহ, আমি আপনাকে ঘৃণা করি?”
“এখন অবশ্য অনেকটা কম ।”
“ইনিয়েবিনিয়ে ওটাই তো বললেন।”
তাজদার পরিস্থিতি বুঝে ফেললো। আর কথা না বাড়ানোই শ্রেয়। সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা আসুক সে চায় না। এখন তার ক্লান্ত লাগছে। অতীতের করা ভুলগুলোর ভারে নাকি অন্য কিছুর ভারে সে জানে না। তবে এখন শাইনাকে খেপানোটা উচিত হবে না। সে ধীরেসুস্থে বলল,”পরে কথা হচ্ছে। হুম? বাই।”
“পালান। আপনি এটা খুব ভালোই পারেন।”
“তোমার কাছ থেকে শিখেছি। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত। আমি তোমার কাছ থেকে কক্ষনো কিছু চাইবো না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”
“আমাকে আর একবার ফোন করলে আমি আপনাকে…
“আমি তোমাকে আবারও ফোন করবো।”
“করবেন না।”
“করবো।”
“করবেন না বললাম তো।”
“আচ্ছা বেশ।”
শাইনা শান্ত হয়ে এল। তাজদার শেষমেশ ছোট্ট করে বলল,
“করবোই।”
বলেই কল কেটে দিল। শাইনা শব্দ করে চিরুনীটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে দিল। পাল্টাতে পারলে আগে নিজের পছন্দ পাল্টে নিত? তো নিল না কেন?
সে চিরুনীটা ড্রেসিং টেবিল থেকে তুলে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলো। তন্মধ্যে বাবু কেঁদে উঠেছে। শাইনা তার মুখের উপর ঝুঁকলো ধীরেধীরে। শান্ত হয়ে এল মেয়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে। রাতে যখন তাজদার ফোন করলো শাইনা তখন বলল,
“শুনুন আপনার মেয়ের দায়িত্ব আপনি নিন। আমার ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। পড়তে পারছিনা ওর জন্য। খাওয়াও, হাগুমুতু পরিষ্কার করো, কাপড়চোপড় ধোও, কোলে নিয়ে বসে থাকো, রাত জাগো, অসুস্থ হলে চিন্তা করতে করতে রাতের ঘুম হারাম। আপনি বাবা হয়ে করছেনটা কি? নিয়ে যান আপনার মেয়েকে। ওর একবছর হওয়ার আগেই দেশে আসবেন। যেভাবেই হোক আসবেন। নিয়ে যাবেন।”
তাজদার সিদ্দিকী চুপচাপ সবটা শোনার পর বলল,”থ্যাংকস। আমি ভাবতেও পারিনি তুমি এই কথাটা নিজ থেকে বলবে। আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
শাইনা ক্যামেরার দিকে ঝুঁকলো।
“কি বললেন?”
“তুমি যা বললে।”
“আবার বলুন।”
“আমি তাজনাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।”
“নিয়ে তো যাবেনই। আপনার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে। কি করে আমাকে নাস্তানাবুদ করা যায় তার সব ফন্দি এঁটে ফেলেছেন অনেক আগে।”
“আমার কাছে নিয়ে আসবো না? তুমি ওকে একবারও তো আমার সামনে বুকে নিয়ে আদর করলে না। দেখে মনে হচ্ছে প্রতিবেশীদের কারো মেয়েকে বিছানায় ফেলে রেখেছ। মা মেয়ের এত দূরত্ব কেন? আমার সাথে যা করার করেছ। মেয়ের সাথে এত অবহেলা কেন?”
শাইনা আকাশ থেকে পড়লো। তার বাচ্চাকে সে আদর করে না? তার মাথা এলোমেলো লাগছে। এই লোকটা কি বলছে এইসব? সে ফোনটা বিছানায় ফেলে কাঁদতে লাগলো এলোমেলো ভাবে। তাজদার তা বুঝতে পেরে ডাকাডাকি করছে,”শাইনা কথা শোনো!”
শাইনা ফোন তুললো। কল কেটে দিয়ে বলল,”নিমকহারাম।”
তার চোখে জল টলমল করছে। আবার গড়িয়ে পড়ছে। তাজদার সিদ্দিকী এত বড়ো কথা বলতে পারলো? দাদীমা, শাহিদা বেগম দুজনেই এসে তাকে কাঁদতে দেখে বলল,”কি হলো? কোন পোকায় আবার কামড়ালো?”
শাইনা একনাগাড়ে বলে গেল,”আমি নাকি আমার বাবুকে আদর করিনা। আমাকে কীসব বললো। ওই লোককে বলে দাও আমাকে যেন আর জীবনেও ফোন না করে।”
সে বলতে বলতে কাঁদছে মেয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে। ওকে আদর না করে থাকা যায়? তাজদার সিদ্দিকী তাকে ভাবেটা কি?
চলমান….
Share On:
TAGS: তাজমহল সিজন ২, প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৭+১৮
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২৩
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১০
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৯
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৯
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৭+৮
-
তাজমহল সিজন ২ গল্পের লিংক
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৩